বাংলা সাহিত্যে হাসান আজিজুল হকের অবদান
দীপঙ্কর সরকার
' আগুন পাখি ' র স্রষ্টা বরেণ্য লেখক হাসান আজিজুল হকই বোধ হয় নজরুল ইসলামের পর এপার বাংলা ওপার বাংলা কথাসাহিত্যে সমান সমাদৃত । তিনি পশ্চিমবঙ্গের অবিভক্ত বর্ধমান জেলার কাটোয়া মঙ্গলকোট ব্লকের যব গ্রামে ১৯৩৯ সালের ২রা ফেব্রুয়ারি এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন । তাঁর পিতার নাম মোহাম্মদ দোয়া বখস্ আর মাতা হলেন জোহরা খাতুন । শৈশব থেকে কৌশোরে তাঁর বেড়ে ওঠা ওই যব গ্রামেই । ১৯৫৪ সালে যবগ্রাম মহারাণী কাশীশ্বরী উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত শিক্ষা গ্রহণ করেন ।
১৬ বছর বয়সে দেশভাগের সময় বর্ধমান থেকে পরিবারের সঙ্গে বাংলাদেশ তথা পূর্ব পাকিস্তানে চলে যান তিনি । এরপর সেখানেই তাঁর বেড়ে ওঠা । ১৯৫৬ সালে খুলনা শহরের অদূরে দৌলতপুর ব্রজলাল কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাশ করেন ।১৯৫৮সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দর্শন বিষয়ে স্নাতক ও ১৯৬০ সালে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন । ১৯৬০ সালে অষ্ট্রেলিয়ার মেলবর্নে পি এইচ ডি করতে গেলেও পরিবেশের কারণে তা অসমাপ্ত রেখেই প্রত্যাবর্তন করেন ।
১৯৬০ থেকে ১৯৭০ পর্যন্ত তিনি রাজশাহী সিটি কলেজ , সিয়ারগঞ্জ কলেজ , খুলনা সরকারি কলেজ , মহিলা কলেজ এবং সরকারি ব্রজবালা কলেজে অধ্যাপনা করেন । ১৯৭৩ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন এবং ২০০৪ সাল পর্যন্ত ৩১ বছর সেখানে অধ্যাপনা করে অবসৃত হন ।
ছাত্রাবস্থা থেকেই হাসান আজিজুল হকের লেখা লেখির সূত্রপাত । সিকান্দার আবু জাফর সম্পাদিত' সমকাল ' পত্রিকায় ১৯৬০ সালে ' শকুন ' নামক গল্পের প্রকাশের মধ্য দিয়ে তাঁর সাহিত্যাঙ্গনে অনুপ্রবেশ এবং তা পাঠক মহলে সমাদৃত হয় । তবে রাজশাহী কলেজে পড়ার সময় কলেজের উদ্যমী তরুণ মিসবাহুল আজীম সম্পাদিত ' ভাঁজ পত্র ' চার পাতায় রাজশাহীর আম মাহাত্ম্য বিষয়ক প্রথম লেখা প্রকাশিত হয় ।
প্রথম যৌবনেই প্রগতিশীল ছাত্র রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ায় পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর হাতে চরম নির্যাতনের শিকার হতে হয় তাঁকে । সে সব বিষয় ও তাঁর গল্প-উপন্যাসে প্রভাবিত হয় । ষাটের দশকে আবির্ভূত এই প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক তাঁর সুঠাম গদ্য ও মর্মস্পর্শী বর্ণনা ভঙ্গির জন্য প্রসিদ্ধি লাভ করেন ।
তাঁকে ছোটগল্পের রাজপুত্র বলা হয়ে থাকে । জীবন সংগ্রামে লিপ্ত নির্যাতিত , লাঞ্ছিত সাধারণ মানুষের কথকতা তাঁর গল্প-উপন্যাসের প্রধান উপজীব্য । রায় বঙ্গ তাঁর অনেক গল্পের পটভূমি । হাসান আজিজুল হক তাঁর অর্ধশতাব্দীরও বেশি সুদীর্ঘ সাহিত্য জীবনে দিয়েছেন বিচিত্র ও বিস্ময়কর অনেক ছোটগল্প আর জীবন দর্শন ও চিন্তারসে জারিত বহু সুস্বাদু গদ্য ।
হাসান আজিজুল হকের রচনাবলিকে ছোটগল্প , উপন্যাস , প্রবন্ধ , নাটক , উপন্যাসিকা ও শিশু সাহিত্য প্রভৃতি বিভাগে ভাগ করা যায় ।
তাঁর গল্পগ্রন্থ গুলো যথাক্রমে--' সমুদ্রের স্বপ্ন শীতের অরণ্য '(১৯৬৪) , ' আত্মজা ও একটি করবী গাছ '(১৯৬৭) ,' জীবন ঘষে আগুন '(১৯৭৩),' নামগোত্র হীন '(১৯৭৫),' পাতালে হাসপাতালে '(১৯৮১),' নির্বাচিত গল্প '(১৯৮৭),' আমরা অপেক্ষা করছি '(১৯৮৮),' রাঢ়বঙ্গের গল্প '(১৯৯১),' রোদে যাব '
(১৯৯৫),' হাসান আজিজুল হকের শ্রেষ্ঠগল্প '(১৯৯৫), ' মা মেয়ের সংসার '(১৯৯৭),' বিধবাদের কথা ও অন্যান্য গল্প ' (২০০৭) প্রভৃতি ।
হাসান আজিজুল হক রচিত উপন্যাস গুলো হল--
' আগুন পাখি '(২০০৬),' সাবিত্রী উপাখ্যান '(১৯১৩) ,' শামুক '(১৯১৫) প্রভৃতি ।
তাঁর রচিত প্রবন্ধ গ্রন্থ গুলো হল-- ' কথা সাহিত্যের কথকতা '(১৯৮১),' চালচিত্রের খুঁটিনাটি '(১৯৮৬), ' সক্রেটিস '(১৯৮৬),' অপ্রকাশের ভার '(১৯৮৮) ,' অতলের আধি '(১৯৯৮),' কথা লেখা কথা '(২০০০), ' লোকযাত্রা আধুনিক সাহিত্য '(২০০৫),' একাত্তরঃ করতলে ছিন্নমাথা'(২০০৫) ,' ছড়ানো ছিটানো '(২০০৮),' কে বাঁচে কে বাঁচায় '(২০০৯),' বাচনিক আত্মজৈবনিক ,'(২০১১) ,' চিন্তন কথা '(২০১৩) ' রবীন্দ্রনাথ ও ভাষা ভাবনা '(২০১৪) প্রভৃতি ।
নাটক --চন্দর কোথায় (জর্জ শেহাদের নাটকের ভাষান্তর)।
হাসান আজিজুল হকের শিশু সাহিত্য -- ' লাল ঘোড়া আমি '(১৯৮৪ সালে প্রকাশিত কিশোর উপন্যাস) ' ফুটবল থেকে সাবধান ' (১৯৯৮সালে প্রকাশিত শিশু তোষ গল্প ) ।
উপন্যাসিকা--' বৃত্তায়ন '(১৯৯১) , ' শিউলি '(২০০৬) এছাড়াও তাঁর কয়েকটি স্মৃতিকথা ও আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ ও সম্পাদিত গ্রন্থাবলিও রয়েছে । ' সমুদ্রের স্বপ্ন ও শীতের অরণ্য ' গ্রন্থের অন্তর্গত ' শকুন ' এ লেখক সুদখোর মহাজন তথা গ্রামীণ সমাজের তলদেশ উন্মোচিত করেন । এছাড়াও অন্যান্য ছোটগল্প যেমন তৃষ্ণা , উত্তর বসন্তে , বিমর্ষ , রাত্রি , প্রবাসী , জীবন ঘষে আগুন , মন তার শঙ্খিনী , বিধবাদের কথা ,র মতো অসংখ্য ছোটগল্পের ভাণ্ডারে মণিমুক্তোর মতো ঝলমল করবে । মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে লেখা তাঁর গল্পগুলোর পরতে পরতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে শিউরে ওঠার মতো মুক্তি মুক্তিযুদ্ধের বিভীষিকাময় বিবরণ । তাঁর আত্ম সমীক্ষায় জানান ," গল্প তৈরি করে লিখে যাওয়া , সেটা আমার দ্বারা কখনওই হয় না । আমার কাজ অনেকটা কামার-কুমোরের মতো হাতে নাতে কাজ । অভিঞ্জতার বাইরে আমি কিছুতেই যেতে পারি না । " তাঁর লেখার উপাদান অবশ্যই জীবন থেকে নেওয়া , তিনি জীবনবোধের লেখক । তিনিই তো লিখেছেন ,' জীবন ঘষে আগুন ' । তাঁর লেখায় আছে কৃষক-শ্রমিক প্রভৃতি প্রান্তিক মানুষের জীবন সংগ্রাম , নারীর জীবন সংগ্রাম ।
ষাটের দশকে আবির্ভূত ছোট গল্পের বরপুত্র আজিজুল হক অনেক পরে উপন্যাস রচনায় ব্রতী হন। তাঁর উল্লেখযোগ্য প্রথম উপন্যাস ' আগুন পাখি ' বাংলা সাহিত্যে এক অভাবনীয় সংযোজন । সাজানো গোছানো একটা সংসার , কিছু জীবন হুট করেই বদলে যায় । ফুটে ওঠে প্রতিবাদ আর এই প্রতিবাদ কেবলই নিজের জন্য , আপন অস্তিত্বের জন্য । এভাবেই একটি পরিবারের উত্থান পতনের ভেতর দিয়ে লেখক অঙ্কন করেন গোটা সমাজের উত্থান পতনের চিত্র । এই উপন্যাসের জন্য ২০০৮ সালে কলকাতা থেকে আনন্দ পুরস্কার লাভ করেন তিনি ।
' আগুন পাখি ' র বহুদিন পর তিনি ' সাবিত্রীর উপাখ্যান ' নামক আর এক আশ্চর্য আখ্যান রচনা করেন , যেখানে এক সাধারণ কিশোরীর ধর্ষিত হওয়া থেকে তার নারী হয়ে ওঠা এবং তার জীবন সংগ্রাম এমনভাবে অঙ্কন করেছেন লেখক যা কেবল হাসান আজিজুল হকের পক্ষেই সম্ভব । এ জন্যই তিনি ," লেখকদের লেখক ' ।
এছাড়াও তিনি ' শিউলি ' ও ' বৃত্তায়ন ' নামক দুটি উপন্যাসিকা রচনা করলেও ' বৃত্তায়ন ' কে তিনি উপন্যাস বলে স্বীকার করতে চান নি । সে যাই হোক ,
হাসান আজিজুল হক তাঁর রচনার প্রসাদগুণে ও চরিত্র চিত্রণে , তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণ ও নির্মেদ উসপস্থাপনার জন্য তিনি দীর্ঘদিন পাঠকের মনের মণিকোঠায় বিরাজ করবেন । এজন্যই সমালোচকদের অভিমত , রবীন্দ্রনাথের পর বাংলা কথাসাহিত্যে হাসান আজিজুল হক শ্রেঠ গল্পকার ।
বাংলা সাহিত্যে তাঁর অবদানের জন্য হাসান আজিজুল হক বিবিধ পুরস্কারে ভূষিত হন ।
১৯৬৭ সালে ' আদমজী পুরস্কার ' , ১৯৭০ সালে ' বাংলা সাহিত্য একাডেমি পুরস্কার ' , ১৯৯৯ সালে' একুশে পদক ' ও ২০০৮ সালে ' আনন্দ পুরস্কার ' লাভ করেন । এই অসামান্য গদ্যশিল্পী তাঁর সার্ব-জৈবনিক সাহিত্য চর্চার স্বীকৃতি স্বরূপ ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে' সাহিত্য রত্ন ' উপাধি লাভ করেন । এছাড়াও ২০১২ সালে আসাম বিশ্ববিদ্যালয় ও ২০১৮ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সম্মান সূচক ডি লিট ডিগ্রি পান ।
এহেন কালজয়ী সাহিত্যিক বেশকিছুদিন ধরে বার্ধক্যজনিত কারণে নানাবিধ রোগে ভুগ ছিলেন । অবশেষে ১৫ নভেম্বর ২০২১ নিজ বাসভবন ' উজান ' এ শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন । আর সঙ্গে সঙ্গে এপার বাংলা ওপার বাংলায় নেমে আসে শোকের করাল ছায়া । সাহিত্যাকাশে এই নক্ষত্র পতন এক অপূরণীয় ক্ষতি ।
---------------------
ঠিকানা
দীপঙ্কর সরকার
কাঁঠাল পুলি
(সিংহের হাটের কাছে)
চাকদহ
নদীয়া।