গল্প।। রক্ষা কালী ।। উত্তম চক্রবর্তী
টাকা থাকলেই যে সুখ বা শান্তি থাকবে তার কোন গ্যারান্টি নেই। অনেকের টাকা আর শান্তি দুটোই আছে কিন্তু সুখ নেই। আবার অনেকের টাকা আছে সুখও আছে কিন্তু মনে শান্তি নেই। আর এরকমই একজন মানুষ অচিন্ত্য শিকদার, যার মনে কোন শান্তি নেই। কলকাতায় একটা বিশাল ইলেকট্রনিক্স দোকানের মালিক। এক মেয়ে আর এক ছেলে নিয়ে সুখের সংসার। মেয়ে বি.এ করছে, সবার ছোট আর আদরের। আর ছেলে এম. বি. এ করে বাবার ব্যবসায় হাত লাগিয়েছে। কিন্তু অচিন্ত্যর মনে শান্তি নেই।
আসলে অচিন্ত্যর স্ত্রীর হার্ট খুব দুর্বল। প্রায় দশ বছর যাবৎ ভুগছে অচিন্ত্যর পঞ্চাশ বছরের স্ত্রী বনানী শিকদার। বনানী এমনিতে শান্ত ধরনের মহিলা। কিন্তু রেগে গেলে ভয়ঙ্কর অবস্থা হয়। এই তো কয়েক মাস আগেই একটা সামান্য অপরাধে বাড়ির এতোদিনের কাজের মহিলা কুচকুচে কালো রঙের চল্লিশোর্ধ কালীকে মাসের মায়না হাতে ধরিয়ে দিয়ে বিদায় করে দিয়েছে। কালীর দেশ বর্ধমানের এক গ্রামে। স্বামী ভাগচাষী, দুটো মেয়ে নিয়ে ওদের ছোট গরীবের সংসার। স্ত্রীকে অনেক বুঝিয়েও কালীর চাকরিটা বাঁচাতে পারেনি অচিন্ত্য। কালী সেদিন কাঁদতে কাঁদতে দেশে ফিরে যায়।
অচিন্ত্য কলকাতার অনেক বড় বড় হাসপাতাল নার্সিং হোমে বনানীকে দেখিয়েছে, অনেক পরীক্ষা নিরীক্ষা করিয়ে ওষুধ পত্র সবই চলছে আজ দশ বছর যাবত। কিন্তু বনানীর অবস্থা দিনে দিনে আরও সঙ্গিন হয়ে উঠল। শেষে একদিন কলকাতার অ্যাপোলো হাসপাতালে ওকে ভর্তি করানো হল। ডাক্তাররা মেডিক্যাল বোর্ড বসিয়ে আলোচনা করে অবশেষে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন যে এখন কেউ যদি হার্ট ডোনেট করে তবেই সেই ব্যাক্তির মৃত্যুর পর তার জীবন্ত হার্ট ট্র্যান্সপ্লাণ্টেশন করে বনানীকে বাঁচানো যেতে পারে। এছাড়া আর কোনভাবেই রুগীকে বাঁচানো সম্ভব নয়। আজ আট দিন বনানী ভেনটিলেশনে আছে।
বর্ধমানের আগে বুদবুদ থেকে চার পাঁচ কিলোমিটার দুরে ন্যাশনাল হাই ওয়ের এক পাশে গ্রামে ওদের বাড়ি। বড় রাস্তার ঠিক ওপারে কালীর স্বামী দীনেশের ক্ষেত। কালী রোজ দুপুরে একটা ঝোলায় দীনেশের খাবার নিয়ে হাইওয়ে পার হয়ে ওপারের ক্ষেতে গিয়ে স্বামীকে খাবার দিয়ে আসে। হঠাৎ সেদিন কালী দুর থেকে ভীষণ স্পিডে ছুটে আসা একটা ট্রাকের নিচে পড়ে বড় একটা এক্সিডেন্ট করে বসল। ওর স্বামী দুর থেকে দেখে ছুটে আসে আর সঙ্গে আরও অন্যান্য চাষী ও রাস্তার লোক দৌড়ে আসে ঘটনাস্থলে। এ্যাম্বুলেন্সে করে কালীকে বর্ধমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। ওখানে ডাক্তাররা অনেক চেষ্টা করেন এই গরীব মহিলাটিকে বাঁচাতে। কিন্তু কালী ব্রেন ডেড হয়ে কোমায় চলে যায়।
কালীর স্বামী খুব উদার প্রকৃতির মানুষ। কালীকে আর বাঁচানো সম্ভব নয় বুঝতে পেরে ওর শরীরের গুরুত্বপূর্ণ অংশ গুলি সব দাণ করে দিতে চাইল। ডাক্তাররা কালীর স্বামীকে দিয়ে কাগজ পত্রে সই সাবুদ করিয়ে নিলেন। ওঁদের কাছে আগেই খবর ছিল কোন হাসপাতালে কার কোন অঙ্গের ট্র্যান্সপ্লাণ্টেশনের প্রয়োজন। কালী তিন দিন বাদেই শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করল পর বর্ধমান হাসপাতাল পুলিশের সাহায্যে গ্রীন করিডোরের সহায়তা নিয়ে কালীর হার্ট, দুটো কিডনি, লাং, চোখ সব পাঠিয়ে দিলেন কলকাতার বিভিন্ন হাসপাতালে। সেদিনই সন্ধ্যায় অপারেশন করে কালীর হার্ট বসিয়ে দেওয়া হল বনানীর দেহে। কয়েকদিন বাদেই সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরল বনানী।
বাড়ি ফিরেই স্বামীকে বলল, তুমি কালীকে ডেকে পাঠাও। আমি ওকে তাড়িয়ে দিয়ে খুব অন্যায় করেছি গো। আমার ওর অভিশাপ লেগে গিয়েছিল বোধহয়। ভাগ্যক্রমে আজ আমি বাড়ি ফিরে এসেছি।'
অচিন্ত্য শিকদার লোকজন লাগিয়ে খোঁজ নিয়ে জানতে পারলেন কালী এক্সিডেন্টে মারা গেছে আর ওরই হার্ট বসেছে তার স্ত্রী বনানীর দেহে। সেই খবর শুনে কান্নায় ভেঙে পড়ল বনানী।
--------শেষ---------