সালটা ছিল ২০২০। যে সময়ের কথা সেই সময় করোনার জন্য দেশ জুড়ে চলছে লক ডাউন। তখন সবে মাস খানেক হয়েছে। এরকম হঠাৎ করে লক ডাউন ডেকে দেওয়ায় যে সব শ্রমিক দেশের এক রাজ্য থেকে অন্য রাজ্যে কাজের জন্য গিয়েছিল, তারা সেই ভিন রাজ্যেই আটকে পড়লো অনির্দিষ্ট কালের জন্যে। সেখানে প্রথম কয়েকদিন তাদের অন্ন সংস্থান হলেও কাজ না থাকায় কোনো মালিকই বেশি দিন আর তাদের দায়িত্ব নিতে চাইলো না। সেই সমস্ত রাজ্যের সরকার বাহাদুরও তাদের দায়িত্ব নিতে অস্বীকার করলো। ফলে তাদের অন্ন সংস্থান হয়ে পড়লো অনিশ্চিত। এদিকে সমস্ত যানবাহন বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ফিরে আসারও কোনো পথ ছিল না। এর ফলশ্রতি হিসাবে সেই সব লক্ষ লক্ষ পরিযায়ী শ্রমিক যারা অন্যান্য রাজ্যে কাজ করতে গিয়ে আটকে গিয়েছিল, তারা যে কোনো মূল্যে নিজের রাজ্যে ফেরার চেষ্টা করতে লাগলো। কখনো গলা কাটা দাম দিয়েও ম্যাটাডোর ভাড়া করে, কখনো রাস্তা ধরে মাইলের পর মাইল পায়ে হেঁটে আবার কখনও রেল লাইন ধরে হেঁটে তারা ফিরতে চেয়েছিল নিজের দেশে, নিজের রাজ্যে, নিজের পরিবারের কাছে।
এমনই একজন পরিযায়ী শ্রমিক ছিল রামু। রামু পেটের দায়ে কাজ করতে গেছিলো ভিন রাজ্যে। সেখানে রাজমিস্ত্রির অধীনে জোগাড়ের কাজ করত সে। রামুর সঙ্গে থাকতো তার স্ত্রী আর তার মেয়ে। একটা ঘিঞ্জি বস্তিতে একটা ছোট ঘরে থাকতো তারা। করোনা যখন সর্বগ্রাসী হয়ে বস্তিতে ছেয়ে গেছে তখন প্রাণ বাঁচাতে সেখান থেকে রামু চলে আসতে চাইলো তার নিজের রাজ্যে। কাজ কর্ম হাতে না থাকায় রামুর মালিকও তার এবং তার পরিবারের দায়িত্ব নিতে চাইলো না। পাথেয় বাবদ কিছু টাকা ঠেকিয়ে দায় সারলো সে। সেই টাকা দিয়ে কোনো মতে কিছু খাবার কিনে দু দিন চললো রামুর। কিন্তু দুদিন তার ঘোরাঘুরিই সার হলো পথে পথে কিন্তু কিছুতেই বেরোতে পারলো না ওই রাজ্য থেকে। এদিকে সঞ্চিতিও শেষের দিকে। পরের দিন রামু খবর পেলো যে তার রাজ্যেরই একদল শ্রমিক নিজেদের দেশে ফেরার জন্য জমা হচ্ছে তারই বাসার কাছে। কাল বিলম্ব না করে রামু যোগাযোগ করলো তাদের সাথে। ঠিক হলো সেই দিন বিকেলবেলা রওনা দেবে তারা। রেললাইন ধরে হাঁটতে আরম্ভ করলে নিকটবর্তী জংশন স্টেশন, যেখান থেকে তাদের রাজ্যের 'শ্রমিক স্পেশাল' ট্রেন ছাড়বে পরের দিন বেলায়, সেখানে পৌছতে পরেরদিন ভোর হয়ে যাবে। ওই দলটা ছিল গোটা কুড়ি লোকের একটা দল যাতে কিছু স্ত্রীলোক আর বাচ্ছাও ছিল। যাইহোক, যেটুকু টাকা পয়সা ছিল তা দিয়ে সেই রাতে খাওয়ার জন্য রুটি, সবজি আর আচার কিনে রামু তার পরিবারকে সঙ্গে নিয়ে ভিড়ে গেলো ওই দলের সাথে। বিকালে যাত্রা শুরু করে ঘণ্টা খানেক রাস্তা দিয়ে হেঁটে তারা পৌঁছে গেলো রেল লাইনের কাছে। তারপর শুরু হলো রেললাইন ধরে হাঁটা। ঘণ্টা খানেক ধরে হাঁটার পর কিছুক্ষন ধরে বিশ্রাম নেয় তারা। তারপর শুরু হয় আবার হাঁটা। এইভাবে চলতে চলতে যখন রাত প্রায় ১১ টা বাজলো, তখন তারা খাবার জন্য বিরতি নিল। যে জায়গাটায় তারা থামলো, ঠিক তার আগেই ছিল একটা বাঁক, যেখানে হঠাৎ করে ট্রেন এসে গেলেও বোঝা যাবে না। তারা চিন্তা করেছিল, সবই তো এখন বন্ধ, সুতরাং এখন ট্রেন আসার কোনো সম্ভাবনাই নেই।
কিন্তু " মাটি কাটি দংশে সর্প আয়ুহীন জনে"। ওই সময় একটা মালগাড়ি ওই জায়গার উপর দিয়ে যাওয়ার কথা ছিল। নির্দিষ্ট সময়ে যখন মালগাড়ি টা ওই বাঁক অতিক্রম করে দ্রুত গতিতেএগিয়ে আসছিল, তখন পরিযায়ী শ্রমিকদের ওই দল সবে খাওয়া শুরু করেছিল। রামুই প্রথম ট্রেনটাকে দেখতে পায়। সে উঠে দাঁড়িয়ে হাত দেখিয়ে ট্রেনটা থামানোর চেষ্টাও করেছিল। কিন্তু ট্রেনের গতি বেশি থাকায় আর তাদের বিশ্রাম স্থান থেকে ওই বাঁকের দূরত্ব কম হওয়ায় ট্রেনটাকে তাদের বিশ্রাম স্থানের আগে চেষ্টা করেও থামানো গেলো না। ট্রেনটা ওই দলটার উপর দিয়ে চলে গেলো। মাত্র দুজন ছাড়া বাকি সবাই ট্রেনের ধাক্কায় মৃত্যুবরণ করলো। যারা বেঁচে রইলো তাদের মধ্যে একজন হলো রামু। চোখের সামনে তার বউ মেয়েকে ট্রেনের তলায় চলে যেতে দেখলে একজন মানুষের যে অবস্থা হওয়া উচিৎ, রামুর নিজেরই অবস্থা এতই করুন ছিলো যে বউ মেয়ের বিয়োগ ব্যথা অনুভব করার মতো অবস্থায় সে ছিল না। ট্রেন টা চলে যাওয়ার পর চারিদিকে ভর্তি রক্ত আর মাংসের দলা তার সঙ্গে খাবার রুটির টুকরো, আচারের ভাঙ্গা শিশি ইত্যাদি। তার মধ্যে বেঁচে থাকা লোকগুলোর যন্ত্রণা কাতর গোঙানির আওয়াজ আর কান্না। সারা রাত ওই ভাবেই পড়ে থাকার পর ভোর বেলা স্থানীয় লোকজন ওই দৃশ্য দেখে ছুটে আসে উদ্ধারের জন্য। পুলিশ খবর পেয়ে ছুটে আসে। বেঁচে থাকা লোক গুলোকে অ্যাম্বুলেন্সে করে হাসপাতালে পাঠানো হলো। পথে আরো একজনের মৃত্যু হলো। শুধু রামু হসপিটাল পর্যন্ত পৌঁছেছিল। সেখানে ভর্তি হওয়ার কয়েক ঘন্টার মধ্যে সেও চলে গেলো ইহলোক ছেড়ে।
শুরু হলো পরিযায়ী শ্রমিকদের মৃত্যু নিয়ে ব্রেকিং নিউজ, রাজনীতির ঠেলা ঠেলি আর বিভাগীয় তদন্তের দাবি। পরে অবশ্য বিভাগীয় তদন্ত হয়েছিল কিন্তু ড্রাইভার নেশাগ্রস্ত না থাকায় কেবল একটা অ্যাকসিডেন্ট এর চার্জ দিয়ে মাস তিনেক সাসপেন্ড করা হয়েছিল ওই ড্রাইভার সাহেবকে।
এরপর দেখতে দেখতে বছর ঘুরে গেলো। পরিযায়ী শ্রমিকদের ট্রেন অ্যাকসিডেন্টে মৃত্যু শুধুই রয়ে গেলো খবরের কাগজের পাতায়। আস্তে আস্তে মানুষ করণার বিপর্যয় সামলে উঠতে লাগলো, সব কিছু আস্তে আস্তে স্বাভাবিক হতে লাগলো, বাস, ট্রেন আবার সবকিছুই আগের মত চলতে লাগলো। মানুষ সব কিছু ভুলে গেলো। শুধু যারা মরলো তারা কিন্তু কোনো বিচার পেলো না।
পরের বছর শীতকালের ঘটনা। ওই ড্রাইভার সাহেব অনেকদিন হলো আবার ডিউটিতে যোগ দিয়েছেন। আবার তিনি চলেছেন ওই একই লাইনে মালগাড়ি নিয়ে। রাত তখন ১২ টা বাজে। ঠিক সেই বাঁকের মুখটা টপকে ড্রাইভার সাহেব ট্রেনের আলোতে দেখতে পেলেন রেললাইনের উপর বসে আছে জনা বিশেক লোক। আর একজন প্রাণপণে হাত দেখিয়ে ট্রেনটা থামাতে বলছে। বুকটা ধড়াস করে উঠলো ড্রাইভার সাহেবের।গতবারের স্মৃতি তাঁর মনে তখনও জীবন্ত। ঝেড়ে ব্রেক মারলেন তিনি। ট্রেন টা লাইনে আগুনের ফুলকি জ্বালিয়ে দাঁড়িয়ে গেলো লোকগুলোর হাত দশেক আগে। ড্রাইভার সাহেব পড়িমরি করে ট্রেন থেকে নেমে এলেন লোকগুলোকে একটু কড়া ভাষায় বোঝাবার জন্য। কিন্তু একি? কোথায় কি? কোনো লোকজন তো নেই? কেবল ড্রাইভার সাহেব একা দাঁড়িয়ে আছেন সেই অভিশপ্ত জায়গার হাত দশেক আগে। হঠাৎ তিনি শুনতে পেলেন কারো গোঙানির শব্দ, কেউ বা আবার কাদঁছে। একটু সাহস করে তিনি আস্তে আস্তে কয়েক পা এগোতেই শুনতে পেলেন স্ত্রী পুরুষ মিলিয়ে অনেকগুলো গলার খিল খিল হাসির শব্দ। এই প্রবল শীতেও ঘামতে লাগলেন ড্রাইভার সাহেব। তার হৃদস্পন্দন তখন ট্রেনের গতিতে ছুটছে। ছুটে এসে কাঁপা হাতে তিনি স্টার্ট দিলেন ট্রেনের। গতি বাড়িয়ে দ্রুত ওই স্থান থেকে দূরে চলে যাওয়ার চেষ্টা করলেন। কিন্তু শীতের কুয়াশায় লাইন স্পষ্ট দেখতে না পাওয়ায় মালগাড়ি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে উল্টে গেলো সেই অভিশপ্ত জায়গার আসেপাশে। ড্রাইভার সাহেব দম বন্ধ হয়ে মারা গেলেন ওই ট্রেনের মধ্যেই। পরের দিন আবার ব্রেকিং নিউজ বেরোলো কাগজে," আবার দুর্ঘটনা ঘটেছে সেই অভিশপ্ত জায়গায় যেখানে পরিযায়ীদের মৃত্যু ঘটেছিল।" তারা মনেহয় এইবার বিচার পেলো। আপনারা কি বলেন?
---------------------------
অঞ্জন রায় চৌধুরী
২২ শ্রীরাম শিরোমনি রোড
বহরমপুর
মুর্শিদাবাদ
পিন: ৭৪২১০১