১৮৬৯ সাল। পৃথিবীর ইতিহাসে ঘটে গেল একটা অন্যরকম বিপ্লব। সেই বিপ্লবের নেপথ্যে কোন বোমা-গুলি-বন্দুক, সিংহাসনের টানাপোড়েন ছিল না। ছিল না কোন রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম। তবুও সেই বিপ্লবের ফলে একদল সর্বগ্রাসী জীবের আগ্রাসন থেকে রক্ষা পেয়েছিল অনেক নিরপরাধ এবং অবলা প্রাণ। এই সর্বগ্রাসী জীব কারা? হ্যাঁ, ঠিক ধরেছেন, মানুষ। আর যারা বেঁচে গেল, কিছুটা হলেও যাদের অনবরত খুন হয়ে যাওয়া বন্ধ হল, তারা কারা? হ্যাঁ, তারা সেই সবুজ উদ্ভিদ আর বন্যপ্রাণী। তবে এদের মধ্যে মূলত, তাৎক্ষণিক ভাবে সেই সময় লাভবান হয়েছিল হাতি। ব্যাপারটা তাহলে খুলেই বলা যাক।
সেই সময় বিলিয়ার্ড খেলা হত ইউরোপের অভিজাত মহলে। হঠাৎ হল কি, ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষদিকে এই খেলা বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠলো। শুধু ইউরোপ নয়, অন্যান্য দেশেও এর জনপ্রিয়তা বাড়তে লাগল। আর যত এর জনপ্রিয়তা বাড়তে লাগলো, ততই খুন হতে লাগলো বন্য দাঁতাল হাতি। কেন? আসলে, বিলিয়ার্ড খেলা হত যে বলে, সেগুলো হত আইভরি বল। মানে সেই বল বানানো হত হাতির দাঁত দিয়ে! আর হাতির দাঁত পাওয়ার জন্য হাতি হত্যা করতেই হত। যখন থেকে বিলিয়ার্ড খেলা জনপ্রিয়তার তুঙ্গে উঠতে লাগলো, তখন থেকে হাতি ও মারা হতে লাগলো প্রচুর পরিমাণে। একটা সময় এমন দাঁড়ালো যে অসংখ্য হাতি মেরেও বলের ঠিকঠাক যোগান দেওয়া গেল না। সেই পরিস্থিতিতে নিউইয়র্কের এক ব্যবসায়িক সংস্থা " দ্য নিউইয়র্ক বিলিয়ার্ড কোম্পানি " ঘোষনা করলো, যে কেউ এই আইভরির যথাযথ বিকল্প কিছু তৈরী করতে পারবে, তাকে তাদের পক্ষ থেকে ১০০০০ ডলার পুরস্কার দেওয়া হবে। সেই সময় জন ওয়েসলে হায়াৎ নামে এক ছাপাখানা কর্মী ঠিক এই জিনিসটা নিয়েই কাজ করছিলেন, সঙ্গে ছিলেন তাঁর ভাই ইসাইয়া হায়াৎ। এই পুরস্কারের বিজ্ঞাপন ওয়েসলে হায়াৎ কে উৎসাহিত করে তুললো। তিনি আরো গভীর মনোযোগ নিয়ে এই বিকল্প পদার্থের খোঁজে মেতে উঠলেন। এই গবেষণা চলতে চলতেই এমন একটা ঘটনা ঘটলো যাতে এই বিকল্প আবিষ্কারের পথ আরো মসৃণ হয়ে গেল। একদিন হঠাৎ ওয়েসলে হায়াৎ এর হাত থেকে একটা কলোডিওন ভর্তি বোতল পড়ে গেল মেঝেতে। বোতল ভেঙে মেঝেতে ছড়িয়ে পড়লো সেই কলোডিওন। আর কয়েক মুহুর্ত পর, হায়াৎ অবাক হয়ে দেখলেন, সেই ছড়ানো কলোডিওন গুলো জমাট বেঁধে বেশ শক্ত আর রবারের মত একটা জিনিসে পরিণত হল। হায়াৎ এই জিনিসটা দিয়েই বানালেন বিলিয়ার্ড বল। তবে সেই বল খুব একটা কাজের হল না। আসলে সমস্যাটা হল, বিলিয়ার্ড খেলার সময় এই বলগুলো ঠোকাঠুকি হলেই ফেটে যেত। ফলে এটা একটা সাময়িক ব্যর্থতা আর হতাশা তৈরী করলো। কিন্তু হায়াৎ দমার পাত্র নন। তিনি গবেষণা চালাতে লাগলেন নিজের মত করে এবং কিছুদিনের মধ্যেই এই সমস্যার সমাধান করে ফেললেন। কি ভাবে? তিনি ওই কলোডিওন এর সঙ্গে মেশালেন কর্পূর। তৈরী করলেন প্রথম বানিজ্য সফল বিকল্প " সেলুলয়েড" । এই সেলুলয়েড দিয়েই তৈরী হতে লাগলো বিলিয়ার্ড বল। হাতির দাঁত এর এই বিকল্পকেই বলা যায় মানুষের তৈরী প্রথম "প্লাস্টিক"। এই একবিংশ শতাব্দীতে আমরা প্লাসটিক বলতে অনেক ধরনের জিনিস বুঝি। কিন্তু প্লাস্টিকের ঠিকঠাক অর্থ হল, 'নমনীয় এবং যাকে ইচ্ছামত আকার দেওয়া যায়'। আবার বর্তমানে ব্যবহার হয় যে সমস্ত পলিমার, যেমন পলিইথিলিন বা পলিথিন, পিভিসি, টেফলন এরাও প্লাস্টিক। তবে পলিথিন মাত্রই প্লাস্টিক হলেও, সব প্লাস্টিক কিন্তু পলিথিন নয়। আর এই প্লাস্টিকের প্রায় সবটাই মানুষের তৈরী, প্রকৃতি শুধুমাত্র এদের উপাদান গুলো সরবরাহ করে, কিন্তু এদেরকে প্লাসটিক রূপে প্রকৃতিতে পাওয়া যায় না।
তবে হায়াৎ এর আগেও প্লাস্টিক নিয়ে গবেষণা হয়েছে। প্রাকৃতিক পলিমার ( এরা আসলে অনেক বড় শৃঙ্খলে যুক্ত কার্বনের জৈবযৌগ অণু) ব্যবহার করে প্লাসটিক তৈরীর চেষ্টা প্রথম কে করেন তা সঠিক ভাবে বলা না গেলেও ১৮৫৫ সালে ইংরেজ গবেষক আলেকজান্ডার পার্কস প্লাসটিকের একটা প্রাথমিক রূপ তৈরী করেছিলেন।
যাইহোক, হায়াৎ-এর তৈরী প্লাস্টিক ( সেলুলয়েড) শুধু যে বিলিয়ার্ড বল তৈরীতে কাজে লাগলো তা কিন্তু নয়। এই সেলুলয়েড দিয়েই তৈরী হল ফটোগ্রাফির ফিল্ম, চলচ্চিত্রের ফিল্ম।
এরপর প্লাস্টিকের দুনিয়ায় পা রাখলো বেকেলাইট। ১৯০৭ সালে এই বিকল্প পদার্থটা তৈরী করেন লিও বেকল্যান্ড। এটা তৈরী হয়েছিল এক ধরনের রেজিন থেকে। এদেরকে একবার তাপ এবং চাপের সাহায্যে একটা নির্দিষ্ট আকৃতি দিয়ে দিলে সেটাই বজায় থাকে, তা আর বদলায় না। এরা তাপ সহ্য করতে পারে, অল্প চাপে ভেঙে পড়ে না, বিদ্যুৎ নিরোধক, সূর্যের আলোতে এদের রঙের কোন পরিবর্তন হয় না, অর্থাৎ এদের অনেক গুণ, অনেক কাজেও ব্যবহার হতে লাগলো এই বেকেলাইট। ইলেকট্রিকের সুইচ থেকে আর মগ পর্যন্ত এই বেকেলাইটে তৈরী হতে লাগলো। আজো বেকেলাইট যথেষ্ট ব্যবহার হয়। এমনকি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এই ব্যাকেলাইট দিয়ে বানানো হয়েছিল অস্ত্র।
এরপর বলতে হয় সেলোফেন আবিষ্কারের গল্প। সেও এক মজার ঘটনা। একদিন সুইডেনের টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ার ডক্টর ব্রাণ্ডেনবার্গার একটা রেস্টুরেন্টে বসে আছেন। পাশের টেবিলে এক খদ্দের খাচ্ছেন। হঠাৎ হল কি -- সেই পাশের টেবিলের ভদ্রলোক দিলেন তরকারির বাটি একেবারে উল্টে। টেবিলে তরকারি পড়ে একাকার কাণ্ড। টেবিলক্লথটা গেল নোংরা হয়ে, ওয়েটার সেই টেবিল ক্লথটা পাল্টে দিতে তবে শান্তি।
এই ঘটনা ব্রাণ্ডেনবার্গার কে চিন্তিত করলো। তিনি ভাবলেন এমন একটা টেবিলের ঢাকা যদি বানানো যায়, যার উপর তরকারি বা ওই জাতীয় কিছু পড়লে সেটাকে একটা পরিষ্কার কাপড় দিয়ে মুছলেই দাগটা উঠে যাবে, তবে এই সমস্যার সমাধান করা যাবে। যেমন ভাবা, তেমনি কাজ। চেষ্টা চলতে থাকলো। ১৯১৩ সাল নাগাদ তিনি কাপড়ের উপর ভিসকোজ নামে একটা প্রলেপ দিলেন, কিন্তু সেটা হয়ে গেল খুব কঠিন আর ভঙ্গুর, যার ফলে সেটা ঠিক কাজে লাগলো না। হাল ছাড়ার পাত্র তিনি নন। এবার তিনি নিজের তৈরী একটা যন্ত্রের সাহায্যে ওই ভিসকোজকেই খুব পাতলা চাদরের আকার দিলেন। এবং এবার তিনি সফল হলেন। সেই পাতলা চাদরটা হল খুব স্থিতিস্থাপক আর জলনিরোধী। একেবারে ব্রাণ্ডেনবার্গার যা চাইছিলেন ঠিক তাই। ব্রাণ্ডেনবার্গার এর আবিষ্কৃত এই জিনিসটা আজো প্রচুর পরিমাণে ব্যবহৃত হয়, আমরা সবাই সেই জিনিসটাকে চিনি সেলোফেন নামে।
আবার ওয়ালেস হিউম ক্যারোদার্স তৈরী করলেন নাইলন। ওয়ালেস হিউম ক্যারোদার্স ছিলেন পশ্চিম ভার্জিনিয়ার চার্লসটনের "ডুপন্ট" নামে একটা কোম্পানির গবেষক। ১৯৩৮ সাল নাগাদ এই নাইলন তৈরী হয়। তখন পশুর রোম বা চুল থেকে তৈরী হত টুথব্রাশের ব্রিসলস। ১৯৩৮ সালে এই নাইলনের ব্রিসলস দেওয়া ব্রাশ বাজারে এলে বেশ ভালোই সাড়া পাওয়া গেছিল। ১৯৩৯ সালে প্রথম যেদিন নাইলনের তৈরী মোজা বাজারে আসে, শোনা যায়, সেই দিনই ক্রেতারা সমস্ত মোজা কিনে নিয়েছিলেন!
এরপর ১৯৩৮ সালে ডুপন্ট কোম্পানির কর্মী রয় প্লাঙ্কেট খানিকটা আকস্মিক ভাবেই আবিষ্কার করেন টেফ্লন, যা দিয়ে বাসন পত্রের উপর প্রলেপ দেয়া হয়।
আবার ১৯৩৩ সালেই মোটামুটি পলিথিন এর শিল্প উৎপাদন শুরু হয়ে যায়। আর পলিথিনের বানিজ্যিক উৎপাদন শুরু হয় ১৯৪৪ সালে। এর নেপথ্যে ও কিন্তু সেই ডুপন্ট, যদিও তার সঙ্গে টেক্সাসের বেটেলি কর্পোরেশন ও যুক্ত ছিল।
এই ভাবেই প্লাস্টিকের জয়যাত্রা এখনো অব্যাহত। অবশ্য এখন এই প্লাসটিকের অন্যতম সদস্য কয়েক ধরনের নষ্ট হয় না এমন পলিথিন সভ্যতার মাথাব্যাথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই পলিথিন একটা ভয়ঙ্কর দূষক হয়ে দাঁড়িয়েছে, ড্রেনেজ সিস্টেম আটকে ফেলে বন্যার কারণ হয়েছে। এমনকি গভীর সমুদ্রের তলায় সামুদ্রিক জীবের পেটেও এই পলিথিন মিলেছে।
তবুও, প্লাস্টিক সভ্যতাকে যেমন এগিয়ে দিয়েছে তেমনি অনেক বৃক্ষ নিধন, হাতির মত অনেক বন্য প্রানীর নির্বিচারে বলি হওয়াটা খানিকটা হলেও আটকেছে।
ঠিকানা*
======
অনিন্দ্য পাল
প্রজত্নে -- বিশ্বনাথ পাল
গ্রাম -- জাফরপুর
পোঃ-- চম্পাহাটিি
পিন - ৭৪৩৩৩০
থানা -- সোনারপুর
জেলা -- দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা
পশ্চিমবঙ্গ, ভারত