০১
ক্যালেন্ডারে আজকে ২০শে বৈশাখ। আজ প্রায় একমাস বৃষ্টির লেশমাত্র নেই,
নিদেনপক্ষে একটু ঝড়ের ঝলক। কাল রাতে যদিও বা একটু মেঘ জমেছিল তাও কেটে
গেছে আজ সকালে। উপহার হিসেবে রেখে গেছে একরাশ গুমোট গরম।
ওই যে চাঁদনী পুকুরপাড়ে ভাঙ্গা ঘর মতো কি একটা দেখছেন না ! ওখানেই
পাওয়া যাবে ছেলেটাকে । এই মজা পুকুরের ভাঙ্গা ঘাটের কাছে জঙ্গলাকীর্ণ ঘরের
আবডালে ছেলেটা কি যে খুঁজে পায় কে জানে ! প্রতিদিন দুপুরে সবাই ঘুমালে ও
এখানে আসে এই নির্জনতায় সামিল হতে। পুকুরটা এখন শুষ্ক তবে বর্ষাকালে একটু
জল থাকে তখনও ছেলেটা আসে এই ভাঙ্গা ঘাটের জলে পা ছোঁয়াতে।
শোনা যায় একসময় এই পুকুর ছিল চৌধুরী বাড়ির। কোন এক জ্যোৎস্না রাতে এই
পুকুরের পাশ দিয়ে যাবার সময় পুকুরের গহীন জলে পূর্ণ চন্দ্রমাকে দেখতে
পেয়ে বড়বাবু এই পুকুরের নাম রেখেছিলেন "চাঁদনী পুকুর"। আজ পুকুরের যা
অবস্থা,ঘটি ডোবে না নামে তালপুকুর।
০২
এই পুকুরের পাশে এই প্রকৃতির নগ্ন নির্জনতায় ছেলেটা শোনে তার মনের
গভীরের কোন চিরঅচেনা শব্দ । ভাঙা শানের জায়গায় জায়গায় দাঁত বার করা
ইটের খোঁদলে ও খুঁজে পায় ইতিহাসের করুন বিষন্নতা। আজও যেন এই পুকুরের ঘাটে
লেগে আছে রক্তের দাগ। ও ঘটনাটা শুনেছে ঠাকুমার কাছে, ঠাকুমা শুনেছিল তার
মায়ের কাছে।
সে অনেক
দিনের কথা । সালটা ১৮৮৫-এর কাছাকাছি। দেউড়ির ঘড়ি বলল রাত একটা । বাড়ির
কর্তা তখনও বাড়ী ফেরেনি । কর্তামা সামনের দরজার খোলা পাল্লায় মাথা দিয়ে
বসে আছেন। ছোট বাবু বাড়ির মাঝখানের উঠোনটায় কপালে চিন্তার ভাঁজ ফেলে
মন্থর গতিতে হাঁটছেন। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। কোনার ঠাকুর ঘরে প্রদীপ
জ্বেলে চন্ডীর সামনে মাথা কুটছেন বড় গিন্নি। ইশারায় ছোটবাবু ছোট গিন্নিকে
কর্তামাকে ঘরে নিয়ে যেতে বললেন। তিনি যেতে নারাজ।
কি হলো যে বড়বাবুর ? আজ তো বাইজি বাড়ি বন্ধ , তাহলে এখনো তাহলে ফিরছেন
না কেন? সব দোষ ঐ মুখ পোড়া তেজ বাহাদুরের । সাধ করে খাস কলকাতা থেকে
ঘোড়াটাকে কিনে এনেছিলেন কর্তাবাবু। ব্যাটাকে আজকেই ছুটে পালাতে হলো এই ঘোর
অমাবস্যায় ! তাও এই ঘোর সন্ধ্যায়! এখন বাবু কোথায় খুঁজবেন ওটাকে?
এদিকে বড় বাবু লোক নিয়ে খুঁজতে বেরিয়েছেন।
০৩
ভোর হয়েছে। চৌধুরী বাড়ির ঠাকুর ঘরের দিককার শিউলি তলায় আজও ফুল পড়ে
আছে । শুধু আজকে কেউ কুড়ায়নি , এই যা পার্থক্য । সারা বাড়ি জুড়ে
কান্নার রেশ । একে একে সবাই আসছে নিথর বাবুকে দেখতে । শিওরে বড়গিন্নির
কাঁধে অশ্রু ভেজা চোখে মাথা দিয়ে আছেন ছোটগিন্নি ,চোখ ফুলে রক্ত জবা ।
কর্তামা প্রলাপ বকছেন , "......পই পই করে বলেছিলুম ওদের পুলিশে দিওনা... ছাড়বে না তোমাকে.... শুনলে না তো.....হায় ঠাকুর !"
ছেলেটা কেঁপে উঠলো । এই পুকুরের ধারেই তো বড় কর্তাকে..... উফ্! আর
ভাবতে পারছেনা... কেমন ভয় লাগে এসব ভাবলে । আজ আর ও পুকুরে নামেনি । একটু
আগেই এসব উল্টোপাল্টা ভেবেছে এখন পুকুরের ঘাটে পা দিলে বড়বাবু দেহ ওর
সামনে ভেসে উঠবে । এদিকে বিকেলের আকাশটা আজ মেঘলা। গম্ভীর ভাব চারিদিকে।
আবছা অন্ধকার। সামনে যেন সেই দিনের দৃশ্য ধীরে ধীরে ফুটে উঠছে ধার চকচকে
রামদা উঠছে আর নামছে পুকুরপাড়ের পাকুড় গাছটায় রক্তের ছিটে....
কয়েকফোঁটা পুকুরের জলে....করুণ আর্তনাদ...উহু! আর পারছে না । কাঁপ লেগে
যাচ্ছে ! মনে হচ্ছে কোন শীতল সরীসৃপ শিরদাঁড়া বেয়ে নেমে গেল । আকাশে
মেঘের গর্জন শোনা গেছে। পাতায় তখন ঝড়ের দোলা লেগেছে.....
০৪
খুব পা টিপে টিপে আজ ও এসেছে পুকুরঘাটে। চারিদিকে যা কাদা! কাল
রাতে গাঁয়ের রামু গোয়ালার গোয়ালের চালটা পড়ে গেছিল। সেই রাতে কি কান্ড!
আকাশের ওই অবস্থা তার ওপর এমন বৃষ্টি, দুটো গাই গরুকে নিয়ে কি যে
জ্বালায় পড়েছিল ! সকাল হতেই বোঝা গেছে সর্বনাশের বহরখানা । তা যাক সে
কথা, এখন দুপুরের সায়ান্ন বেলা। আকাশের অবস্থা কালকের মতই। আজকেও বোধহয়
কালকের ঘটনার পুনরাবৃত্তি হবে। কার পুজোয় দেবরাজ এত তুষ্ট হলেন কে জানে?
পুকুরে আজ অনেক খানি জল বেড়েছে । ভাঙ্গা ঘাটের শেষ দুটো সিঁড়ি জলে
ডুবে গেছে। চারিদিকটা কেমন ভেজা ভেজা । কেমন একটা সোদা গন্ধ লেগে আছে
বাতাসে। এই গন্ধটা ওর দারুন লাগে। কেমন যেন মোহমাখা ।এটা কি প্রকৃতির গন্ধ!
পুকুরের জলের ধারে ঘুরছে একটা ডাহুক পাখি। কাদায় তার ছোট ছোট পায়ের
ছাপ । ওর ছানাদের জন্য হয়তো খাবার খুঁজতে বেরিয়েছে । কি পাবে কে জানে
এই ঘোলা জলে।
পাড়ের
কাছে ধুতরা ফুলের গাছ। ফুলের উপর জলের বিন্দু । আজ সকালেও একটু বৃষ্টি
হয়েছে। পুকুরের জলটা কেমন শান্ত অথচ দেখো একটা ঢিল ছুড়লে এখনই গোল গোল
হয়ে কাঁপতে থাকবে। বিজ্ঞান কি বলে জানিনা কিন্তু এটা ওর দারুন লাগে । সব
জিনিসকে কাটাছেঁড়া না করেও দেখলেও বোধহয় মন্দ হয় না। মেঘ ডাকছে , আবার
কোথা থেকে বর্ষণের হালকা আমেজ ভেসে আসছে। মাথার ওপরে পুরনো আম গাছের পাতা
থেকে বিন্দু বিন্দু জল ঝরে পড়ছে ওর মুখে— মাথায় ....ওর মুখে মুচকি হাসি , -"আজ তবে আসি রে"–ও বলল।
কে এই ছেলেটা কে জানে ?
====================