ছোটোগল্প ।। টাইম পাস ।। সৌমেন দেবনাথ
টাইম পাস
সৌমেন দেবনাথ
মেহেদীর মুখে রাজ্যের মেঘ। হৃদয়ের গোপন কুঠিরে তার পর্বতসম কষ্ট। আমার রুমে এসে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলতে লাগলো, শান্তি তুমি পালিয়ে যাও। সুখ তুমি হারিয়ে যাও। কিসের প্রচেষ্টা! কিসের প্রত্যাশা! ও কেনো জীবন থেকে চলে গেলো? আজ ইচ্ছা করছে স্মৃতিখণ্ডের কাঁচগুলো আবার জোড়া দিয়ে তোমার মুখ দেখি। ওহ, আমি তোমার জীবনের সুর হতে পারিনি, হয়েছিলাম কিছু শব্দ। হৃদয়ের সবটুকু অনুরাগ দিয়েও পারলাম না তোমার অভিমান ভাঙাতে। তুমি কি হাজার সুখের মাঝে হারিয়ে ফেলেছো আমার দেয়া সুখগুলো, আমার কাছ থেকে চেয়ে নেয়া সুখগুলো? তিলে তিলে গড়ে তোলা বিশ্বাসের প্রাচীর তুমি একটি মুহূর্তে কিভাবে ভাঙলে? অপেক্ষার করাতে রক্তাক্ত হৃদপিণ্ড, তোমার অনুভবের সূক্ষ্মকণাগুলো কি তা বুঝতে পারে না? স্মৃতির জানালা খুলে যখন তোমাকে স্বপ্নালোকে দেখি তখন ভাবি ভালোবাসার প্রদীপ নিভিয়ে দিলে কী এমন কারণে?
মেহেদীর বর্তমান যে অবস্থা তা ব্যাখ্যাতীত। অপ্রাপ্তিতে ওর প্রচণ্ড বিতৃষ্ণা জন্মেছে। রায়হান এলো। প্রচণ্ড দেশ প্রেমিক। দেশ নিয়ে তার চিন্তার শেষ নেই। সব সময় দেশ নিয়ে তার ভাবনা। বললো, অসম দেশটাকে সংগ্রামী চেতনায় ভেঙে সমান করবো। ভয় করলেই ভয়, ভয় না করলে কিসের ভয়! মৃত্যু নামক রঙিন তীর হাতে নামতে হবে অশনি বিনাশে।
আমাদের মাঝে এসে উপস্থিত হলো সব্যসাচী। দুই হাতের চেয়ে তার মুখ চলে বেশী। অকারণেই কথা বলে। কথা বলতে শুরু করলে থামে না। বিষয়ভিত্তিক কথা তার কাছ থেকে আশা করাও অবান্তর। যখন যা মনে আসবে, তাই বলতে শুরু করবে। আজ এসেই বলা শুরু করলো, যেখানে বিশ্বাস আছে, সেখানে সন্দেহ আছে। মানুষকে সন্দেহ করার চেয়ে বিশ্বাস করা বেশী উচিত। ঝগড়া করা ঠিক, ঝড়ের মত মনের ময়লা দূর করে দেয়। বুক হালকা হয়। তবে অনেক ঝগড়া সুন্দর সম্পর্ক বিনষ্টের কারণ।
সচ্যসাচীর কথা শুনে মেহেদী দীর্ঘশ্বাস ফেললো। আমি সব্যসাচীকে থামাতেই অলোক এলো। ফিশারীজে পড়ে। সারাদিন মাছ নিয়ে গল্প বলবে। কেউ কেউ যখন বলে মাছ নিয়ে পড়ার কী আছে, তখন সে রেগে গিয়ে মাছ নিয়ে কেনো পড়তে হবে বলতে শুরু করে। কিন্তু আজ ও মাছ নিয়ে কিছু বললো না, বললো, আজ ক্যাম্পাসে এক স্বর্গীয় নারী দেখেছি। নারী মানে ছাত্রী! যৌবনরঙা দ্বীপ্ত অঙ্গ থেকে ভেসে এলো হৃদয় দগ্ধানো স্ফূলিঙ্গ। চন্দ্রমুখ, দীঘল কেশ, হিরকোজ্জ্বল সলজ্জ প্লাটিনাম হাসি, মায়াবি কণ্ঠ, চোখে চকচক শাণিত ধার! আমি কাঠপাথর হয়ে গিয়েছিলাম, বিছুটি পাতা ছোঁয়ালেও প্রতিক্রিয়া হতো না। মানুষ এত সুন্দর কি করে হয়!
অলোকের কথা শুনে মেহেদী গালে হাত দিয়ে হা করে শুনছিলো। রায়হান অলোককে বললো, তোর রুচি সম্বন্ধে জানা আছে। কাচ-কাঞ্চন তোর কাছে সমান। যা দেখিস, তাতেই তোর ভালো লেগে যায়। যা দেখিস তার চেয়ে বেশী বর্ণনা করিস।
আমি সবাইকে বললাম, আমার পরীক্ষা চলছে। তোমরা গেলে আমি পড়তে পারি।
সবাই গেলেও মেহেদী গেলো না, ও বললো, শরীরের আঘাত দুই দিন পরে সারে কিন্তু হৃদয়ের আঘাত সারে না। বারবার ওর কথা মনে পড়ছে, ওর কণ্ঠ শুনতে ইচ্ছা করছে, ওকে দেখতে ইচ্ছা করছে, ওর হাত ধরে হাটতে ইচ্ছা করছে, ওর সাথে রিক্সা চড়ি না কত দিন হলো! একা আমি বাঁচবো না। আমি ঘুমাই, কিন্তু আর আগের মত স্বপ্ন দেখি না। আশাশূন্য জীবন আমার। যাবো না ওর কাছে। আমি কি কুকুর, তাড়িয়ে দিলে আবার ফিরে যাবো!
মেহেদীর অত্যাচারে আমি অতিষ্ঠ। খুব বিরক্তি প্রকাশ করলাম। মেঝে থেকে সব্যসাচী তা দেখতে পেয়ে বললো, কখনো অধৈর্য হবে না। থাকতে হবে সবার সান্নিধ্যের উষ্ণতায় তৃপ্ত, জীবনের জয়গানে উদ্দীপ্ত। শ্বাপদ সংকুল ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্দ, কণ্টকাকীর্ণ পথ তবেই উত্তরণ সম্ভব।
এদের যন্ত্রণায় আর পারি না। মেহেদীকে কোনো মতে বিদায় করতেই ইয়াসিন এলো। ইয়াসিনের আসা দেখে শাকিলও এলো। ইয়াসিন বিবাহিত। শাকিল তাকে নেড়ে নেড়ে রাখে না আর। বললো, মেয়েদের কান্না হলো জয়ের মূল্যবান কৌশল। খবরদার, বৌয়ের নাকে কান্নার পাত্তা দিবি না। আর নারীর বুদ্ধি শুনবি না, ওদের বুদ্ধি হাটুতে, মগজে না, মগজে গোবর৷ নদী, নারী, শৃঙ্গধারী এ তিনে না বিশ্বাস করি।
আমি ওদের দুইজনকে বের হতে বললে শাকিল গেলেও ইয়াসিন গেলো না, ও বললো, জব না পেয়ে বিবাহ করবেন না। আমার জীবনটা কীটের চেয়েও খারাপ।
বললাম, বৌ যন্ত্রের যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ? আগ ভেবে কাজ করতে পারোনি? যাও এখন।
ও গেলে আমি দরজা বন্ধ করে দিলাম। হলের উত্তর-পুর্ব ব্লকে আমরা বিশজন ছাত্র থাকি। সবার মধ্যে উত্তম সম্পর্ক। আমি আর সব্যসাচী বড়। বাকিরা আমাদের চেয়ে ছোট। পড়াশোনা আর আড্ডা-মজার মধ্য দিয়ে আমাদের দিন চলে যায়। তবে সবাই আমার রুমে বেশী আসে, কারণ জানি না। একটু পরেই সুধা আমাকে ফোন দিলো। ওর ফোন ধরলাম না। কথা শেষ না করতেই কেটে দেয় তাই। আমি ব্যাক দিলাম। এবার আর ও কল রাখার কথা ভাববেও না। যশোরে পড়ে ও। আমার খুব ভালো বান্ধবী। আমার খোঁজ খবর নেয়, কী করি না করি, খেলাম কিনা, এসব। এও কি কম!
জনিকে নিয়ে আমার রুমমেট এলো। দরজা খুলে দিলাম। জনি বললো, মতি ভাই, ধ্রুব এর মধ্যে আমি অমিত সম্ভাবনার ভ্রূণ দেখতে পাচ্ছি। দেখবেন ও একদিন শচীন হবে।
আমি হ্যাঁ-সূচক মাথা ঝাঁকিয়ে বললাম, আমার পরীক্ষা চলছে। বন্ধুর সাথে গল্প করো৷
জনি ক্রিকেট জগৎ নিয়ে তানভীরের সাথে আড্ডায় মাতলো। তথ্যবহুল মানুষ সে। পেপারে শুধু খেলার পাতা পড়ে। আর বন্ধুদের সাথে খেলা নিয়ে তর্ক করে জেতে। আমার রুমমেট আবার বলিউড প্রেমী। বললো, জনি, আগে মাধুরীকে বেশী ভালো লাগতো, তবে এখন ক্যাটরিনা আমার প্রিয়। তবে আলিয়া ভাটকে দেখলে ক্যাটরিনাকে আর দেখি না।
ওদের যন্ত্রণায় আমি প্রিন্সের রুমে গেলাম। ও বললো, মতি ভাই, এত পড়ে কী হবে? বই এত না পড়ে, ঘরের মধ্যে বন্দী না থেকে জগৎটাকে দেখেন। নিভৃতচারী মানুষ কখনো আগে জব পান না।
সব্যসাচী দরজায়। বললো, জীবন কী আর বই পড়ে জানা যায়? জীবন হলো সড়ক, যার শেষ নেই। জীবনের ক্রিজে যে বেশী রান করতে পারবে সেই জীবনের মানে খুঁজে পাবে, জীবনকে তখনই সে উপভোগ করতে পারবে। জীবনে দুঃখের চোখ রাঙানী থাকবে, কষ্টের শাসানী সহ্য করতে হবে, দুর্ভোগের প্রতাপ জীবনের অনুষঙ্গ, ডরলে কি চলে?
প্রিন্স বললো, শোনেন মতি ভাই, ঘেরাটোপে থেকে নিজস্ব স্বাধীনতা নিঃশেষ করবেন না। চোখের স্বপ্ন চোখেই থাকবে যদি না প্রাকটিক্যাল হন। বুকের ভেতর যে ফুলের বাগান, সেই বাগানে ফুল ফোঁটাতে হলে অন্ধ অনুভূতিতে কাজ হবে না। স্বপ্নকে শুধু আপাতত চক্ষে দেখলে হবে না, বাস্তবায়নের চেষ্টা করবেন।
এত জ্ঞান গ্রহণ ভালো লাগলো না। হাটতে হাটতে বাইরের দিকে যেয়ে সুধাকে ফোন দিলাম। সুধার মন খারাপ। বললাম, মন খারাপের কারণ কী?
সুধা বললো, আমার সর্বশেষ বান্ধবীটাও প্রেমে পড়েছে।
বললাম, তা মন খারাপ হবে কেনো?
সুধা বললো, ওরা সব সময় ফোন নিয়ে ব্যস্ত থাকে। ক্লাস ফাঁকি দিয়ে ঘুরে বেড়ায়। বিকাল হলে শপিং মলে যায়, পৌরপার্কে যায়। মনিহারে সিনেমাও দেখে।
আমি বললাম, তা তুই-ও প্রেমের বাজারে নেমে যা। তা তো যাবি না।
সুধা বললো, প্রেমের পথে যাবো না। টাইম পাসের জন্য তুই তো আছিস। ফোন দিলে ফোন ধরবি।
সুধার সাথে কথা বলার পর থেকে ভালো লাগছে। রুমে এলাম। জনি যায়নি। সবাই মিলে ওরা আড্ডা দিচ্ছে। রায়হান বলছে, আমরা ফোয়ারার জলে স্নান করি না, মজা কিংবা শ্যাওলা জলে শরীর ভাসাই। ঠোঁটে আলগা রং নেই, তবুও ঠোঁটে থাকে সদা সাদা হাসি। আমাদের সম্পর্কগুলো হার্দিক, আত্মিক, আন্তরিক। পৌরাণিক নয়, কাল্পনিক নয়, যান্ত্রিক নয়। আমাদের টাকা নেই, হৃদয় আছে। রক্ত দিই, মান দিই না, অধিকার ছাড়ি না। আমাদের লাল সবুজের পতাকা আছে। বায়ান্ন আছে, ঊনসত্তর আছে, একাত্তর আছে। মানচিত্র আছে। প্রাণের মানচিত্র।
রায়হানকে কেউ থামানোর নেই। ও বলেই চলেছে৷ দেখি কতো বলতে পারে। বকুল এসে আমার বেডে বসলো। শান্ত ছেলে। কিছু বলছে না। রায়হান ধমক দিয়ে বললো, বোবা কেন্? কিছু বল্...।
বকুল বললো, জ্ঞানীদের কথা মনোযোগ দিয়ে শুনতে হয়। জ্ঞানীদের কথার মাঝে উচ্চবাক্য করতে নেই। সেই কথা মনের হার্ডডিস্কে সেভ করে রাখতে হয়। প্রয়োজনের সময় কাজে লাগাতে হয়। কেনো চুপ বুঝলি?
রায়হান খুব খুশী হলো। জনি এসে তানভীরের সাথে ছবি দেখতে লাগলো। খুব মিল ওদের মাঝে। রায়হানের কথা শুনে ওরা দুইজন বিরক্তি বোধ করছে। কিন্তু রায়হানের কথা থামছে না। পাশের রুম থেকে শাকিল এলো, সিনেমাতে কিছুক্ষণ চোখ রেখে রায়হানের কাছে এলো, বললো, প্রতিটি পুরুষই নায়ক, কিন্তু প্রতিটি নারীকে নায়িকা বলতে আমার দ্বিমত আছে। পুরুষ রত্ন হয়ে জন্ম গ্রহণ করে, নারীকে রত্ন হতে হয়। উদ্বৃত্তপত্রে পুরুষ যায় সম্পদ পাশে, আর নারী যায় দায় পাশে।
একথা অলোক শুনে ফেলেছে। ও ভীষণ রেগে বললো, নারী হলো মুক্তোর মালা, গলায় রাখতে হয়। নারী হলো রূপের রানী, বিস্ময়ে দেখতে হয়।
মেহেদী এসে দরজায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো, নারীকে বিশ্বাস করলে ঠকতে হয়। নারীর ছলনায় পড়ে চোখের ঘুম হারাম হয়েছে। ক্ষণিকের জন্য জীবনে অতিথি হয়ে এসে জীবনের বারোটা বাজিয়ে ছেড়েছে। সে কেনো এসেছিলো জীবনে, যদি এমন করেই চলে যাবে! চোখের জল দিয়ে মনের এত বেশী দুঃখ প্রকাশ করা যায় কি? কথা দিয়ে হৃদয় নিয়ে পাথর দিয়ে হৃদয় ভেঙে চুরে চলে গেলো নির্বিধায়। একরত্তি একটি মেয়ের কাছ থেকে প্রত্যাখ্যাত হয়ে বুঝেছি কাকে বলে প্রেমের বাজার!
মেহেদীর এমন বুকভাঙা উক্তিতে কেউ একটু আফসোসও প্রকাশ করলো না। বরং কেউ কেউ হেসে নিলো। জনি বললো, কালকের খেলার খবর জানেন? মুশফিক সেঞ্চুরি করেছেন, বাঘ কারে কয়!
তানভীর জনির কথায় কান না দিয়ে রায়হানকে ডেকে বললো, কাল একটা হিন্দী ফিল্ম দেখলাম। যা সুন্দর...
তানভীরের কথা শেষ না হতেই রায়হান বললো, বাংলা ছবি দেখো। বাংলা হলো প্রাণের ভাষা। এই দেশের মাটির সোঁধা গন্ধে প্রাণটা ভরে।
কোথা থেকে লিংকন হাতে কাগজ নিয়ে ছুটে এলো। কবিতা লেখে ও। নতুন কবিতা লিখলেই সবাইকে ডেকে ডেকে পাঠ করে শোনায়। আজো সে কবিতা পাঠ করতে চায়, এত স্রোতা একত্রে সে পায়নি। ও কবিতা পাঠ করতে লাগলো, আশার কুঁড়ি ঝরে গেছে/ মালা দিয়ে কী হবে?/ স্বপ্নের সাথী হয়ে আজো তুমি আছো হৃদয়ের কাছাকাছি/ কেনো অজান্তে মনে দোলা দাও?/ কেনো মনটাকে ছুঁয়ে যাও?/ আজ আছি একা নিঃসঙ্গ বিরহী নক্ষত্রের মত/ সমুদ্রের উত্তাল ঢেউয়ে ভেসে যাচ্ছি/ তোমার কথা মনে পড়লে কিচ্ছু ভালো লাগে না/ তোমার জন্য এত অশ্রুক্ষরণ আর তুমি কিভাবে ভাসো সুখ সাগরে?/ যদি কথা এক সাথে দিই তবে কেনো একা আমি পথ চেয়ে রই?/ দয়া করে ফিরে এসো চিন্তার করিডোরে।
কবিতা পাঠ শেষে লিংকন মুখ তুলে দেখে মেহেদী ছাড়া কেউ নেই। মেহেদী বললো, কবিতাটা আমাকে দে।
লিংকন বললো, তোকে দেবো কেন্? পেপারে দেবো। যা!
লিংকনের পিছন পিছন মেহেদী চলে গেলো। আমি কিছুক্ষণ পড়ার চেষ্টা করে যখন পড়াতে মন বসাতে পারলাম না তখন সুধাকে ফোন দিলাম। স্কুল কলেজের বন্ধুগুলো খুব ক্লোজ হয়। একই অঞ্চলের তো তাই। সুধাকে ফোন দিয়ে বন্ধুদের কথায় বলাবলি করি। কে কোন ভার্সিটি পড়ছি এসব নিয়েও কথা চলে। বললাম, ইউনুছ, মিঠুন দিনরাত পড়েও রেজাল্ট করতে পারছে না।
সুধা বললো, লাকী, জামেনা ওরা তো সব পরের ঘরে চলে গেছে। রুবিনা তো বিয়ে করার জন্য মুখিয়ে আছে। চার বছর ধরে প্রেম করছে। আমার সময় কাটে না। কখনো পড়ি, কখনো একা একা হাটি। এই মতি, তোর ভার্সিটির ভালো দেখে একটা ছেলের সাথে আমার যোগাযোগ করিয়ে দে না! আমি প্রেম করবো। আমার প্রেম করার শখ চেপেছে। বান্ধবীরা প্রেম করে, মজা করে, গিফট পায়!
আমি বললাম, ভালো বন্ধুর সাথে তোর বন্ধুত্ব করিয়ে দিলাম। গণ্ডগোল বা ব্রেকআপ হলে আবার আমায় দোষ দিবি না তো?
সুধা একগাল হেসে বললো, ওরে ভালোবাসার জন্য কি ভালোবাসবো! পাগল নাকি তুই! জাস্ট টাইম পাস!
আমি সুধার কথা শুনে বিস্মিত হলাম। বললাম, তুই কোন হৃদয়ের জানি না। সব পারিস!
সুধা আমাকে বললো, আমার বাবা মা আমার বড় তিন বোনকে নিজ হাতে বিবাহ দিয়েছেন, আমার তিন বোনই অনেক সুখী। আর আমাদের বান্ধবী গোলাপী, বয়ফ্রেন্ডের হাত ধরে বিবাহ করলো। ছেলেটা এখন সময় দেয় না। টর্চারও করে। গোলাপী কল করে আমাকে সব বলে, কান্না করে। বাবা মায়ের কাছেও যেতে পারছে না৷ তাই বলছি, বাবা মা যার হাতে আমাকে তুলে দেবে তাকে ঘিরেই স্বপ্ন দেখবো। এখন অনলি ইনজয়। দিবি কোনো বন্ধুর নাম্বার?
আমি সুধার এহেন আবদার রক্ষা করিনি। হাসানকে কল দিলাম। ও ঢাকার একটা কলেজে পড়ে। আমরা একত্রে ইন্টারমিডিয়েট এ পড়েছি। নারীর এমন চরিত্র হাসানের কাছে বললাম। সুধার নাম বলিনি, কারো নাম ধরে বলাও ঠিক না তাই। হাসান তো আমার কথা বাগানে ফেলে দিলো। সে বলে, নারী যাকে ভালোবাসে মন প্রাণ উজাড় করে ভালোবাসে। ছেলের মন ফিরতে চাইলেও মেয়ের মন ফেরে না।
বুঝলাম অলোকের মতই হাসানও নারীপ্রেমিক। এদের বলে লাভ নেই। হাসান বললো, জানিস তো, আমিও প্রেম করি। কত ভাল মেয়ে ও। ওর জন্যই আমার জীবনটা রঙে রঙে রঙিন হয়ে উঠছে। তোর বান্ধবীকে নাম্বার দে। জড়িয়ে গেলে বুঝবে কারে বলে টাইম পাস!
ক্যাম্পাস থেকে ফিরছি। পথে সজীবের সাথে দেখা। এক সাথে আসছি। ও বললো, মতি ভাই, সব কিছুতেই ভেজাল। কিছু একটা যে কিনে খাবো, ভেজালের ভয়ে তা আর হয়ে উঠে না।
আমি বললাম, সব খাঁটি ভালো না। খাঁটি সোনায় অলংকার হয় না, খাঁটি সত্য কথা বিশ্বাসযোগ্য হয় না, খাঁটি প্রেম অনেক সময় পরিণতি পায় না।
অলোক আমাদের সাথে যোগ দিলো। বললো, বাসস্টান্ডে একটা মেয়ে দেখলাম, বড় আবেদনময়ী। সাগর চোখে খুশীর পরাগ। যৌবনার পোশাকের কি বাহার! আহ্, বুকটা ভরে গেছে।
সজীব অলোকের কথায় সমর্থন করে বললো, তোমার সাথে ঘোরা দরকার। আমরা তো সুন্দর মেয়ে দেখি না। ডাইনিং-এ খেয়ে কেউ গেলো টেলিভিশন রুমে, কেউ গেলো পত্রিকা রুমে, কেউ নিজ রুমে গেলো ঘুমাবে। আমিও রুমে গেলাম। রুমমেট রুমে নেই। ও হয়ত নামাজে গিয়েছে। পরীক্ষাটা আজ তেমন ভালো হয়নি। এদের সাথে শেয়ার করলে বলবে, রেজাল্ট দিয়ে কী হবে? পাশ করলেই যথেষ্ঠ। সুধাকে ফোন দিলাম। ও আমায় সান্ত্বনা দিতে পারে। বললাম, আজ পরীক্ষাটা কেমন দিলাম বুঝতে পারছি না। মনে হয় ভালো হয়নি।
সুধা বললো, সব যদি লিখে এসে থাকিস, ভালো নাম্বার পাবি।
বললাম, সব লিখেছি।
সুধা বললো, তবে নিশ্চিন্তে থাক। পরের পরীক্ষা দেয়ার পর দেখিস মনে হবে আজ যে পরীক্ষা দিয়েছিস এটিই ভালো হয়েছে। আচ্ছা, আমাকে নাম্বার দিচ্ছিস না কেন্? আমাকে কিন্তু এ বিষয়ে এড়িয়ে চলছিস!
আমি মনে মনে ভাবলাম, এখনো ওর টাইম পাস করার খায়েস যায়নি? হাসান যেভাবে বলেছে, জড়িয়ে গেলে তো মসিবত।
সুধা আবার বললো, দিবি না?
আমি পড়ে গেলাম দ্বিধায়। দেবো, না দেবো না এ নিয়ে এবং দিলে কার নাম্বার দেবো এ নিয়ে।
সুধা বললো, বুঝেছি, তুই বন্ধু হওয়ার অযোগ্য। বলেছি তো, প্রেম করবো না, তোর ক্যাস্পাসের গল্প শুনবো, সে কিসে পড়ে, কী হবে জীবনে এসবই শুনবো।
আমি অনেক ভাবলাম, শাকিলের নাম্বার দেবো, না অলোকের নাম্বার দেবো। শাকিল নারী বিদ্বেষী। নারীর পাল্লায় পড়ে শাকিলের কী অবস্থা হয় এটা দেখার লোভ জাগলো। ওর নাম্বারটাই দিলাম। সুধা খুব খুশী হয়ে বললো, কৃপণ?
আমি বললাম, অকারণে তো তোকে কেউ কল দেবে না। প্রথম প্রথম তুই কল দিয়ে মজা ধরিয়ে দিবি।
সুধা এবার বললো, একটা নাম্বারে হবে না। একজনে টাইম পাস হবে না। আর একটা নাম্বার দে।
আমি বললাম, আমি নেই? আমার সাথে টাইম পাস করবি না আর?
সুধা বললো, তোর হিসাব আলাদা। তুই চিরজীবনের বন্ধু। তোর সাথে টাইম পাস করবো না। ভালো বন্ধুদের সাথে কেউ টাইম পাস করে না। দে, আরো একটা নাম্বার দে।
এবার কার নাম্বার দেবো তাই ভাবলাম। ব্যর্থ প্রেমিক মেহেদীর নাম্বারটাই দিলাম। দেখি ওর জীবনে কোনো পরিবর্তন আসে কিনা! সুধা দ্বিতীয় নাম্বার পেয়েও খুশী। বললো, সকাল, বিকাল কাটবে ভালো এবার। তোকে অনেক ধন্যবাদ।
আমি বললাম, খবরদার, ওরা যেন জানতে না পারে আমি তাদের নাম্বার তোকে দিয়েছি। আমার মান-সম্মান সব যাবে।
সুধা আমাকে নিশ্চিন্তে থাকতে বললো। আমি সুধার এই কাণ্ডে রীতিমত বিস্মিত। হাসানকে ফোন দিলাম। বললাম, হ্যাঁরে, তোর প্রেমের কী খবর?
হাসান বললো, বন্ধু, জীবনটা ওর জন্য পূর্ণতা পেয়েছে। ও অনেক ভালোবাসে আমাকে।
আমি বললাম, ভালো। সব মেয়ে তো আর এক না। আমার সে বান্ধবীকে দুটো নাম্বার দিলাম। ওমা! কি খুশী সে!
হাসান বললো, যাদের নাম্বার দিয়েছিস তাদের সাথে যোগাযোগ রাখিস। তোর বান্ধবী তাদের সাথে কথা বলে কিনা, জানাবি। তোর ভার্সিটির মেয়ে এত খারাপ, ছি!
আমি হাসানকে বললাম, কোনো একজনের জন্য গোটা ভার্সিটিকে দোষারোপ করা ঠিক না।
হাসান আমার কথাতে সমর্থন প্রকাশ করে বললো, তা ঠিক।
সুধা আর হাসানের সাথে কথা বলে আমি প্রিন্সের রুমে গেলাম। ওর রুমে আসর বসেছে। লিংকন একটা কাগজ নিয়ে চুপ করে বসে আছে। বারবার কবিতাটা পাঠ করতে যেয়ে বাঁধা পেয়ে পেয়ে চুপ হয়ে গিয়েছে। কেউ কবিতা শুনবে না। লিংকন তাই ক্ষোভে বললো, মাংসের শরীর পঁচে যায়, শব্দের শরীর বেঁচে থাকে চেতনার প্রতিটি কণায়। কাব্য হৃদয়ের নদী হয় নাব্য। কবিদের মূল্যায়ন কি তোরা করতে জানিস?
মেহেদী বললো, তুমি কবিতা পাঠ করো।
লিংকন অন্তত একজনের রাজি হওয়াতে উৎফুল্ল হয়ে কবিতা পাঠ শুরু করলো, প্রেম হলো চোখে চোখ পড়া/ লাজুক কিংবা মুচকি হাসি/ অপেক্ষা, ইতস্তত কথা/ চার চোখের মিলন/ আনন্দের মহাকাব্য কিংবা লক্ষ কোটি অশ্রুকণা/ ইঞ্চি ইঞ্চি বৃষ্টিপাত/ আনলিমিটেড দুঃখমালা/ বৃহদাংশ খাঁটিসোনা/ নকশি কাঁথায় স্বপ্ন আঁকা/ প্রতিশ্রুতির হিমালয়/ বিশ্বাসে পঁচন কিংবা বিশাল স্বার্থ, কাম/ বর্গমাইল অনিঃশেষ অশ্রুপাত/ বেদনার বিষাদ সিন্ধু।
অলোক আর মেহেদী হা করে কবিতা শুনলো। বাকরুদ্ধ তারা দুইজন। শাকিল বললো, নারীকে বাদ দিয়ে কবিতা লিখতে পারিস না?
অলোক বললো, নারীকে নিয়েই কবিতা লিখতে হয়। কবিতা মানেই নারী।
রায়হান বললো, দেশ নিয়ে কিছু লেখো। সার্বিক সমস্যা সমাধানের নিমিত্তে কিছু লেখো, কবি।
সব্যসাচী বললো, খেটে খাওয়া শ্রমজীবী মানুষদের নিয়ে কিছু লিখতে তো পারো। প্রেমের সস্তা কবিতা দিয়ে তো দেশ জাতির কিছু হবে না।
সব্যসাচীর কথাকে মেহেদী মেনে নিতে পারলো না, বললো, প্রেমের কবিতা সস্তা? সবচেয়ে বাস্তব প্রেম। লিংকন, তুমি প্রেমের কবিতায় লিখবে।
অলোকও মেহেদীকে সমর্থন করাতে শাকিল ক্ষেপে গেলো, বললো, যদি প্রেমের কবিতা লেখো, তবে অলোক আর মেহেদীকেই শোনাবে। আমরা কেউ শুনবো না।
অলোক আর মেহেদী ব্যতীত আর সবাই শাকিলকে সমর্থন দিলো।
পরদিন ক্যাম্পাস থেকে আসতেই মেহেদী আমার কাছে এলো। ওকে খুব উৎফুল্ল দেখাচ্ছে। এত উৎফুল্ল ও সাম্প্রতিক সময়ে ছিলো না। ও বললো, মতি ভাই, আপনার বাড়ি না যশোর? যশোর খুব সুন্দর জায়গা। খেজুর গাছ আছে, কপোতাক্ষ নদ আছে। মাইকেল মধুসূদন দত্তের বাড়ি সেখানে। মনিহার সিনেমা হল আছে।
আমি বললাম, হঠাৎ যশোরের এত প্রশংসা কেন্?
মেহেদী বললো, পরে বলবো মতি ভাই।
আমার বুঝতে বাকি থাকলো না, সুধার সাথে কথা হয়েছে। শাকিলের খবর কী জানার জন্য ওর রুমের দিকে গেলাম। শাকিল বললো, মতি ভাই আসেন, বসেন। আপনার সাথে কথা আছে। সবাই আমাকে নারী বিদ্বেষী বলে। আসলে আমি ভেবে দেখলাম, আমি ভুল। নারীর কোমল হৃদয়ের সংস্পর্শে যে কোনো পুরুষ মোমের মত গলতে বাধ্য। নারীত্বে বিলীনে পুরুষের অমিয় সুখ। শুধু কণ্ঠ শুনে যদি মন এত ভালো হয়ে যায়, তবে তার ছোঁয়া পেলে জীবন ধন্য হয়ে উঠবে।
আমার বুঝতে বাদ থাকলো না দুইজনের সাথেই সুধা কথা বলেছে। দুইজনকেই একদিনে কুপোকাত করে ফেলেছে। বাইরে গিয়ে হাসানকে ফোন দিলাম। ও ফোন ধরেই বললো, নিশ্চয় ঐ দুই ছেলের সাথে তোর বান্ধবী কথা বলেনি!
আমি বললাম, তোর ধারণা ভুল। বলেছে। দুইজনকেই সে ধরাশায়ী করে ফেলেছে।
হাসান এতক্ষণে বললো, মেয়েদের চরিত্র বোঝা দায়। রাজা, বাদশারা তাই ওদের প্রলোভনে বলি হয়েছে, আর আমরা তো সাধারণ মানুষ। তোর বান্ধবীর এসব খবর যদি যাদের নাম্বার দিয়েছিস ওরা জানে তোদের সম্পর্কে প্রভাব পড়বে না তো?
আমি ভ্রূ কুঁচকে বললাম, সত্যই ফ্যাঁসাদে পড়েছি। মেয়েদের সাথে কথা না বলাই উচিত। অনভিজ্ঞতার জন্য বিপদে পড়, বেশী বুদ্ধির জন্য ফাঁদে পড়ে আর বলে নারীর ক্ষমতায়ন নেই।
বন্ধু দেখলাম তবুও নারীর পক্ষে, ও বললো, ওরা আছে বলে স্বপ্ন দেখি। বাঁচার মতো বাঁচি। আমার মনে হয় তোর বান্ধবীকে বোঝানো উচিত। শুরুতেই থামানো দরকার।
আমি সুধাকে ফোন দিলাম। সুধা বললো, মেহেদী সাজিয়ে গুছিয়ে কথা বলে। শাকিল নিজেকে খুব বেশী প্রকাশ করে। মেহেদী ফুলে বসা বিমুগ্ধ মৌমাছির মত, একমনা। শাকিল নদীর মত চঞ্চল, হরিণের মত উচ্ছ্বল। তবে দুইজনই মাছের মত, খাদ্য পেলে মৃত্যুফাঁদও মাড়াতে ভুল করবে না।
সুধার বিশ্লেষণ ভালো লাগলো। একদিনে মানুষ চিনে নিয়েছে। বলতে হয় মেধা কি!
আমি বললাম, খবরদার, মুখে আমার নাম নিবি না। আমি ভাই গা বাঁচিয়ে চলা মানুষ। ডাল দিয়ে ভাত খাই সোজা পথ দিয়ে হেটে চলে যাই।
সুধা আজও আমাকে নির্ভয় দিলো।
কৌতূহল থেকেই আমি মেহেদীর রুমে গেলাম। সব্যসাচীও পিছন পিছন এলো। বললো, মতি তো ঘর থেকে বেরই হতো না। এখন দেখি এর ওর রুমে ঘুরে বেড়ায়।
আমি বললাম, মুক্তোভরা ঝিনুক পেলে পিষে যাওয়া একটা মানুষ আবার কী করে জীবনের দিশা পায়, তাই দেখার জন্য এলাম।
মেহেদী লাজুক হেসে বললো, মতি ভাই কি যে বলেন! জীবনে মন্দঘন ঘটনা, আনন্দঘন ঘটনা থাকবে। এ নিয়েই জীবন। মানুষ দুঃখে ম্রিয়মাণ, সুখে বিহ্বল হবে এটাই স্বাভাবিক। মাঝে কিছুদিন আমার বিষাদে গেছে, এখন আবার জীবনে সুস্বাদ ফিরেছে।
সব্যসাচী বললো, পিষে যাওয়া থেকে মোড় ঘুরিয়ে ফিরে আসার নামই জীবন। প্রতিটি মানুষের মধ্যেই আছে ঘুরে দাঁড়ানোর শক্তি। রাত্রির অবসানের পর জীবনে আবার ঊষার আলো ফোঁটেই।
শাকিলও যোগ দিলো। শাকিলকে দেখে বললাম, ইদানিং শাকিলকে খুব লাজুক টাইপের দেখা যাচ্ছে। অনুভূতির তলদেশে ঘুরে ঘুরে মনে হয় জীবনের ঋজু পথ খুঁজে পেয়েছে!
শাকিল বিজ্ঞজনের মত করে বললো, যে হাসি ভাবাতে জানে, যে কণ্ঠস্বর তোলপাড় তুলতে জানে; সে হাসি, সে কণ্ঠস্বরের ঠিকানা যদি পাওয়া যায়, জীবনে পরিবর্তন আসেই। মন আকুলি-বিকুলি করে শ্রুতিমধুর কথা শুনে। কথায় কি জাদু, কণ্ঠে কি মধু, হাসিতে কি অমৃত, আহা!
শাকিলকে সমর্থন করে মেহেদী বললো, কখনো ভাবিনি আমার জীবনে আবার সূর্যালোকের রশ্মি পড়বে! জীবন আবার রংধনু রঙে রাঙবে! মরে যাওয়া মনে নতুন করে ঢেউ জাগবে! ভালোবাসায় সৃজন ডালপালায় গোলাপ ফোঁটেরে, গোলাপ ফোঁটে।
রায়হান এসেই বললো, সবাইকে বেশ চনমনে লাগছে। কারণ কী?
আমি বললাম, কার মনে কি যে দোলা দিচ্ছে সেই জানে! মনের গোপন কথা কেউ কি বলে! গোপন কথা বললে কি আর গোপন থাকে!
রায়হান বললো, সবার মনে ভালো লাগা থাকাটাই ভালো। অন্তরের সুজনকে লালন করে, অন্তরের হিংসার লাগাম টানতে পারলেই সুখ সহজলভ্য হবে।
অলোক রায়হানের কথা শুনে বললো, এজন্যই সামাজিক হয়ে মেতে উঠতে হবে নির্দোষ আনন্দে। অশ্রুর সরোবরে ফুঁটবে ভালোবাসার কমল। হিংসা সর্বদা নতজানু প্রেম ভালোবাসার কাছে।
সব্যসাচী বললো, শান্তির জন্য কবুতর উড়িয়ে দিই, শান্তির জন্য নোবেল পুরস্কার দেয়া হয়, শান্তি কিন্তু হয় না। শান্তির জন্য ছাড় দিয়ে অগ্রসর হতে হয়। অহিংসার ধারা যত বইবে হিংসার ধারা তত কমবে। শান্তির বাতাস তত বইবে। পৃথিবীটা কবে হবে প্রেমময়ে ভরা!
অলোক বললো, শান্তিপ্রিয় মানুষের সংখ্যা মুষ্টিমেয় নয়। শান্তিপ্রিয়রা সংযত থাকেন। আজ কোনো তর্কতর্কি নেই। মন ভরে আছে অজানা সুখানুভবে। স্বপ্ন যতই অমূলক হোক, স্বপ্ন দেখতে মানা কেনো? সব সৃষ্টি স্বপ্নের হাত ধরেই।
আমাদের মাঝে লিংকন কবিতা নিয়ে হাজির। এসেই বললো, প্রেম ভালোবাসার কবিতা তো তোমরা কেউ শুনবে না, তাই আজ একটা বিদ্রোহ ভাবাপন্নের কবিতা এনেছি। অনিয়মের শিকড় উপড়ে ফেলার মত জ্বালাময়ী কথা দিয়ে কবিতা লিখেছি।
শাকিল বললো, আমরা আজ প্রেম ভালোবাসার কবিতা শুনবো। প্রেম ভালোবাসায় জীবনের শ্রেষ্ঠ জিনিস। জীবনকে পৌঁছে দেয় জীবনের কাছে।
অলোক শাকিলের দিকে চেয়ে বললো, তুমি একটা গাঁধা, জল খেলে ঘোলা করেই। প্রেমে কেউ দেউলিয়া হয় না। প্রেমে অবিশ্বাস করা পাপ। মানব জীবনের পাতায় পাতায় প্রেম।
মেহেদী বললো, আমরা বিদ্রোহী কবিতা শুনবো না। প্রেমের কবিতায় শুনবো। প্রেম থাকলেই পৃথিবী সুন্দর হবে। বিদ্রোহ কখনোই জাগবে না।
রায়হানও একমত হয়ে বললো, যাও লিংকন, প্রেমের কবিতা নিয়ে এসো।
লিংকন প্রেমের কবিতা আনতে নিজ রুমে গেলে আমি আসর থেকে বের হয়ে পড়লাম। সুধাকে ফোন দিলাম। বললাম, তুই তো মেহেদী আর শাকিলকে পাগল করে ফেলেছিস!
সুধা বললো, ওরা আমাকে গিফট দিয়েছে। ওরা খেজুরের রস খেতে চেয়েছে। আমি ওদের কপোতাক্ষ নদের ঘোলা জল খাওয়ায়ে তবেই ছাড়বো।
সুধার কার্যকলাপ সুবিধাজনক ঠেকছে না। হাসানের সাথে বিষয়টি আবার শেয়ার করলাম। বললাম, আমার ভার্সিটির ঐ দুই ছেলে তো স্বপ্ন দেখা শুরু করেছে।
হাসান বললো, যে যাকে ভালোবাসে সে তাকেই চায়, তাকেই ভাবে। তার জন্য অপেক্ষা করে, তার অপেক্ষায় রোদে পোড়ে, বৃষ্টিতে ভেজে। ভালোবাসার বাঁধন বড় কঠিন বাঁধন।
আমি বললাম, আমার বান্ধবীকে নিয়ে আছি চিন্তায়। ডটকমের যুগ। কবে না ধরা পড়ে যাই!
হাসান বললো, তোর বান্ধবী খুব সেয়ানা। এসব শেয়ানা মেয়ের সাথে তোর বন্ধুত্ব হয় কি করে! তোকেও তবে তো ঠকাচ্ছে, খাটাচ্ছে, নাচাচ্ছে, বুঝতে পারছিস না। দিবি তোর বান্ধবীর নাম্বারটা আমাকে?
আমি বললাম, তুই তো তিন বছর প্রেম করছিস? আমার বান্ধবীর নাম্বার নিবি কেন্?
হাসান বললো, আমি কি প্রেম করবো! কত সেয়ানা মেয়ে একটু দেখতাম। দে, তোর বান্ধবীর নাম্বারটা দে।
হাসানকে এখনি সতর্ক করা দরকার। তাই আর কথা লুকিয়ে রাখা ঠিক হবে না। বললাম, আমার ঐ বান্ধবী আমার ভার্সিটির না। ওর নাম্বার তোর কাছেও আছে। এবং প্রতিদিন সেই নাম্বারে তোর চোখ যায়। আমাদের বান্ধবী সুধা আজ আর সেই সুধা নেই। পুরুষ নাচিয়ে বেড়ায় সে।
সুধার নাম শুনতেই হাসান চুপ হয়ে গেলো। ঐ সুধার প্রেমেই যে গত তিন বছর ও অন্ধ হয়ে আছে।
-----------------------
ছবিঋণ- ইন্টারনেট ।