গল্প।। মহাজাতি সদনের সামনে ।। গোবিন্দ মোদক
গোবিন্দ মোদক
সে আমার শিক্ষকতা জীবনের প্রথম দিককার কথা। আমার ক্লাস ফাইভের ছাত্ররা বায়না ধরলো- স্যার, আমাদেরকে নিয়ে কলকাতা বেড়াতে নিয়ে যাবেন?
একজন গেম টিচার হিসেবে আমার দায়িত্ব ছিল শুধু ওদেরকে খেলাধূলা শেখানো। হেডমাস্টার মহাশয় সেই সঙ্গে সংস্কৃতিক দিকটাও যোগ করে দিয়েছিলেন। আমি ক্লাস ফাইভে সদ্য ভর্তি হওয়া ছেলেগুলোকে ভীষণ ভালবাসতাম এবং গেম টিচার হিসেবে নয় একজন অভিভাবক হিসেবেও ওদেরকে ভালবাসতে শুরু করলাম। কাজেই কলকাতা বেড়াতে নিয়ে যাওয়ার আবদার আমি উপেক্ষা করতে পারলাম না। যাই হোক আমি বললাম- তোমাদেরকে কলকাতা বেড়াতে নিয়ে যাব বটে, কিন্তু সেইসঙ্গে তোমাদের একটি কাজও থাকবে। তোমরা সবাই কলকাতা বিষয়ে যে যেটুকু পারো অল্পবিস্তর পড়াশোনা করে নেবে লাইব্রেরী থেকে বই নিয়ে এবং কলকাতা থেকে ফিরে এসে সবাই লিখে জানাবে কলকাতা বেড়ানোর কোন ঘটনাটি তোমার সবচেয়ে ভালো লেগেছে অথবা কোন বিষয়টি তোমার মনে রেখাপাত করেছে বা কলকাতা বেড়ানোর সম্পর্কে তোমার যা অভিজ্ঞতা সেটিকে কিন্তু লিখতে হবে। ছাত্ররা তো হইহই করে রাজী হয়ে গেল। কাজেই আমাদের যাওয়া আটকায় কে!
নির্দিষ্ট দিনে দু'খানা বাস ভর্তি ছাত্রদের নিয়ে রওনা হলাম আমি এবং ভূগোল বিভাগের বিকাশবাবু। কলকাতা পৌঁছে টিফিন সেরে নিয়েই একে একে জাদুঘর, বিড়লা প্লানেটোরিয়াম, শহীদ মিনার ইত্যাদি ঘুরে পৌঁছালাম চিড়িয়াখানায়। তারপর ওখান থেকে ফেরার পথে মহাজাতি সদন হয়ে হাওড়ার ব্রিজ দেখে ফেরার পথ ধরা।
আসল মজা হল সোমবারের দিন। সেদিন আমার ক্লাস ছিল ক্লাস ফাইভের ঘরে। আমি যথারীতি সবাইকে বললাম যে- আমি তোমাদেরকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি পালন করেছি অর্থাৎ তোমাদেরকে কলকাতা ঘুরিয়ে নিয়ে এসেছি। কি, সবার ভালো লেগেছে তো! সবাই সমস্বরে হ্যাঁ-বাচক উত্তর দিলো। আমি তাকে খুব সন্তুষ্ট হয়ে বললাম- বেশ আমি সন্তুষ্ট, কিন্তু এবার তোমাদের প্রতিশ্রুতি পালনের পালা। কলকাতা বেড়াবার পরিপ্রেক্ষিতে কার কি ভালো লেগেছে বা কার কেমন মনে হয়েছে সেটি লিখে কিন্তু জানাতে হবে। ছাত্ররা তো মহাখুশি। সবাই খাতা পেন গুছিয়ে লিখতে বসে গেল এবং ক্লাস শেষ হবার আগেই সবাই জমা দিয়ে গেল।
পরদিন অবসর সময়ে আমি ওদের দেওয়া খাতা দেখতে বসে গেলাম। দেখতে পেলাম কারোর ভালো লেগেছে জাদুঘরের মমি, কারোর ভালো লেগেছে জাদুঘরের বিশাল হাতির কঙ্কাল, কারও ভালো লেগেছে বিড়লা প্লানেটরিয়াম, কারো বা শহীদ মিনার, কেউ বা আশ্চর্য হয়েছে হাওড়া ব্রিজের নকশা দেখে। কেউ বা আবার দোতলা বাস দেখে বিমোহিত হয়েছে। সবথেকে ভিন্নধর্মী লেখা লিখেছে ক্লাসের সবথেকে নিরীহ ছেলেটি। তার নাম সুমন। তার লেখটির শিরোনাম- 'মহাজাতি সদনের সামনে'। সে লিখেছে — সে দেখেছে মহাজাতি সদনের সামনে একটি খোঁড়া-অন্ধ মানুষ পারাপারের জন্য অপেক্ষা করছিল এবং বলছিল আমাকে কেউ সাহায্য করুন, রাস্তাটা পার করে দিন। কিন্তু কেউই এগিয়ে আসেনি। অবশেষে স্কুলের ইউনিফর্ম পরা একটি ছেলে (যতদূর সম্ভব ক্লাস সেভেন কিংবা এইটে পড়ে তেমন একজন কেউ) এসে তার হাত ধরে তাকে এগিয়ে দিয়েছিল এবং রাস্তা পার করে দিয়েছিল। এই ঘটনাটি সুমনের মনে খুব রেখাপাত করে। সুমন সেটিই গুছিয়ে লিখেছে। ঘটনাটি পড়ে আমার চোখ চোখে জল এলো। পরদিন ক্লাসে গিয়ে সুমনের কাঁধে হাত রাখলাম। সুমন আমার দিকে গাঢ় চোখে তাকাল। আমি ওর চোখে দেখতে পেলাম আগামী দিনের একজন প্রকৃত মানুষকে।
^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^
স্বরচিত মৌলিক অপ্রকাশিত গল্প ।
প্রেরক: গোবিন্দ মোদক।
সম্পাদক: কথা কোলাজ সাহিত্য পত্রিকা।
রাধানগর, ডাক- ঘূর্ণি, কৃষ্ণনগর, নদিয়া।
পশ্চিমবঙ্গ, ভারত, ডাকসূচক - 741103
WhatsApp/ফোন: 8653395807/ 7044404333
email id: modakgobinda001@gmail.com