গল্প ।। প্রাপ্তি ।। আবদুস সালাম
সাবির আলি মিশনে ছেলেদের পড়ার খরচ যোগাতে গিয়ে রাজমিস্ত্রির যোগাড়ের কাজ করতে কেরল চলে যায় । বাড়িতে রেখে যায় স্ত্রী আর মেয়েকে । ফোনে কথা বলতে পারতো না রোজ । নিজের ফোন ছিলনা। একটা ফোন যে কিনবে সে পয়সাটুকুর কথা ভাবতেই পারেনি । বাড়তি খরচ করবে এই ভাবনা মন থেকে উড়ে গিয়েছিল, যেদিন দুটো ছেলেকে মিশনে ভর্তি করে দিয়ে এসেছিল। ঠিকমত কাজ করতে পারিনা বলে অন্যদের চাইতে কম মজুরী দিত মালিক মানে ঠিকাদার।
পরপর দুটো ছেলের পড়ার খরচ যোগাতে নাকানি চোবানী খাচ্ছিল। ঠিকাদারকে বলে- কয়ে রাতের বেলা দারোয়ানের কাজটুকু চেয়ে নেয় । সারাদিন জোগাড়ীর কাজ শেষে রাতে ঠিকাদারের মাল জোগানো। শরীর যেন নিতে পারে না। এখানে শিক্ষিত অশিক্ষিতের ভেদাভেদ নাই। যা করতে এসেছো করো নইলে রাস্তা দেখো । ঠিকাদার মাঝে মাঝে বলে" শিক্ষুতি লোক নিয়ে কি হামি ধুঁই খাবো"-----।
এই বয়সে মানে, যে বয়সে মানুষ বিদেশ খাটতে যায় সে বয়সে তো সাবির গ্রামে নিজের বাবার পাওয়া বিঘা পাঁচেক জমি চাষ করে দিব্যি সংসার চালিয়ে নিচ্ছিল । শিক্ষিত মানুষ চাকরি হয়নি। তবু ওই সামান্য চাষ আর পাড়ার কিছু রাজমিস্ত্রির ছেলেদেরকে পড়িয়ে দিব্যি চালিয়ে নিচ্ছিলো তার সংসার ।
এতে নিজের ছেলে মেয়েদের পড়াশোনা চলতো আর অন্যদে্র পড়ানোও হতো । উপরি পাওনার মতো কিছু রোজগার ও হতো।
এভাবেই চলছিলো দিন। পরিবার এই নিয়ে দুঃখ থাকলেও মানিয়ে নিয়েছিল স্বপ্না ভাবী ।
অপেক্ষাকৃত বড়োলোকের ঘরের মেয়ে স্বপ্না । বাবা কিছুতেই বিয়ে দিতে চাইছিল না এখানে ।সাব্বিরের ব্যবহার ও মনে মনে একটু প্রেম গাঁটছড়া বাঁধার ইন্ধন যুগিয়ে ছিল তাদের।হয়তো বা এটাই আল্লাহ তায়ালা তাদের জন্য বরাদ্দ করে রেখেছেন।
মিশনে ছেলেদের ভর্তির একটা সাধ মনে মনে দুজনেরই পোষা ছিলো। সুযোগ পেয়েছে আজ। তাই আর সংসারের কথা চিন্তা না করেই ভর্তি করে দিলো। টাকা কোথা থেকে আসবে চিন্তা না করেই স্বপ্না ভাবীকে সাথে নিয়ে খলতপুর গেল ইন্টারভিউ দিতে । মিশনের কনফারেন্স হলে সারা রাত মশার কামড় খেয়ে কম পয়সায় ছেলে যাতে পড়তে পারে তার জন্য অপেক্ষা। শেষে ঠিক হয় খলতপুরেই পড়তে পারবে । তবে মাসে সবচেয়ে কম চার্জ এককালীন পাঁচ হাজার টাকা আর মাসে দু হাজার টাকা দিতে হবে। কি করে যোগাড় হবে এ কথা চিন্তা না করেই রাজি হয়ে যায়।
শুরু হয়ে যায় লড়াই।
স্বপ্না ভাবী বাড়িতে একা।সাথী কেবল পাঁচ বছরের মেয়ে সুফিয়া। একদম বাড়তি কোনো খরচ নয়। পাশের বাড়ীর সাকিলা ভাবীর বাড়িতে বিকেল বেলায় গল্প করতে যেত। সবসময় মনে চিন্তা সাবির বিদেশে ভালো আছে তো ? যদি কোন অসুখ বিসুখে পড়ে তাকে দেখবে কে? এতো দিন তো কোথাও একা থাকেনি আমাকে ছাড়া ।
পাড়ার মেয়েদের বিড়ি বাঁধা শেখার গল্প, এছাড়া অন্য ভাবীদের সংসারের সুখদুঃখের গল্প শুনতে শুনতে কখনো কখনো চোখ জলে ভিজে যায়।এই শিল্প যে মৃতপ্রায় সংসারে সঞ্জীবনী সুধা তার বলার অপেক্ষা রাখেনা । সংসারের হাল ধরতে গিয়ে মেয়েদের এই কাজ শেখা। অনেকের স্বামী বিদেশে খাটতে যায়। তাদের দেখভাল করার কেউ থাকে না । আবার কারো স্বামী বিদেশ গিয়ে দোসরা সংসার পেতেছে। বাড়িতে টাকা পাঠাই না। পেট তো আর কোন অজুহাত মানেনা , অভিমান মানে না। তাই পাড়ার ভাবীদের দুঃখের গল্প শুনতে শুনতে একটু ওদের কে সাহায্য করতে এগিয়ে আসা। পরের বিড়ির মুখ মারতে মারতে কখন যে বিড়ি বাঁধা শেখার হাতে খড়ি হয়ে যায় এই সব মেয়েদের ।
যে বাড়ির বারান্দায় এসব কাজ কর্ম চলে সেই বাড়ির মালকিন হলেন আয়েশা ম্যাডাম । চেহারা খুব ভালো ছিলো না বলে অনেক ছেলের বাবা পছন্দ করেন নি । পাত্রী দেখে গিয়ে মহচব্ করে খেয়ে রাতে ফোন করে বলেছে আমাদের মেয়ে পছন্দ নয় । বেশ কয়েকজন পাত্রের বাবা এসেছে আর রাতের বেলায় জবাব দিয়েছে মেয়ে পছন্দ নয় । আরে বাবা ঘটকের কাছে তো সব শুনেছিস।ছবি দেখেছিস । খোঁজ খবর নিয়েই তো এখানে আসা । দেনাপাওনা কেমন দিবে সব ঠিকঠাক করেইতো বাবা এসেছিস । তবে অতোগুলো টাকা পয়সা খরচ করিয়ে ,লোকজনকে জানিয়ে ,ঢাকঢোল পিটিয়ে ঘটা করে বলে গেলি তোমার মেয়ে সুন্দরী নয়।আসার কি দরকার ছিল বাবা ? না মেয়ের বাবা বলে তাকে শাস্তি দিতে এহেন আচরণ । দেখ মেয়ে জন্ম দেওয়ার কেমন শাস্তি । তোদের নিজের মেয়ে হলে এই আচরণ করতে পারতিস? একজন মেয়েকে যখন দেখতে এসে পাত্রপক্ষ বলে মেয়ে আমাদের পছন্দ নয় , তখন মেয়েদের মনে যে কি ঝড় বয়ে যায় কেউ লক্ষ্য করেছেন কি? যাক বেশ কয়েকবার এই অস্বস্তিকর অবস্থায় পড়ে আয়েশা জেদ ধরে বসে আর বিয়ের পিঁড়িতে সে বসবে না।
নতুন উদ্যমে শুরু করে পড়াশোনা।ডি এল ই ডি ট্রেনিং।টেট পরীক্ষার জন্য প্রস্তুত হওয়া ।জেদ তাকে পেয়ে বসেছিল। তাকে সাবলম্বী হতেই হবে । এক চান্সেই টেট পরীক্ষায় পাশ করে যায় । কাউন্সিলিং এর মাধ্যমে গ্রামের স্কুলেই পেয়ে যায় চাকরি।
এরপর অনেক ছেলে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসে । অবলীলায় সবাই কে না করে দেয় । এ বাড়ির বারান্দা সব মেয়েদের তীর্থস্থান।
সকাল বেলায় পাড়ার বিড়ি বাঁধা মায়েদের মেয়েদের বিনাপয়সায় পড়াশোনা করায়। স্কুল যাওয়ার সময় হলে ওদের ছেড়ে দিয়ে নিজের স্কুলে চলে যায়। পাড়ার মেয়েদের বিকেলে তার বাংলা ঘরের বারান্দায় বসে বিড়ি বাঁধে । সব ব্যাবস্থা নিজের উদ্যোগে করে।
প্রথম প্রথম বেশ লাগতো। পরে তাদের বাদ পড়া ছাঁট পাতা থেকে বিড়ির পাতা কাটতে শিখে নেয় ।বিড়ির মশলা না দিয়ে তুষ দিয়ে বাঁধতে শুরু করে। প্রথম ট্রেনিং-- ইত্যাদি ইত্যাদি--।
এদের পদাঙ্ক অনুসরণ করে স্বপ্না ভাবীও বিড়ি শ্রমিক বনে যায় অজান্তেই। চলতে থাকে মেয়েকে স্কুল পাঠিয়ে দিয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে নেমে পড়া। এ কাজ সাবির কে না জানিয়ে করে চলেছে। স্বপ্না বড়োলোকের মেয়ে। এখানে বিয়ে করেছিল বলে বাবা মা খালি হাতে বিদেয় দিয়েছিল।এ নিয়ে কোনো দিন তার স্বামী কোন অনুযোগ করেনি ।
বিড়ির মশলার গন্ধ সরাসরি আঘাত আনতে শুরু করে তার ফুসফুসে। হায়রে কপাল । বাড়িতে কোনদিনও মা-বাবা ভাত খেয়ে থালাগুলো ধুয়ে আনতে বলেনি।যা মা যা ভালো করে পড়াশুনা কর।স্বামীর বাড়িতে তো কাজ করতেই হবে।যতোদিন বিনা কাজে থাকতে পারা যায় ততটুকুই লাভ। "ছাই তোলা আর ভাত রাঁধা তো মেয়েদের কপালে লিখেই দিয়াছে আল্লাহ তাআলা।'"একে খন্ডাবে কে?
মেয়েকে স্কুলে পৌঁছে দিয়েই একমনে লেগে যায় বিড়ি বাঁধতে। ফেলে ঝুলে দুহাজার না পারলে ও দেড় হাজার বিড়ি তাকে বাঁধতেই হবে। মিশনের টাকা ছাড়া নিজের ওষুধ কেনার খরচ জোগাড় করতে হবে।
একদিকে সাবির ভাই অন্য দিকে স্বপ্না ভাবী । অকাতরে বয়ে নিয়ে চলেছে তাদের ভাঙা তরী।জল,ঝড় -ঝাপটা খেয়ে মেরুদন্ড সোজা করে ভাঙা তরীকে কূলে ভিড়ানোর আপ্রাণ চেষ্টা করে আজ সফল বাবার তকমা তার গলায়। লোকে যখন তার ভাঙা তরী তীরে আনার গল্প বলে তখন মন টা জুড়িয়ে যায়। মনে মনে গর্ব অনুভব হয় ।যাক আল্লাহ তাআলা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের জয় বার্তা এনে দিয়েছেন।
অনেক আশা মনে মনে ডালপালা মেলতে শুরু করে । জীবনের না পাওয়া দিন গুলো কে পাওনা গন্ডায় মিটিয়ে নেওয়ার সময় এসেছে এখন। স্বপ্নাকে কোনো দিন অটো ছাড়া টোটোতে চাপাতে পারিনি। কারণ অটোর ভাড়া পাঁচ টাকা আর টোটোর ভাড়া দশ টাকা। পারত পক্ষে হেঁটেই পৌঁছে গেছে বাড়ি। বলেছে এই টুকুই তো রাস্তা, গল্প করতে করতে চলে যাবো চলো।বরং ঐ টাকার বেগুনী খেতে খেতে চলে যাবো চলো ।হাসি মুখে সব মেনে নিয়েছিল স্বপ্না। কোনদিন হোটেলে গিয়ে দুপুরের খাওয়াটা সারবো একথা মনে আনতে পারেনি সাবির ।বলেছে চলো ঐ টাকা দিয়ে গোস্ত কিনে আনবো । সবাই মিলে এক সঙ্গে পেট ভরে খাবো ।
-----
ছেলের চাকরি হয়ে গেছে ।এখন আমাদের এ না খাওয়ার দুঃখ টা নেই বলো । ছেলে বড়ো চাকরি পেয়েছে। বড়ো বড়ো মান্যগণ্য লোকেদের সাথে ওদের ওঠাবসা। এককথায় হাই সোসাইটিতে আনাগোনা।
মাঝে মাঝে ছেলে আবদার করে মায়ের হাতের রান্না খাবে। কাজের মেয়ের হাতে রান্না খেতে খেতে জিভে চড়া পড়ে যাচ্ছে । মাসের প্রথমদিকে ছেলেরা তাদের কর্তব্য মনে করে কিছু কিছু টাকা দিয়ে যেতো ওদের মায়ের হাতে। সাবির আলী কোনো দিন ঐটাকা ছুঁয়ে ও দেখেনি। কেননা ছেলেদের রোজগারের টাকা হাত পেতে কেমন করে নিই ।অন্তরদহনে জর্জরিত হোতো সাবির । এতো দিন ওদের মা আমাদের কে ভালোবেসে আদর করে রান্না করে খেতে দিতো । হয়তো শাক ভাত । এতে কোনো কৃত্রিমতা ছিল না । আর আজ ছেলেদের আবদার মা কেমন ভালো রাঁধুনী তার প্রশংসা করার জন্য মায়ের হাতের রান্না খাবে বলে গাড়ীতে করে আসা । এখানে ভালোবাসার কোন স্থান নেই ।
চায়ের দোকান , পাড়ার মা বোনেদের পুকুর ঘাটে স্বপ্নাভাবী আর সাবির ভাইয়ের ছেলের সাফল্যর কথা যখন বলে তখন বুকের ছাতি টা অনেক চওড়া হয় বইকি। এতোদিন যারা তাদের অবহেলা , ঘৃণা করতো তারাই এখন তাদের মেয়েদের বৌ করে আনার জন্য আবদার করে । সাবির ভাই মনে মনে হাসে । সাবির গরিব মানুষ হলেও অনেক সম্ভ্রান্ত বাড়ির লোকজন ঘটক কে বলে পাঠায় বিয়ে দেওয়ার জন্য। কারও বাবার একটা মেয়ে ,কেউ আবার ফ্যাক্টারির মালিক। কেউ বলে রাজকন্যা সমেত রাজ্য একসাথে পাবে । কোন কোন ঘটক এসে আবার অফার দেয় যা চাইবেন তাই দিয়ে দিবে । আপনি একবার মুখ খুলুন। মাথা টা ঘুরে যেতো।আজ আমার বাড়ির বউ করার জন্য বড়োলোকের বাড়ির লোক বাড়ি কাদা করে দিচ্ছে। কি দুঃখে যে সংসার চলেছে। কেউ খোঁজ খবর নেয়নি। ঈদে ছেলে মেয়েদের একটা নতুন জামা কিনে দিতে পারেনি। নিজেদের কাপড় সে তো অলীক কল্পনা মাত্র।
স্বপ্না ভাবী খুব হিসেবি মানুষ । ছেলে কে বলতো কষ্ট করে চাকরি পেয়েছিস। দু'বছর আরাম করে চাকরি কর । ভাঙাচোরা বাড়ি খানা ঠিক ঠাক কর।হাতে দুটো পয়সা জমুক। চিরকাল তো চালফুটো ঘরে বর্ষার পানি খেলাম। তার পর বিয়ের কথা ভাববি।এরই মাঝে এক একটা ভদ্র এবং পরহেজগার বাড়ির সন্ধান পেয়েছে।সাবিরের আবার ইচ্ছে কোন রকম পণ নেওয়া চলবে না । আমরা গরীব মানুষ । অপরের ধন নিয়ে বড়োলোকের দলে নাম লেখাতে পারবোনা ।আমার বাড়ি আসতে গেলে খালি হাতেই আসতে হবে । মাটির ঘরে বড়ো জোর চোকির উপর ঘুমাতে হবে ।সবাই ভাবতো সাবির ভাই কঞ্জুস মানুষ। এতো এতো ভালো অফার নিশ্চয় একটা কে লুফে নিবে। তখন শালার ঘ্যাম দেখিস। কেউ আবার বলাবলি করছে" কতো টাকা জী লিবে শালা ? শালার কপাল। এবার আ্যখুন সাবির কে সাবিরা্ কেহু বুলবিন্যা তোরা।বুলবি সাব্বির মুড়োল। অর কপালে কপাল ঠ্যাকেঁয় লিবি সব বিহ্যান্তে।"
এক বছর চাকরি হতে না হতেই ছেলে বাড়িতে বিয়ে করবো বলে জানিয়ে দেয়।সাবির আকাশ থেকে পড়ে । এতো তাড়াতাড়ি বিয়ে। মেয়েটার কথা একবার ওকেউ ভাবলো না ।বাবা আমাদের পড়াতে সব শেষ করে ফেলেছে।মা অসুখ বাঁধিয়েছে।কি করে বোনের পড়ার খরচ চলবে? এখন ছেলে যেহেতু বিয়ে করবে বলে জানিয়েছে তখন তো হাত পা গুটিয়ে বসে থাকতে পারে না ।
বউ দেখার কথা ভাবছি । অনেকেই তো বলছে। ভাবছি রাতে খেতে বসে সবাই মিলে আলোচনা করে বউ দেখতে যাবো। ছেলে ডিউটি সেরে যখন বাড়ি এলো তখন রাত দশটা।চোখ সবার ঢুলুঢুলু। অগত্যা এশার নামাজ পড়ে ছেলের সাথে একসাথে খাবো বলে অপেক্ষা। হন্তদন্ত হয়ে হাত-পা ধুয়ে বসে পড়লো খাবারের জন্য ।মা খুব ক্ষিদে লেগেছে । তাড়াতাড়ি দুটো খেতে দাও । দুপুরের খাবার ঠিকমতো খাওয়া হয়নি। অনেক পেশেন্ট ছিল । তার পর আবার চেম্বার। মাথা খারাপ হওয়ার জোগাড়। অবলীলায় মা হাসি মুখে ছেলের পাতে ভাত খুলে দেয় ।পরে বুড়ো বুড়ি তে কি হাঁড়ির শেষের ভাত খুলে বসে পড়ে খেতে। হাঁড়ির শেষ ভাত তাই দুচারটে কাঁকর রয়েছে। চাল বাছাই করতে করতে দেখতে পাইনি। বয়স হয়েছে । চোখের দৃষ্টি কমেছে। ছেলের উগ্র মেজাজের দাপটে হতভম্ব হয়ে যায় স্বপ্না। চাল বেছে রাঁধতে পারোনা ।এক সপ্তাহ পর বাড়ি এসে কাঁকর সিদ্দ ভাত। বউ দেখতে যাওয়ার কথা ভয়ে বোলতে পারলোনা সে রাতে।
ভাবলো সকাল হলে বলবো চা খাওয়ার সময়।চা খেতে বসে ছেলে মুখ গম্ভীর করে বললো আমি সুকন্যা কে বিয়ে করবো। ওখানে বলে দিয়েছি তোমরা দেখতে যাবে। স্বপ্না বলে ওতো অনেক দূর । শ্বশুর বাড়ি এক এক দিন যাওয়ার ইচ্ছে থাকলেও তো যেতে পারবিনা বাবা । বরং কাছাকাছি অনেকেই তো বলছে । তাদের বাড়ি দেখে আয় কেন। আমাদের ও তো বিহ্যায় বিহ্যানের বাড়ি যাওয়ার ইচ্ছে হবে।অতো দূরে কেমন করে যাবো ? আমার ওখানে বিয়ে দেওয়ার ইচ্ছা নেই।
ছেলে সপাটে চড় কসার মতো উত্তর দিলো তোমাদের সব কথা সবসময় মেনে চলতে হবে এমনকি মানে আছে না কি? ওদের কাছে আমি কথা দিয়েছি। দু'বছর ধরে ওদের সাথে সম্পর্ক। কি করে সম্পর্ক মুছে ফেলবো । এটা তো আমার দ্বারা হবে না মা।
মা বলে তোর সাথে আমার চব্বিশ বছরের সম্পর্ক। গরীব মা বাবা বলে দুযুগের সম্পর্কে দাঁড়ি টানা যেতে পারে। দুবছরের প্রেমের সম্পর্ক ছাড়া অসম্ভব। এটা গরীব রাজমিস্ত্রি বাবা আর বিড়ি বাঁধা মা বলেই সম্ভব রে খোকা । আমাদের কোন সাধ আহ্লাদ থাকতে নেই । গরীব মা-বাবার ছেলে নিয়ে স্বপ্ন দেখা বারণ।যে বোকা মা-বাবা এটা ভেবেছে তার কপালে দুঃখ ছাড়া কিছুই জোটেনি ।
সাবির আলি নিজের মনকে বোঝায় "দূর বোকা গরীবের আবার ঘোড়ার রোগ"।অতো আদিখ্যেতা কিসের? ওর কপালে ছিল ও বড়ো হয়েছে। তুই কতো টাকা ছেলের পিছনে খরচ করেছিস্। মিশনে দেখতে গিয়ে কোন দিন এক কোট্যা হরলিক্স কিনে দিয়েছিলি ? সব বাবারা কতো ভালো ভালো খাবার তার ছেলেকে দিতো। আমরা চেয়ে চেয়ে দেখতাম ।এক একদিন ওরা খেতে পারতো না তখন দিতো।কি মজার মজার সব খাবার ।এক দিন এক প্যাকেট বিরিয়ানী ও দিতে পারোনি । তাহলে এতো দরদ কেন বাবা," ওর মাকে বোঝাতো এগুলো সব গরীব হওয়ার অভিশাপ। আমরা যেমন আছি তেমনি ই থাকবো ।অযথা দুঃখ করে লাভ নেই।ওরা ভালো থাকলে ই হলো। আমরা আর ক'দিন থাকবো। যাকে নিয়ে আসবে সেই আমার বৌ। ভেবে নাও এটাই আমাদের কপালে আল্লাহ তাআলা লিখেছেন।
স্বপ্নার অন্তর ফেটে চৌচির হয়ে যায়। ভাত খেতে বসে কাঁদে, নামাজের পাটিতে বসে কাঁদে, রাতে শুতে যাওয়ার সময় ওর বাবা যাতে শুনতে না পায় তার জন্য বালিশে মুখ গুঁজে গুঁজে কাঁদে।
বিয়ের আয়োজনে কোন ঘাটতি নেই। সাবির ভেবেছিলো যাবে না ।লোকে কি বলবে , এই ভেবে রওনা দেয় ।এ যেন অন্য আকাশে অযাচিত ভাবে যাওয়া । বিয়ের গাড়ি যখন পৌঁছালো তখন বেলা গড়িয়ে গেছে। যাহোক আগত লোকেদের আগ্রহের ভাঁটা পড়েছে। কোন আগ্রহই যেন চোখে পড়ছে না। হয়তো ওদের জামাই পছন্দ ছিল না।কি জানি মন টা কেমন যেন খচখচ করছিল ।ওরা আরও ভালো জামাই পেতো হইতো। বড়োলোকেদের সব ব্যাপার স্যাপার।
সামান্য কিছু মিষ্টি মুখে করে বিয়ে পড়ানোর ব্যাবস্থা করার প্রস্তুতি শুরু হলো । কেউ একবার এলোও না বিয়ে পড়ানো হবে তার কাগজ পত্রে সই স্বাক্ষর করতে।জামাই কে নিয়ে সব কাগজে সই স্বাক্ষর করে নেই । বিয়ে পড়ানোর কাজ শেষ হলে খাওয়ার ব্যাবস্থা। রাতে থাকার ব্যবস্থা হয়েছে হোটেলের ডাইনিং হলে। পেতে দিয়েছে ত্রিপল। তার উপর বেডসিট। অগত্যা সবার মাঝে আমার ও সেখানে হয় ঠাঁই। মশারা তেড়ে আসছে ।গুন গুন করে গান গাইছে। কিছুতেই ঘুম আসে না । কয়দিনের খাটাখাটনিতে কোমরের ব্যাথা টা বড্ডজ্বালাতন করতে লাগলো।
কন্যা পক্ষের কেউ একবার ও এলোনা যে বিহ্যায় তো এসেছিল সে কোথায়? ছেলে ও একবার খোঁজ নিলোনা আব্বু যে এসেছে সে কোথায় আছে?
সবাই ঘুমে আচ্ছন্ন। ফ্যানের সাঁই সাঁই আওয়াজ টা তখন আমার সহচরী । ঘুম যখন আসছেই না তখন অজু করে সাবির তাহাজ্জুদ নামাজ পড়ে নেই।
দূরে কোন প্যান্ডেলের মাইক থেকে ভেসে আসছে অমানুষ ছায়াছবির গান---কি আশায় বাঁধি খেলাঘর বেদনার বালুচরে -------
------------------------
#ছবিঋণ- ইন্টারনেট।
আবদুস সালাম, মুর্শিদাবাদ।