হৃদ মাঝারে রাখবো
মিঠুন মুখার্জী
দেবাদৃত সকালবেলা কলেজে যাওয়ার সময় অদিতিকে ফোনে জানায় আজ কলেজ থেকে তারা জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে যাবে। তারা দুজনেই রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের এম.এ দ্বিতীয়বর্ষতে পড়ে। দুজনেরই বিষয় বাংলা। দমদম নাগেরবাজার-এর কাছেই অদিতির বাড়ি। দেবাদৃত বারাসাতের চাঁপাডালির কাছেই থাকে। বাবা প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক। অদিতির বাবা ভৈরবচন্দ্র কলেজের ইংরেজির অধ্যাপক।বেশ সম্ভ্রান্ত পরিবারের মেয়ে সে। কলেজেই তাদের প্রথম সাক্ষাৎ হয়, সেখান থেকেই বন্ধুত্ব ও প্রেম। প্রেমে পড়লে সবাই খারাপ হয় না।প্রেম এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণা ও শক্তি হয়ে ওঠে কখনো কখনো। কিন্তু বঙ্কিমচন্দ্র লিখেছেন 'বাল্য প্রণয়ে অভিসম্পাত আছে।'
দুটি ক্লাস করার পর তারা ব্যাগ পিঠে নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেরিয়ে মেট্রোয় জোড়াসাঁকোর উদ্দেশ্যে যাত্রা করে। গিরিশ পার্ক মেট্রো স্টেশনে নামতে হয় ঠাকুর বাড়ি যেতে। ঠাকুর বাড়ি যখন পৌঁছায়, তখন বেলা একটা বাজে। সূর্য মাথার উপর বিরাজমান। আজ বিশেষ কোন দিন না হওয়ায় ঠাকুরবাড়িতে তেমন ভিড় ছিল না। দেবাদৃত দুটি টিকিট কেটে অদিতিকে নিয়ে মিউজিয়ামে প্রবেশ করে। এই নিয়ে দেবাদৃত দশবার ঠাকুরবাড়ি এসেছে। এখানে এলে তার মন ভালো হয়ে যায়। হিন্দুদের তেত্রিশ কোটি ঠাকুরের চেয়ে প্রাণের ঠাকুর রবি ঠাকুরকে দেবাদৃতের বেশি ভালো লাগে। রবীন্দ্রনাথের সকল সৃষ্টি একজীবনে পড়ার খুব ইচ্ছা জাগে তার। এককথায় বইপাগল সে।
বিকেল চারটের সময় তারা মিউজিয়াম থেকে বেরিয়ে বুকস্টল থেকে দুটি বই কেনে। 'কাদম্বরীর সুইসাইড নোট' (রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়) ও 'ঠাকুরবাড়ির অন্দরকথা'। প্রথম বইটি অদিতি কেনে ও পরেরটা দেবাদৃত। যখন তারা কাদম্বরীর আত্মহত্যা করার কক্ষের সামনে, তখন অদিতির মন ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠে। দেবাদৃত বুঝতে পারে অদিতির এমন মনের অবস্থার কারণ। সে জানে অদিতি কাদম্বরীর আত্মহত্যা মেনে নিতে পারেনি।সে ঠাকুরবাড়ির পুরুষদের এর জন্য দায়ী করে, বিশেষ করে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে। অদিতি রবি ঠাকুরকে পছন্দ করে, কিন্তু দেবাদৃতের মতো অন্ধবিশ্বাস নেই। অদিতি মাঝেমাঝে দেবাদৃতকে বলতো-- 'রবি ঠাকুরকে কোনো দিন অভাবের সাথে লড়াই করতে হয়নি, বাবার জমিদারি ছিল তাই কোনো বাঁধা পাননি; কিন্তু নজরুল সারা জীবন লড়াই করেছেন অভাবের সঙ্গে, তিনিও কম বড় কবি নন।'
সন্ধ্যা ছটায় সেদিন ঠাকুরবাড়ি থেকে বাড়ি ফিরেছিল আদিতি। দেবাদৃত ফিরেছিল সাতটা। এরা একে অপরকে খুব বোঝে। তারা দুজনেই দশের মধ্যে থাকত স্কুল জীবনে। শুধু পড়াশোনা নয়, সব বিষয়েই তারা অত্যন্ত সচেতন। স্পেশাল পেপার রবীন্দ্রসাহিত্য থাকায় অন্য লেখকদের তুলনায় রবি ঠাকুরের সাহিত্য বেশি পড়তে হয় তাদের। তবুও নজরুল যেন অদিতির মনের কোন এক জায়গায় অবস্থান করে। দেবাদৃত অদিতিকে মাঝে মাঝে তাদের সম্পর্কের পরিণতি নিয়ে প্রশ্ন করলে অদিতি হেসে বলত--" ভালোবাসার কখনো পরাজয় হয় না, যদি মনের মিল থাকে। সব ভালোবাসার পরিণতি এক হয় না। বিয়েতেই ভালবাসার সার্থকতা আমি মানি না।" এ প্রসঙ্গে আরো বলতো-- "রবি ঠাকুর সারা জীবনে কত নারীকে ভালোবেসেছেন, এমনকি কাদম্বরী দেবীকে, তাই বলে কি বিবাহ করেছেন? তাই বলে তাঁর ভালোবাসা কি মিথ্যা হয়ে গেছে?" অবশ্য দেবাদৃতের কাছে ভালোবাসা যেভাবে অভিব্যক্ত, অদিতির কাছে ঠিক অন্য। তবু তাদের দুজনের বিশ্বাস ছিল তারা সারা জীবন একসঙ্গে কাটিয়ে দেবে।
পরদিন অদিতি কলেজ যেতে না পারায় দেবাদৃত খুব একাকিত্ব বোধ করে। কলেজের বাংলার অধ্যাপক সুবিনয় মজুমদারের মেয়ে নবনীতা মজুমদারও তাদের সঙ্গে পড়ে। সেও দেবাদৃতকে খুব পছন্দ করে। ওর অদিতির সঙ্গে ঠান্ডা লড়াই চলে সবসময়। পিতার কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ে একটু দিদি দিদি ভাব। যাকে বলে প্রফেসর পিতার একমাত্র মেয়ে ভালোবাসায় ও প্রশ্রয়ে একেবারে মাথায় চড়ে বসেছে। তাছাড়া কলেজে রাজনীতিও করে মাঝে মাঝে। অদিতি না আসায় সুযোগ বুঝে তার মনের মধ্যে লুকিয়ে থাকা ভালোবাসাকে দেবাদৃতের কাছে নিবেদন করে। অদিতি সম্পর্কে এমন কিছু কথা বানিয়ে দেবাদৃতকে বলে যেগুলি সে প্রথমে বিশ্বাস করে না। তবে দীর্ঘক্ষন কারো সম্পর্কে বললে মানুষের মন একসময় একটু হলেও মানতে বাধ্য হয়। দেবাদৃতেরও এমন হয়েছিল।
নবনীতা দেবদৃতকে জানায়, -- " অদিতি তাদের কলেজের উপাচার্যের ছেলে দেবাংশুর সঙ্গে বেশ কিছুদিন প্রেম করছে। তুমি সামান্য একজন প্রাইমারি শিক্ষকের ছেলে, তোমাকে হয়তো ওর আর ভালো লাগছে না।" দেবাদৃত নবনীতার সব কথা শুনেও বিশ্বাস করে না। কিন্তু কয়েকদিন পর কলেজের লাইব্রেরীতে দুজনকে একসাথে দেখে দেবাদৃতের মনেও সন্দেহ হয়। সে লক্ষ করে অদিতি যেন কয়েকদিন ধরে তাকে এড়িয়ে চলছে।
এই ঘটনার পর তিনদিন বিশ্ববিদ্যালয় আসে নি দেবাদৃত। অদিতি ফোন করেও পায় না তাকে। দেবাদৃতের বাড়িতে গিয়ে দেখে প্রচন্ড জ্বরে কাতরাচ্ছে দেবাদৃত। অভিমানে অদিতির সঙ্গে তেমন কথা বলে না। দেবাদৃতর মা অদিতিকে বসতে বললে অদিতি জানায়-- 'দেবা ইউনিভার্সিটি তিন দিন যাচ্ছে না, তাই বাড়ি চলে এলাম খবর নিতে। সামনে পরীক্ষা তো তাই'। দেবাদৃত কথা বলছে না দেখে মনের কষ্টে আর বেশিক্ষণ না দাঁড়িয়ে চলে আসে অদিতি। বাড়ি ফিরে একপ্রকার কান্নায় ভেঙে পড়ে সে। দেবাদৃতের সামনে ভালোবাসার অভিব্যক্তি প্রকাশ না করলেও তার কান্না প্রমাণ দেয় সে তাকে যথেষ্ট ভালোবাসে।
অদিতি তেমন জটিল মনের মানুষ নয়। তাই দেবদৃতের এহেন আচরণ বুঝে উঠতে পারেনি। পরের দিন হঠাৎ অদিতির কাছে একটা ফোন আসে। একজন মেয়ে জানায়-- "দেবাদৃতের থেকে দূরে চলে যা, নতুবা তোর কপালে অসীম দুঃখ আছে।" অদিতির বুঝতে দেরি হয়না এই অবস্থার জন্য কে দায়ী।পরদিন কলেজের উপাচার্যের কাছে গিয়ে নবনীতার নামে রিপোর্ট জানায় সে। উপাচার্য নবনীতাকে ও তার পিতা সুবিনয় মজুমদারকে ডেকে পাঠায়। নবনীতা ভয় পেয়ে সকল সত্যকথা তাদের জানিয়ে দেয়। নবনীতার এরুপ আচরনের জন্য উপাচার্য এক সপ্তাহ তাকে ক্লাস না করার শাস্তি দেন। সমস্ত সত্য বিষয়টি বন্ধুদের মারফত দেবাদৃত জেনে যায়। দেবাংশু অদিতির যে শুধু ভালো বন্ধু আর কিছুই নয়, এটা অদিতির কাছ থেকে জানতে পারে সে। বন্ধুদের সামনে অদিতির কাছে ক্ষমা চায় দেবাদৃত। চোখে জল দেখা যায় অদিতির। সে বলে--" তুমি আমায় অবিশ্বাস করবে আমি কোনোদিন তা ভাবি নি। এই ঠুনকো বিশ্বাসে সারা জীবন আমাকে আগলে রাখবে তুমি?" এরপর অদিতি চলে যেতে চাইলে দেবাদৃত রবি ঠাকুরের একটি বিখ্যাত গানের উক্তি কবিতা আবৃত্তির মতো ব্যক্ত করে অদিতিকে বলে--" আমারো পরানো যাহা চায়, তুমি তাই, তুমি তাই গো। / তোমা ছাড়া আর এ জগতে মোর কেহ নাই, কিছু নাই গো।" হঠাৎ অদিতির পা এই কথাগুলো শুনে আটকে যায়। সমস্ত অভিমান মুহূর্তে ভেঙে যায় তার। দুটি মানুষের অভিমানের অশ্রু আনন্দ অশ্রুতে রূপান্তরিত হয়। তবে জীবনে এরকম ভুল বোঝাবুঝি বারবার তাদের মধ্যে হবে না তা কে বলতে পারে।
------------------------------------
ছবিঋণ- ইন্টারনেট ।
মিঠুন মুখার্জী
C/O-- গোবিন্দ মুখার্জী
গ্ৰাম : নবজীবন পল্লী
পোস্ট+থানা -- গোবরডাঙা
জেলা -- উত্তর ২৪ পরগণা
পিন-- 743252
মোবাইল: 9614555989