Click the image to explore all Offers

গল্প ।। রেহান ।। অনিন্দ্য পাল

 

রেহান

অনিন্দ্য পাল 


এক. 
 
রমেন বাড়ির সদর দরজা খুলে বেরিয়ে এলেন। ফেব্রুয়ারির সকাল সাতটা, অথচ কুয়াশায় এক মিটার দূরবর্তী জিনিসও দেখা যাচ্ছে না। বহুদিন এত সকালে বাজারে যান নি। যাওয়ার দরকার পড়েনি। বাড়ির দরজায় মাছ, সবজি এমনকি পাউরুটি, বিস্কুট ও পৌঁছে যায়। আর পাড়ার মুদিখানা তো আছেই। কতটা খাদ্য-খাবার আর খাওয়া যায় দুজনে! যদিও ডায়াবেটিস, থাইরয়েড বা ব্লাডপ্রেসার জনিত সমস্যা এখনও  রুমেলা বা রমেনকে মুঠোবন্দী করেনি। 
          বাজারের ব্যাগ দুটোর দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন রমেন। তারপর কুয়াশা ছিঁড়ে এগিয়ে চললেন। মনের মধ্যে এতটুকু ইচ্ছা অনুভব করছেন না রমেন। শরীরটাকে কোনমতে রাজী করিয়ে হাঁটতে থাকলেন। সাবধানে পা ফেলছিলেন রমেন। রাস্তাটা নষ্ট হয়ে গেছে। এখানে সেখানে খোয়া উঠে, গর্ত হয়ে গেছে, অসাবধানতায় পা পড়লে দুর্ঘটনা ঘটতেই পারে। রেহানের ঘটেছিল। সতেরো বছরের ছেলেটা... ভাবতে ভাবতেই কিছুতে একটা হোঁচট খেয়ে সামনে ঝুঁকে পড়তে যাচ্ছিলেন রমেন। এদিক ওদিক করে কোনমতে নিজেকে সামলে নিলেন। সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে দেখলেন, একটা বেশ বড়সড় পাথরে হোঁচট খেয়েছেন। 'কবে যে রাস্তাটা ঠিক করবে?' মনে মনে এই কথাগুলো বলে আবার এগোতে লাগলেন রমেন। কুয়াশা আরো ঘন হচ্ছে সামনে। রাস্তার দুপাশে চাষের জমি গুলো দেখে মনে হচ্ছে বিশালাকায় কুয়াশার পুকুর। সূর্যটা একটা অসহায় ম্লান গোলকের মত ভেসে আছে পূর্ব দিকে। হঠাৎ রমেনের মনে হল, ফোনটা নিয়ে আসলে ভালো হত। একটা ছবি তোলা যেত। অনেকদিন ফেসবুকে কিছু পোস্ট করা হয়নি। 
একটা ক্রিং ক্রিং শব্দ এগিয়ে আসছে সামনে থেকে তার দিকে। রাস্তার ধার বরাবর দাঁড়িয়ে গেলেন রমেন।  কাছে আসতে দেখলেন স্বপন। কাগজ দেয় ছেলেটা। কলেজে পড়ে। একবার ভাবলেন কাগজটা নিয়ে নেবেন। কিন্তু কিছু বললেন না। স্বপন তাকে পেরিয়ে চলে গেল। এই গ্রামে কাগজ দিয়ে ও আবার যাবে অন্য গ্রামে। পরপর চার পাঁচটা গ্রামে কাগজ দিয়ে তবে বাড়ি ফিরবে। তারপর কলেজে যাবে।শিয়ালদহের কাছে একটা সরকারি কলেজে অর্থনীতি পড়ে। রমেন ও পড়তেন কলকাতার কলেজে। রুমেলার এক ক্লাস নীচে। রুমেলা শহরের মেয়ে। খোদ কলকাতায় সাতপুরুষের বাস। কি করে যে রমেনকে মনে ধরেছিল, আজও সেটা রমেনের নিজের কাছেই রহস্য বলে মনে হয়! বিয়ের আগে রমেনদের বাড়িতে এসে একটাই অভিযোগ ছিল রুমেলার। 'এতটা রাস্তা হেঁটে আসতে হবে? একটা ভ্যান ও যদি আসতো! ' না, তখন ভ্যান, রিকশা কিছুই আসতো না এই জাফরপুর গ্রামে। সবচেয়ে কাছের চম্পাহাটি স্টেশন থেকে প্রায় আড়াই কিলোমিটার ভিতরে এই গ্রামে আসার রাস্তাটা ছিল মাটির, দুপাশে ফাঁকা মাঠ। কোথাও ঘন বসতি আবার কোথাও এক-দু ঘর মানুষ খুঁজে পাওয়াও ছিল বেশ মুশকিল। রমেনের এখনও মাঝে মাঝে মনে হয়, এই গ্রামে যদি একটা নদী থাকতো, খুব ভালো হতো বোধহয়। কিন্তু ঠিক কেন যে ভালো হতো সেটা কখনো  বুঝতে পারে না সে। হয়ত এখানকার গ্রাম্য প্রকৃতির আপাত রুক্ষতা এর জন্য দায়ী। রুক্ষই বটে। জলের অভাবে অনেক সময়ই চাষের জমিগুলো চৌচির হয়ে শুয়ে থাকে, যেন আকাশের দিকে তাকিয়ে প্রার্থনা করে, একটু জল চায় মহাশূন্যের কাছে। জল চায়, যাতে আবার এই শুকনো, নগ্ন, দগ্ধ দেহটাকে সবুজ দিয়ে ঢেকে নিতে পারে। অথচ এখান থেকে সুন্দরবন খুব বেশী দূরে নয়। ছোটবেলায় মা বলতো, 'এই পাণ্ডববর্জিত দেশে কেন যে এলাম?' তখন বুঝতে পারে নি রমেন, এখন বোঝে। এই গ্রাম যে রমেনের খুব প্রিয় তাও নয়, তবে আজন্ম এখানে থাকতে থাকতে এখানকার হাওয়ার গন্ধ, সবুজের রূপ আর ফাঁকা মাঠের ঐশ্বর্য তাকে সৎ-ভাইয়ের মত গলা জড়িয়ে ভালোবাসা দিয়েছে। আজও দেয়। 
          আবার একটা শব্দ। এবার মোটরের। একটা মোটরবাইক বেশ জোরেই রমেনের অনেকটা কাছ দিয়ে চলে গেল। হেডলাইটের আলোটা দেখে সরেই দাঁড়িয়েছিল, কিন্তু বাইক চালক বোধহয় তাকে দেখতে পায়নি। একটা টর্চ আনলে ভালো হত। মনে মনে হেসে ফেলে রমেন। দিনের বেলা টর্চ জ্বেলে হেঁটে গেলে কেমন লাগবে ব্যাপারটা! তবে এই মজার ভাবনাটা তাকে একটু স্বস্তি দিল। বাড়ি থেকে বেরোনোর সময় রুমেলার সঙ্গে খিটিমিটিটা না করলেই হত। ও কি করে জানবে আজ পুরুষোত্তম আসছে! এই ফোন, এস এম এসের যুগে চিঠি মারফত যদি কেউ নিজের আসার দিনক্ষণ জানায়, আর সেই চিঠি যদি ঠিক নির্ধারিত দিনের আগের দিন বিকেলে হাতে এসে পৌঁছায়, তবে নিশ্চয়ই প্রাপককে দোষ দেওয়া যায় না। কিন্তু রমেনের তখন এত কিছু ভাবার সময় ছিল না। সাতসকালে বাজারে যেতে হবে, এটা যতটা না রাগিয়েছে তার চেয়ে বেশি রাগ হয়েছে, পুরুষোত্তমের জন্য ভাল দেখে মাছ আনতে হবে, সেটা ভেবে। পা চালালেন রমেন। একটু দূর থেকে কোলাহল কানে আসছে। মাছের আড়তটা ঘুরে সবজি কিনতে যাবেন, এমনটাই ভেবে এসেছেন। 
 
দুই. 
ফোড়নটা একটু পুড়ে উঠতেই ডালটা ঢেলে দিলেন রুমেলা। তারপর কাঁটা দিয়ে ভালো করে নাড়লেন। সাঁতলানোর একটা সুন্দর গন্ধে ভরে উঠলো রান্নাঘরটা। অন্যদিন হলে রমেন এতক্ষণ এসে বলতেন, ' ওহ্, মাতিয়ে দিয়েছ একেবারে! ডালটা তুমি অসাধারণ রাঁধো - বুঝলে। এই রকম ডাল আর একটু আলুভাজা, ব্যাস! আর কিছু না হলেও এক থালা ভাত আমি অনায়াসে খেয়ে নিতে পারি। ' মনে মনে হাসেন রুমেলা। রমেনের এক থালা ভাত মানে দু-হাতার বেশি নয়। কিন্তু আজ রমেন এলেন না। সেই যে সকালে বাজার করে এসেছেন, তারপর থেকে আর সাড়া-শব্দ নেই। চুপচাপ দোতলার ঘরে বসে আছেন। মাঝখানে একবার রুমেলা চা দিয়ে এসেছেন। কিন্তু কোন কথা হয় নি। আজকাল এই রকমের হাইপার টেনশন রমেনকে ভোগায়, রুমেলা জানেন। বুঝিয়েছেন অনেকবার। পুরুষোত্তম আসছে, এতে এত মুষড়ে পড়ার কী আছে? এত টেনশনেরই বা কী আছে? দেখাই যাক না তার বক্তব্যটা কী? কিন্তু নাহ্! রমেন স্বাভাবিক হতে পারেন নি। রেহান কে নিয়ে দুশ্চিন্তা যে রমেনের অভ্যাসে পরিণত হয়েছে, সেটা রমেনকে যারা চেনেন, সবাই জানেন। কিন্তু রুমেলার এই বাতিক আসে না। গত সপ্তাহেই রেহানকে দেখতে গেছিলেন। ভালোই আছে। 
'ভোর হল, দোর খোল' -- ডোরবেলের আওয়াজে চমকে উঠলেন রুমেলা। এসে পড়লো কি তবে? বিকেলে আসবে, এমনটাই ভেবেছিলেন রুমেলা। সেই সঙ্গে একটা সুপ্ত বিপরীত চিন্তাও করেন নি তা নয়। না ও তো আসতে পারে! এরকম একটা ক্ষীণ সম্ভাবনা দু-একবার উঁকি দিয়েছে, যদিও বুদ্ধির জোরালো সমর্থন ছিল না সেই ভাবনার স্বপক্ষে। 
গ্যাসটা অফ করে কিচেন থেকে বেরিয়ে দরজা খুললেন রুমেলা। কিন্তু সামনের মানুষটাকে কি চেনেন  তিনি? দৃশ্যের এরকম অভিঘাত রুমেলা এর আগে একবারই পেয়েছেন, বারো বছর আগে। 
        একজন অতি রুগ্ন মানুষ, যাকে দেখে কখনোই মনে হয় না পঞ্চান্ন বছর বয়স, মনে হচ্ছে যেন বয়স আশি পেরিয়েছে! শরীরটা একটু ঝুঁকে পড়েছে সামনের দিকে। মাথায় চুল নেই বললেই চলে, যে কটা আছে সব সাদা। সবচেয়ে ধাক্কা খেলেন রুমেলা, মানুষটার মুখের দিকে তাকিয়ে। এতটা ভাঙা মুখ কি ছিল কখনো পুরুষোত্তমের? এতটা জেগে ওঠা হনু আর কোটরের মধ্যে ঢুকে যাওয়া চোখ কী করে হল পুরুষোত্তমের? কয়েক মুহুর্ত স্তব্ধ হয়ে থেকে রুমেলার মুখ থেকে একটাই শব্দ বেরিয়ে এল, ' পুরু! ' 
           সামনের মানুষটার চোখের দিকে কিছুটা সময় তাকিয়ে থাকার পর পুরুষোত্তমের ঠোঁটে এক টুকরো হাসি ফুটে উঠলো। সেই হাসির মধ্যে কোন বিষণ্ণতা ছিল না। একটা খুশীর আমেজ পরিপূর্ণ ছিল। 
       রুমেলার চোখ থেকে চোখ নামিয়ে সাইড ব্যাগটা কাঁধের উপর একটু ঠিক করে নিলেন পুরুষোত্তম। তারপর বললেন, 
-- চলে এলাম! বিরক্ত হলি বল? 
-- হ্যাঁ, হলাম! রমেনের গলায় চমকে উঠলো রুমেলা। 
রমেন যে কখন রুমেলার পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে সেটা কেউ খেয়াল করে নি। 
-- ওকে ভিতরে আসতে বলবে তো! নাকি ... 
-- আরে, আয় আয়! রুমেলা একটু লজ্জিত আর ব্যস্ত হয়ে উঠলেন। 

তিন: 
অন্য দিন এই সময় রমেন একটু পড়েন। রবীন্দ্রনাথ, কখনো মানিক, কখনো বা নতুন কোন লেখকের উপন্যাস। স্বপনকে দিয়ে আনিয়ে নেন। কয়েক দিন আগে স্বপন নলিনী বেরার একটা সদ্য পুরস্কৃত উপন্যাস এনে দিয়েছে, সেটাই পড়বার চেষ্টা করছেন। কিন্তু কিছুতেই মনঃসংযোগ করতে পারছেন না। স্মৃতি  যে এত যন্ত্রণার হতে পারে, সেটা এর আগে কখনো উপলব্ধি করেন নি রমেন। 
সদ্য উচ্চ-মাধ্যমিক পরীক্ষায় পঁচাত্তর শতাংশ নম্বর নিয়ে পাশ করেছিল রেহান। বায়না ধরলো বাইকের। তার সব বন্ধুদের আছে, তারও চাই। রুমেলা একেবারেই রাজি হননি, কিন্তু রমেন ছেলের বায়না বরাবর যেমন মিটিয়েছেন, এক্ষেত্রেও তাই করলেন। ছেলের ইচ্ছা পূরণ করার মধ্যে একটা শ্লাঘা অনুভব করতেন রমেন। আত্মীয় স্বজনের চোখে নিজের একটা অপরাজেয় ছবি দেখতে চাইতেন, ধনী হিসেবে খানিকটা সমীহ চাইতেন তাদের কাছে। 
           সেদিনও সকাল থেকে কুয়াশা মুড়ে ফেলেছিল  চারদিক। রাস্তাঘাট ঝাপসা। রেহানের টিউশন ছিল, তারপর কলেজ। বাইক নিয়ে একেবারে বেরোত ছেলেটা। সেদিনও বেরোল, একরকম জোর করেই। রুমেলা অনেক বার করে নিষেধ করেছিল। রমেন করেননি। ছেলে ডাকাবুকো, এটা তার অহংকার ছিল। 
রেহান উচ্চ গতিতে বাইক ছোটায়, এই নালিশ অনেকের কাছ থেকেই শুনেছিলেন। শুনে মৃদু হেসে চলে আসতেন। মনের মধ্যে একটা সুখের বাষ্প ঘনিয়ে উঠতো। একবার রেহানের পিঠে আলতো চাপড় মেরে বলেছিলেন-- " এত জোরে বাইক চালাস কেন? লোকজন ভয় পায়! " তারপর বাবা ছেলে দুজনেই হেসে উঠেছিলেন। 
          কিন্তু সেদিন হাসতে পারেন নি। খবরটা স্বপনই এনেছিল। কুয়াশা ঢাকা খোয়া ওঠা রাস্তায় বাইকের চাকা পিছলে রেহানের শরীরটা দুমড়ে মুচড়ে তালগোল পাকিয়ে গেছিল। হাসপাতালে তিন দিন লড়েছিল  ছেলেটা। কিন্তু ছেঁড়া অন্ত্র, নষ্ট হয়ে যাওয়া কিডনির সঙ্গে লড়াই চলে না। চলে যাওয়ার আগে একবার চেয়ে দেখেছিল, কাউকে চিনতে পারেনি বোধহয়। 
  -- কিছু কথা আছে, চল তিন জন একটু ছাদে বসি। চমকে উঠলেন রমেন। পুরুষোত্তম! কখন এসে দাঁড়িয়েছেন, লক্ষ্য করেন নি রমেন। 
রুমেলা ছাদে পায়চারি করছিলেন। পুরুষোত্তমের কন্ঠস্বরে সচকিত হয়ে শাড়িখানা ঠিকঠাক করে নিলেন। রমেন একটা মাদুর বগলদাবা করে এনেছেন।  পুরুষোত্তমের কাঁধে সেই সাইড ব্যাগ। অবাক হলেন রুমেলা। ছাদে সাইড ব্যাগটা কি কাজে লাগবে বুঝতে পারলেন না। 
কোলকুঁজো হয়ে বসেছেন পুরুষোত্তম। একটু দূরত্ব বজায় রেখে বসেছেন রুমেলা। রমেন রেলিংএ হেলান দিয়ে এক দৃষ্টে পুরুষোত্তমের দিকে তাকিয়ে আছেন। পুরুষোত্তম শুরু করলেন, 
-- রুম, রান্নাটা তুই এখনও ভালোই করিস। অনেকদিন  পর ভেটকি মাছের পাতুরি খেলাম। অতুলনীয়। তোর মনে আছে মা তোকে একবার চচ্চড়ি স্পেশালিষ্ট বলেছিল বলে পরদিন তুই ভেটকির পাতুরি করে এনেছিলি। আমাদের সবার ভালো লাগলেও মা বলেছিল, নুন বেশী হয়েছে! 
পুরুষোত্তম একটু হাসলেন। রমেনের মনে হল পুরুষোত্তম জোর করে নিজেকে হাসাবার চেষ্টা করছেন। একটু তির্যক স্বরে বললেন, 
-- কেন, আফসোস হচ্ছে? তোমার রাঁধনি চলে এসেছে তাই! আজ তাই ফয়সালা করতে এসেছ নাকি? 
      রুমেলার চোখে চোখ রেখেই কথাগুলো বললেন রমেন। রুমেলা বোধহয় একটু অন্যমনস্ক ছিলেন। রমেনের পুরুষোত্তমকে বেঁধাটা ঠিক খেয়াল করলেন না। 
পুরুষোত্তম মাথাটা নীচু করে চুপ করে ছিলেন। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, 
-- রমেন, একটা রাত যে আমার জীবনটাকে এভাবে ওলটপালট করে দেবে, সেটা একেবারেই ভাবতে পারিনি। রেহান চলে যাবার পর, তুমি যখন প্রায় অর্ধ- উন্মাদ, তখন রুম এর সামনে আর কোন পথ খোলা ছিল কিনা আমার জানা নেই। ও যখন বললো, সাইকোলজিস্টরা বলেছে একমাত্র সন্তান মারা যাবার আঘাতে তুমি প্রায় পাগল হয়ে গেছ, তোমাকে আবার স্বাভাবিক করা সময় সাপেক্ষ, যদিও কেউ নিশ্চিত বলেনি তুমি সুস্থ হবেই, সেই ভয়ঙ্কর সময়ে রুম যেটা ভালো মনে করেছে সেটাই করেছে। আর এটুকু একেবারে সত্যি যে, রুম যা করেছে, সবটুকুই তোমাকে বাঁচানোর জন্য। 
রুমেলা কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলেন, পুরুষোত্তম থামালেন। 
-- আমি একটু বলে নিই। তোমরা নিশ্চয়ই ভাবছো, আমি এলাম কেন? সত্যিই আমার আসার কথা ছিলো না। কিন্তু এলাম। এলাম কারণ... 
মাথাটা আবার নীচু করে কয়েক মুহুর্ত চুপ করে থাকলেন। তারপর আবার শুরু করলেন, 
-- রমেন, তুমি নিশ্চয়ই মহাভারত পড়েছ। বেদব্যাস সন্তানহীন কৌরব বংশকে সন্তান দিয়েছিলেন। সেই প্রথা তখন প্রচলিত ছিল। আমরা নিয়োগ প্রথা হিসেবে জানি। সম্ভোগ নয়, শুধু মাত্র সন্তান উৎপাদনের জন্য এই প্রথা অবলম্বন করা হত। নারীতে উপগত না হয়ে শুধুমাত্র বীজ বপন করাই ছিল এর উদ্দেশ্য। বংশ রক্ষাই ছিল এর মূল উদ্দেশ্য। 
আবার একটু চুপ করে গেলেন পুরুষোত্তম। তারপর হঠাৎ এক ঝটকায় মাদুর থেকে উঠে রমেনের হাতদুটো চেপে ধরে বললেন, 
কিন্তু আমি পারি নি! ব্যর্থ প্রেম সেদিন প্রতিশোধ নিতে চেয়েছিল। আমি সমস্ত শরীর দিয়ে পারিনি ঠিকই, কিন্তু সমস্ত মন দিয়ে ভোগ করেছি রুম কে। কিন্তু বিশ্বাস করো, সেই মুহুর্ত টুকুই, তারপর থেকে আজও আমি ক্ষমা করতে পারিনি নিজেকে। রোজ রোজ তিল তিল করে তোমার জিয়নকাঠি রুমের গর্ভে যত বেড়ে উঠেছে, তত আমি ধ্বংস হয়ে গেছি নিজের ভিতরে। তারপর যখন রুম মা হল আবার, এই সন্তানের নাম রাখলো তোমাদের হারিয়ে যাওয়া ছেলের নামেই, তখন আমি নিজেকে শেষ করে দিতেও গেছি। পারিনি। পারিনি শুধু অপরাধ স্বীকার করতে না পারার যন্ত্রণা নিয়ে মরতে পারবো না বলে। ওই একটা রাতের স্মৃতি আমাকে প্রত্যেক সেকেন্ডে খেয়েছে, খেয়ে চলেছে। আমাকে ঘুমোতে দেয়নি, খেতে দেয়নি, এতটুকু শান্তি দেয়নি এত গুলো বছর। তাই এখানে আসা ছাড়া আর কোন উপায় আমার ছিল না। ভয় ছিল, এই বারোটা বছর ধরে তোমাদের নতুন করে সাজানো জীবন, রেহান, সব কিছু যদি আমার জন্য আবার ... 
একটু থামলেন পুরুষোত্তম। হাঁপ ধরেছে। একটু জল চাইলেন ইশারায়। রুমেলা নীচ থেকে জল এনে দিলেন। 
ছাদের এক কোণে রেলিং ধরে দাঁড়ালেন পুরুষোত্তম। বিকেলের আলো ম্লান হয়ে আসছে। একটু একটু করে ঠান্ডা হচ্ছে বাতাস। একটু পরেই ঝুপ করে সন্ধ্যা নেমে আসবে। রুমেলা শাড়িটা চাদরের মত করে গায়ে জড়িয়ে নিলেন। ঠাকুরের প্রদীপ জ্বালিয়ে দিতে হবে, কিন্তু আজ এখান থেকে যেতে পারবেন কখন, জানেন না। 
রমেন চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিলেন। এবার একটু ফুঁসলে উঠলেন। 
-- এই সমস্ত কথা আজকে বলতে এসেছ কেন? সত্যি কথা বলতে কি, এই মুহূর্তে আমার ইচ্ছা করছে তোমাকে ঘাড় ধরে বাড়ির বাইরে বার করে দিই। শুধু রুমেলার জন্য এখনও চুপ করে আছি। তুমি যে সুযোগ নিয়েছ, সেটা সরাসরি স্বীকার করতে পারছো না? আর তুমি তো বরাবর এইরকম, তাই হয়ত রুমেলা তোমাকে ছেড়ে এসেছিল! 
একটু থেমে, তীক্ষ্ণ বিদ্রূপের সুরে বললেন, 
-- কি অদ্ভুত হাস্যকর ব্যাপার দেখ! আমার বাড়ি এসে, চর্ব্যচোষ্য খেয়ে, আমার বিছানায় শুয়ে আমার স্ত্রীর সঙ্গে শোয়ার গল্প শোনাচ্ছ! এত লজ্জাহীন কি করে হতে পারে কেউ? ভাবতে পারছি না! 
-- তুমি চুপ করবে? সব জেনেও তুমি এগুলো বলতে পারছো? তোমাকে সুস্থ করে তোলার জন্য আর কি রাস্তা খোলা ছিল আমার সামনে? দু'বছর ট্রিটমেন্ট চলার পরও ... যাকগে চুপ কর। 
রুমেলা একটু রেগেই বললেন কথা গুলো। 
সন্ধ্যার বাতাস ভারী হয়ে উঠছে। এবার রুমেলা ভারী গলায় বললেন, 
-- রেহান আমারো সন্তান ছিল। আমার কোল খালি করে চলে গেল, এর দায় তো তোমাকেও নিতে হবে। বাইক তো আমি কিনে দিই নি! কিন্তু তোমাকে কখনো দোষারোপ করিনি আমি। তুমি ভেবেছ কখনো, আমি কি নিয়ে বাঁচতাম? ছেলেটা চলে গেল, তুমি ওরকম হয়ে গেলে! আমিতো সন্তানের জন্য শোক টুকুও করতে পারিনি! তোমাকে বাঁচানো ছাড়া আর একটাই পথ খোলা ছিল আমার সামনে, আত্মহত্যা। কিন্তু সেটুকুও আমি করতে পারি নি, সেই তোমার জন্য। হ্যাঁ, পুরুষোত্তমের সঙ্গে আমার সম্পর্ক ছিল। কিন্তু সেটা বিয়ের আগে। ওর অযোগ্যতা, আমাকে তোমার দিকে ঠেলে দিয়েছে। একটা বাউণ্ডুলে মানুষের জন্য সংসার একটা তালপাতার ছাউনি ছাড়া আর কিছুই নয়, এটা আমি যেদিন বুঝেছি, সেদিন থেকেই ওর বাঁধন কেটে দিয়েছি। আর এসব কথা তো অনেকবার বলেছি তোমাকে। তবু তোমার বিশ্বাস হয় না? কেন? এখনও কি সেই সময় আছে, আমি তোমাকে ছেড়ে আবার ওর কাছে ফিরে যাবো? তুমি কি সেটা মনে করো? আশ্চর্য! 
-- তোমাকে তো দোষারোপ করিনি আমি! কবে কিভাবে পুরুষোত্তমের বীর্যে জন্মানো সন্তানকে রেহানের পোষাকে দেখে রেহান ভাবতে শুরু করেছিলাম, কবে আবার স্বাভাবিক মানুষ হয়ে উঠলাম, এসবের কিছুই আমি জানি না। কিন্তু পুরুষোত্তম আজ নিজেই স্বীকার করতে এসেছে, ও তোমাকে ভোগ করেছে! এটা শুনে কি ভাবে আমি ওকে মেনে নিতে পারি? ও তোমার প্রাক্তন প্রেমিক, একথা তুমিই বলেছ আমাকে! কিন্তু সেটা নিয়ে কখনো মাথা ঘামাইনি আমি। 'নিয়োগ' এর জন্য তুমি ওকেই নির্ভরযোগ্য মনে করেছিলে, তাতেও আমার আপত্তি নেই। আর এমন নয় যে ওর সন্তান বলে আমি  রেহানকে ভালোবাসি না, আমি তো ওকে এখানেই রাখতে চেয়েছিলাম। তুমি রাজি হওনি। হোস্টেলে দেওয়ার সিদ্ধান্তটা সম্পূর্ণ তোমার ছিল। 
        চুপ করে গেলেন রমেন। সন্ধ্যার মোলায়েম আলো-আঁধারি এই আধা-গ্রাম অঞ্চলে অন্য ভালোলাগা তৈরি করে। বসন্ত আসছে, কোকিলের ডাক মাঝে মাঝেই শোনা যাচ্ছে। এই ছাদ থেকে খানিকটা দূরে একটা বিরাট শিরীষ গাছের উপর পাখিদের কলরব বুঝিয়ে দিচ্ছে, রাত আসছে, বাড়ি ফেরার সময় হয়ে এল। আশেপাশের প্রায় সব বাড়িতেই একে একে শাঁখ বেজে উঠছে। কোথাও কোথাও দু-একটা বিদ্যুতের খুঁটিতে আলো জ্বলে উঠলো। 
    অন্ধকার ছাদেও নামছে। আলোর ব্যবস্থা থাকলেও এখন কেউ আলো চাইছেন না। 
রমেন এতক্ষণ অনেক কথাই বলেছেন। কিন্তু যেটা সকাল থেকে তাকে চিন্তায় ফেলেছে, হয়তো রুমেলাকেও, সেই কথাটা বলা হয় নি। সবাই চুপচাপ। পুরুষোত্তম রেলিং এ ঝুঁকে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছেন। 
কয়েক মুহুর্ত পরে পুরুষোত্তম বললেন, 
-- আমি অকৃতদার। কিন্তু আমারো একটা জীবন ছিলো। লেখালেখি, বেড়ানো এসব নিয়েই তো বেশ ছিলাম। এরকম কিছু ঘটবে জীবনে সেটা তো আমিও কখনো ভাবিনি। আসলে জীবনটাকে নিয়ে কিছু করবো সেটাই কখনো ভাবিনি। 
-- এখন ভাবছো বোধহয়। তা হঠাৎ এতদিন পরই বা ভাবছো কেন? 
         রমেন এতক্ষণ চেপে রাখা উদ্বেগটা প্রকাশ করে ফেললেন। রুমেলা লক্ষ্য করলেন, এই আলো-আঁধারি তে রমেনের মুখটা কেমন হিংস্র হয়ে উঠছে। ভিতরে ভিতরে শিউরে উঠলেন তিনি। 
-- হ্যাঁ। সেটা ভাবাই স্বাভাবিক। কেন ভাববো না বলো?   তুমি হলে কি ভাবতে না? সবাই ভাবতো। আর আমার তো কেউ নেই, আমি তো ভাবতেই পারি। 
    একটু চুপ করে থাকলেন পুরুষোত্তম। আর একবার বোতল থেকে জল খেলেন। তারপর আবার বলতে লাগলেন, 
-- এই গত পনেরো বছরে সমস্ত ভারত প্রায় ঘুরে ফেলেছি। অর্থের চিন্তা আমার কোন কালেই ছিল না, যেমন ছিলনা কোন মানসিক স্থিরতা। বাউণ্ডুলে স্বভাব । এই স্বভাবের জন্যই রুম আমাকে ছেড়ে গেলেও আমি আমার স্বভাব ত্যাগ করতে পারিনি। আজও তেমনি আছি। গত ডিসেম্বরে ঠিক করলাম এবার একটু বিদেশে যাব। বিঘে দেড়েক জমি বিক্রি করলাম। পাসপোর্ট, ভিসা সব তৈরি হল। ট্রাভেল এজেন্সিকে টাকা দিতে যাবার ঠিক আগের দিন ... 
থেমে গেলেন পুরুষোত্তম। 
কোথাও একটা কুকুর খুব করুণ সুরে কেঁদে উঠলো। এখনও এই অঞ্চলের মানুষের বিশ্বাস, কুকুর এরকম ভাবে কাঁদলে খুব খারাপ কিছু ঘটতে চলেছে। রুমেলা কেঁপে উঠলেন। রমেনের বিরক্ত মুখ থেকে একটা শব্দ  অজান্তেই বেরিয়ে এল। 
অন্ধকার গাঢ় হয়ে আসছে। কৃষ্ণপক্ষ, আজ একাদশী। চাঁদের ভগ্নাংশ এখনও পৌঁছায়নি আকাশে। এই সময়টা একটু রহস্যময়তা তৈরি করে। সময় যেন সন্ধ্যা পেরিয়ে রাতের দিকে অভিসারে চলেছে। একটা মায়াময় ঔদাসীন্য ছড়িয়ে পড়তে থাকে অবসৃত মানুষগুলোর মনে। কেউ জানে না, আগামী কয়েক মুহুর্ত সময়ে কি ঘটতে চলেছে, কি বা ঘটতে পারে! সবাই নিজের ভাবনায় এতটাই মগ্ন যে, কেউ লক্ষ্য করলো না একটা বেশ বড় আকারের পেঁচা ছাদের ঠিক পাশে নিস্তব্ধ দাঁড়িয়ে থাকা বিদ্যুতের সিমেন্ট-খুঁটির উপর এসে বসলো। গায়ের সাদা রংটা এই অন্ধকারেও পাখিটাকে অস্পষ্ট দৃশ্যমান করেছে। 
পুরুষোত্তম নিস্তব্ধতা ভাঙলেন। 
-- চলেই হয়ত যেতাম। ইজিপ্ট। বহুদিনের ইচ্ছা। কিন্তু একটা মেডিকেল চেকআপ করার দরকার হল। আর সেটাই আমাকে এখানে নিয়ে এল। তোমাদের অনিচ্ছা সত্ত্বেও এসেছি এখানে। কিন্তু কেন? একবারো ভাবলে না তো, যে মানুষটা সমস্ত জীবন বাউণ্ডুলে হয়েই কাটিয়ে দিল, সে ... 
যাইহোক, যেটা তোমাদের মনে হয়েছে, সেটাই হয়ত স্বাভাবিক। 
রমেন, কিছু একটা বলতে গেলেন। কিন্তু অনেকটা সময় কোন কথা না বলায় প্রথমটায় একটু গলাটা আটকে আটকে এল। রুমেলার কাছ থেকে একটা জলের বোতল নিয়ে কয়েক ঢোক খেয়ে নিলেন। কিন্তু ততক্ষণে পুরুষোত্তম আবার বলছেন, 
-- আটকে দিল। বললো যেতে দেওয়া যাবে না। বললো হাতে মাত্র মাস তিনেক সময় আছে। 
রুমেলা একটু উদ্বিগ্ন হয়ে উঠলেন, তীব্র স্বরে বললেন,  
-- মানে? পরিস্কার করে বল! এরকম হেঁয়ালি করছিস কেন? এবার তো একটু বদলাও? 
-- আর বদলাবো না। সে সময়ও আর নেই। 
একটু হেসেই বললেন পুরুষোত্তম। রুমেলার প্রতিক্রিয়া না পাওয়া গেলেও রমেনের এবার ধৈর্যচ্যুতি হল। 
-- আমি নীচে যাচ্ছি। তোমরা স্মৃতি আওড়াও। চাইলে পরবর্তী বেড়ানোর পরিকল্পনাটাও করে ফেলতে পারো, তবে আমাকে বাদ রাখবে। 
সিঁড়ির দিকে যেতে যেতে রাগতস্বরে কথাগুলো বললেন রমেন। 
পুরুষোত্তম আটকালেন। রমেনের হাতটা ধরে বললেন, 
-- না না, তা হয় না। আজকের আলোচনার উপর আমার জীবনের সবচেয়ে কঠিন প্রশ্নের উত্তরটা নির্ভর  করছে। একটু দাঁড়াও রমেন। 
অত্যন্ত বিরক্ত মুখে রমেন ফিরে এসে আবার রেলিং ধরে দাঁড়ালেন। 
পুরুষোত্তম রুমেলার দিকে তাকিয়ে বললেন, 
-- রুম, খুব কষ্ট দিচ্ছি। একটু স্বার্থপর হতেই হল। আসলে ... থেমে গেলেন পুরুষোত্তম, তারপর আবার বললেন, ' আসলে আমার হাতে আর সময় নেই। তিনটে মাস, তার মধ্যেই যা করার করতে হবে।' 
রুমেলাও এবার স্পষ্ট বিরক্তির স্বরে বললেন, ' আরে বাবা সেটা কেন? সেটাই তো বলছিস না! ' 
-- হ্যাঁ, সেটা তো বলতেই হবে। আমাকে বলতেই হবে, আমার হয়ে তো বলার কেউ নেই। আসলে...
একটু থেমে আবার বললেন, 
-- আসলে ওই মেডিক্যাল টেস্ট করতে গিয়ে ধরা পড়লো, ক্যান্সার। লাস্ট স্টেজ। মৃত্যু আমাকে সবচেয়ে বেশি তিনমাস সময় দিতে পারে, তার বেশি নয়। 
  রমেন বুঝতে পারলেন না, পুরুষোত্তমের এই কথাটা তাকে কষ্ট দিল না কেন! একটা দীর্ঘশ্বাসও তৈরি হল না রমেনের গভীরতম অনুভূতিতে। 
           রুমেলার দিকে তাকাতে সাহস হচ্ছে না! কি বলবেন, কি করবেন? তখনি একটা ভাবনা উঁকি দিয়ে গেল, এই কারণে কি আসা! বাকি কয়েকটা মাস নিজের ঔরসজাত সন্তান কে নিয়ে গিয়ে নিজের কাছে রাখার জন্যই কি তবে ... 
-- সেই জন্যই এলাম। আর তো কেউ নেই কোথাও। 
পুরুষোত্তমের গলাটা এবার ভেঙে এল। 
                  রুমেলা একটু এগিয়ে এলেন। একটা ভাঙাচোরা শরীর, একটা বিধ্বস্ত প্রায় ধ্বংসপ্রাপ্ত মানুষ। সমস্ত শরীরে মৃত্যু নিয়ে এতক্ষণ তাদের সঙ্গে কথা বলে চলেছেন, আর তারা কেউ বুঝতেই পারলেন না! প্রায় দৌড়ে গেলেন রুমেলা, ছাদের আলোটা জ্বেলে দিলেন। এলিডির সাদা আলোয় ভরে উঠলো ছাদের সমস্তটা। পুরুষোত্তমের দীর্ঘায়িত ছায়া রমেনের পায়ের কাছে এসে থেমে গেছে। 
-- এই শেষ কটা দিন আমার একমাত্র সম্বল রেহান। এটা এখন তোরাও জানিস রুম! আমার এখন আর কিছুই চাইবার নেই। আর তোরা বা কেউ ইচ্ছা করলেও আমাকে কিছু দিতে পারবি না। 
তাই আমি নিজেই আমার দরকারটা মেটাতে এসেছি।  আমি জানি তোরা আমাকে ফেরাবি না। রেহান। রেহানই এখন আমার একমাত্র সম্বল। আর যত গুলো দিন পৃথিবীতে আছি, ওর জন্যই ...
 থামলেন পুরুষোত্তম। 
          রুমেলা রেলিং এর উপর মাথা রেখে মুখ নীচু করে আছেন। মাঝে মাঝে ফুলে ফুলে উঠছে তার শরীর। সাদা ঝকঝকে আলোয় পুরুষোত্তমের হনু জেগে ওঠা শুকিয়ে ওঠা মুখটা হঠাৎ করেই খুব উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। একটু বড় শ্বাস নিয়ে আবার বলতে লাগলেন, 
  -- কি রে, ভয় পেলি? মৃদু শব্দ করে হেসে উঠলেন, পুরুষোত্তম। 
-- না রে, তোদের ভয়ের কিছু নেই। আমি রেহানকে নিতে আসিনি। এসেছি তোদের বিরক্ত করতে। ভাবলাম, জীবনের এই শেষ কটা মাস যদি তোরা থাকতে দিস! রেহানকে কয়েকটা দিন হোস্টেল থেকে বাড়িতে আনতে পারলে ভালো হত। এই মুহূর্তে এই পৃথিবীতে আমার এইটুকু ছাড়া আর কিছু চাওয়ার নেই। রেহানের উপর কোন অধিকার আমি দাবী করিনি, করবোও না। শুধু বাকি কয়েকটা মাস তোদের গলগ্রহ হয়ে তোদের মধ্যেই থাকতে চাই। 
      একটু তির্যক হাসলেন রমেন। বুকের ভিতরটা কেমন যেন ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। নিজের মৃত্যু পরোয়ানা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে যে  মানুষটা, তার জন্য নয়, রমেন বুঝলেন এ কষ্টটা নিজের জন্যই হচ্ছে। কয়েকটা মাস রুমেলাকে ভাগ করে নিতে হবে, সবচেয়ে ঘৃণা করেন যে মানুষটাকে, তার সঙ্গে! 
            একটা কাগজের বান্ডিল সাইড ব্যাগ থেকে বের করে আনলেন পুরুষোত্তম। রমেনের হাতে দিয়ে বললেন, আমার যাবতীয় স্থাবর অস্থাবর রেহানকে দিয়েছি। এগুলো করতে কতদিন সময় লেগে গেল, না হলে তোমাদেরকে জ্বালাতে আরো ক'টাদিন আগেই আসতে পারতাম।  একটু অদ্ভুত মায়াবী হাসলেন পুরুষোত্তম। 
           হঠাৎ খানিকটা হিমেল বাতাস উত্তর দিক থেকে এসে তিনটে নিস্তব্ধ মানুষকে শীতল করে দিল। তখনি বিদ্যুতের খুঁটিতে বসে থাকা পেঁচাটা তীক্ষ্ণ শব্দ করে অন্ধকারের দিকে উড়ে গেল। শিকার ধরতে না কি অন্য কোন কারণে? কে জানে? 
 
ছবিঋণ- ইন্টারনেট ।
                                                       ----------------------------------------

 
ঠিকানা*
======
অনিন্দ্য পাল 
প্রজত্নে -- বিশ্বনাথ পাল 
গ্রাম -- জাফরপুর 
পোঃ-- চম্পাহাটিি 
পিন - ৭৪৩৩৩০
থানা -- সোনারপুর 
জেলা -- দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা 
পশ্চিমবঙ্গ, ভারত 
Mob: 9163812351
        



  






Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.