লিটল ম্যাগাজিন 'বিশ্বতান'
বৈশাখ-১৪৩২ সংখ্যা প্রসঙ্গে
গোবিন্দ মোদক
যখন একটি লিটল ম্যাগাজিনের নাম হয় "বিশ্বতান" এবং সুযোগ্য সম্পাদক শ্রী রাজীব কুমার জানার হাত ধরে তা একাদিক্রমে দীর্ঘ ৪২ বছর ধরে নিয়মিত প্রকাশ পেতে থাকে — তখন তা ভিন্ন মাত্রা পায়। নিতান্ত একনিষ্ঠ সাহিত্য নিবেদিত প্রাণ মানুষ না হলে এ কাজ মন থেকে করা সম্ভব নয়।
রূপকধর্মী চমৎকার প্রচ্ছদের ৪২-তম বছরের বিশ্বতানের বার্ষিক এই সংখ্যাটি (বৈশাখ-১৪৩২) হাতে নিয়ে বিষয়সূচীতে চোখ রাখলেই মন ভালো হয়ে যায়। শুরুতেই সম্পাদকীয় কলম পাঠকের মন কাড়ে। "একটু ভেবে দেখবেন, প্লিজ" শীর্ষক এই সম্পাদকীয়টি যেমন সময়ানুগ তেমনই সমাজ সচেতনতামূলক। তীব্র এই গতিময়তার যুগে ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা, হোমওয়ার্ক, একাধিক টিউশন, পাশাপাশি নাচ গান আঁকা আবৃত্তি ইত্যাদির সঙ্গে সমতা রাখতে গিয়ে খেলাধুলাটা নিতান্তই বাদ পড়েছে। কাজেই তাদের শারীরিক এবং মানসিক বিকাশে ক্ষতিকর প্রভাব পড়ছে যা নিয়ে মাননীয় সম্পাদক মহাশয় রচনা করেছেন তাঁর মূল্যবান সময়ানুগ সম্পাদকীয় কলম যেখানে তিনি অভিভাবকদেরকে সতর্ক হবার কথা বলেছেন।
সুতরাং দেখা যাচ্ছে – মাননীয় সম্পাদক মহাশয় সমাজের জন্য যেমন ভাবেন, তেমনই শিশু-কিশোরদের জন্যও ভাবেন। তাই তাঁর পত্রিকা বিশ্বতানের শুরুতেই শিশু-কিশোর বিভাগ (সবুজ সাথী / সুর প্রভাতী) আলোকিত হয়ে উঠেছে এমনই কয়েকটি সুনির্বাচিত অনবদ্য ছড়া-কবিতাতে যেগুলি শুধু শিক্ষণীয় বা আদর্শমূলকই নয় বা শুধুমাত্র ছোটদের উপযোগী তাও নয়, সেগুলি বড়দেরকেও সমানভাবে ভাবাবে এবং শিক্ষা দেবে। সবুজ সাথী বিভাগে ড. হরিপদ মাইতি রচিত 'মানব জীবন অনেক বড়', রাজীব কুমার জানা রচিত 'আমার গ্রাম', গোবিন্দ মোদক রচিত 'চাঁদ খসা' প্রভৃতি ছড়া-কবিতাগুলি বিশেষভাবেই উল্লেখযোগ্য। বস্তুতপক্ষে দেশ কাল সমাজ নির্বিশেষে এই ছড়া-কবিতাগুলি সর্বক্ষেত্রেই আদরণীয় হবে।
চিত্রাঙ্কন বিভাগে ক্লাস ওয়ানের দেবজিতা জানার আঁকা কয়েকটি যোগাসনের ছবি, পেট্রোল পাম্পের ছবি, রেলগাড়ির ছবি এবং গ্রাম বাংলার ছবি ছাপা হয়েছে যা দেখে ছোটরা নতুন করে আঁকতে অনুপ্রাণিত হবে।
পত্রিকার দ্বিতীয় অংশ 'সাধারণ বিভাগ' যেখানে সুনির্বাচিত বেশ কিছু গল্প, প্রবন্ধ, গদ্য-কবিতা, পদ্য-কবিতা, রম্য গল্প, ভ্রমণ গল্প প্রকাশিত হয়েছে। কবিতা বিভাগে ড. অনিমেষ চট্টোপাধ্যায় (দু'টি অণু কবিতা), চিত্তরঞ্জন পাত্র (ইতিহাস কথা বলে), সুজিত কুমার রায় (শ্রী রামকৃষ্ণ গীতিকা), ডাঃ শান্তনু গুড়িয়া (ডিজিট্যাল ইণ্ডিয়া), স্বপন দত্ত (ভুল), ডাঃ প্রকাশ অধিকারী (জাগ্রত দেশপ্রেম এবং ...), ইন্দ্রনীল জানা (স্মৃতি বিজড়িত বর্ষার সন্ধ্যায়) প্রমুখ কবি উপহার দিয়েছেন ফিরে পড়বার মতো কিছু সুপাঠ্য কবিতা।
পত্রিকার গদ্য বিভাগটি তুলনামূলকভাবে বড় এবং যথেষ্টই বলিষ্ঠ। গল্পকার শাহারউল ইসলাম উপহার দিয়েছেন 'বকুল' শীর্ষক একটি বলিষ্ঠ গল্প যেটি প্রকৃত অর্থেই বাস্তবানুগ এবং চমকপ্রদ। রণেন্দ্রনাথ দাসের 'বাংলীর পটে' শীর্ষক গল্পটি আকারে ছোট হলেও সুপাঠ্য। মধ্যপ্রদেশের ভোপাল থেকে মনীষা দাশগুপ্ত উপহার দিয়েছেন তথ্যবহুল ভ্রমণ গল্প — "কন্যাকুমারী — এক কুমারীর তপস্যাভূমি"। পত্রিকার অন্যতম ভ্রমণ গল্পটি লিখেছেন সুশিক্ষক নিরঞ্জন কুণ্ডু যেখানে 'নাড়াজোল রাজবাড়ী ভ্রমণের বিভিন্ন দিক উদ্ভাসিত হয়েছে গল্পকারের বলিষ্ঠ কলমে। রাজীব কুমার জানা রচিত "হাম্বা-হাম্বা! তুহুঁ-তুহুঁ!!" একটি অসাধারণ ধর্মকথা যার রচনাশৈলী পাঠকমনে অণুরণন জাগায়।
এই নিয়মিত বিভাগগুলি ছাড়াও চার ফর্মার এই পত্রিকাতে রয়েছে পুস্তক পর্যালোচনা বিভাগ, রয়েছে পত্র-পত্রিকা-পুস্তক প্রাপ্তি স্বীকার বিভাগ, পাঠক-পাঠিকার মতামত বিভাগ প্রভৃতি। পত্রিকার আর একটি উল্লেখযোগ্য ভিন্নধর্মী সংযোজনা — বিশ্বতানের সূচনা লগ্ন থেকে লেখক-লেখিকাদের বর্ণানুক্রমিক তালিকা প্রকাশ যা খুব কম পত্রিকাতেই দেখতে পাওয়া যায়। সেই দিক থেকে বিশ্বতান অবশ্যই পৃথক কৃতিত্বের দাবীদার।
লিটল ম্যাগাজিন সম্পর্কে একটি আপ্তবাক্য চালু আছে, সেটি হলো — একজন সম্পাদকের অনির্বাণ চেতনার অনিবার্য বহিঃপ্রকাশ এক একটি লিটল ম্যাগাজিন। আপ্তবাক্যটি বিশ্বতান পত্রিকা সম্পর্কে সর্বৈব সত্য — কারণ সম্পাদক শ্রী রাজীব কুমার জানা আপন অনুভববেদ্যতা এবং সৃজনশীলতা দিয়ে বিশ্বতানকে সৃজন করেছেন এবং ৪২ বছর ধরে লালন পালন করে চলেছেন বাহ্যিক কোনও সহযোগিতা ছাড়াই। এমন "ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো" সম্পাদক আছেন বলেই আমরা আজও ক্ষুদ্র পত্র-পত্রিকার ঘ্রাণ পাই আর সাহিত্য জগৎ তথা পৃথিবী থেকে লিটল ম্যাগাজিন নামক বস্তুটি এখনও বিলুপ্ত হয়ে যায়নি। কাজেই, কোনও ধন্যবাদই শ্রী রাজীব কুমার জানা এবং বিশ্বতান পরিবারের সম্পর্কে যথেষ্ট নয়। আমরা সাগ্রহে তাকিয়ে থাকব বিশ্বতানের ৪৩-তম সংখ্যার দিকে এবং কামনা করবো বিশ্বতানের দীর্ঘায়ু॥
লিটল্ ম্যাগাজিন: বিশ্বতান
(বৈশাখ- ১৪৩২)
সম্পাদক: শ্রী রাজীব কুমার জানা
প্রকাশ স্থান: মেছেদা বাইপাস, পোস্ট- কাঁথি,
জেলা- পূর্ব মেদিনীপুর।
মূল্য: ১৫ টাকা
___________________________
গোবিন্দ মোদক।
রাধানগর, ডাক- ঘূর্ণি, কৃষ্ণনগর, নদিয়া।
পশ্চিমবঙ্গ, ডাকসূচক - 741103