আতঙ্ক
মিঠুন মুখার্জী
গোবরডাঙ্গার এক মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে স্বপ্না মুখার্জী। ছোটবেলা থেকে স্বপ্ন দেখতো ডাক্তার হওয়ার। বাবা প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক। ব্যাংক থেকে লোন নিয়ে মেয়েকে ডাক্তারি পড়ানোর স্বপ্ন পূরণ করতে গতবছর পাড়ি দিয়েছিলেন পূর্ব ইউরোপের ইউক্রেনে। কিয়েভ মেডিকেল কলেজের প্রথম বর্ষে ভর্তি করেছিলেন স্বপ্নাকে। গতবছর মার্চ নাগাদ করোনার ঝুঁকি নিয়ে মেয়েকে রেখে চলে এসেছিলেন মাতৃভূমিতে। কিন্তু এক বছর যেতে না যেতেই বাবা-মার সাথে সাথে স্বপ্নার স্বপ্ন পূরণ অপূর্ণ থেকে গেল।
রাশিয়া ও ইউক্রেনের হঠাৎ করে বীভৎস যুদ্ধ মানুষের স্বপ্নকে ভেঙে খানখান করে দিয়েছে। হোস্টেল ছেড়ে প্রথমে স্বপ্না আশ্রয় নিয়েছিল কিয়েভের একটি বাংকারে। হাজার হাজার স্থানীয় ও বিদেশী মানুষেরা ঠাসাঠাসি করে ছিল। তিন দিন থাকতে হয় এখানে তাকে। খাবার ছিল যৎসামান্য, জলও পর্যাপ্ত ছিলনা। টয়লেটে জল দেওয়ার জল খেয়ে প্রাণে বেঁচে ছিল স্বপ্নারা। কলকাতা থেকে তার সাথে আরো দুজন পড়ুয়া ছিল। ঋষি ও সুশ্রী। এরা দু'জনই হাতিবাগানের কাছে থাকে।
মোবাইলটা তিনজনের কাছেই ছিল। কিন্তু একমাত্র ঋষির ফোনেই ফুল চার্জ ছিল। স্বপ্নার ফোনে ত্রিশ পার্সেন্ট ও সুশ্রীর ফোনে কুড়ি পার্সেন্ট চার্জ ছিল। একদিন বাংকারে অতিবাহিত হওয়ার পর ঋষি ছাড়া অন্য দুজনের ফোন বন্ধ হয়ে যায়। বাড়ির সঙ্গে যোগাযোগ করতে খুবই অসুবিধা হচ্ছিল তাদের দুজনের।ঋষির ফোন দিয়ে কয়েকবার যোগাযোগ করেছিল স্বপ্না ও সুশ্রী। স্বপ্না সুশ্রীকে বলেছিল--- "জীবন গড়ার জন্য আমরা এখানে এসেছিলাম। কিন্তু সে জীবন নিয়ে বাড়ী ফিরতে পারব কিনা বুঝতে পারছি না!!" তাদের তিনজনের চোখে-মুখেই আতঙ্কের ছাপ ছিল। অনবরত বোমা, বন্দুকের গুলি, মিসাইল হানার শব্দ তাদেরকে বেশি করে উদ্বিগ্ন করে তুলেছিল। বাংকারে আটকে থাকা তিন দিন কয়েকবার স্বপ্না ও সুশ্রীকে কান্না করতে দেখা যায়।
তিনদিনের দিন বাঙ্কার থেকে বেরিয়ে প্রাণ বাঁচাতে তারা পৌঁছায় কিয়েভের রেলস্টেশনে। তিল ধারণের জায়গা নেই সেখানে। হাজার হাজার মানুষ স্টেশনে দাঁড়িয়ে। যথেষ্ট পরিমাণে ট্রেন চলছে না। তাছাড়া ইউক্রেনের সেনারা শুধুমাত্র ইউক্রেন বাসিদেরই ট্রেনে উঠতে দিচ্ছিল। কোন বিদেশীকে তারা ট্রেনে উঠতে দিচ্ছিল না। অনেকেই বন্দুকের বাটের বাড়ি ও লাথি খেয়ে আহত হয়েছেন। স্বপ্নার হাতে বন্দুকের বাড়ি লেগে হাত খানিকটা ফুলেও যায়। ঋষির তৎপরতায় স্বপ্না ও সুশ্রী প্ল্যাটফর্ম থেকে বেরিয়ে আসতে পারে। একবার যদি ওই ভিড়ে কেউ পড়ে যেত, তবে তাকে বাঁচানো খুব কঠিন হয়ে যেত। এরপর তারা রেলস্টেশন থেকে বেরিয়ে বিমানবন্দরে যাওয়ার পরিকল্পনা নেয়। কিন্তু এত পরিমাণে বোম ও মিসাইল হামলা চলছিল যে, তারা সে ঝুঁকি নেয় নি। তাছাড়া পৃথিবীর সবচেয়ে বড় বিমান ছিল ইউক্রেনের। সেই বিমানকে রাশিয়ার সৈন্যরা ঐদিন ধ্বংস করে দেয়। এয়ারপোর্টে তারা বোমা ফেলে। ফলে প্লেন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়।
তারা পুনরায় পূর্বের বাংকারে ফিরে আসে। এরপর ভারত সরকারের নির্দেশ মতো তিন দিন পর যুদ্ধ বিরতির সময় হাঙ্গেরির বর্ডারে তারা ব্যক্তিগত গাড়ি বুকিং করে ও পায়ে হেঁটে পৌঁছায়। তারপর হাঙ্গেরির বুদাপেস্টে থাকা ভারতীয় রাষ্ট্রদূতরা সব ব্যবস্থা করে দেয়। ঋষি, স্বপ্না ও সুশ্রী যে বিমানে করে দিল্লি পৌঁছে ছিল, সেই বিমানে মোট দুশো পঁয়তাল্লিশ জন যাত্রী ছিলেন। দিল্লি থেকে ফ্লাইট ধরে তারা পরদিন দমদম আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে এসে পৌঁছায়। তাদের প্রত্যেকের বাড়ি থেকে আপনজনেরা এয়ারপোর্টে রিসিভ করতে আসেন। আপনজনদের চোখের সামনে দেখে প্রত্যেকের চোখে জল দেখা গিয়েছিল। স্বপ্না তো মাকে দেখে উচ্চস্বরে কেঁদে উঠেছিল।
প্রত্যেক বাবা-মার কাছে তাদের সন্তানের মূল্য পৃথিবীর সমস্ত দামি দামি রত্নের চেয়েও বেশি। তারা না খেয়ে থেকেও সন্তান যেন ভালো থাকে তাই চায়। সন্তানের বড় হয়ে ওঠার পেছনে সবচেয়ে বেশি অবদান থাকে তাদের। তারা চায় তাদের সন্তান তাদের মুখ উজ্জ্বল করে দেশের দশের একজন হোক। কিন্তু সেই স্বপ্ন যখন কোন কারণে ভেঙে যায় অথবা অধরাই থেকে যায়, তখন তাদের দুঃখের অন্ত থাকে না। স্বপ্নার ক্যারিয়ারের শুরুতেই এত বড় হোঁচট খাওয়া তার বাবা- মাকে খুব দুঃখ দিয়েছিল। কিন্তু জীবনের চেয়ে বড় কিছু নেই। স্বপ্না যে বেঁচে ফিরেছে এতেই তারা খুশি। বাড়ি ফিরে সেইদিন রাত্রে স্বপ্না তার বাবা-মার কাছে ইউক্রেনের ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতার কথা বলেছিল। তার চোখ মুখে তখনও আতঙ্ক ছিল। স্বপ্না তাদের বলেছিল--- "আমাদের বাংকারে এক সপ্তাহের মতো থাকতে হয়েছিল। এত মানুষের ঠাসাঠাসির মধ্যে আমি জীবনেও থাকি নি। আমার দম বন্ধ হয়ে আসছিল। তারপর মোবাইলে চার্জ ছিল না। তাড়াতাড়ি হোস্টেল ছাড়ার কারণে চার্জার আনতে আমরা তিনজনই ভুলে গিয়েছিলাম। দিনরাত শুধু বোমার শব্দ, গুলির শব্দ শুনে শরীর ঠান্ডা হয়ে আসছিল। যেদিন রেলস্টেশনে সাহস করে গিয়েছিলাম, সেদিন দেখেছি রাস্তার বিভিন্ন জায়গায় সাধারণ মানুষ ও সেনাদের মৃতদেহ পড়ে আছে। চোখের সামনে উঁচু ইমারতগুলি বেশিরভাগই ধ্বংস হয়ে গেছে। রাশিয়ার সেনাদের সাঁজোয়া গাড়ি দিয়ে চারচাকার গাড়ি গুলিকে পিষে দিতে দেখেছিলাম। কি নিষ্ঠুর! এরা মানুষ কিনা সেই মুহূর্তে আমার মনে সন্দেহ জেগেছিল। নারী-পুরুষ-শিশু-বয়স্ক সকলের উপর সে কি অত্যাচার!! আমাদের কাছে ভারতের জাতীয় পতাকা ও পাসপোর্ট থাকায় আমরা কিছুটা রক্ষা পেয়েছিলাম। আমরা ভারতীয় বলতেই রাশিয়ান সৈন্যরা পাসপোর্ট চেক করে ছেড়ে দিয়েছিল। এই সাতদিন আমাদের চোখের জল বাঁদ মানেনি। প্রত্যেক মুহূর্তে মনে হয়েছে আর আমরা দেশে ফিরতে পারব না। আর মা-বাবা ভাই-বোনদের সঙ্গে দেখা হবে না। কিন্তু ঈশ্বরের অসীম কৃপা যে আমরা অক্ষত দেহে বাড়ি ফিরতে পেরেছি।"
স্বপ্নার বাবা-মার চোখে জল দেখা গিয়েছিল। স্বপ্নার কথা শুনে স্বপ্নার মা বলেছিল--- "তুই চিন্তা করিস না। ঈশ্বর যা করেন মঙ্গলের জন্যই করেন। আমরা তোকে ফিরে পেয়েছি, আমাদের কাছে এই অনেক। রাজ্য সরকার ও কেন্দ্রীয় সরকার ভারতে পড়ার ব্যবস্থা করেছেন ইউক্রেন ফেরত পড়ুয়াদের। যদি তুই কলকাতাতেই পড়ার সুযোগ পাস তাহলে আর ইউক্রেনের ফিরে যেতে হবে না। তাই এই এক বছর দুঃস্বপ্ন ভেবে ভুলে যাস। আমরাও ভুলে যাব। তুই ভাল থাক আমরা সেইটাই চাই"। এই বলে স্বপ্নার বাবা-মা দুজনেই স্বপ্নাকে জড়িয়ে ধরে সান্তনা দেয়।
--------------------------------
মিঠুন মুখার্জী
C/O-- গোবিন্দ মুখার্জী
গ্ৰাম : নবজীবন পল্লী
পোস্ট+থানা -- গোবরডাঙা
জেলা -- উত্তর ২৪ পরগণা
পিন-- 743252