ধারাবাহিক উপন্যাস ।। পরজীবী ( পর্ব- ৫) ।। অভিষেক ঘোষ
পঞ্চম পরিচ্ছেদ
২০১৫
"দেখো দেখো কে এয়েচেন দেখো, নিতাই বসতে একটা জায়গা দে রে ।" - নবকান্তবাবু কাকে যেন দেখে ব্যস্ত হয়ে বলে উঠলেন ।
বাড়ির পুরোনো ভৃত্য, পঞ্চাশোর্ধ্ব নিতাই কোমর থেকে নেমে আসা ধুতিটা একটু টেনে ভুঁড়ির উপর তুলে নেয় । তারপর হাস্যকর ভঙ্গিতে একটু কাত হয়ে আড়মোড়া ভাঙে । যেন তার কোনো তাড়া নেই । তারপর একটা বেতের শক্তপোক্ত চেয়ার এনে নবকান্তবাবুর সামনে রাখে । নবকান্তবাবুকে সবাই বলে জ্যাঠামশাই । তাই পার্থ-ও তাঁকে 'জ্যাঠামশাই' বলতে শুরু করেছে । ইনি ষাটোর্ধ্ব কৃষ্ণকান্ত মিত্রের পিসতুতো দাদা । বেশ আড্ডাবাজ লোক । বয়স সত্তরের কাছাকাছি, বেশিও হতে পারে, ঠিক বোঝা যায় না । কৃষ্ণকান্ত বয়সের সাথে সাথে বাতিকবাবু-তে বিবর্তিত হয়েছেন । কবে, কেন, কীভাবে তাঁর এ দশা হল, সে খবর নিশ্চই নবকান্তবাবু রাখেন । কিন্তু ওসব ব্যাপারে উনি খুব সাবধানী । চট্ করে মুখ খোলেন না । অতীত নিয়ে উনি গল্প করেন ঠিকই, কিন্তু যেগুলো পারিবারিক ইতিহাসের গোলমেলে দিক, এমন সমস্ত বিষয় এড়িয়ে যান ।
বেতের চেয়ারে বসে আগন্তুক প্রবীণ ভদ্রলোকটি, অপরিচিত পার্থর দিকে তাকিয়ে, নবকান্ত ঘোষকে প্রশ্ন করেন - "তা এনাকে তো ঠিক চিনলাম না !"
"তা চিনবে কী করে ? ইনি তো আজই সকালে এয়েছেন । ওই পুজোর ছবি-টবি তুলবেন ।"
বৃদ্ধ এবার পার্থ-কেই প্রশ্ন করেন, "তা কোন্
চ্যানেল থেকে? নাকি খবরের কাগজ?"
"না... আসলে আমি কোনো টিভি চ্যানেল বা, প্রতিষ্ঠিত সংবাদপত্রে কাজ করিনা । আমি আসলে তথ্যচিত্র বানাতে এসেছি, সেটাই প্রাথমিক ভাবনা আর কি... তাছাড়া আমার কয়েকজন বন্ধু একটা ব্লগ বানিয়েছে। সেখানে কিছু লেখা আর ছবিও দেওয়ার ভাবনা আছে এই পুজো নিয়ে । এই আর কি !"
"আচ্ছা… ভালো । তার মানে ব্যক্তিগত উদ্যোগ
! তা আর পুজো-বাড়ি পেলে না হে ! এই ভাঙাচোরা দালান আর দুই থালার নৈবিদ্দি দেখতে চলে
এলে ? কী ছবি তুলবে এখানে? অবশ্য আমাদেরও যে বিশাল আয়োজন, তা বলছি না। তবু এর চেয়ে
অনেক ভালো।"
এবার বোধহয় নবকান্তবাবুর গায়ে লাগে । তিনি সোজা হয়ে বসে বলেন, - "তাই নাকি? তা তোমাদের গৃহদেবতা তো নিজেকেই রক্ষা করতে পারেন না হে! তোমরা আর কি বংশের ঐতিহ্যরক্ষা করবে?"
"ওই দেখো… আবার সেই পুরোনো কথা.. ! এই তোমার এক ব্যামো!"
এবার পার্থ কৌতূহল বোধ করে । যেন একটা গল্পের খোঁজ পায় ।
নবকান্তবাবু অবশ্য মুডে ছিলেন । হাসি মুখেই পার্থর দিকে তাকিয়ে বলেন, "এই যতীনদের গৃহদেবতা হলেন শ্যামসুন্দর-রাধারাণী । শ্যাম কষ্টিপাথরের, রাধারাণী তখনকার দিনের ভারি পিতলের পালিশ করা, একেবারে ঝকঝকে বিগ্রহ । বছর পঁচিশ আগে একবার চুরি হয়েছিলো ।"
"আরে থাক্ না সেসব কথা । দ্যাখো... যাকে পাবে শোনাবে !" - যতীনবাবু মৃদু আপত্তি জানান ।
"আরে আমাকে বলতে দাও... তা সেই চোরেরা যতীনদের পুকুরপাড়ে সেই রাধারাণীর মূর্তিখানা ফেলে গেসলো । কেন বলো দেখি ?"
কিছুক্ষণ ভেবে পার্থ বলে, "সোনা ভেবেছিল, কিন্তু তারপর ভুল বুঝতে পেরে ?"
"সাবাশ !" নবকান্তবাবু সোৎসাহে বলে ওঠেন ।
"কিন্তু ক্ষতি করে দিয়ে গেল বুঝলে ।" - যতীনবাবু বলতে থাকেন, "তোমাকে তুমি করেই বলছি, কিছু মনে কোরো না । চোরেরা কিন্তু শ্যামসুন্দরের মূর্তি নেয় নি । এমনি গয়নাগাটি যা ছিলো নিয়েছে নিশ্চয় বিগ্রহ থেকে খুলে, মন্দিরে বসেই ভরে নিয়েছে ঝোলায় । কিন্তু রাধারাণীর মূর্তি দেখে নির্ঘাত সোনাই ভেবেছিলো । তাই তুলে নিয়ে যায় । তারপর পুকুরপাড়ে বসে বাঁ হাতখানা কেটে পরীক্ষা করে দেখে ।"
"আর তখনই বুঝতে পারে... এ হল পিতল । তখন ওই মূর্তি আর সেই কাটা হাতটুকু ওখানেই ফেলে রেখে চলে যায় । তো এই হল গল্প । পরদিন সকাল বেলা সেই মূর্তি খুঁজে পাওয়া যায় । ধর-পাকড় কিছু হয়েছিল, কিন্তু চোর-কে খুঁজে পাওয়া যায় নি ।"
"বলে নিশ্চই খুব শান্তি পেলে নব ! তা তোমাদের বাড়ির গল্পটাও বলেই ফ্যালো । ওটা বলবে বলেই তো প্রসঙ্গটা তুললে ।" - পাঞ্জাবির উপরে কাঁধে ফেলা পাট করা চাদরটা ঠিক করে নিতে নিতে বললেন যতীন বাবু ।
এমন সময় চন্দ্রকান্ত-র একমাত্র ছেলে বুবুন পিছন থেকে বলে ওঠে, "আমি বলব, আমি বলব ।"
সে যে কখন পার্থর পিছনে এসে দাঁড়িয়ে গল্প শুনছিল, পার্থ খেয়ালও করে নি । নবকান্ত বাবু একগাল হেসে বলেন, "বলো দাদুভাই, তুমিই বলো ।"
"গল্পটা হল..." - বুবুন একটু সুর টেনে শুরু করে, "…তখন আমাদের একজন দারোয়ান ছিল । কিন্তু সে ঘুমিয়ে পড়েছিল । একটা চোর এমন সময় চুপিচুপি এসে ঢুকে পড়ল আমাদের গোপালের ঘরে । কষ্টিপাথরের ননীচোরা গোপাল বসেন ধারে, জানালার দিকে । তারপর কৃষ্ণ, বাঁ দিকে রাধা । প্রচুর গয়না ছিল গায়ে । চোর এসেছিলো গয়না চুরি করতে । নিয়েও ছিলো গয়না খুলে । কিন্তু পালাতে পারে নি । কেন বলো তো ?" - নবকান্ত বাবু-কে প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয় বুবুন ।
"কারণ গয়না খুলে নিয়ে চোর বাবাজি যেদিকেই তাকায়, দেখে চারটে দরজায় চারজন দারোয়ান দাঁড়িয়ে । ইয়া লম্বা, হাতে গদা । তাই না দাদুভাই ?"
"হ্যাঁ বলরাম এসেছিল তো ! তাই ভয়ে চোরটার কেঁদে ফেলার অবস্থা । ওদিকে তো ততক্ষণে দারোয়ানের ঘুম ভেঙে গেছে । দৌড়ে এসেই চোরকে ধরে ফেললো । ব্যাস গোপালের গয়না নেওয়া আর হলো না । কেমন জব্দ ?" - হাসি মুখে সদ্য পড়া ফোকলা দাঁতে হেসে উঠলো বছর দশেকের ছোট্ট বুবুন ।
এই সময় ভিতর বাড়ি থেকে একটা হাঁক শোনা যায় - 'বুবুন ?'
"মা ডাকছে, আমি যাই... " বলে বুবুন ছুটে পালায় । নবকান্তবাবু প্রসঙ্গ পালটে বলেন, "সে রামও নেই সে অযোধ্যাও নেই । এই তো দেখছ অবস্থা । আমাদেরও যা, যতীনদের-ও তাই, উনিশ-বিশ । তা কী হে যতীন, বিশুদ্ধ সিদ্ধান্ত মতে সন্ধিপূজা আরম্ভ কখন ? আমাদের তো শেষ হতে হতে রাত সোয়া বারোটা !"
"আমাদের তো রাত ৭টা ৪৪ মিনিট গতে সন্ধিপূজা আরম্ভ । রাত ৮টা ০৮ মিনিট গতে বলিদান । রাত ৮টা ৩২ মিনিট মধ্যে সন্ধিপূজা সমাপন । শ্রী শ্রী কালিকা দেব্যাবির্ভাব । মহিষমর্দিনী দেব্যাবির্ভাব । মহারাত্রি নিমিত্তানুষ্ঠান । তারপর তো কুমারী পূজা ।"
নবকান্তবাবু প্রশংসার সুরে বলে ওঠেন, "দেখেছ, দেখেছ, সব মুখস্ত । পারোও যতীন মনে রাখতে । সেকেন্ড মিলিয়ে বলে দেবে ! আমি বাপু এত মনে রাখতে পারি না ! বয়সও তো হচ্ছে ।"
"রাখো তোমার বয়স... আমি তোমার চেয়ে এক বছরের বড়ো.." বলে হাসতে থাকেন যতীনবাবু । নিতাই আর পার্থও হাসিতে যোগ দেয় । ওদিকে আটচালায় আবার বাজনা বাজতে শুরু করে।
ক্রমশঃ-----------
লেখকঃ- অভিষেক ঘোষ
কাবিল-এ-তারিফ
উত্তরমুছুন