অনুমিতা শুয়ে আছে আজ হসপিটালের বেডে। ভাবছে ফেলে আসা জীবনের কত কথা। স্মৃতির দর্পণে ভেসে উঠছে লাঞ্ছনা-গঞ্জনা নিন্দার একরাশ মিথ্যা বানানো গল্প কথা। বন্ধ্যাত্বের তকমা তার নাকি ললাট লিখন।কোন শুভ কাজে তার উপস্থিতি অমঙ্গলের ছায়া দেখতে অভ্যস্হ পাড়া- পড়শিরা ।আড়ালে আবডালে তাকে নিয়ে মজা টিটকারি চলত।
এ ব্যাপারে অনুমিতার স্বামী রমেন সব সময় তার পাশে ছিল ।সমস্ত বিপদ অসম্মানের হাত থেকে বুক দিয়ে আগলে রাখতো ।অন্ধ কুসংস্কারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করত ।বিজ্ঞানভত্তিক ব্যাখ্যা দিয়ে সকলকে বোঝাবার চেষ্টা করত।
স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ ডাক্তার রায়চৌধুরীর তত্ত্বাবধানে দীর্ঘ দুই বছর অপেক্ষার পর, নমিতার গর্ভে সন্তান এসেছে ।এ কথা শোনার পর অনুমিতার স্বামী রমেন সেদিন উৎফুল্ল হয়ে অনিতা কে বুকে জড়িয়ে আনন্দে কেঁদে ফেলে।
এই মুহূর্তে রমেন কে কাছে পেতে খুব ইচ্ছে করছে অনুমিতার, কিন্তু হসপিটালের নিয়ম অনুযায়ী তাকে বাইরে অপেক্ষা করতে হচ্ছে ।
হসপিটালের ওয়েটিংরুমে বসে বসে ভাবছে রমেন ।কারণ ডাক্তারবাবু তাকে বলেছেন আলট্রাসনোগ্রাফি রিপোর্টে ক্রিটিক্যাল পজিশনে বাচ্চার অবস্থান। সিজার করার সময় রক্তের প্রয়োজন হতে পারে। সেইমতো রমেন সব ব্যবস্থাই আগাম করে রেখেছে। অনু মিতাকে সে সব কথা শোনায় নি ।মনে মনে শুধু একটাই প্রার্থনা সন্তান যেন সুস্থভাবে ভূমিষ্ঠ হয় ।আর অনুমিতা মাতৃত্বের স্বাদ যেন পায় ।তার শুন্য কোল ভরে যাক চাঁদের ফুটফুটে আলোতে।
অনুমিতাকে ও.টি তে নিয়ে যাওয়ার আগে রমেনকে প্রয়োজনীয় কাগজপত্রে সই করে নেওয়া হলো। স্টেচারে করে ও.টি তে প্রবেশ করল অনুমিতা, সঙ্গে সিস্টার ,অপলক নয়নে তাকিয়ে আছে রমেন তার মুখের দিকে।এক অজানা আতঙ্কে তার বুকের স্পন্দন যেন বেড়ে গেল।
ভিতরে অপারেশন চলছে, বাইরে রমেন অস্থিরভাবে পায়চারী করছে। একটা একটা মিনিট কাটছে আর উৎকণ্ঠায় রমেনের বুকের কাপন বেড়ে চলেছে।
অনেকক্ষণ অপেক্ষার পর ও. টি- র দরজা খুলে গেল ।ডাক্তারবাবু বের হয়ে আসলেন । রমেন ছুটে যায় ডাক্তারের কাছে,-- ডাক্তারবাবু বলুন আমার অনুমিতা -- রমেন কে থামিয়ে দিয়ে ডাক্তার চৌধুরী বলেন আপনার পুত্র সন্তান হয়েছে সুস্থ আছে ।তবে, ---তবে কি ডাক্তার বাবু অবস্থা সংকটজনক আমরা সবরকম চেষ্টা করে চলেছি , এখনও জ্ঞান ফেরেনি।ওনাকে আইসিইউতে রাখা হয়েছে বাহাত্তর ঘন্টা না কাটলে কিছু বলা যাবে না।
রমেনের মাথায় যেন আচমকা বজ্রপাত হলো, তার হৃদস্পন্দন থেমে যাওয়ার উপক্রম হল ।কোন রকমে নিজেকে সামলে বলতে থাকে, ডাক্তারবাবু যেমন করে হোক আমার স্ত্রীকে আমার কাছে ফিরিয়ে দিন। না হলে যে আমার সন্তান মাতৃ হারা হয়ে যাবে ।স্ত্রীর অপূর্ণ সাধ পূরণ করার একটা সুযোগ করে দিন। ডাক্তার বাবু বলেন দেখুন আমরা সবরকম চেষ্টা করবো দেখা যাক কি হয়!
অবশেষে সকলের সব প্রার্থনা প্রচেষ্টা ব্যর্থ করে ,মায়ার বাঁধন ছিন্ন করে অনুমিতা পরলোকে চলে গেলেন।
রমেন সদ্যোজাত শিশু পুত্রকে বুকে জড়িয়ে, অনুমিতার মৃতদেহের সামনে হাউ করে কাঁদতে লাগল ,আর বলতে লাগল দেখ অনু তোমার ফুটফুটে পুত্র সন্তান হয়েছে ,কেউ আর তোমাকে বন্ধ্যাত্বের বদনাম দিতে পারবেনা ,কেউ আর তোমাকে অশুভ অমঙ্গল বলে দূরে ঠেলে দিতে পারবে না ।তুমি একবার তোমার সন্তানকে বুকে নিয়ে ওদের মুখে ঝামা ঘষে বলে দাও,আমি বন্ধ্যা ন ই।
অনুমিতার মুখে যেন বিদ্রুপের হাসি, সে যেন বলছে অন্ধ কুসংস্কারের নাগপাশ থেকে মুক্ত হোক এই ঘূণে ধরা সমাজ।
সকালের সোনালী রোদে চিকচিক করছে পবিত্র নিষ্পাপ শিশুর মুখ। চেতনার আলোয় প্রস্ফুটিত বিকশিত হবে আগামী প্রজন্ম।
----------------
অশোক দাশ
ভোজান ,রসপুর ,হাওড়া, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত।
মোবাইল নম্বর-৮৩৪৮৭২৫৩৩৩