সাত্যকি সামন্ত। রাশভারী দুঁদে উকিল। তাঁর দীর্ঘদিনের সহকারী হওয়া সত্ত্বেও শুভজিত তাঁর সঙ্গে কথা বলতে এখনও ভয় পায়। কাজের কথা ছাড়া অন্য কথা বলবার মানুষই নন যেন সাত্যকি সামন্ত। কিন্তু আজ যেন স্যারকে বেশ হাসিখুশি এবং সহজ লাগছে। তাঁর ব্যক্তিত্বের কঠিন আবরণের নিচে এতোখানি সারল্য যে থাকতে পারে তা ভাবতে পারছিল না শুভজিত। শুভজিতের অবাক মুখের দিকে তাকিয়ে স্বভাববিরুদ্ধ মুচকি হাসি হাসেন সাত্যকি সামন্ত ; ভাবটা এমন যেন -- কি হে ! খুব অবাক হচ্ছো তো !
তা শুভজিত খুব অবাকই হয়। তার মনের মধ্যে উশখুশ করতে থাকে ছ'বছর ধরে জমে থাকা সেই অমোঘ প্রশ্নটি। ইতস্তত করলেও একসময় জিজ্ঞাসাই করে ফেলে শুভজিত --- স্যার, একটা কথা ছিল।
--- অবিলম্বে বলে ফ্যালো বৃথা কালক্ষেপ না করে !
স্যারের সরস উত্তর শুনে হেসে ফেলতে যাচ্ছিলো শুভজিত। কিন্তু নিজেকে সংযত করে প্রশ্নটা রাখলো ধীর স্বরে --- স্যার, আপনার সব ভালো, কিন্তু আপনার এই সর্বক্ষণের সঙ্গী কাম ভৃত্যকে দেখলেই কেমন যেন বিসদৃশ মনে হয়। গালে বীভৎস একটা কাটা দাগ, চোখদু'টো কুতকুতে ! কেমন যেন অপরাধীর মতো মুখ।
--- ইউ আর রাইট, মাই বয়। এই কালু একদা অপরাধীই ছিল। তারপর ওর যখন অনুশোচনা আসে আমি তখন ওকে বাঁচাই, আশ্রয় দিই। সে আজ বারো-তেরো বছর আগের কথা। সেদিন আমি ওর জীবন বাঁচিয়েছিলাম, আর আজ ও আমার জীবন বাঁচানোর জন্য সবকিছু করতে পারে।
--- তা হয়তো হবে স্যার। কিন্তু যদি ওর পুরোনো অপরাধ প্রবৃত্তি আবার চাগাড় দিয়ে ওঠে ?
--- সেটা অসম্ভব নয়। কিন্তু আমি ওকে দয়ালু মহসীনের কথাটি বলেছিলাম।
--- দয়ালু মহসীন ?
--- দয়ালু মহসীনের ঘরে একদিন একটা চোর চুরি করতে এসেছিল। মহসীনের ঘুম ভেঙে যাওয়ায় চোরটি ধরা পড়ে যায় এবং তাকে ছেড়ে দেওয়ার জন্য কাকুতি-মিনতি করতে থাকে। দয়ালু মহসীন শান্ত স্বরে তাকে প্রবোধ দেন এবং একপোঁটলা জিনিসপত্র ও টাকা-পয়সা দিয়ে তাকে বিদায় করেন। তাঁর এই মহানুভবতা চোরটিকে স্পর্শ করে এবং সে তার চৌর্যবৃত্তি ত্যাগ করে একটি আদর্শ মানুষে পরিণত হয়।
--- তাহলে স্যার, আপনি বলতে চাচ্ছেন এই কালু তার অতীত মুছে ফেলে দিয়ে ....
--- ইয়েস মাই বয়, য়ু আর কারেক্ট। আমরা ক্রমাগত যখন একটা মানুষকে অবিশ্বাস করতে থাকি, তখন সে প্রথমে অসহায় এবং পরে ক্রমশ বেপোরোয়া হয়ে ওঠে। তখন সে করতে পারে না এমন কোনও কাজ নেই। কিন্তু তাকে যদি ভালোবেসে কাছে টেনে নিয়ে তাকে বিশ্বাস করতে পারা যায়, তাহলে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সেই মানুষটি আত্মবিশ্বাস ফিরে পায়। সে ভাবে যে -- সে এখনও ফুরিয়ে যায় নি ; সে ভাবে যে তাকে বিশ্বাস করার মতো পদার্থ এখনও তার মধ্যে বিদ্যমান।
--- কিন্তু স্যার ....
--- কোনও কিন্তু নয়। আমার কথা বিশ্বাস না হয় তুমি বিশপের বাতিদান ( Bishop's candlestick ) লেখাটি পড়ে নিতে পারো।
সাত্যকি সামন্ত আবার তাঁর স্বভাব গম্ভীর স্বরূপে ফিরে আসেন। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে শুভজিত।
==================================
# ছবিঋণ- ইন্টারনেট।
গোবিন্দ মোদক।
সম্পাদক: কথা কোলাজ সাহিত্য পত্রিকা।
রাধানগর, ডাক- ঘূর্ণি, কৃষ্ণনগর, নদিয়া।
পশ্চিমবঙ্গ, ভারত, ডাকসূচক - 741103