আমাদের বাসটা ঠিক সাড়ে সাতটায় বিয়ে বাড়ির সামনে গিয়ে দাঁড়াল। আমরা পাত্র পক্ষের গেষ্ট, মানে বরযাত্রী। স্বাভাবিক আপ্যায়নে কোনো ত্রুটি না রাখার আপ্রাণ চেষ্টা চলছে। এটা আবার আমার বাড়াবাড়ি মনে হয়। বেশি তেল মারার অন্তরালে থাকে কিছু গোপন করার চেষ্টা। আমার তা জেনে লাভ কি? এখন আর ভালো লাগে না। নেহাতই শ্বশুর বাড়ির ব্যাপার। স্ত্রীর বা মেয়ের খারাপ লাগতে পারে, তাই আসা।
বিয়ে বাড়ি মানে ইয়াং মেয়েদের আনন্দ। আমার মেয়েটা তার মামাতো দাদার বিয়ে বলে অনেকটাই নিজেকে ছেড়ে বেরিয়ে এসেছে। সুন্দর করে সেজেছে। হাসছে,কথা বলছে,ওটাই আমার আনন্দ। এই বয়সে খাওয়া দাওয়ার প্রতি বা ওই সকলের যা থাকে, তা আর নেই। রিঙ্কুও গিন্নি বান্নী হয়ে বৌদিদের সঙ্গে আছে। ঘুরছে।এই দূর থেকে সব দেখার মধ্যেই মা।
আপনি ধীমানদা না? এক পঞ্চাশ ছুঁই ছুঁই মহিলা পিছনে এসে জানতে চাইলেন।
আমারও কেমন চেনা চেনা মনে হল। ঠিক মনে করতে পারলাম না। একটু বোকা বোকা উত্তর দিলাম, হ্যাঁ। কিন্তু কেন বলুন তো!
থিয়েটার টু ডে মনে পড়ে? জাহানারা? আপনি শাহজাহান?
হ্যাঁ, হ্যাঁ, তুই মানে তুমি, মানে এই আপনি উদাসীনা ! এত পরিবর্তন! এখানে?
আমার মেয়ের বিয়েতেই তো এসেছো! তুমি?
আমার বড় শালা মানে আমার -
বৌদি এসেছেন?
হ্যাঁ, উনি এসেছেন । মেয়েও এসেছে। কিন্তু তোর মেয়ে মানে, সেই মেয়ে!
হ্যাঁ, এসো। আমার মেয়েকে আশীর্বাদ করবে না?
অবশ্যই! অবশ্যই! চল। আমার আজ যে কী আনন্দ হচ্ছে। চল, চল!
উদাসীনা আমাদের ইয়াং বয়সের নাট্যকর্মী। উত্তরপাড়া থেকে রোজ বালিগঞ্জে যেত রিয়ার্সাল দিতে। পাঁচ ছ বছর চুটিয়ে কত নাটক করেছি, কত রাতে ওকে পৌঁছে দিয়ে বাড়ি ফেরার লাস্ট ট্রেন ফেল করে কারো বাড়ি থেকে গেছি। পরে গাড়ি ভাড়া করা হলে আমি একটু দূরে সরে গেলাম। তবে ওর সমস্ত সমস্যায় আমি ছিলাম ফার্স্ট ম্যান। আর মেয়েদের ফার্স্ট ম্যান হতে পারাও খুব ভাগ্যের ব্যাপার। কি জানি সবটাই হয়তো বয়স, আমি তো অন্যদের মতো আগাগোড়া হই হই করতে পারি না। আর যাকে তাকে প্রেম তোষামোদ করতে পারি না। তবে নাটকটা খারাপ করতাম না। উদাসীনা ছিল অন্যদের মধ্যে যোগ্যতমা কোঅ্যাক্ট্রেস।
আমাকে নিয়ে গেল মেয়ের কাছে। ঘর ভর্তি আত্মীয় স্বজন। বেশির ভাগ মেয়ে। অস্বস্তি বাড়ছিল।কিন্তু কিচ্ছু করার নেই।
তৃণা , বল তো ইনি কে ? সীনা আমাকে পাশে দাঁড় করিয়ে জানতে চাইল ।
কিছুক্ষণ মুখের দিকে হাসি মুখে চেয়ে থেকে বলল, তুমি বলো।
ধীমান কাকু রে। আমার সব থেকে প্রিয়জন,অকৃত্রিম বন্ধু,গাইডার ।আমাদের গ্রেট শাহজাহান। আহা তোমার সেই "জাহানারা, বেটীয়া" ডাকটা এখনো কানে বাজে।
আমি - সে কী জাহানারা! তারা আমার পুত্র।
সীনা - হোক পুত্র। কী যায় আস। পুত্র কি কেবল পিতার স্নেহের অধিকারী? পুত্রকে পিতার শাসনও করতে হবে!
আমি - আমার হৃদয় শুধু এক শাসন জানে। সে শুধু স্নেহের শাসন! বেচারি মাতৃহারা পুত্র কন্যারা আমার! তাদের শাসন করব কোন প্রাণে জাহানারা! ঐ চেয়ে দেখ - ঐ স্ফটিক গঠিত (একটু দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে) - ঐ তাজমহলের দিকে চেয়ে দেখ - তার পর বলিস তাদের শাসন করতে।
দুজনে হেসে ফেললাম। এত দিন পরেও মনে আছে।কম শো করেছি! সুযোগ পেয়ে ঝালিয়ে নিলাম সকলের সামনে।সীনার মুখে উজ্জ্বল হাসি।তোমার এখনো মনে আছে!
ও কি আর ভোলার জিনিস! এখনো ঘুমের মধ্যে মাঝে মাঝে -
আমারও।
সীনা ফিরে গেছে সেই সব দিনে। সে মেয়েকে বিয়ে দিচ্ছে বলে মনেই হল না। না হওয়াই ভালো। অতীতের কালো দিনগুলো যত ভুলে যাওয়া যায়, ততই ভালো। যারা ধরে বসে থাকে, তাদের ঠিক পছন্দ হয় না। প্রেম, আদর্শ, বিবেক এগুলো এতোই আরোপিত ; ভাবলে হাসি পায়।
মেয়েটা নেমে এসে আমাকে প্রণাম করে জানতে চাইল , কেমন আছেন?
ভারী মিষ্টি কন্ঠস্বর। সীনাকে বললাম, ঠিক তোর মতো গলা! বাঃ বাঃ, ভালো থাক মা। সুখী হ।মাথায় হাত রেখে বললাম।
না না, ওভাবে আশীর্বাদ করলে হবে না। এই যা তো ঠাকুর মশাইকে ডেকে নিয়ে আয়। বিধি সম্মত আশীর্বাদ করতে হবে।
তুই এসব মানিস? এই কি পাগলামো করচিস! ওরে তোর মেয়ের শ্বশুর বাড়ি, আমার শ্বশুর বাড়ি এক! চুপিচুপি কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে বললাম, কথা হবে। নানান প্রশ্ন উঠবে।
ঠিক আছে , বিয়ের পর মেয়ে জামাইকে কিন্তু আশীর্বাদ করে যেতে হবে। কথা দাও।
দিলাম। যা, আত্মীয় স্বজনদের দ্যাখ। বিয়ের লগ্ন কটায় ? সব ঠিক আছে তো?
তুমি আছো, আর আমার ভাবনা কী। কতবার তোমার কথা মনে হয়েছে। ঠিকানা রাখিনি, পুরনো ফোন নম্বর অচল। তবু দেখ,সেই প্রয়োজনের দিনেই তোমাকে পেয়ে গেলাম। এখন তোমার সব দায়িত্ব।
এ তো মহা ঝামেলায় পড়া গেল! কোথাও কিছু নেই কর্তা। ঢাল নেই, তলোয়ার নেই, নিধিরাম সর্দার। আগেকার মতো ফর্ম আছে আর কি। আগে চেনা জানা অতো তোয়াক্কা করতাম না। বহু দিন বসে গেছি। পা আর ওঠে না, মন সায় দেয় না। সীনার নতুন কোথাও বিয়ে হয়েছে কি না কে জানে। সেই সন্তান কি এইটা? কে জানে বুকটা দুরু দুরু করছিল। শ্বশুর বাড়ির সকলে আমার দিকে চেয়ে আছে। কি কান্ড ! মেয়ে রয়েছে ! রিঙ্কু রয়েছে ! ওদের কি বলব?
যথাবিধি অনুসারে রিঙ্কু মেয়েকে নিয়ে এসে জানতে চাইল , কোথায় গিয়ে ছিলে?
অহেতুক মিথ্যে কথা বলতে পারি না। তাছাড়া বলবই বা কেন। আমি কোনো অন্যায় করিনি। যৌবনের শুরুতে নাটক এই জিনিসটা ভালোভাবে দিয়ে গেছে। অকারণে মিথ্যে বলতে পারি না। বললাম, আমাদের বেয়ান, আমাদের নাটকের মেয়ে সীনা, মানে উদাসীনা ।
নায়িকা নাকি? রিঙ্কু টুক করে জিজ্ঞেস করে বসল।
নাটকের বাইরের লোকেদের নিয়ে এই একটা ঝামেলা। লেখকদের নায়ক মানে লেখক, নাটকের নায়িকা মানে গার্ল ফ্রেন্ড। তাছাড়া হতেই পারে। চলমান জীবনে দুটো মন কেন বিয়ের পরে কাছে আসবে ? সীনার প্রথম সন্তান তো কোনো দোষ করে নি। যদি কোনো অন্যায় থাকে তা এই সমাজের। প্রকৃতির কোনো মন্ত্র নেই, আইন নেই, টিটকারি নেই। মেয়ের সামনে মিথ্যে বলতে যাবই বা কেন! বললাম, নায়িকা তো বটেই। তবে জীবন নাট্যের নয়।
কই আগে তো বলো নি?
আমি কি জানতাম নাকি? তুমি মুখে বলে ছিলে, কার্ড তো দেখাও নি! আমি অভিযোগ ঠুকে দিলাম। ইদানীং আমাকে সব কিছু বলে না। মেয়ে আর মা, সব সময় শলা পরামর্শ চলছে।
তুমি কত খোঁজ নাও? মেয়েদের এই একটা মুদ্রা দোষ। সুযোগ পেলে জ্ঞান থাকে না, কামড়ে ধরবেই।
মেয়ে মৃদু ধমক দিল, আঃ মা। তারপর আমার উদ্দেশ্যে বলল,তোমাকে উনি কিসব দায়িত্ব দিলেন?
আর দ্যাখ না। মেয়ের বিয়ের সব দেখা শোনা করতে বলল। তা কি হয়! আসলে নাটক দলে যখন ছিল, কোনো রকম সমস্যায় পড়লে আমার কাছে ছুটে আসত। এমন কি, ও - আর বলতে পারলাম না। হাজার হোক মেয়ের বিয়ে। একটা জীবনের প্রশ্ন। বললাম , চল, একটু ফাঁকা দেখে বসি।
আমি শুধু ভাবছিলাম রিঙ্কুর দাদা ব্যাপারটা মেনে নিলেও, বৌদিকি মেনে নেবেন? এদিকে আমি বা এদের কীভাবে সব বলব? বিশেষ করে যেখানে অবৈধ সম্পর্ক জড়িয়ে।
দোটানার মধ্যে একটা লোক জন কম জায়গা দেখে বসলাম তিন জনে। বললাম, আগে তোদের প্রমিস করতে হবে, আজকের যা শুনবি , কাউকে কোনো দিন বলবি না।
তা কি করে হয়? তুমি এমন কথা বললে -
মা? বাপিকে বলতে দাও। তারপর আমার দিকে চেয়ে বলল, বেশ, আমরা কাউকে বলব না। তুমি বলো।
সার্টিফিকেট ২
দ্যাখ মা, জীবনে অনেকে অনেক রকম ভুল করে। ওই তৃণা বলে মেয়েটা তো কোনো অন্যায় করে নি! আমরা এমন কিছু করব না, যা ওর জীবনটা ধ্বংস করে দিক। তাই নয় কি?
তা তো অবশ্যই। মেঘনা বলল।
ওই মেয়েটা যখন মায়ের গর্ভে আসে তখন ওর মায়ের বিয়ে হয়নি। উদাসীনারা খুব বড়লোক ছিল। ওর বাবা ব্যাংকের ম্যানেজার, মায়ের সম্পত্তি কম ছিল না। তবে মেয়েটা খুব ভালো ছিল। তখনকার ইংলিশ এম এ। অধ্যাপিকা । কি খেয়াল হল নাটক করবে। দেখতেও খারাপ নয়। সাহসী, অতো লোক লজ্জা টজ্জার ধার ধারত না। কোনো রকম জড়তা নেই। বোধহয় একটাই ভুল ও করে ফেলে ছিল। সেটা অ্যাকসিডেন্ট । কিন্তু কোনো ভাবে দমে যায় নি। সকলে জানাজানি হবার আগে বিয়ের সিদ্ধান্ত নিল। যদিও প্রস্তাবটা আমি দিয়ে ছিলাম।
সেই জন্যেই তো কাউকে না বলার প্রতিজ্ঞাটা করিয়ে নিলে। তুমি কি জিনিস আমি জানি না? যারা সিনেমা নাটক করে,তাদের চরিত্র ঠিক থাকে নাকি?রিঙ্কু ঠেলে উঠল।
মানে? তাতে দোষের কি হলো?
মেয়ের সামনে তুমি বলতে পারলে দোষের কি হল? তারপর ফুঁপিয়ে কান্না।
এতে কান্নার কি হলো? এই রকম করলে আমি কিন্তু চলে যাব !
তা তো যাবেই। সবাই জেনে ফেলেছে। এবার পালাবে না? আমিও যেদিকে দুচোখ যায় চলে যাব ।
বলতে বলতে ফুঁপিয়ে কান্না জুড়ে দিল।
একটু দূরে কয়েক জন ছিল। তারা ফিরে ফিরে দেখছে। কি মুশকিল, এদের বোঝাবে কে!
মেঘনা ধমক দিল, আঃ মা, কি হচ্ছে এসব? বাপিকে সবটা বলতে দাও না ! নইলে চলো, আমরা তিনজনেই চলে যাই। বাইরে গিয়ে যে যা খুশি করো ।
ঠিকই, কেন যে ঈশ্বর তোমার ঘটে কিছু দেয়নি! আমি বললাম।
বাপি ?
আমি চুপ করে গেলাম।
কুৎসার গন্ধ পেলে সব সমাজ নড়ে চড়ে বসে। একজন একজন করে আমাদের চারপাশে ঘুর ঘুর করা শুরু করে দিল শ্বশুর বাড়ির লোকজন। এক সময় রিঙ্কুর মেজদা ও মেজবৌদি এলো।
কি করছিস রে তোরা এখানে ? ওদিকে সবাই খুঁজছে। মেজদা জানতে চাইলেন।
কিছু নয় দাদা, আপনারা যান, আমরা যাচ্ছি। আমি বললাম।
সে তো যাবেই। এখানে কি করছো সেটা বলো?
একটা দরকারী কথা বলে নিচ্ছি। আপনারা যান।
দরকারটা সকলে জানলে ক্ষতি ছিল না। কী যে করেন!এই মেঘনা তোরা আয়। মেজবৌদি একটু রাগ দেখিয়ে ঠুকে দিলেন। জল অনেক দূর গড়াবে বুঝলাম।
মেঘনা বলল, তোমরা যাও, আমরা এক্ষুণি যাচ্ছি।
দেরি করিস না। সকলে দেখছে। বলে মেজদা তাঁর স্ত্রীকে বললেন, কই, এসো দেখি। যত বাজে ঝামেলা।
পৃথিবীতে সন্দেহের মতো বাজে অসুখ দ্বিতীয়টা নেই। মনের মধ্যে ঢুকলে সহজে বের হবার নয়। আজ আমি আমার শ্বশুর বাড়ির লোকেদের কাছে ভিলেন। কিন্তু কি দোষ আমার! কোনো দিন ঈশ্বরকে জ্বালাতন করিনি, আজ বার বার মনে মনে বলতে থাকলাম, দোহাই ঈশ্বর তৃণাকে রক্ষা করো। ওর যেন কোনো ক্ষতি হয় না ।
যদিও আমার মেয়ে ও স্ত্রী নিজেদের ভুল বুঝতে পেরে সহজ হয়ে গেল। আসলে আমি কিছুই চাপি নি বা মিথ্যা বলি নি। আমার ন্যায় অন্যায় বিচারের দায়িত্ব ওদের হাতে ছেড়ে দিলাম। সব মানুষ প্রথমে অজ্ঞানতা বশত রেগে যায়। সেটা কাটিয়ে উঠতে পারলে সবটা স্বচ্ছ।
অদ্ভুত ভাবে রিঙ্কু আর আমার মেয়ে আমাকে কিছু করতে দিল না। দুজনেই হাসিখুশি, হাঁকডাকে সীনাদের বাড়ির লোক হয়ে গেল !নিজেরাই গিয়ে সীনার সঙ্গে আলাপ করল! ডেকে নিয়ে এলো।ছবি তুলল।মেঘনা বলল, মঞ্চে বাবার অভিনয় দেখিনি।আজ আপনাদের বাড়িতে এক ঝলকে সে সাধারণ পুরণ হয়ে গেলো।
উণি,মঞ্চের বাইরেও ওই রকম দূর্বল।রিঙ্কু বলল।
নাটক করতে গিয়ে লাভ কি হলো জানেন, সারাক্ষণের একজন গাইড পেয়ে গেলাম।বেশির ভাগ নাটকে ধীমানদা আমার বাবা,নয়তো দাদা।নিপাট ভালো মানুষ।ওনাকে সব সময় ওই ভাবেই পেতাম ।
কথায় কথায় সকলেই সহজ হয়ে গেল।ওরা যদিও বুঝতে পেরেছিল একটা বড় ভুল করে ফেলেছে। তাই সকলকে বোঝাতে চেষ্টা করছিল,তোমরা যা ভাবছো তা ঠিক নয়।তাছাড়া স্বভাব মিশুকে ওরা । মেয়েটা কেবল আমার মতো একটু চাপা স্বভাবের।
যথা সময়ে বিয়ের অনুষ্ঠান শুরু হয়ে গেল। বড়দা, মেজদা, ছোড়দা,তাঁদের স্ত্রী, আত্মীয় স্বজন ভিড় করে আছে বর কনেকে ঘিরে। আমি বসে আছি পাত্র ও পাত্রীর পিছনে। সীনা আমার একপাশে। তার ওপাশে মেঘনা। রিঙ্কু আমার এপাশে। ব্রাহ্মণ যখন দুজনের হাত ঘটের ওপর রেখে মন্ত্র শুরু করতে যাবেন, সীনা বলল, ঠাকুর মশাই একটু দাঁড়ান।আমার কিছু কথা আছে। এখানে এখন সবাই উপস্থিত আছেন। বিশেষ করে পীযূষ এবং তৃণা আছে। একটা কথা না জানালে বোধহয় খুব বড় ভুল হয়ে যাবে।
আমি বাধা দিলাম, আঃ সীনা, ওসব কথা এখন থাক। পরে বলবি।
না ধীমানদা, তুমি না আসলে আমি হয়তো এই সাহস কোনো দিন পেতাম না। তোমাকে দেখার পর ঠিক করে ফেলি, আজ আমি যেভাবেই হোক সকলের সামনে বলবই। সে কথা তৃণা পর্যন্ত জানে না।
একটু নিজেকে শক্ত করে নিল । ও যেটা বলতে যাচ্ছে, তা বলতে গিয়ে কেঁদে ফেলতে পারে। এত স্মার্ট একজন মহিলা ভেতরে কত বড় যন্ত্রণা নিয়ে বেড়াচ্ছে, তা ভাবাই যায় না। ওর হাসি, ওর এতক্ষণ টেনসান মুক্ত ঘুরে বেড়ানো ঝুরঝুর করে ভেঙে পড়তে পারে। তার জন্য নিজেকে সংযত হতেই হবে। আমিও চাই না ও কেঁদে ফেলুক। নাটক ওকে ভেঙে পড়তে দেবে না।
রিঙ্কু বোঝাতে চেষ্টা করল , থাক না, ছেড়ে দিন।
মেঘনা তাকে সমর্থন করে বলল, না আন্টি, আপনি বলুন। এটা সকলের শোনা দরকার। অন্তত আমার বাবার দিকে চেয়ে, আপনি বলবেন।
হ্যাঁ তুমি ঠিক বলেছো। তারপর একটু গলা ঝেড়ে নিয়ে বলল, একদিন এইরকম বিয়ের আসর থেকে তৃণার বাবা ফিরে গিয়েছিল।
সঙ্গে সঙ্গে চারদিক আকস্মিক নীরব থমথমে হয়ে গেল। তৃণা তার মায়ের দিকে তাকিয়ে। ও একদিনের জন্য জানতে পারে নি,ওর বাবা জীবিত।ও জানত,মাতৃগর্ভে ওর বাবা মারা গেছেন ।
সীনা সে দিকে তাকাল না।ভালোই করেছে।তৃণার দিকে তাকালে ও সব গুলিয়ে ফেলত।তাই তাড়াতাড়ি শুরু করে দিল,সেটা খুব লজ্জার। আমরা একটাঅন্যায়ও করেছিলাম।সেটা বলতে দ্বিধা নেই। আমাদের বিয়ের আগেই তৃণা আমার গর্ভে এসে গিয়েছিল।
একটা গুঞ্জন উঠলো।সেটাই স্বাভাবিক। সমাজে সতীর সংখ্যা বেশি। অথচ সমাজটার দিকে চাওয়াই যায় না।
সীনা মুচকি হেসে শুরু করল, তাই তাড়াহুড়ো করেই বিয়ের আয়োজন করা। আমার শ্বশুর মশাই সেটা বুঝতে পেরে একের পর এক চাপ বাড়াচ্ছিলেন। তিনি বিনীতভাবেই বললেন, এই মুহূর্তে বাড়িটা সারানো দরকার। তাই -
তিনি মুখে বলতে পারলেন না। ছেলে হিসাব করে লাখ দুয়েক নিল। একটা গাড়ি না হলে মানায় না, আমি কলেজে যাব। অতএব দুজনে চারচাকা নিয়ে এলাম। টুকটাক আসবাব কেনা কাটা চলতে থাকল । আমি বিয়ে করব। সত্যি কি যে আনন্দ হচ্ছিল। মনের মানুষকে পাব। তখন আমার টাকা, বা বাবার টাকা বলে জ্ঞান করিনি। যা কিছু, সব তো আমাদের। আমাকে তো দুটো বাড়ি সামলাতে হবে।
সব যখন তুঙ্গে, কেনাকাটা থেকে ডেকরেটিং, ক্যাটারিং, সব সব। ঠিক বিয়ের আগের দিন পনের লক্ষ টাকা চেয়ে বসলেন শ্বশুর মশাই। বাবা আমাকে প্রথমে বলেন নি। রাতে নিখিলেশ ফোন করে জানতে চাইল , কই কিছু বললেন না তো তোমার বাবা?
কি বলবে?
ও বলল, তোমার বাবা কিছু বলেন নি?
না, কি হয়েছে? আমাকে বলো না! আমি বললাম।
ও বলল, ঠিক আছে, পরে বলব। শুধু এইটুকু জেনে রাখো খুব দরকার।
আমি জানতে চাইলাম, কোনো বিপদ হয়নি তো?
নিখিলেশ হেসে বলল, না না, কাল বিয়ে আজ বিপদ হতে পারে?
বলে ফোন কেটে দিল। বাবার কাছে গেলাম। খুব মন খারাপ। সত্যি তখন ওনার কাছে অত ছিল না। বাবা কিছু বলবেন না। আমি ছাড়লাম না। শেষে বললেন। শুনে আমার কান মাথা রাগে আগুন হয়ে উঠল। মনে মনে ঠিক করে ফেললাম ওদের উচিত শিক্ষা দেব। বাবাকে বললাম, কাউকে কিছু বুঝতে দেবে না। কাল ওদের বোঝাব উদাসীনা কি জিনিস বাবা কিছুতেই রাজি ছিলেন না। আমি জেদ ধরলাম। বার বার বলতে থাকলেন, তোর কি হবে।
পরের দিন ঠিক এই রকম সময়ে সেদিন আমি আমার শ্বশুর মশাইকে ডেকে বলেছিলাম, শুনুন পরিমলবাবু ,আপনি যে পনের লাখ চেয়েছেন তার বিনিময়ে আমি আপনার ছেলের বৌ হতে পারব না। আপনারা কি বিয়ে দেবেন?
ভদ্রলোক খেপে গেলেন। মানে, আগে বলা হয়নি কেন? নিখিল?
ছেলের দিকে অগ্নি মূর্তিতে তাকিয়ে। নিখিলেশ একই ভাবে রাগত আমার দিকে। সত্যি বলছি,তখন আমার ভেতরটা চুরমার হয়ে গেল।এই মানুষটাকে ভালো বেসে -
সীনার চোখে জল।নিজেকে সামলে নিল।
পরিমলবাবু তখন বাবাকে জিজ্ঞেস করলেন, মিত্র বাবু?
বাবাও বললেন,না,এই রকম অভদ্রদের সঙ্গে আমি কাজ করব না।
ওনারা ব্রাহ্মণকে ডেকে তুলে নিলেন। নিখিলেশকে জিজ্ঞেস করলাম ,তোমার মত?
সে বিশ্রী হেসে বলল,ওই ধীমানের সব অপকর্ম আমার ঘাড়ে চাপিয়ে দেবে এত সস্তায়?
রাগে আমার কান লাল হয়ে গেল।টান মেরে ছুঁড়ে ফেললাম বিয়ের সাজ সজ্জা।একটা আশা ছিল নিখিলেশ শেষ পর্যন্ত রুখে দাঁড়াবেই । তা না,সে উল্টো গাইতে শুরু করল। রেগে বললাম,পুলিশে খবর দাও বাবা।
ধীমানদা ভিড় ঠেলে এসে আমাকে ধমক দিয়ে বললেন, কি করছিস? যে আসছে সে কি শিক্ষা পাবে?
তার সব পরিচয় তো শেষ । আমি বললাম।
ধীমানদা বললেন, সব হবে।যে ওর বাবা,ও সেই পরিচয় পাবে। আমাকে ওদের বোঝাতে দে।তা না হলে তোর পরিচয়ই ওর পরিচয় হবে।
ও তোমার নামে -
আমার কথা শেষ করতে না দিয়ে বললেন, ও ভাবতে পারেনি এভাবে ফাঁসবে।ওকে আমরা বোঝাব , তোর কোনো চিন্তা করতে হবে না।
নিখিলেশকে টেনে তুলে নিয়ে গেল তার বোন ও ভগ্নিপতিরা। কি অশ্রাব্য গালি গালাজ ,আমি আজও ভাবতে পারি না ।
সীনা একটু থেমে ভাঙা গলায় বলল,বিয়ে আমাদের হয়নি। তারপরে ধীমানদারা ওকে বুঝিয়ে ছিল। ওকে বা ওর বাবাকে জেলে পুরতে কয়েক মিনিটের ব্যাপার ছিল। ধীমানদা সব সময় পাশে থেকে আমাকে শান্ত করেছেন। বুঝিয়েছেন । শুধু এই তৃণার মুখ চেয়ে কিছু করতে পারিনি।
বাবা মারা গেলেন। আমাদের নাট্যদল ভেঙে গেল। অফিসে, পাড়ায় , সর্বত্র ও একা হয়ে গেল।ওর লোভী বাপটা আবার বিয়ে দিতে চেয়েছিল। তখন ধীমানদারা বুঝিয়ে ছিলেন,তোদের সার্টিফিকেট এখন উদাসীনার গর্ভে। নিখিলেশ আর বিয়ে করে নি। তবে নিজেকে ধ্বংস করেছে। আমিও পারিনি রক্ষা করতে।
তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,একদিন সে পৃথিবী ছেড়ে চলে গেল। তারপর পেলাম উকিলের চিঠি। ওর যা কিছু ছিল, সব মেয়ের নামে দিয়ে গেছে।আমি নিখিলেশের পরিচয়ে মেয়ে মানুষ করেছি। এবার আমার ছুটি।বলুন, এই মেয়েকে আপনারা কি গ্রহণ করবেন?
পুরো অনুষ্ঠান বাড়ি নীরব। কেবল আলোগুলো জ্বলছে হাসি মুখে। সকলের মাথা নিচু। রিঙ্কুর বড়দা বললেন, ঠাকুর মশাই , আপনি শুরু করুন। এই শাঁখ বাজাও, উলু দাও।
পীযূষ আবার তৃণার হাতটা নিজের হাতের ওপর তুলে নিল।
-------------------------------
১ জানুয়ারী ২০২২
ঠিকানা