তিন বছর প্রায় হলো ,আজও মনে পড়লে শিহরণ জাগে। আফ্রিকার তানজানিয়ার সেরেঙ্গিটির সেই রাত! চলেছি সেরেঙ্গিটির জঙ্গল দর্শনে-সাভানা ঘাসে ভরা হলুদ দিগন্ত। আকাশিয়া জাতীয় কিছু গাছ ও দেখা যাচ্ছে। জঙ্গলে ঢোকর মুখেই পশুরাজের দর্শন।এত কাছ থেকে, যে গাড়ির জানলা দিয়ে হাত বাড়ালেই ছোঁয়া যায়;কেশরে রোদের আভা চকচক করছে। নির্লিপ্ত ভাবে একবার আমাদের দেখে নিলেন।
গাড়ির সামনে পার হচ্ছে জেব্রা,হরিণ এবং উইল্ডে--বিস্টের দল। প্রকৃতির সৃষ্ট এই সৌন্দর্যে চোখ জুড়িয়ে যায় । কিছুটা যাবার পর দেখি,রাস্তার ওপর মা এবং মেয়ে সিংহী দুপুরের খাবারে ব্যস্ত। মা সিংহী একটি বন্য শূকর শিকার ধরে আগলে রেখেছে আর তার মেয়েকে খেতে সাহায্য করছে। গাড়ী,মানুষ কিছ্তেই তাদের ভ্রুক্ষেপ নেই। প্রকৃতির রাজ্যেও মায়ের স্নেহের নিদর্শন একই রকম। হঠাৎ দেখি,গাড়ির পাশে একটি গাছে একটা লেপার্ড।
গাছের ডালের সাথে গায়ের রঙ প্রায় মিশে গেছে।দূরে কোনো খাবার নজর আসতেই,গাছ থেকে নেমে তীব্র গতিতে ঘাসের অরণ্যে মিলিয়ে গেল।
জঙ্গলের নানান দৃশ্যে এতটাই মগ্ন হয়ে পড়েছিলাম যে কখন বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হয়ে গেছে, খেয়াল হয়নি।
রাত্রিবাসের ব্যবস্থা ছিল জঙ্গলের ভিতররেই একটি ক্যম্পে। ঘরের সামনে একফালি বারান্দা, দুটি চেয়ারও রাখা আছে।ওখানে বসে সামনের বিস্তৃত অরণ্য উপভোগ করা যায় ।
ক্যম্পে ঢোকার মুখেই দুই তিনটি হায়নার সাথে আমাদের দেখা- আমাদের দেখেই ঘাসের মধ্যে লুকিয়ে পড়ল।
সন্ধ্যার পর তাবু থেকে বেরনো মানা । এমনকি বারান্দায় বসাও নিষেধ। শ্যাম এবং চার্লস রাতে এসে ডিনারের তাবুতে নিয়ে গেল এবং পৌঁছেও দিয়ে গেল। ওদের হাতে বড় টর্চ ও লাঠির মত এক অস্ত্র।
রাতে যাতে আমরা কোনোভাবেই তাবুর বাইরে না বেড়োই তা বার বার বলে গেল।
তাবুতে এসে সবে ঘুমোবার তোড়জোর করছি,হায়নার বিচিত্র ডাক!শুনেছিলাম হায়নার হাসির কথা,এবার সেই বিচিত্র ডাক নিজের কানে শুনে বুক কেঁপে উঠল।
রাত একটু বাড়তেই হাতির দলের আগমন।তাবুর চার পাশে ফোঁস ফোঁস শব্দ। মাসাই ছেলেটি বলেছিল যে , রাতে প্রায়ই জলের সন্ধানে হাতি এদিকে চলে আসে।এমনকি সামনের বারান্দায় সিংহও এসে বসে।
বিছানায় শুয়ে হাতির বৃংহণ আর পদশ্বব্দের আওয়াজে ভয়ে কেঁপে উঠছিলাম। হাতির ওই
ভয়ংকর দাঁত যদি কোনোভাবে তাবুর মধ্যে ঢুকিয়ে দেয় তবে তাবুর এই কাপড় ছিঁড়তে কতক্ষণ! অনেকক্ষণ এইভাবে চলার পর মাসাই ছেলেরা ড্রাম জাতীয় কিছু বাজিয়ে এবং মুখে অদ্ভুত আওয়াজ করে তাদেরকে তাড়াতে সক্ষম হয়। কিন্তু ঘণ্টা খানেকের মধ্যে আরেকটি দল এসে হাজির ।
মাঝে মাঝে হায়নার ডাক,এছরাও নানা রকম অজানা ডাক ও শব্দ;সারা রাত চোখের পাতা এক করা গেল না।
এই অদ্ভুত শিহরণ জাগানো রাতের অভিজ্ঞতা আমার পক্ষে পুরোপুরি লিখে বা বলে বোঝানো সম্ভব নয় ।
ভোরের আলো ফুটতেই শ্যাম আমাদের খোঁজ নিতে হাজির। তাবুর বাইরে সিংহের পায়ের সদ্য ফেলা ছাপ দেখে তারও উপস্থিতি সম্বন্ধে নিশ্চিত হলাম।
সকাল বেলার চা খেযে খাবার প্যাক করে গাড়ী নিয়ে আমরা গোরংগোরোর উদ্দ্যেশ্যে বেড়িয়ে পড়লাম।
----------------------------------
ডাঃ মধুমিতা ভট্টাচার্য
Add 44/8 Raja Rammohan Roy Road
Metro Park
Kolkata 700082