অণুগল্প ।। জ বা ব ।। চন্দন মিত্র
জ বা ব
চন্দন মিত্র
—মে আই কাম ইন?
বোর্ডে অঙ্ক কষতে কষতে বিনয়বাবু আগন্তুকের দিকে না-তাকিয়েই বললেন— নো, নো। প্লিজ ওয়েট আ মিনিট।
জীবনে এই প্রথম মিস্টার মল্লিক এমন বিড়ম্বনায় পড়লেন। ইন্সপেকশনে গিয়ে এর আগে কোথাও ক্লাসরুমের বাইরে দাঁড়িয়ে এমন অপেক্ষা করতে হয়নি। কোলকাতার নামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ম্যাথামেটিক্সে এমএসসি বছর বত্রিশের মিথুন মল্লিক ভিতরে ভিতরে তেতে উঠলেন। এমনিতেই বিনয়বাবু সম্পর্কে তাঁর একটা অ্যালার্জি তৈরি হয়েছে। প্লেন বিএসসি বিনয়বাবুকে এ তল্লাটে সবাই অঙ্কের জাদুকর নামে চেনে। কেবল নিজের স্কুল বরদাপ্রসাদ বিদ্যানিকেতন নয়, এই মহকুমা শহরে তিনিই অঙ্কের শেষ কথা। এক্সপার্ট হিসাবে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ইন্টারভিউতে তিনি ডাক পান। মিথুনবাবু এখানে জয়েন করার মাসখানেকের মধ্যে বিনয়বাবু সম্পর্কে এইসব সুখ্যাতি শুনেছেন এবং ঈর্ষায় জ্বলেছেন। আজ ইন্সপেকশনের সুযোগে তিনি তাঁকে বুঝিয়ে দিতে চান, বিনয়বাবু তাঁর যোগ্যতার অধিক মর্যাদা ভোগ করে আসছেন এতদিন। গ্রামেগঞ্জে এমনটাই হয়। কথায় আছে গ্রামদেশে শেয়াল রাজা। তবে বিনয়বাবুর যে চেহারা তিনি কল্পনায় এঁকেছিলেন তার সঙ্গে বাস্তবের মানুষটির কোনো মিল খুঁজে পেলেন না। মনে হল লোকটি সার্থকনামা। মাঝারি উচ্চতার পঞ্চাশ-পেরনো ছিপছিপে চেহারা, পরনে সুতির সাদা হাফহাতা জামার সঙ্গে কালো প্যান্ট, ইন করা। ঘড়ি-আংটির কোনো বালাই নেই। ছোটো করে ছাঁটা গোঁফদাড়ি ; কোঁচকানো একমাথা কাঁচাপাকা চুল। পায়ে চামড়ার সাধারণ স্যান্ডেল।
অঙ্ক কষা শেষ করে বিনয়বাবু বিনয়ের সঙ্গে করজোড়ে বললেন— নমস্কার, আসুন আসুন। কিছু মনে করবেন না।
মিথুনবাবু ক্লাসরুমে পদার্পণ করলেন। ছাত্রছাত্রীরা যথারীতি দাঁড়িয়ে সম্মান জানাল। মিথুনবাবু সবাইকে বসতে বললেন।
— আমি স্কুল ইন্সপেক্টর মিথুন মল্লিক।
—স্যার আপনি বসুন। আমি আসলে অঙ্কটার একেবারে শেষ পর্যায়ে ছিলাম। দুঃখিত।
—না, না, ঠিক আছে। এটা ক্লাস নাইন তাই তো ?
—হ্যাঁ স্যার।
—আপনি অঙ্কটা এই নিয়মে করাচ্ছেন কেন ? এর থেকেও একটা সহজ নিয়ম আছে। আপনি বরং আপনার চেয়ারে বসুন। আর দেখুন।
মিথুন মল্লিক টেবিল থেকে চক ডাস্টার তুলে নেন। বিনয়বাবুর কষা অঙ্ক মুছে তিনি পুনরায় খসখস শব্দে ভিন্ন নিয়মে অঙ্কটি কষতে থাকেন।
বিনয়বাবু নিতান্ত বাধ্যের মতো একপাশে সরে গিয়ে মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে থাকেন। প্রথম সারির ছেলেমেয়েরা বুঝে নেয় এই উটকো লোকটি আসলে তাদের পরম শ্রদ্ধেয় বি এম স্যারকে হেনস্থা করতে চাইছেন। হতেই পারেন ইন্সপেক্টর, তা বলে ক্লাসে ঢুকে এসব তিনি কী শুরু করলেন। ছেলেমেয়েরা মনঃক্ষুণ্ণ হয়। স্যারের দিকে তাকিয়ে তাদের খারাপ লাগে।
অঙ্ক শেষ করে মল্লিকবাবু বিজয়ীর হাসি হেসে বলেন— আরে, আপনি এইভাবে দাঁড়িয়ে আছেন কেন ? দেখুন এতে সংকোচের কিছু নেই। সকলের সব নিয়ম জানা থাকার কথা নয়। তবে কী বলুন তো সহজবোধ্য নিয়মটাই বেছে নেওয়া উচিত। তাতে স্টুডেন্টদের সুবিধা হয়। আসলে বয়সের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের চর্চার মানসিকতাও নষ্ট হয়ে যায়। বাই দ্য ওয়ে, আমি আসি কেমন।
—স্যার, আপনি দয়া করে একটু বসুন। বিনয়বাবু মুখ খোলেন।
মল্লিকবাবু প্রসন্ন মনে বিজিতের মুখে প্রশংসা শোনার জন্য উৎকর্ণ হলেন। বাইরে অবশ্য সে ভাব যতটা সম্ভব গোপন রাখলেন।
—ঠিক আছে বসছি। তবে যা বলার একটু সংক্ষেপে বলুন। ডি আই-এর সঙ্গে আজকে একটু বসতে হবে।
—বলছি স্যার, এই অঙ্কটা আর কোন কোন নিয়মে করা যায় একটু যদি বলতেন।
মল্লিকবাবু ঠিক ধরতে পারেন না, বিনয়বাবু প্রশংসার বদলে এ আবার কী ভণিতা শুরু করলেন।
—না, না, এই দুটোই তো নিয়ম। আমার কথাটাকেই আপনি অথেনটিক ধরতে পারেন। আপনি বোধহয় জানেন না, আমি ম্যাথামেটিক্সে এমএসসি।
বিনয়বাবু বিনয়ের সঙ্গে বলতে শুরু করেন —স্যার আমাকে মিনিট দশেক সময় দিতে হবে। এই অঙ্কটি পাঁচটি পদ্ধতিতে কষা যায়। আরও তিনটি পদ্ধতিতে আমি কষে দেখাব আপনাকে। পাঁচটি পদ্ধতির মধ্যে সহজতম পদ্ধতিটিই আমি স্টুডেন্টদের শিখিয়েছি।
ছবিঋণ- ইন্টারনেট । ---------------------------
চন্দন মিত্র
ভগবানপুর (হরিণডাঙা),
ডায়মন্ড হারবার, দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা
সূচক— ৭৪৩৩৩১