Click the image to explore all Offers

গল্প ।। আত্মগোপন ।। জীবন পাইক

 

 আত্মগোপন

  জীবন পাইক 
 
  এমন ভুল তো কখনো হবার নয় ৷বেশ কয়েক বার সুভাষগ্রাম রেল প্লাটফর্মে  সমবয়সী ছেলেটাকে দেখার পর চেনা চেনা লাগলেও একটা সংশয়ের দোলায় দুলেছে সুচন্দর ৷প্রায় সময় একটা প্রশ্ন মনের মাঝে ঘুরপাক খাচ্ছে ৷ ৷ছেলেটি বড়োই চেনা অথচ কেও?আচ্ছা আমি যদি ওকে চিনতে পারি ও নিশ্চয়ই আমাকে চিনবে ৷ও যদি চিনত তবে তো কোন সমস্যা থাকতো না ৷ও যদি বিকাশ না হয় তবে কি অন্য কেউ? বিধাতার কি বিচিত্র লীলা !যমজ ছেলে কিংবা যমজ মেয়ের মধ্যে বিশেষ কোন প্রভেদ চোখে পড়ে না ৷প্রকৃতিতে এমন অনেক নজির আছে ৷ক্রিকেটার শচীন তেন্ডুলকরের মতোই হুবহু এমন এক ব্যক্তির খোঁজ মিলেছিল একটা সময় ৷সৌরভের দাদাগিরি মঞ্চে ছয় জোড়া জমজ ভাই বোনের উপস্থিতি হয়েছিল ৷সেখানে কারোর সঙ্গে কারোর ফারাক করার উপায় নেই ৷সুচন্দর সব সময় ভাবে তবে হয়তো এটা এমন একটি ঘটনা ৷ বিকাশের কথা একটা সময় ভাবতে চায় না ৷নিজের বিভিন্ন সামাজিক কাজকর্মে ডুবে থাকলে  ৷ 
            বিকাশ সুচন্দরের সহপাঠী ৷একইগ্রামে  বাড়ি ৷এক ইস্কুল থেকে ওরা মাধ্যমিক পাশ ও করেছে ৷সবচেয়ে বড়ো কথা  ছোটবেলা থেকে দু'জন এর এক সঙ্গে খেলাধূলা করে বেড়ে ওঠা ৷বিকেল বেলায় সূর্য পশ্চিম আকাশে ঢলে পড়ার আগে ওরা পাড়ার অন্য ছেলেদের সঙ্গে গোরুর পাল মাঠে ছেড়ে দিয়ে খালের কাদা মাটি জলে টুপটুপ করে ডুব দিয়ে কাঁকড়া ,মাছ, চিংড়ি ধরেছে ৷কখনো পাকুড় গাছের ঝুলন্ত ডাল থেকে একসঙ্গে ঝাঁপিয়ে পড়েছে নোনা খালের জলে ৷একসঙ্গে নোনা মাটি গায়ে মেখে কবাডি খেলে ঘরে ফিরে বড়দার হাতে কি মারটা না খেয়েছিল সুচন্দর ৷ সেসব দিনের কথা কখনো কি ভোলা যায়?যায় না ৷
             বিশেষ কোন কাজকর্মে ডুবে না থাকলে ছোটবেলার ওই সব কথা ভেসে ওঠে মনের মধ্যে ৷ও নিশ্চয়ই বিকাশ নয় ৷যদি হতো ,তাহলে ও এসব কথা ভুলে যায় কি করে ?যত পুরোন দিনের কথা হোক না ৷শৈশবের বন্ধু আর ছেলেবেলার গল্প কেউ কি কখনো ভুলতে পারে?পারে না ৷এর মধ্যে হঠাৎ একদিন সুকান্ত সরণির মোড়ে খোশমেজাজে গল্পে ব্যস্ত ছেলেটিকে দেখে সুচন্দর হন্তদন্তে বাইক থামিয়ে বলে-আরে,ভাই বিকাশ তুমি?কি করছো এখানে ?বাড়ি থেকে এলে কবে ?
           ছেলেটি একবার মাত্র ঘুরে তাকালো সুচন্দরের দিকে ৷তারপর মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে আবার খোশমেজাজে আগের ছেলেটির সঙ্গে গল্পে ডুবে গেল ৷তার মুখ ভঙ্গিতে ফুটে উঠল সে সুচন্দরকে আগে কখনো দেখেছে বলেই তার মনে হচ্ছে না ৷কিংবা বিকাশ নামের কোন ছেলে এই পৃথিবীতে থাকতে পারে বলেও তার মনে হয় না ৷
       বড়ো বেকায়দায় আর লজ্জায় পড়ে সুচন্দর আবার বাইক স্টার্ট করে ৷
---কিরে কি হল?
---নাহ,কিছু না চল ৷
---এবার তুই চশমাটা নে ৷খালি চোখে বুঝতে পারছি তোর বড্ড ভুল হচ্ছে ৷
বাইকের সোয়ারি বন্ধু নিখিলেশের এমন কথায় একটু ইতঃস্ততের সুরে সুচন্দর বলে-
--- নারে ভাই ,কোথায় একটা ভুল হচ্ছে মনে হয় ৷চোখে ভুল একদিন দেখতে পারি ,দুদিন দেখতে পারি ৷দিনের পর দিন এমন তো হবার নয় ৷  
সুচন্দর ভাবে যতই দিন বদলাক ,সময়ের চাকা গড়িয়ে চলুক ,বয়স চল্লিশের দোর গড়ায় পৌঁছাক, শরীরের পরিবর্তন হোক  শৈশবের বন্ধুকে চেনা কি সেখানে দুরুহ হয়ে পড়ে ?সেখানে  বন্ধুত্বের গন্ধ কি বিন্দু মাত্র ফুটে বেরোয় না ?
          দিন কয়েক পরে স্কুলে বেরোনোর বড়ই ব্যস্ততা ছিল সুচন্দরের ৷গিন্নির ফরমাশে সকাল সকাল বাজার থেকে টুকিটাকি বাজার আর ছোটদের টিফিনটা তাকে এনে দিতে হবে ৷বড়ো ব্যস্ত পায়ে  বাজার থেকে ফিরছিল ও ৷সামনে পিছনে কে আছে আর কে নেই কোন ভ্রুক্ষেপ ছিল না ওর ৷
---অ্যাই-অ্যাই দাঁড়াও ৷তোমার সঙ্গে আমার অনেক কথা আছে ৷
মাথায় শৌখিন সাহেবি টুপি৷ মুখে রংচঙে মাক্স ৷কালো সানগ্লাসটা চোখে ছিল ৷কথা বলতে বলতে এই সময় সানগ্লাসটা হাতে চলে আসে ৷
  একটু থতমত খেয়ে যায় সুচন্দর ৷এই শহরতলিতে নতুন জায়গায় ওর ঘর তৈরি বেশি দিন হয়ে ওঠে নি ৷স্কুলে শিক্ষকতার চাকরি পেয়েছে তা প্রায় বছর সাতেক হল ৷ঘর তৈরি হল তিন বছর ৷এলাকায় এখন সেভাবে পরিচিতি হয়ে ওঠে নি ৷পাড়ায় সুচন্দর বললে পাশের বাড়ির লোক ও ঠিকানা বলতে পারবে না ৷শুধু পাড়াপড়শিরা জানে প্রতিবেশী লোকটি কোন এক স্কুলে চাকরি করেন ৷
        অপরিচিত লোকটির এধরণের কথায় একটু স্তম্ভিত হয়েছিল সুচন্দর ৷এই সাতসকালে ভয় পাওয়ার তেমনটা কিছু ছিল না ৷
----এসো ,এদিকে সরে এসো ৷ওই গলির দিকে চলো ৷আজ আমাকে তোমার বলতে হবে তুমি কেন আমায় ডাক?
-----আমি ডাকি?
-----হ্যাঁ আমাকেই তো ডাক?
সুচন্দর হাঁ করে তাকিয়ে থাকে তার দিকে ৷
মাথার টুপি ও মুখের মাক্সটা এসময় খুলে ফেলে ছেলেটি ৷
 একগাল হেসে ফেলে সুচন্দর ৷
---কি ভাই বিকাশ তোকে তো চেনাই যায় না ৷ একে বারে বদলে গেছিস দেখছি ৷
---বিকাশ !কে বিকাশ?
---কেন তুই৷
---তুই!মানেটা কি?আমাকে না চিনে না জেনে একেবারে তুই?আপনি বড়ো আজব লোক তো !
এবার খুব অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে সুচন্দর ৷একটু আমতা আমতা করতে থাকে ৷
----আচ্ছা,বাড়িটা কি আপনার  কাশীপুর?
নীরবে সম্মতিসূচক মাথা নাড়ে সুচন্দর ৷
---আপনার বড়ো দাদার নাম কি সুমিত?
সুচন্দর ভাবে ছেলেটা বিকাশ না হয়ে পারে না ৷নিজের কাশীপুর গ্রামের নাম জানে ৷সুমিত দাদার নাম ও ঠিক জানে ৷অথচ নিজের ছোটবেলার বন্ধু সুচন্দরকে চেনে না ৷কথাগুলো ভাবতে গিয়ে ওর হাসি লাগে ৷
    এতক্ষণ পর নিজের ছদ্ম আচরণ সরিয়ে এবার স্বনামে ধরা দিল বিকাশ ৷তবে একটু গৌর চন্দ্রিকা করে ৷ও বলে ,--
       ----ভাই আজ তোর সঙ্গে আমার এই সাক্ষাতের গল্প কখনো যেন কাউকে বলিস না ৷ আমি খুব ভয়ে ভয়ে আছি ৷বড়োই বিপদে বলতে পারিস ৷
    বিস্ময়ে ভাবতে বসে সুচন্দর ৷একি কথা!ও কেন নিজেকে আড়াল করতে চাইছে ৷নিজেকে এভাবে আড়াল করা ,লুকিয়ে রাখার মধ্যে কি এমন গর্ব থাকতে পারে ৷ও নিজের নাম পরিচয় বদলে ফেলেছে ৷ওর নতুন নাম শংকর ৷পুরোনো নামটা ও মুছে ফেলার চেষ্টা করছে ৷নিজের গ্রাম,গ্রামের মানুষ আত্মীয় পরিজনকে ও মনের মধ্যে মেরে ফেলেছে ৷ও এখন পলাতক ৷ কিন্তু কেন?
      ও বেশী কিছু বলে নি ৷ শুধু বলেছিল ,গ্রামের মানুষ জনের কাছ থেকে বহু লক্ষ টাকা তুলে সারদা কোম্পানিতে ফিক্সড ডিপোজিট করিয়েছিল ৷আর কোম্পানির শেখানো বুলি পাঁচ বছরে টাকা ডবল হয়ে ফিরবে কথাগুলো বলেছিল ৷
      গ্রামের সরল মানুষ গুলো কোম্পানিকে চিনতো না ৷চিনতো বিকাশকে ৷তাদের সারা জীবনের জমানো টাকা কোম্পানির অ্যাকাউন্টে জমাতে গিয়ে আজ ওরা নিঃস্ব৷ বিকাশকে দেখে ওরা টাকা জমিয়েছে ওখানে ৷ও নিশ্চয়ই ওখান থেকে টাকা ফেরাতে পারবে ৷সুদ না আসুক আসল তো আসবে ৷ওরা তো আর জানে না সাধারণ মানুষের মতো বিকাশ ও ওখানে অনেক টাকা রেখে ফেঁসে আছে ৷ বাড়িতে দু বেলা গ্রামের মানুষ জনের পায়ে পায়ে হাঁটায় বাধ্য হয়ে এক প্রকার গৃহত্যাগী হয়ে বিকাশ এখন ভবঘুরে আত্মগোপনকারী এক মানুষ ৷ গা ঢাকা দেওয়া ছাড়া ওর আর বিকল্প রাস্তা নেই ৷
                     -------------------------------------------------
 


 
সুভাষগ্রাম,দক্ষিণ ২৪পরগণা,পশ্চিমবঙ্গ
মোবাইল নং--৮৬৯৭৪৮৯৯৭৯
তারিখ--২৫-০২-২০২২

Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.