জামিল মিয়া সকাল থেকে ইট ভাঙছে। একাজে তার অভ্যাস নেই। প্রয়োজনটা এতই সত্য হয়ে গেছে যে, অনাভ্যাসকেও অভ্যাসে পরিণত করে ফেলেছে। হাতুড়ির আঘাতে আঘাতে বাম হাতের পাঁচটি আঙুলের মাথা রক্তাক্ত হয়ে গেছে। ইটের গুঁড়ায় গুঁড়ায় রক্ত বন্ধ হয়েও গেছে। আঙুলের রক্ত বন্ধ হলেও মনের রক্তক্ষরণ বন্ধ হয় না, কেউ দেখেও না, কেউ বোঝেও না।
প্রচণ্ড গরম। মাথার উপর সন্ত্রাসী সূর্য হিংস্রতা ছড়াচ্ছে। ছাতা মাথায় দিয়ে কাজ প্রত্যক্ষ করছেন ইউনুছ সাহেব। একজনের মাথায় ছাতা ধরে প্রকাশ করে করে দশজনের মাথার থেকে ছায়া কেড়ে নেয়ায় যার কাজ। শকুন কখনো শবের পাশে বসে দুধকলা দেয় না। জামিল মিয়াকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ববিতার আব্বা, এবার মেয়ে হলে নাম রাখবি শাবনূর।
জামিল মিয়া কথার মর্মার্থ না বুঝতে পেরে চুপ থাকে। তিন মেয়ে তার। শখ করে নাম রেখেছে ববিতা, সুচরিতা, চম্পা। বাংলা সিনেমা দেখে দেখেই বড় হয়েছে সে। সিনেমা দেখেই কেদেছে, হেসেছে। ভিলেন রাজীবকে সে খুব অপছন্দ করে।
ববিতা ঢাকা শহরে গার্মেন্টসে কাজ করে। সংসার তো তার টাকায় চলে। জামিল মিয়া সুচরিতাকে নিয়ে যেতে বলে। ববিতা বলে, ওরে পরামু বাজান।
ইউনুছ সাহেব আবার বললেন, ছেলে হলে তো কাজে লাগানো যেতো।
এলাকায় ইউনুছ সাহেবের রাজনৈতিক প্রভাব তুঙ্গে। ভয়ে কেউ মুখ তুলে কথা বলতে পারে না। মহল্লার যুবক ছেলেরা তাঁর হাতিয়ার। যখনই ডাকেন কাছে পান। আগে তিনি অনেক ভালো ছিলেন। চেহারায় কোনো পরিবর্তন হয়নি। কিন্তু কথায় খুব তীর্যকতা। মানুষ বদলে যাওয়ার আগে তার কথা বলার ধরন বদলে ফেলে।
জামিল মিয়া কাজ শেষ করে বাড়ি আসে। ছোট মেয়েটা কোলে এসে উঠে। সব বাবা ঘরে ফেরার সময় বাচ্চাদের জন্য মিষ্টি-খাবার আনে। সে কখনো আনতে পারে না। বুকে জড়িয়ে বসে থাকে। আশায় বুক বাঁধে, আশা না থাকলেও সবাইকে সে আশা দেয়। নিজে নিরাশার মধ্যে হাবুডুবু খায়, নিরাশার দোলাচলে দোদুল্য থেকেও সংসারের মানুষকে আশা দেয়, সান্ত্বনা দেয়। তার বৌ বললো, এবার ঈদে আমার তিন মাইয়ার জামা কিননা দিবেন।
জামিল মিয়া কিভাবে কিনবে বৌ তা ভাবতে চায় না। শখ আর স্বাধ প্রকাশের সময় মানুষ অন্যের সীমাবদ্ধতা আমলে নেয় না। জামিল মিয়া কী করবে? আশা দেয়। সারাদিন কাজ করে তিনশত টাকা হয়। চাল কিনবে কী দিয়ে আর তরকারি-লবণ কিনবে কী দিয়ে? শুধু বললো, শুচোরিতা স্কুলো গেছিলো?
যখন কোনো উত্তর এলো না তখন জামিল মিয়া কেমন কষ্ট অনুভব করলো। বাচ্চা স্কুলে গেলে তার যে কী ভালো লাগাটা কাজ করে ও বলে বোঝাতে পারবে না। যদিও তার মাথার মতো তার মেয়ের মাথায়ও গোবর আর ছাই।
ইউনুছ সাহেবের বাড়িতে কাজ শেষ। আবার সে চার রাস্তার মোড়ে চলে গেলো। চার রাস্তার মোড় যেটাকে সবাই শ্রম বেচা হাট বলে। কাজ না থাকলে ঐ শ্রম বেচা হাটে গেলেই কাজ জুটে যায়। রায়হান স্যার এসে তাকে কাজের জন্য নিয়ে গেলেন। প্রগতিমনা মানুষ। কাউকে সমালোচনা করতে পিছপা হন না। সরকারি দল, বিরোধী দল সবাইকে কথার বাণে জর্জরিত করেন। পাশ দিয়ে যখন কিছু আড্ডাবাজ ছেলে চলে গেলো তখন তিনি বললেন, বুঝলে জামিল, দিনের বেলা মিছিল, মিটিং আর রাতে আমার আম, লিচু চুরি।
যার বা যাদের কাছ থেকে যা তিনি প্রত্যাশা করেন তা যদি তার বা তাদের কাছ থেকে না দেখতে পান খুব ভেঙে পড়েন। কত ভালো ঘরের ছেলেগুলোও সামান্য স্বার্থের জন্য নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। বাধা দেন না, বুদ্ধিও দেন না, গা বাঁচিয়ে চলেন। অথচ তাদের জন্য মায়া, মানে মায়া কান্না।
রায়হান স্যার আবারও বললেন, আমরা আমাদের তরুণ প্রজন্মকে হারিয়ে ফেলছি।
জামিল মিয়া কী বলবে বুঝতে পারে না। রায়হান স্যার আবার বললেন, এই অপরিণামদর্শী ছেলেগুলোকে কিভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে দেখেছো?
জামিল মিয়া মূর্খের মতো চেয়ে থাকে। কিছুই বোঝে না সে। মন খারাপ রায়হান স্যারের। যদি কেউ ব্যবহৃত হচ্ছে, অথচ সে যে ব্যবহৃত হচ্ছে জানতে না পারে, তবে নিত্য ব্যবহার্য হয়ে উঠে। অত্যাবশ্যক ব্যবহার্য হয়ে উঠলে সে ঐ বলয় থেকে আর বের হতে পারে না। সেও ঐ বলয়কে আপন করে নেয়। একটা সময় পর্যন্ত তার ফল মিষ্টি হলেও একটা সময় পর তার যে তিক্ত ফল হাড়ে হাড়ে টের পায়। রায়হান স্যার আবার বললেন, বোধ থাকতে মানুষ বোধের প্রয়োজনীতা বোঝে না, বিবেকের সঠিক প্রয়োগ করে না। বোধ-বিবেকে যখন পঁচন বুঝতে পারে তখন নির্বোধ হয়ে বসে পড়ে।
জামিল মিয়া চেয়ে থাকলো। আলোচনা সু্বিধা হবে না দেখে রায়হান স্যার ভেতরে চলে গেলেন। জামিল মিয়া একনিষ্ঠচিত্তে কাজ করতে থাকলো। কাজের প্রতি মায়া তার, কাজ যে তাকে অন্ন দেয়।
ববিতার সাথে জামিল মিয়ার নিয়মিত কথা হয়। বড় মেয়ে। বংশের প্রদীপ জ্বেলে প্রথম এসেছিলো। অন্য দুটি মেয়ের চেয়ে বেশি আদর পেয়ে মানুষ হয়েছে। অন্য দুটি কাছে থাকে তাই ববিতার জন্য বুকটা বেশি পোড়ে। মানুষ যখন ববিতার আব্বা বলে ডাকে ববিতার মুখটা তখন সামনে ভেসে উঠে। একদিন মেয়ে বললো, বাজান, মালিকেরা গাল পাড়ে। অপমান করে। আবার আমরা যারা এক লগে কাম করি, তারা মিছিল করতে ডাহে।
জামিল মিয়া মেয়েকে সাবধান করে দেয়। মানুষ বিপদে পড়লে জামিল মিয়ার মাথায় বুদ্ধি আসে না। অথচ মেয়ের মুখের কথা শুনামাত্রই পিতার মাথায় কোথা থেকে বুদ্ধি এসে জড়ো হলো। সন্তানকে আশ্রয়-প্রশ্রয়, সান্ত্বনা দিতে মা বাবাকে শিক্ষিত হতে হয় না৷ বুদ্ধিহীন গরুও বুদ্ধি দিয়ে তার বাছুরকে রক্ষা করে।
জামিল মিয়া বলে, মা, কাম করবি, বারিত ফিরবি। কারো লগে যাবি না।
আব্বার কাছ থেকে মোবাইল নিয়ে সুচরিতা বলে, বু, এবার আমারে একটা লাল জামা কিননা দিবি?
বড় বোনের প্রতি বোনের আবদারের শেষ নেই। বড় বোন কাজ করে, কাজ করলে ভাগ্যের পরিবর্তন হয়। কত ইনকাম করে সে খেয়াল কারো নেই। সবাই তার উপর নির্ভর করে। এই আবদার, এই নির্ভরতা এমনিতেই জন্মে, সৃষ্টি হয়।
জামিল মিয়া মেয়ের কাছ থেকে মোবাইল কেড়ে নিয়ে বলে, মা, তুই আহনের সময় কিচ্ছু কিনবি না। ট্যাকাডি আনবি। একটা গরু কিনমু। তোর মায়ে পালবো।
এভাবে কথা চলতে থাকে। এর মধ্যে মোমিন সাহেব এলেন। কোণঠাসা হয়ে আছেন। দল ক্ষমতায় নেই। মুখ ফুঁটে না বললেও সারাদিন মনে মনে সরকারি দলের হঠাৎ পতন কামনা করেন। জামিল মিয়াকে বললেন, জামিল, কাজ করে দিবি?
জামিল মিয়া মোমিন সাহেবের কথায় রাজি হয়ে কাজে গেলো। ঘর থেকে মোমিন সাহেব বেশি বের হন না। জামিল মিয়াকে পেয়ে মনের দুঃখ খুলে বলছেন। বললেন, রাজনীতি করার আর উপায় নেই। সরকারের কাজ-কর্ম নেই, আমাদের দমন-পীড়ন নিয়েই আছে।
জামিল মিয়া বুঝতে পারলো না, মোমিন সাহেবকে সরকার কখন দমন করতে এলো। ও কাজ করতে থাকে। মোমিন সাহেব আবার বললেন, সভা-সমাবেশ করতে পারছি না, মিছিল-মিটিং করতে পারছি না। দলের জন্য কিছু করতে পারছি না।
জামিল মিয়া ভাবে, সারাদিন কাম কইরাও সংসারের লইগা কিছু করতে পারতাছি না। আর হেয় আছেন দলের লইগা কিছু করনের লইগা।
কাজ শেষে জামিল মিয়া বাসায় ফিরছিলো। রায়হান স্যার বাসায় ফিরছিলেন। জামিল মিয়াকে ডেকে গতদিনের কাজ করার জন্য টাকা দিলেন। দিয়ে বললেন, জামিল কাগজ পড়ি, টেলিভিশন দেখি। সবাই সাধু। ক্ষমতায় যেই যায় সেই রাবণ হয়। বিরোধী দলে থাকলে সব দেবতা হয়।
জামিল মিয়া প্রশ্নিল চোখে তাকায়। রাবণ, দেবতা কিছুই বুঝলো না। রায়হান স্যার আবার বললেন, রুই-কাতলার মতো বোয়ালের সাথে যদি টাকিও যোগ দেয় তবে পুঁটির কি অবস্থা হবে ভেবে দেখেছো?
জামিল মিয়ার মাথা ঘুলিয়ে গেছে, রুই-কাতলা, টাকি, বোয়াল আর পুঁটির কথা শুনে।
রায়হান স্যার জামিল মিয়ার চুপ থাকা দেখে বললেন, চলো, তুমি বুঝবে না। এসব তোমাকে জানতে হবে না। জানলে তুমিও ভেঙে পড়বে।
অনেক কিছু না জানায় ভালো। জানলে যন্ত্রণা বাড়ে। জানলে জীবন যাপনে বিঘ্ন ঘটে। জানলে সুস্থ মানুষও অসুস্থ হয়ে পড়ে। বেশি জানেওয়ালা মানুষই মানসিক রোগী, অসুখী। না-জানেওয়ালাদের মানসিক পীড়া নেই। বরং জানলেই গন্তব্যে পৌঁছাতে মনোবল অটুট থাকে না। হাজার ভাবনা পেয়ে বসে।
জামিল মিয়ার মনে প্রশ্ন কাজ করতে থাকলো। আর নিজের মূর্খতাকে দায়ী করতে থাকলো। শিক্ষিত লোকের এতো ভারী কথা ওর মাথায় খেললো না।
বাড়ি ফেরার সময় জসিম, জামালদের সাথে দেখা, তারা বললো, জামিল কাকা, রায়হান স্যার, বৃহস্পতিবার কলেজ মাঠে সমাবেশ হবে। উপর থেকে নেতারা আসবেন তৃণমূল নেতাদের মধ্যে শক্তি সঞ্চারের জন্য। ইউনুছ ভাইয়ের পক্ষ থেকে আমরা মিছিল নিয়ে যাবো। আপনারা সাথে থাকবেন।
ওরা দ্রুত চলে গেলো। জামিল মিয়া বললো, বেবাক মানুষ একখানে হইলে ভালা লাগে। মেলা মেলা ভাব লাগে।
রায়হান স্যার বললেন, তোমার পেটের ভাতের সন্ধান করো, মিছিল-মিটিংয়ে যেয়ে লাভ নেই।
জামিল মিয়া হ্যাঁ-সূচক মাথা ঝাঁকালো। অন্নের প্রয়োজন যাদের, অন্যজ্ঞান তাদের করা ঠিক না। তাদের অন্ন অণ্বেষণের চেষ্টা করাটায় অনন্য বুদ্ধিমত্তার কাজ। অন্নহীনে কেউ অন্ন দেয় না। কারণ বিজ্ঞরা অন্নহীন খুঁজে দারিদ্র্যকে বিজ্ঞাপিত করেন না।
জামিল মিয়া ক্ষমার ভঙ্গিতে বললো, স্যার, মিছিল-মিটিংয়ে আমি কখখনো যামু না।
সপ্তাহে প্রতিদিন কাজ চলে না, যে সংসারে লবণ আনতে পান্তা ফুরায় সে সংসারে কাজ বন্ধ থাকলে আর রক্ষা থাকে না। রোগ হলেও সমস্যা নেই, কিন্তু কাজ থাকতে হবে। শ্রমজীবীদের রোগ বলে কিছু নেই। আবার কাজ করলে টাকা পেতে লেগে যায় কয়েক সপ্তাহ। দিন এনে দিন খাওয়া মানুষের পাওনা টাকা যারা আটকে রাখে তারা কোন আত্মার মানুষ! ইউনুছ সাহেবের বাড়ি গেলো, ইউনুছ বাই, আমার ট্যাকাটা যদি দ্যান...
জামিল মিয়া কথা শেষ করতে পারিনি, তার আগে ইউনুছ সাহেবের বৌ দুই ঠোঁটে তর্জনী চেপে ডাকতে বারণ করলেন। এমন ভাব করলেন যেন তাঁর স্বামী মন্ত্রী-এমপিদের সাথে জরুরি বৈঠক করছেন। জামিল মিয়া কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে বললো, ভাবী, কামের ট্যাকা যদি দিতেন...
ভাবী বললেন, তোমার ভাই খবর শুনছেন। এখন কোনো কথা বলবেন না। কাল এসো।
তখনই ইউনুছ সাহেব মোবাইল কানে বাইরে বের হয়ে এলেন, জ্যি স্যার, পারবো। আমি পাঁচশত জন ডেলিভারি দিতে পারবো।
ঐ পাশের স্যার বললেন, পাঁচশত জনে সমাবেশ জমবে না। আপনার দায়িত্ব এক হাজার।
ইউনুছ সাহেব উপরের নেতাকে আশ্বস্ত করলেন। তিনি হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন দল চালানো যা তা কথা নয়। প্রাণের থেকে দল কেউ করে না। স্বার্থের লোভে সবাই দৌড়ায়। পদ পেতে অর্থ, পদ পেলে অর্থ আর অর্থ। তাই পদ টিকিয়ে রাখতেও শুধু অর্থ।
স্ত্রী বললেন, জামিল টাকার জন্য দাঁড়িয়ে।
ইউনুছ সাহেবের মাথা গরম। অনেক দায়িত্ব কাঁধে। বললেন, বাড়ি যা জামিল। তিনশত টাকার জন্য বাড়ির উপর এসেছিস! যা, বাড়ি যা।
স্ত্রী বললেন, জামিলের অনটনের সংসার!
ইউনুছ সাহেব রেগে গেলেন, এতো দরদ লাগলে হাতের সোনার বালা দিয়ে দাও।
জামিল মিয়া অবস্থা অনুকূল না দেখে চলে গেলো। পাওনা টাকা চেয়েও যে পাওনাদার বিব্রত হয় সেই সমাজে বাস করা দূর্বিষহ হবে। যে শ্রমিক ঘাম ঝরিয়ে সেবা দেয় তার ঘামের দাম অর্থে হয় না, সাথে সান্ত্বনা আর সহমর্মিতাও দিতে হয়। দিতে হয় ভালোবাসাও।
ইউনুছ সাহেব স্ত্রীকে বললেন, এক হাজার জনতা আমাকে দিতে হবে। দল ক্ষমতায়, তাও কেউ মাগনা যাবে না। কেউ বিনা পয়সায় কোনো দিন গেছে? প্রচুর অর্থ দরকার। সান্ত্বনা দাও, মাথা বিগড়ে দিও না।
উপর থেকে নেতারা আসার কথা শুনলেই ইউনুছ সাহেবের নাওয়া খাওয়া থাকে না। আবার টেলিভিশন অন করলেন। কোন নেতা কি বলছেন তা মনোযোগ দিয়ে শুনছেন। নিজ দলের এক এক নেতার এক এক কথা তার কাছে অনুপ্রেরণা, উপদেশ ন্যায়। দলকে মনে প্রাণে ভালোবাসলে এমনি ভাব সবারই হয়।
জামিল মিয়া বাড়ি এলো। বৌকে শুকনো মুখে বললো, ইউনুছ বাইয়ের ট্যাকা আছে, বারি আছে, জমি আছে, হেইতে তয় এতো দৌরাদৌরি করেন ক্যান? সম্মানি মানুষ কিন্তু আমার অপছন্দের মানুষডির হেইতের বারি এতো আসোন যাওয়ন ক্যান? শিমুল চাচার গুণ্ডা পোলা ঐ যে বৌ পিঠায়া মাইরা ফালাইছে, হেয়ও দেহি ইউনুছ বাইয়ের পিছে পিছে গুরে।
বৌ ভাত খেতে দেয়। বড় মানুষদের নিয়ে ওদের ভাবার সময় নেই। মেজ মেয়েটা আবদার করে, বাজান, আমারে লাল জামা কিননা দিবা না?
জামিল মিয়া হেসে বললো, দিমু। এখন যা। খেলগা।
অন্যদিন ফেরার পথে মোমিন সাহেবের সাথে দেখা জামিল মিয়ার। মোমিন সাহেব হঠাৎ বলে বসলেন, সাপ কখন সোজা হয় জানো?
হঠাৎ এমন প্রশ্নে দ্বিধান্বিত হলো জামিল মিয়া। প্রশ্নিল চোখে চেয়ে থাকলো। মোমিন সাহেব আবার বললেন, বেশি আটলে রশি ছিঁড়ে যায়, বেশি চিপলে লেবু তিতো হয়, বেশি চুলকালে ঘা বাড়ে, বেশি বাড়লে ঝড়ে ভাঙে। কোনো বেশিই ভালো না। সর্বশ্রেষ্ঠ উক্তি, আলোচনা।
হা করে কথাগুলো জামিল মিয়া শুনলো। কথাগুলো গুরুত্বপূর্ণ সে বুঝতে পারছে। কিন্তু কোন বিষয়ে ধরতে পারছে না। বললো, এডি কিয়ের লইগা কন?
মোমিন সাহেব চশমা খুলে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন, ঢাকার খবর জানো?
ঢাকার খবর রাখার কোনো প্রয়োজন আছে বলে জামিল মিয়া মনে করে না। গাঁয়ের খবর রাখার সময় নেই যার, পরগাঁয়ের খোঁজ কেনইবা রাখবে সে। জামিল মিয়া মিষ্টি হেসে উত্তর দিলো, ঢাহা তো অনেক দূর! ববিতা কয় একদিন লাগে যাইতে!
জামিল মিয়া যে উনার কথা বুঝতে পারছে না, তিনি বুঝতে পেরেছেন। তবুও বলছেন। মনের ক্ষোভ প্রকাশ করলে মনের ক্ষোভ কমে। জামিল মিয়া যে বুঝতে পারছে না, ও যে বোঝার চেষ্টাও করছে না মোমিন সাহেব বুঝতে পেরেও বলে চলেছেন। যাকে যা বলা দরকার তাকে তা না বলাও বোকামি। কিন্তু মনের মধ্যের জমা কথাগুলো না বলতে পারলে অস্থিরতা কাজ করে। তাই যাকে সামনে পান দল ও মতের মনে করলে তাকেই মনের কথা খুলে বলেন। মন ভার কমে, হিংসাত্মক মনোভাবও কমে। বললেন, শাসনের নামে কেউ অপশাসন পছন্দ করে জামিল?
জামিল মিয়া অপশাসন কি তাই বোঝে না। সে তো চাল-ডালে ভালই চলছে। কেউ তো কাঁধে বাড়ি মারছে না। মোমিন সাহেব আবার বললেন, আমাদের নেতা-কর্মীদের মিথ্যা মামলা দিয়ে গ্রেফতার করছে। একজন কর্মী হিসেবে বসে বসে দেখছি।
মামলা, গ্রেফতার এসব কথা শুনামাত্র জামিল ভয় পেয়ে গেলো। মোমিন সাহেব বলেই চলেছেন, মাটি কামড়েও বেঁচে থাকতে পারছি না। দল ক্ষমতায় গেলে পইপই করে শোধ নেবো। দেশের আপামর জনগণের মত-ইচ্ছাকে সরকার মূল্যই দিচ্ছেন না। আমরাও তো দেশের জনগণ! আমাদের মতের কী মূল্য নেই?
জামিল মিয়া চুপ থাকে। মোমিন সাহেব বুঝতে পারলেন, তিনি এতক্ষণ উলুবনে মুক্তো ছড়িয়েছেন। তিনি দ্রুত পায়ে হেটে চলে গেলেন। জামিল মিয়া নিজে নিজে বোঝার চেষ্টা করলো। জ্ঞানীদের পাশে গেলে নিজেকে খুব ধিক্কৃত মনে হয়। দুজনের শরীরের গন্ধেও আকাশ-পাতালের পার্থক্য। একজন পেট নিয়ে ভাবছে, অন্যজন দেশ নিয়ে। পেট নিয়ে যে ভাবছে সে কাজ করে দেশের উন্নয়নে ভূমিকা রাখছে। আর যিনি দেশ নিয়ে ভাবছেন তিনি কোনো কাজই করছেন না। দেশকে যারা টেনে নিয়ে যাচ্ছে তাদের সমালোচনায় ব্যস্ত।
জামিল মিয়া নিজেকে সান্ত্বনা দিলো। ওতো ভেবে লাভ নেই। তার ভেজা ভাতে লবণ চায়। তার জন্য কাজ চায়। যে যে অবস্থানে আছে সেখান থেকে সে সে কাজ একনিষ্ঠভাবে করলে তারচেয়ে বড় দেশপ্রেম আর কি আছে?
সবাই মিলে টেলিভিশনে বাংলা সিনেমা দেখছে। সিনেমা শুরুর আগে তারা একে অন্যের সাথে বাজি ধরেছিলো আজ সিনেমার নায়ক-নায়িকা কে কে হবে এই নিয়ে। যে জিতেছে সে নিজেকে খুব করে উপস্থাপন করছে। আর দুই মিনিট বাকি আছে, হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এলেন রায়হান স্যার। জামিল মিয়াকে বললেন, বাসা যেতে যেতে খবর শেষ হয়ে যাবে। ভাই, খবরে দাও।
জামিল মিয়া রায়হান স্যারের কথা ফেলতে পারেন না, অভদ্রতা হবে। তাই অনিচ্ছা সত্ত্বেও খবরে দিলো। যারা টানটান উত্তেজনাকর সিনেমার মুহূর্ত উপভোগ করছিলো তাদের মধ্যে হট্টগোল বাধলো। ওদের মতো যারা নিছক বিনোদনে বিশ্বাসী তারা কখনই কোনো কালে খবরে গুরুত্ব দেয়নি। ওরা খবরের কিছু বোঝে না। ঢাকার চালচিত্র টেলিভিশন পর্দায় দেখানো হচ্ছে যা সিনেমার চিত্রকেও হার মানাচ্ছে। রায়হান স্যার বললেন, দেখেছো? একি অবস্থা দেশের!
জামিল মিয়া বললো, পুলিশে গুল্লি করে ক্যান?
রায়হান স্যার মাথার চুল উসকো ভুসকো করতে করতে চলে গেলেন। জামিল মিয়া আবার সিনেমাতে ফিরলো। দর্শকরা সব চুপ হয়ে গেলো। জামিল মিয়া মনে মনে বললো, ঢাহার খবর লইয়া আমার কি হইবো? ওডি দেখনের লইগা কি টিভি কিনছি?
খেটে খাওয়া দিন-মজুর এই মানুষদের যদি কাজ চলে তবে প্রতিটি দিনই মহা-আনন্দের। ঝুট-ঝামেলা বোঝে না। ঝুট-ঝামেলায় ঢোকে না। নিজেরা নিজেরা প্রতিদিনই ঝগড়া করে সামান্য বিষয় নিয়ে। কারো বিচার করা লাগে না৷ নিজেরা নিজেরা মিলে আবার এক হয়ে যায়।
পরদিন জামিল মিয়া নাকে মুখে দুটো খেয়ে, চুলে পানি ছিটানি দিয়ে চিরুনি করে চৌরাস্তার মোড়ে চলে গেলো। দাঁত মাজে না, দাঁত মাজার সময় নেই। দাঁত মাজা নাকি বড় লোকের কাজ। তার নিজের বাবাও কোনো দিন দাঁত মাজেননি। বৃদ্ধ বয়সে তবুও মাংস চিবিয়ে খেতেন। চৌরাস্তার মোড়ে আব্বাস, কদম আলীও এসে বসে আছে। শ্রম বেচা হাটের শ্রমিকরা অধীর অপেক্ষায় বসে থাকে কখন বিক্রি হবে। দেখতে জোয়ান আর শক্ত মনে হয় যাদের তারা আগে বিক্রি হয়ে যায়। পরে বিক্রি হয় জীর্ণ দেহের শ্রমিকগুলো। শেষে বিক্রি হয় বয়স্করা। এক ক্ষেতওয়ালা এসে সুরত আলী আর মহিনকে নিয়ে গেছেন। আর একজন ক্ষেতওয়ালা তাঁর জমি কুপাবেন। জামিল মিয়ার কোদাল নেই, তাই সে কাজে যেতে পারলো না। কাজ করার যন্ত্রপাতি না থাকলে দুটি শক্ত-সমত্থ হাতের মূল্য থাকে না। আজকে চার জনের কাজের কোনো সংস্থান হলো না, তার মধ্যে জামিল মিয়াও একজন। কাজ না পেলে কাজহীন মানুষগুলো বিশ্রামকে অভিশাপ মনে করে। কর্মহীন থাকা মানে অন্নহীন থাকা। চার জনের সংসারে ক্ষুধার একটু বাড়াবাড়ি। পেটে ক্ষুধা এদেরই বেশি। তিনবেলা পেট পুরে খেলেও ক্ষুধা লাগে। আর ধনীরা একমুঠো খান। ক্ষুধা লাগে না। ব্যায়াম করে ক্ষুধা লাগান। এই শ্রমজীবী মানুষগুলোর যদি কাজ না থাকে তবে মহা-সমস্যা হয়ে যায়। এই মানুষগুলোর কর্মই কেবল, কোনো ফল পায় না। ওদের হৃদয় ভাঙার শব্দ কেউ শোনে না। ওরা হৃদয় ভাঙার শব্দ কাউকে বলেও না। খেয়ে পরে বেঁচে থাকলেই ওদের ঢের প্রাপ্তি। উচ্চাশা নেই দালানবাড়ি আর মাংস ভাতের।
একে অন্যের বিড়ির আগুন নিয়ে পাঁচজন বিড়ি টানতে লাগলো। বড় ব্যস্তস্থল এই চার রাস্তার মোড়। কত ভদ্রলোকের চলাফেরা। থুথু ফেলার সময়ই কেবল তাদের দিকে ভদ্র সমাজ তাকান। তবুও তাদের আক্ষেপ নেই। একে অন্যের সাথে গল্প করে সংসারের হাল-হকিলত বর্ণনা করে সময় কাটে। কেউ বেশি স্বপ্ন দেখে না। অলীক স্বপ্ন দুঃখের কারণ। অল্প প্রাপ্তিতে পরম আত্মপ্রসাদ পায় ওরা। জীবনহীন জীবন নিয়ে জীবন চলছে, কোনো খেদ নেই।
মহিন ও সুরত আলীর যদিও একটানা এক সপ্তাহ কাজ চললো কিন্তু জামিল মিয়ার কাজ চললো চারদিন। জিনিসপত্রের যে দাম তাতে তার দফারফা অবস্থা। জামিল মিয়া কেনো কাজ পেলো না সে কিছুটা বুঝতে পারলেও পুরোটা বুঝতে পারলো না। তার আব্বা তাকে বলে গেছেন, আব্বা, কাজে যায়বা পাঁচ মিনিট আগে, কাজ থেইকা ফিরবা পাঁচ মিনিট পরে। এতে তোমার বেশি কষ্ট হইবো না। কিন্তু মালিকের ভালোবাসা পাইবা। সবার আগে মানুষ তোমারে কাজে নিবো।
অর্থাভাবে জামিল মিয়া নিজের হাতে অতি যত্নে পালন করা ছাগলটা বিক্রি করে দিলো। পাড়ার মৈজুদ্দিন মোল্লা বললো, ছাগলডা না বিক্রি করলে পারতিস না?
জামিল মিয়া বললো, ছাগলডার বাচ্চা হয় না।
অন্যদিন কাজ শেষে বাড়ি ফেরার পথে জামিল মিয়া দেখলো কলেজ মাঠে সমাবেশ হচ্ছে। লোকে লোকারণ্য। জামিল মিয়া ভেবেই পায় না তিন বেলা কাজ করেও সংসার চলে না। এত মানুষ এখানে ভিড় করে কি করে! কি লাভ! ওদের কি কোনো কাজ নেই? ওদের সংসার কি করে চলে? কিসে চলে?
নেতারা জ্বালাময়ী ভাষণ দিচ্ছেন। জামিল মিয়া একটু উঁকি মেরে দেখার চেষ্টা করে বাড়ি চলে এলো।
সাবের সাহেবের পুকুর খননের কাজ পেলো ওরা। সবার মুখে হাসি ফুঁটলো। ধার করে জামিল মিয়া একটা কোদাল কিনলো, ঝুড়ি কিনলো। কাজে লেগে গেলো। কিসের রোদ, কিসের কষ্ট আর স্বপ্ন! ওদের স্বপ্নজানালার পরিধি কতটুকুই বা বিস্তৃত! ওদের স্বপ্নের জানালার ফুঁটো দিয়ে আর কতটুকুই বা আলো পৌঁছায়! সকালে এক মুঠো খেয়ে সারাদিন মাটি কাটা কাজ। জীবন কারে বলে...
ইউনুছ সাহেবের সাথে রায়হান স্যারের দেখা। রায়হান স্যারকে ইউনুছ সাহেব খুব সম্মান করেন কারণ নিজের ছেলেটা তাঁর কাছে পড়ে। ইউনুছ সাহেব বললেন, গতকাল কলেজ মাঠে বিশাল জন-সমাবেশ করলাম। সরকারের প্রতি, আমার দলের প্রতি জনসমর্থন জ্যামিতিক হারে বেড়েছে।
রায়হান সাহেব বললেন, হ্যাঁ তা ঠিক। সরকার যে জন-কল্যাণমূলক কাজ করে চলেছেন জন-সমর্থন বাড়বে বৈ কমবে না৷ এতো ভালো সরকার এর আগে আমরা কখনো পাইনি।
ইউনুছ সাহেব বললেন, কিন্তু বিরোধী দলের চোখে ছানি পড়েছে। কিছু চোখে দেখে না। এক একটা অজুহাত তুলে তুলে দেশকে অস্থিতিশীল করছে। হরতাল ডাকছে।
রায়হান স্যার বললেন, ভালো কাজ মানুষের চোখে কম পড়ে। ভালো কাজ যেই করুক মানুষ ভালো চোখে নেয় না। মানুষ খুবই অতীতপ্রিয়। অতীতই ভালো ছিলো ভাবে।
সাবের সাহেবের পুকুর খননের কাজ শেষ। দুই দিন ডাল ভাত খেলো। হাঘরের জন্য পোলাওয়ের গন্ধ পোলাওয়ের চেয়ে অনেক কিছু। নিজে কুঁজো হয়ে গেলেও স্বপ্ন কুঁজো হয় না, স্বপ্নকে কুঁজো হতে দেয়াও ঠিক না। স্বপ্ন ছোঁয়ার সোল্লাসে দিন কেটে যায়।
আবার তারা চৌরাস্তার মোড়ে ফিরে এলো। দূর দূর থেকে ক্ষেতওয়ালারা এসে তাদের নিয়ে যান। যখন যে কাজ তখন সে কাজ করে, সব কাজে তারা পারদর্শী। কখনো ধানকাটা, পাট কাটা, ক্ষেত নিড়ানো, কখনো বা ঘর রং করা। অর্থওয়ালা সাহেবদের অপেক্ষায় তাদের দিন কেটে যায়।
এখন কাজের মৌসুম। তাই তো সবার গোঁফে হাসি। কদম আলী পেয়ে গেলো দারুন একটা কাজ। তা হলো লোডিং ট্রাকের রশি বাঁধা কাজ। অন্য শ্রমিক বন্ধুরা বললো, তুই তো হাতে চাঁদ পাইলি...
এরি মধ্যে দেশে বেঁধে গেলো ডামাডোল। হরতালের পর হরতাল। রায়হান স্যার যাকে দেখেন তাকেই সামনে দাঁড় করিয়ে দেশের খবর দেন। মোমিন সাহেব একদিন সামনে পড়লো। মোমিন সাহেবকে কিছু বলার আগেই মোমিন সাহেব বললেন, দল এতদিনে হার্ডলাইনে গেছে৷ সঠিক কর্মসূচিই দেছে। হরতাল আরো আগে দেয়া উচিত ছিলো।
রায়হান স্যার বললেন, ক্ষমতার জ্যাকেট পরে যা ইচ্ছা তাই করা ঠিক নয়। বিরোধী দলের দমন-পীড়ন কখনোই ঠিক নয়। হরতাল ডেকে বিরোধী দল ঠিকই করেছে। সরকারের চোখে আঙুল নেড়ে নেড়ে সরকারের ভুল দেখিয়ে দিলেও সরকার বোঝে না।
রায়হান স্যারের কথা শুনে মোমিন সাহেব খুশি হয়ে চলে গেলেন। খুব ব্যতিব্যস্ত যেন তিনি।
হরতালের কোপে সবাই দিশেহারা। জামিল, মহিন থেকে যাচ্ছে অবিক্রিত। কেউ তাদের কিনতে আসছে না। কাজ না থাকলে তাদের মাথায় পড়ে বাজ। একদিন কাজ থাকে তো তিন দিন থাকে না। ইনকাম হলে পেটে ভাত, না হলে মাথায় হাত।
একদিন এক টেলিভিশন চ্যানেলের সাংবাদিক এলেন শ্রমজীবী মানুষের সাক্ষাৎকার নেয়ার জন্য। পেটে অন্ন না থাকলেও টেলিভিশনে তাদের দেখা যাবে এতে তারা বেশ আনন্দিত। গ্রামের সব মানুষকে ডেকে নিয়ে এসে জামিল মিয়া বললো, টিভিতে কথা বলছি, খবরে দেখাইবো।
এরপর একে একে প্রিন্ট মিডিয়ার সাংবাদিকরাও খেটে খাওয়া দিন-মজুরদের সাক্ষাৎকার নিতে এলেন। হরতাল যেন তাদের নায়ক বানিয়ে ফেলেছে।
নির্ভেজাল মানুষগুলোর দুর্দিনের শেষ নেই। সংসারে রোগ-বালাই লেগেই থাকে। একে তো কাজ নেই তার উপর হরতাল, মিছিল, মিটিং। শহরে জ্বালাও, পোড়াও হচ্ছে তারাও শুনছে। সে সহিংসতা দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ছে। অলিতে গলিতে রাজপথে মিছিল, মিটিং হচ্ছে। চৌরাস্তার মোড়ে বসে থাকতে তাদের ভয় লাগে। পুলিশের মহড়া বেড়ে গেছে। আব্বাস বললো, আমরা দিন-মজুর, আমাদের কিসের ডর? আমাগো কে কী কইবো?
জামিল মিয়া বললো, আমাগো মাইরা উদ্ধার পাওয়ন সহজ, হেইডা কী জানোস?
আরো কিছু দিন গেলো। রাজনৈতিক অস্থিরতা বাড়তে লাগলো। নতুন নতুন আন্দোলনের ঘোষণা আসছে। শহর জুড়ে থমথমে অবস্থা। সব কিছুকে তোয়াক্কা করে শ্রম বেচা হাট চৌরাস্তার মোড়ে তাদের আসতে হয়।
শহর বা গ্রাম কোথাও বাদ নেই এই ডামাডোলের। জামাল, জসিম ওরা এসে বললো, চলেন হরতাল বিরোধী মিছিলে যাই।
আব্বাস, মহিন, জামিল মিয়া সমস্বরে বললো, গরীব মানুষ, আমরা এ সবের মইধ্যে নাইগা। এসবের কিছু বুঝি না।
জসিম বললো, হরতালের জন্য আপনাদের কাজ-কর্ম নেই। তবে হরতাল প্রতিরোধে মাঠে নামবেন না কেনো?
সুরুত আলী, কদম আলী, রবু, তারা মিয়া বললো, বাই, আমাগো এই সবে ডাইকেন না। মাফ চাই।
ছেলেগুলো রেগে গেলো। এমন ফাঁপা বুলিতে কোনো কাজ হবে না। তাই জামাল বললো, হরতাল বিরোধী মিছিলে না গেলে এখানে বসতে দেবো না।
এভাবে ধমক দিয়ে ওরা চলে গেলো। শ্রমজীবী মানুষগুলো ধমক ভয় পায় না, ভয় পায় ক্ষুধাকে। সর্বভূক ক্ষুধা পেটে। ক্ষুধার পোকারা থেকে থেকে ঘাই মারে। ওরা প্রত্যেক দিন আসে এবং কাজের জন্য প্রতীক্ষা করে।
পরদিন সোহেল, রাসেল ওরা এলো। বললো, কাকুরা, আমরা মোমিন সাহেবের পক্ষ থেকে এসেছি।
ওরা কিসের আলাপে মাতলো। জামিল মিয়া, আব্বাস আলী, বসু মিয়া, রবু ওরা কেবল না-বোধক হাত নাড়ছে। অর্থ কী তা বোঝা গেলো না।
যাহোক, সব কিছুর শেষ আছে, হরতালের যেন শেষ নেই। অর্থাভাবে ধার দেনা বেড়ে যাচ্ছে। খেটে খাওয়া মানুষগুলো চোখে সর্ষেফুল দেখছে। অপরিচিত পাঁচজন সাথে সোহেল, রাসেল আবারও এলো। আর শ্রমজীবী মানুষগুলোকে বোঝাতে লাগলো। কাজ পাওয়া সত্ত্বেও কাজে যাচ্ছে না কেনো তারা? এ কাজে কী পরিশ্রম বেশি? না, এ কাজে অভিজ্ঞতা নেই? না, এ কাজে নামমাত্র টাকা?
বাড়ি ফেরার পথে ইউনুছ সাহেব শ্রমজীবী মানুষগুলোকে থামালেন, তোরা আমার গ্রামের মানুষ। তোদের কত ভালোবাসি বুঝলি না। এই টাকাগুলো নে, ভাগ করে তোরা সবাই নিবি।
ইউনুছ সাহেব কখনো তুই করে কথা বলেন না। আজ হয়ত রাগ থেকে বলছেন।
জামিল মিয়া বাড়ি এলো। বৌটা তার অপেক্ষায়। ছোট্ট আর ছেঁড়া শাড়ি ঘোমটা দেবে, না শরীর ঢাকবে? জামিল মিয়া বৌকে বললো, ইউনুছ বাই কামের ট্যাকা দ্যান না অথচ আমাগো এতগুলো ট্যাকা এমনেই দিলেন ক্যান? কোনো রহস্য আছে?
বৌ সে কথার উত্তর না করে খেতে দিলো।
পরদিন সবাই মিলে রহস্য নিয়ে আলোচনা শুরু করলো। জামিল মিয়ার মন সায় দিলো না। কদম আলী বললো, হরতালের দিন তো কাম কাজ থাহে না। হেইদিন মিছিলে গেলে কি হইবো? মিছিলে গেলেই তো ইনকাম বেশি!
ওরা সবাই মিছিলে গেলো। জামিল মিয়া গেলো না। পরদিন সুরত আলী বললো, সবাই মিল্লা রাস্তা দিয়া হাটি আর স্লোগান দেই, তাতেই ট্যাকা পাই। যাবি না ক্যান?
অভাব-অনটনের কথা ভেবে জামিল মিয়া রাজি হয়ে গেলো।
সন্ধ্যা বেলায় রায়হান স্যার খবর দেখছেন। হঠাৎ তিনি থমকে গেলেন। পুলিশ ভ্যানে চৌরাস্তার শ্রমিকদের অনেকেই। জামিল মিয়াকেও একটু দেখা গেলো।
------------------------------
যশোর