ভুবন বাবু নাতির হাত শক্ত করে ধরে সন্তর্পনে রাস্তা পার হয়। একে একে রবীন্দ্র সদন, বিড়লা তারামণ্ডল, ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল হল দেব মাল্য কে দেখাতে থাকেন। দেব মাল্য বিস্ময়ে অভিভূত। কত অজানা বিষয় তার চোখের সামনে ভেসে ওঠে।
দুপুর রোদে আর বাইরে ঘোরাঘুরি না করে ,ভিক্টোরিয়ার বাগানে ছায়াসুনিবিড় লনে বসে, দাদু নাতি তে মায়ের দেওয়া টিফিন বক্স খুলে ,পরমানন্দে উদরপূর্তি করতে থাকে। খাওয়া শেষ করে ভুবন বাবু তৃপ্তির ঢেকুর তোলেন । এবং দেব মাল্য কে বলে কি দাদু ভাই কলকাতা ঘুরতে ভাল লাগছে তো! দেবমাল্য বলে দারুন আনন্দ হচ্ছে, ইচ্ছে করছে আজ গোটা কোলকাতা ঘুরে ফেলি। সূর্যটা ঢলে পড়েছে পশ্চিমাকাশে, রোদের তেজ স্তিমিত হয়েছে। মৃদুমন্দ দখিনা মলয় সমিরণ ফুরফুরে করে তুলেছে শরীর ও মনকে।
ভুবনবাবু বলেন, চলো দাদুভাই কলকাতা বিরাট শহর একদিনে ঘোরা অসম্ভব। অনেক অনেক কিছু আছে এখানে। তিলোত্তমা কলকাতায় কোন কিছুর অভাব নেই।মন্দির ,মসজিদ, গির্জা, গুরুদ্বার জাদুঘর, বই পাড়া কতকিছু। কত ধরনের কত বর্ণের মানুষ এখানে বাস করেন ।এক কথায় বলতে পারো কলকাতা চলমান ভারত বর্ষ।বড় হয়ে তুমি সব জানতে পারবে।
এবার হাওড়া গামী বাস ধরে হাওড়া স্টেশন তারপর ট্রেনে চেপে আমতা, দেবমাল্যর হাত ধরে ভুবন বাবু এগিয়ে চলেন রানী রাসমণি রোড ধরে বাসের সন্ধানে। ওখানে আসতেই দেখতে পায়, অনেক তরুণ-তরুণী রাস্তায় শুয়ে আছে, কেউ বসে আছে ওদের বুকে লেখা অজস্র প্লাকার্ড, মুখে মুখে স্লোগান। দেব মাল্য দাদুকে জিজ্ঞাসা করে, এরা কারা? ভুবনবাবু বলতে থাকেন ,এরা শিক্ষিত তরুণ- তরুণী, শিক্ষকতা করার জন্য এরা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ। কিন্তু নিয়োগকর্তা নিয়োগ করছে না ।অথচ স্কুলে শূন্য পদ পূরণ হচ্ছে না।
হঠাৎই পুলিশের গাড়ি, পুলিশে- পুলিশে চারিদিক ঘিরে ওই তরুণ-তরুণীকে লাঠিপেটা করতে থাকে ।মুহূর্তে রাজপথ রণক্ষেত্র চেহারা নেয় । ওই সমস্ত ধর্নায় বসা তরুণ-তরুণীদের লাঠিপেটা করতে থাকে। এবং টেনে হিজড়ে পুলিশের জালে ঘেরা গাড়িতে তুলতে থাকে। মুহুর্তের মধ্যে রাজপথ রক্তাক্ত হয়। পুলিশের নির্মম প্রহারে তাজা যৌবনের সর্বাঙ্গে কালশিটে দাগ, জমাট রক্তের ছোপ ।ওদের স্বপ্ন ছিল চাকরির প্রত্যাশা। ভুখা পেটে একটুখানি রসদ, অসহায় ডুবন্ত সংসার কে বাঁচাবার অদম্য প্রচেষ্টা।
ভুবনবাবু ভাবতে থাকেন, ওদের চাকরির দাবিতে আন্দোলন কি ন্যায় সঙ্গত নয়! ওরা কাজ চায়, বিনিময় পেলো লাঞ্ছনা নির্যাতন অপমান, এটাকি প্রত্যাশিত!! বিনা দোষে কারাবাস কি কাঙ্ক্ষিত? কে দেবে এই প্রশ্নের উত্তর!
এরই মাঝে কোনরকমে ভুবন বাবু হাওড়া গামী একটি বাসে চেপে দেব মাল্য কে নিয়ে চলে আসেন হাওড়া স্টেশনে।এবং হাওড়া আমতা গামী ট্রেনে চেপে বসেন। কিন্তু ডোমজুড়ে আসার পর ট্রেন আর আগাচ্ছে না ।ট্রেন অবরোধ। ট্রেন লাইনের উপর কয়েশো ছেলে -মেয়ে। ট্রেন লাইনের উপর টায়ার জ্বলছে লেলিহান অগ্নি শিখা ধোঁয়ার কুণ্ডলী পাকিয়ে আকাশ বাতাস ভারাক্রান্ত করে তুলছে। স্লোগানে স্লোগানে মুখরিত জনপদ। দেব মাল্য ভয় পেয়ে যায়। সে দাদু কে জিজ্ঞাসা করে, দাদু ট্রেন বন্ধ হয়ে গেল কেন? ওরা কারা আগুন জ্বালাচ্ছে?
ওরা একদল ধর্মান্ধ মানুষ। ওদের ধর্মের মানুষের সম্পর্কে কোনো এক অর্বাচীন কটূক্তি করায় ওরা ক্ষিপ্ত হয়ে গেছে। তাই ওরা সারা ভারতবর্ষে বিভিন্ন প্রদেশে এইরকম উন্মত্ত আচরণ করে সম্প্রীতির বাতাবরণ নষ্ট করতে চাইছে। জানো দাদুভাই আমাদের দেশটা টুকরো টুকরো হয়ে গেছে একদল ধর্মের ভেকধারী ক্ষমতালোভী দের জন্য। ভ্রাতৃঘাতী দাঙ্গার রক্ত এখনো লেগে আছে এদেশের মাটির পরতে পরতে। অথচ সনাতন ভারতবর্ষের অহিংস নীতি সহিষ্ণুতার কথা বলে। কবি চন্ডীদাস বললেন 'সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই' ।শ্রীচৈতন্য বললেন 'মেরেছো কলসির কানা তাই বলে কি প্রেম দেব না' ।রামকৃষ্ণ কহেন 'যত মত তত পথ'। বিবেকানন্দ বললেন 'জীবে প্রেম করে যেইজন সেইজন সেবিছে ঈশ্বর'। ধর্ম যে যার মতো করে করুক পালন, অন্য ধর্মে কেন ঘৃণা কেন কটুক্তি! সব ধর্মের সারকথা মানুষকে ভালোবাসা, মানুষের কল্যাণে সৎ পথে জীবন যাপন করা। আপদে-বিপদে মানুষের পাশে থাকা। সকলের ধর্ম হোক মানবতা।
অবশেষে অনেক পরে রেললাইন অবরোধ মুক্ত হয়, ট্রেন চলতে থাকে। ভুবন বাবু তার নাতি কে জড়িয়ে ধরে বলতে থাকে, দাদুভাই তুমি বড় হয়ে বড় মাপের মানুষ হও।মানুষের পাশে থেকে মানবতার গান শোনাও। দাদুভাই সুকান্তর সেই কবিতাটা তোমার মনে আছে 'যতক্ষণ দেহে আছে প্রাণ দাদু- নাতি একসাথে বলতে থাকে,
প্রানপনে পৃথিবীর সরাব জঞ্জাল,
এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি
নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।'
============
অশোক দাশ
ভোজান, রসপুর, হাওড়া, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত