পারুলের ভালো বাড়ি
অঞ্জনা মজুমদার
প্রবল বৃষ্টির জন্য আটটা পাঁচ এর লোকাল ট্রেনটা ধরতে পারল না মিতিন। শিয়ালদহ স্টেশনে একঘন্টা অপেক্ষা করার পর লাস্ট ট্রেনে বেশ ভিড় লেডিজ কম্পার্টমেন্টে উঠে দাঁড়িয়ে থাকতে হল। একটু ভেতরে ঢুকে দাঁড়িয়ে আছে, যদি কয়েকটা স্টেশন পর কেউ নেমে যায় তবে বসতে পারবে। একটা সীটে চারজন মহিলা বসে ছিলেন। তিন স্টেশন পর একজন নেমে গেলে রোগা-সোগা মিতিন বসতে পারল। পা টা একটু ছাড়ল।
কিন্তু বসার পর থেকেই ওর পায়ে কিছু একটা ঠেকছে। বড্ড ভীড় তাই দেখতে পারছে না, কিন্তু অস্বস্তি রয়েই গেল। মিতিন একেবারে শেষ স্টেশনের আগের স্টেশনে নামবে। আরও কয়েকটি স্টেশন পর ভীড় একটু হালকা হতে মিতিন পায়ে কি যেন লাগছে বলে নীচু হতেই একটা বাচ্চা মেয়ে বেরিয়ে এলো হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে। আমাকে ওরা ধরে নিয়ে যাবে। আমাকে বাঁচাও দিদি।
মেয়েটি বছর সাত আটের হবে। গায়ে একটা সাধারণ ফ্রক। পায়ে জুতো, চটি কিছু নেই। কানে একটা রুপোর মাকড়ি। হাতে দুগাছা রুপোর রুলি। কোঁকড়াচুলো মেয়েটি শ্যামলা চেহারা।
কয়েকজন মহিলা মেয়েটিকে ঘিরে ধরলেন।
কি নাম তোর? বাড়ি কোথায় ? এখানে এই ট্রেনে কি করে এলি?
এবার ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। কাঁদতে কাঁদতে বলল, পারুল।
চুড়ি আর ব্যাগ বিক্রি করেন যে দুই দিদি তারা বললেন, বাড়ি কোথায় তোর?
বিতানপুর বটে।
সেটা তো এই লাইনে নয়! কোথায়?
একজন দিদি ব্যাঙ্কে চাকরি করেন। বললেন, ওকে কেউ থানায় নিয়ে যাক। পুলিশ ওর বাড়ি খুঁজে দেবে।
পুলিশের নাম শুনে এক এক করে সবাই সরে সরে গেল। আর মেয়েটি মিতিনের গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে। মিতিনের স্টেশন গোপালপুর আসতেই মিতিন নামল, সঙ্গে পারুল।
মিতিন কিছু বলার আগেই পারুল বলল, আমাকে ফেলে যাস না দিদি। আমি হাইরে গেছি, একা হলে মরেই যাবো।
কি আর করে মিতিন? পারুলকে নিয়েই এগোলো স্টেশনের গেটের দিকে। দেরি হলে প্রতিদিনের মতো কাকা এসেছেন মিতিনকে নিতে। পারুলকে দেখে অবাক হয়ে বললেন, এটা কে রে মা? তোর সঙ্গে এলো?
মিতিন বললে, বাড়ি চলো কাকু, গিয়ে বলবো।
তিনজনে বাড়ির দিকে রওনা হলো।
বাড়ি যাবার পথে দুজন লোক ওদের পিছু পিছু আসছে। কাকার হাতে লাঠি থাকে । এ অঞ্চলে কাকার লাঠিকে সব চোর ডাকাত ভয় করে। কাকা একবার পিছনে ফিরে দাঁড়াতেই লোক দুটি উল্টো পথে দৌড়ে পালাল।
বাড়িতে মা, কাকিমা কোনও প্রশ্ন করলেন না। মা বললেন, আগে হাত মুখ ধুয়ে খাওয়া দাওয়া হোক, ওদের অনেকক্ষণ কিছু পেটে পড়েনি। তারপর সব শুনবো।
খাওয়ার পর মিতিন সব খুলে বলল। পারুল তার নাম আর গ্রামের নাম ছাড়া আর কিছু বলতে পারছে না। আবার সে অন্য কোথাও সে যাবে না। দিদির বাড়িতেই থাকবে।
মা বললেন, বেশ, তুই এখানেই থাকবি। কিন্তু তোর মা বাবা আছে ?
পারুল মাথা নাড়লো, নেই। মামার কাছে থাকত। মামী খুব খাটাত, পেট ভরে খেতে দিত না। পুলিশ মামীর কাছে ফিরিয়ে দিলে ও যেতে চায় না, এটা বোঝা গেল।
সে রাতে পারুল মিতিনের ঘরেই থাকল। পরদিন শনিবার মিতিনের ছুটি। দেরি করে ঘুম থেকে ওঠলো।
কাকু বললেন, পারুল যাই বলুক আমাদের পুলিশকে জানানো উচিত। ফর্মালি নাই বলি, ছোট দারোগা বিমলবাবুকে আমি বলব। দেখি উনি কি বলেন।
থানায় যেতে হল না। বিমলবাবুর সাইকেল এর ঘন্টি শোনা গেল। উনি কাকার বন্ধু। মাঝে মধ্যেই এ বাড়িতে আসেন। মায়ের হাতের নাড়ু তার বড্ড প্রিয়।
পারুল কিন্তু বিমলবাবুকে ভয় পেল না। তিনি ভুলিয়ে পারুলের একটা ছবিও তুলে নিলেন। রাতে দুজন লোক পিছনে পিছনে আসছিল শুনে বললেন, বেশ আমি নজর রাখবো। বৌদি, পারুল যেন বাইরে একা একা না যায়।
বিমলবাবু চলে গেলেন। পারুল সারাদিন ঘরে ছোটাছুটি করে আনন্দেই থাকল। বাবা কাকা কাজে বেরিয়ে গেলে মা সদর দরজা বন্ধ করে দিলেন।
দুপুরে খেয়ে দেয়ে সবাই যখন একটু ভাতঘুমে তখন সদরে টুকটুক করে কড়া নড়ল। পারুল জড়োসড়ো হয়ে ঘরে ঢুকে পড়ল। মিতিনকে ফিসফিস করে বলল, আমাকে ধরে নিয়ে যেতে এসেছে। আমাকে ওদের কাছে দিয়ে দিও না।
জানালার ফাঁক দিয়ে মিতিন দেখে দুজন গুন্ডা মত লোক দরজার কড়া নাড়ছে। বাড়িতে এখন কোনও পুরুষমানুষ নেই। মিতিন ফোন করে পাশের বাড়ির সতুকে ডাকল। সতু আর বিনু দুভাই সব দরকারে এবাড়ির বিপদে আপদে দৌড়ে আসে। আজ ভাগ্য ভালো দুজনেরই কলেজ ছুটি।
ওরা মিতুদিদি বাড়ি আছিস? বলতে বলতে এগিয়ে এলো। আর লোকদুটো ধীরে ধীরে দূরে চলে গেল।
মিতিন দরজা খুলল। সতু বলল, বাবার কাছে সব শুনেছি। আজ আর পারুলের আর তোর কোনও ভয় নেই মিতুদিদি। বিমলকাকু বলেছেন এ বাড়ির ওপর নজর রাখবেন রাতে। আমরাও খেয়াল রাখবো।
আশ্চর্য ব্যাপার শান্ত গোপালপুরে সে রাতে মিতিনের বাড়িতে ডাকাত পড়ল। ডাকাতেরা বোমা ছুঁড়ে পিস্তল দেখিয়ে দরজা ভাঙতে চেষ্টা করেছিল।
কিন্তু পুলিশের কাছে ইনফরমেশন ছিল যে গ্রামে জনা চারেক বাইরের লোক ঢুকেছে। তাই লোকগুলো পারুলকে নিয়ে যেতে চাইলেও পারল না। পুলিশের হাতে ধরা পড়ল।
অফিসার বললেন, এরা মেয়ে পাচার করে। টাকা দিয়ে কিনেছে বলে পারুলকে হাতছাড়া করতে চায় নি। এরা ভয়ানক চক্র। তাই এরা আক্রমণ করল।
আর পারুল সত্যি কথাই বলেছে। আমি ছবি দেখিয়ে খোঁজ নিয়েছি। ছোটবেলায় ওর মা বাবা মারা গেছে। ওর মামী ওকে বিক্রি করে দিয়েছে। মামার কথা বাড়ির কেউ শোনেনা, মাতাল লোক।
নিয়ম মতো ওর হোমে থাকা উচিত। আমি পারমিশন নিয়ে ওকে এ বাড়িতে এখন থাকতে দিয়েছি, পারুল চাইছে বলে।
মা বললেন, আমরা ওকে লেখাপড়া শেখাবো। বিমল ঠাকুরপো আপনি কোর্টের অনুমতি নেবার ব্যবস্থা করুন ও যেন আমাদের মেয়ের মতো এ বাড়িতেই থাকবে।
বিমলবাবু বললেন, তাই চেষ্টা করবো বৌদি। এবার তবে মেয়েটা একটা সুস্থ পরিবেশ পাবে।
পারুল বলল, এটা আমার ভালো বাড়ি। আমি এখানেই থাকব।
মা পারুলকে জড়িয়ে ধরে বললেন, তাই থাকবি।
পারুল একগাল হেসে মা কে আরও জোরে জড়িয়ে ধরলো।
=============================
অঞ্জনা মজুমদার
এলোমেলো বাড়ি
চাঁদপুর পল্লী বাগান
পোঃ রাজবাড়ি কলোনী
কলকাতা ৭০০০৮১
To Know More Deals & Offers : CLICK HERE