ধারাবাহিক উপন্যাস । । পরজীবী (নবম পরিচ্ছেদ)।। অভিষেক ঘোষ
নবম পরিচ্ছেদ
২০১৫
"জানো তো.. এই গাছটায় না ভূত আছে !"
"কে বলল ?"
"টমদা"
"সে আবার কে ?"
"এই তো তোমার পাশে যে দাঁড়িয়ে... মিটিমিটি হাসছে !"
"ওহ্ রজত ? ওর ডাকনাম টম বুঝি ?"
এই কথা শুনে তনুশ্রীর মুখটা যেন কেমন করুণ হয়ে যায় । উত্তরটা আসে স্বয়ং রজতের কাছ থেকে, "আসলে আমি তো কুকুর ! মিত্তির বাড়ির আশ্রিত ! সেই কবে থেকে । তাই দুই দাদা আমায় ছোটো থেকেই 'টম' বলে ডাকতো । মেজদা মাঝে মাঝে বলতো, টমি । ডেকে সাড়া না পেলে, মাথায় চাঁটি মারতো । ওরা টেস্ট ম্যাচ খেলতো প্লাস্টিক বল নিয়ে, আমি ব্যাট হাতে পেতাম না । বলতো, আমার নাকি হাত নেই, থাবা নাকি নোংরা । তাই আমায় কেবল বলই করে যেতে হতো । আমি অবশ্য স্পিন বলটা ভালোই করি । ওরা বারবার আউট হয়ে যেতো, কিন্তু ব্যাট ছাড়তো না । তবে এই টমের স্পিন বোলিং খেলে-খেলেই কিন্তু মেজদা আর ছোড়দা ব্যাটিংটা শিখেছে ।" - বলে হাসতে থাকে রজত ।
তনুশ্রী বিষণ্ন মুখে বলে, "ওইসব কথা থাক্ না এখন । আমিও তো তোমায় টমদা বলি... তাতে কী ?" তারপর কথা ঘোরায়, “বলো তো… তোমার সাথে ছোট্ট হ্যারির মিল কোথায় ?”
রজতের মুখে আবার মৃদু হাসি ফিরে আসে, উত্তর দেয় – “সিঁড়ির নিচে থাকি, দুঃখ চেপে রাখি ।” রজত ভালো মুখে মুখে ছড়া কাটে, সেই গতকাল আটচালায় পা রাখার সময় পাশ দিয়ে যেতে যেতে কী যেন বলেছিলো ! এই বয়সের কোনো ছেলেকে পার্থ কখনও ফতুয়া আর পাজামা পরে বাইরে ঘুরতে দেখে নি । ওই অদ্ভুত পোশাকটায় রজতকে খুবই রোগা লাগছিলো । ওকে হ্যারি পটারের সাথে মেলাতে গিয়ে যদিও পার্থর হাসি পেয়ে যায় । পার্থ তখন তনুকে প্রশ্ন করে, "তনু, তুমি ভূতে বিশ্বাস করো ?"
"হ্যাঁ করি তো ! তুমি করো না ?"
"যাকে দেখা যায় না, তাকে কী করে বিশ্বাস করি বলো তো ?"
"কিন্তু দেখা যায় তো ! আমার মনে হয়, আমি একবার দেখেওছি ।" – রজত মাঝখানে বলে ওঠে ।
"তুমি ভূত দেখেছ ? কী যা-তা বলছ ?"
“হ্যাঁ সত্যিই দেখেছি । বছর তিন-চার আগে । কালীপুজোয় জোর করে সিদ্ধি খাইয়ে দিয়েছিলো সেদিন, তাছাড়া রাতের অন্ধকার ছিলো । তাই ভুল দেখতেও পারি ! তবে খুব চমকে গেছিলাম ! দেখেছিলাম, আমাদের উঠোনে কলের কাছটায় খুব রোগামতো একটা ভূত হামাগুড়ি দিচ্ছে । আর কিছু মনে নেই । তাই এর বেশি বলতে পারবো না ।”
"যাহ্ তাহলে তো একটা দারুণ ভূতের গল্প ফসকে গেলো বলতে হয় !"
"আচ্ছা পার্থদা, আপনি যে এই ভিডিওগুলো তুলছেন, আজ থেকে বহু বছর পরে আপনার মনে হবে না, ভূত দেখছেন ?"
"সে কি ! তা কেন মনে হবে ?"
"বাহ্ রে ! ভবিষ্যতে আপনি যাদের ভিডিওতে দেখবেন, তাদের কেউ কেউ হয়তো তখন বেঁচেও থাকবে না । তাহলে তখন কি আপনি ভয় পাবেন না ?"
"ধুর্ কী যে বলো ! ভয় কেন পাবো ? এগুলো তো স্মৃতিমাত্র । তাহলে তো সিনেমা দেখাই চাপের । ভাবো তো তনু, সুচিত্রা সেন ভূত, উত্তমকুমার ভূত !"
তনু খিলখিল করে হেসে উঠলেও রজত কিন্তু সিরিয়াস হয়েই বললো, "আমাদের স্মৃতি, অনিচ্ছাকৃত ভুল, অপরাধবোধ - এগুলোই আসল ভূত । একথা কি আপনি মানেন না ? তাছাড়া অতীতও তো ভূতই । আপনি যদি মনে করে থাকেন কোনো একটা ঘটনা অতীত হয়ে গেছে বা, একজন মানুষ হারিয়ে গেছেন, মুছে গেছেন, আর তারপর যদি সেই ঘটনা আবার ঘটে বা, সেই মানুষটা হঠাৎ ফিরে আসে, আপনি কি ভয় পাবেন না ? ভূত দেখার মতো চমকে উঠবেন না ?"
হাসতে গিয়েও রজতের গম্ভীর মুখটা দেখে পার্থ নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে । শুধু বলে, "তুমি খুব গল্পের বই পড়ো... না ?"
"তা তো পড়িই । তনুও তো খুব বইয়ের পোকা । তাই না রে ?"
"আমার গা-ছমছমে ভূতের গল্প হেব্বি লাগে । প্লাস যদি রেইনি ডে হয় ।"
"তনু কী যেন একটা ভূতের গল্প শোনাতে চাইছিলে ? এবার বলো তো, শুনি ।" – পার্থ আগ্রহ ব্যক্ত করে ।
পার্থর দিকে চেয়ে নাটকীয় ভঙ্গিতে তনু শুরু করে, "এই যে বটগাছটা দেখছি আমাদের সামনে, এটাতেই ভূত আছে । টমদা বলেছে, ভূতটা নাকি খুব লোভী । প্রায় দু'শ বছর ধরে ভূতটা ওই গাছের ডালে রোদ-ঝড়-বৃষ্টিতে ছিল । ওর জীবনে কোনো হ্যাপিনেস্ ছিল না । ওর খুব একা আর বোরড্ লাগতো । তারপর একদিন সন্ধ্যায় একটা পালকি গাছটার নিচে দিয়ে যাচ্ছিল । সে অনেক বছর আগের কথা, তখন পালকি চলতো । সেই পালকিতে ছিল নতুন বর-বউ । ভূতটা বাতাসে মিশে উঁকি দেয় পালকির ভিতরে । বউটাকে দেখেই তার খুব ভালো লেগে গেল । কিন্তু কী করবে সে ? তার তো শরীর বলে কিছুই নেই ! তাহলে ? এইসব যখন সে ভাবছে, ঠিক সেই সময় পালকির ভিতরে বসে বউটাকে তার বর বলছিলো, তাকে নাকি বিদেশে যেতে হবে কয়েক মাসের জন্য, ব্যবসার কাজে । বরের বাবা খুব বড়ো বিজনেসম্যান কিনা ! ছেলেও বাবার খুব ওবিডিয়েন্ট । এইসব শুনেই ভূতটা একটা প্ল্যান করে ফেললো । দু-দিন পর যেইনা লোকটা বাবার কথা মতো জামা-কাপড় বেঁধে বিদেশে রওনা দিয়েছে, অমনি ভূতটা বরের বেশ ধরে বউয়ের ঘরে চলে গেলো । কিন্তু বউটার সাদাসিধে হাবভাব দেখে ভূতটা কিছুতেই তাকে মিথ্যে বলতে পারলো না । তারপর সে যখন ভাবছে, যাহ্ মিথ্যেমিথ্যে বর সেজে সত্যিকারের বউ পাওয়া তার আর হলো না ! ঠিক তখন বউটা ছুটে এসে তাকে জড়িয়ে ধরলো, মানে মেনে নিলো আরকি । এইভাবে ভূতটা মানুষের বেশ ধরেই রয়ে গেলো ওই বউটার সাথে ।"
"এই রে… তোমার গল্পটা কেমন যেন চেনা-চেনা লাগছে রজত ! কোন্ সিনেমা ?" - পার্থ প্রশ্নটা না করে পারে না ।
"সেটা আপনিই খুঁজে বার করুন ।" - রজত হাসিমুখে বলে ।
তনু রেগে গিয়ে মন্তব্য করে, "গল্পটা শেষ করতেও দিলে না !"
"তনু, তোমাদের এই ভূতের গল্পের শেষটা আমি জানি । কিন্তু কথা হলো, ভূতটা রজতই কিনা !" - কথাটা বলেই পার্থ অনুভব করে, মজা করতে গিয়ে কোথাও একটা গড়বড় করে ফেলেছে সে ।
তনু কিন্তু হালকা মেজাজেই বলে, "টমদা তো একটা ভূতই । বাজে লোক একটা, একটাও বন্ধু নেই । সবসময় একা একা থাকে । বাজারেরে শাড়ির দোকান ছেড়েও কোত্থাও যায় না । ভূত ছাড়া আর কী ?"
রজত তখন কেমন যেন অন্যমনস্কভাবে রুদ্ধস্বরে বলে, "তনু আমি কিন্তু এখন অনেকটাই মানুষ । আগে হয়তো ভূত ছিলাম । তুমি তো জানো ! সদাকাকা মারা যাবার পর ক’দিন খেতে পাই নি, চানও করি নি, মা সেই এক সপ্তা পরে ফিরবে । মায়ের সাথে যোগাযোগ করতে পারি নি । আমি তখন একদম একা, খিদের চোটে সুন্দরপুরে ঢুকে পড়তে বাধ্য হলাম, তখন আমি পুরোপুরি ভূতই হয়ে গিয়েছিলাম ।"
এই কথাতে বছর পনেরোর মেয়েটার গালে যেন একটা দুঃখের ছাপ লাগে । পার্থ বুঝতে পারে না, রজত কী বলছে ! কিন্তু ওকে কোনো প্রশ্ন করতে সে সংকোচ বোধ করে ।
কিন্তু তনুশ্রীর বয়স অল্প হলেও মেয়েটা বুঝদার । চট করে কথা ঘুরিয়ে দেয়, "তোমাদের খিদে পায় নি ? কত বেলা হয়ে গেল !"
পার্থ ঘড়িতে দেখে, দেড়টা বাজে । অষ্টমীর এ-বেলার পুজো দেখে তারা বেরিয়েছিলো । টুকটাক পেটপুজো হয়েছে জলখাবার ছাড়াও, তাই খিদে তেমন পায় নি । পার্থ রজতের দিকে তাকায় । কিন্তু মুখে কিছু বলে না । রজতও তার দিকেই চেয়েছিলো, হয়তো ভাবছিলো অতিথির খিদে পেলে ফিরতেই হবে । তারা হাঁটতে হাঁটতে সুন্দরপুরের লাইব্রেরির পাশে এসে দাঁড়িয়েছে তখন । সূর্য মাথার উপরে সামান্য হেলেছে । এখান থেকে মিত্তির বাড়ি মোটে দশ মিনিটের পথ । বিরাট বটগাছটা ডালপালা মেলে অনেকখানি জায়গা জুড়ে দাঁড়িয়ে আছে । তার ঠিক নীচে জমকালো একটা ইয়াব্বড়ো ছায়া । কাছেই একটা চায়ের দোকান । ডানদিক ধরে এগিয়ে গেলে সুন্দরপুর প্রাথমিক বিদ্যালয় ও মেয়েদের উচ্চ-মাধ্যমিক স্কুল পাশাপাশি । বাঁদিকে গোষ্ঠতলার মাঠ, এখন জনমানবশূন্য । লাইব্রেরির পিছন থেকেই শুরু হয়েছে একটা বিরাট দিঘীর পাড় । লোকে বলে, গ্রামের সবচেয়ে বড়ো পুকুর । পুকুরের ধার ঘেঁষে মাটির রাস্তা । কিছু কদম গাছ রয়েছে । আকাশ ঢাকা পড়ছে মাঝে মাঝে । যেটুকু দেখা যায়, দেখতে ভারি ভালো লাগে । মনে হয় যেন, মনটা উড়ন্ত কোনো পাখি হয়ে গেছে, দিগন্ত ছুঁয়ে ফিরবে বলে জেদ ধরেছে ।
পার্থর ভাবনায় ছেদ পড়ে রজতের কথায়, "পার্থদা, চলো তোমায় একটু ওদিকটা ঘুরে দেখাই । সেই সঙ্গে নন্দকাকার সমাধিটাও দেখিয়ে আনি ।"
"তিনি কে গো ? মিত্তির বাড়ির কেউ ?"
"সেটা একটা রহস্যই বলা চলে ! চলো... যেতে যেতে বলছি ।"
"তোমাদের গ্রাম অনেক পালটে গেছে, তাই না ?"
"কেন বলছো ? মানে তুমি তো এই গ্রামে নতুনই বলা চলে !"
"নতুন আমি ঠিকই । কিন্তু এটুকু বুঝি, ইন্টারনেট আসার পর সবই বদলেছে, তোমাদের গ্রামও । এই তনুই যেমন ফেসবুক করে । তাই না ? তুমি অবশ্য ব্যতিক্রম ।"
"আমার কথা ছাড়ো । তবে তুমি ঠিকই বলেছো । মানুষের গ্রামীণ কালচারের প্রতি টান কমছে । 'পার্বণী' কী, আজকের ছোটোরা বোধহয় জানেও না । আমাদের পুজোয় পাঁঠাবলি বন্ধ হয়ে গেলো ! সবার হাতে এখন ফোন । কিছু না কিছু ডাউনলোড করেই চলেছে । কলেজে নোটিশবোর্ডের সামনে দাঁড়িয়ে আর কেউই নোটিশ পড়ে না, সবাই দেখি মোবাইলে ক্লিচ্ করে একখানা ফটো তুলে নেয় আগেই । গ্রামের মাসিমা দিদিমারাও আজকাল ফেসবুক করছে । দাদারা সবাই হোয়াটস্ অ্যাপ ।"
"কিন্তু কত সুবিধা হয়েছে বলো তো !"
"সে তো হয়েইছে । পচা সিরিয়াল না দেখে ইউটিউব দেখছে । নিজেকে ফরসা বানাচ্ছে অ্যাপে । সুবিধা তো হয়েইছে ।"
"আহা ! পড়াশোনারও তো কত সুবিধা হয়েছে ! সেটা বলো ।"
"পিডিএফ, এমপিত্রি হয়েছে । লোকে আর বই কিনবে না, সিডি কিনবে না । সব ডাউনলোড, শুধুই পাইরেসি ।"
"বাব্বা ! তুমি তো দেখছি অনেক খবর রাখো !"
"রাখতে হয় গো, এটুকু না বুঝে উপায় নেই । পাইরেসি হয় বলেই আমার মতো ভিখিরিরা দুটো ভালো ছবি দেখতে পায় । এবার বলি, গত বছর সেলফি তুলতে গিয়ে ওপাড়ার একটা ছেলে একেবারে পগারপার হয়েছে রেল-লাইনে । সকলে তো মেনেও নিলো, আমার মতো দুয়েকজন ছাড়া । কেউ তো আাপত্তি করলো না, রেগে গেলো না, চিন্তা করলো না । বললো না, আমাদের এইসব অ্যান্ড্রয়েড, ইন্টারনেট চাই না ! তাই দেখছি, সকলেরই এসব চাই । যত পাবে, চাহিদা আরো বাড়বে । এখন ত্রিজি দাও, আরো স্পিড চাইবে । বলে না, খেতে পেলে শুতে চায় !"
"হুম বুঝতে পারি... । এইজন্যই গ্রামের বদলটা বোঝা যায় না । কেউ স্বাভাবিকভাবে বদলালে, স্বেচ্ছায় বদলালে, চট করে সেটা বোঝা যায় না । কেউ তো আর অখুশি নয় । যদি কিছু মানুষ রেসিস্ট করতো, বাধা দিত, তাহলে এই পরিবর্তনগুলোর সাথে তাদের রোজকার স্ট্রাগলটা বোঝা যেত । কিন্তু সবাই সানন্দে মেনে নিয়েছে । তাই বদলটা স্বাভাবিক, জোরজবরদস্তি নেই কোনো ।"
এবার তনুশ্রী মন্তব্য করে ওঠে, "বাব্বা ! তোমরা থামবে ? কী কমপ্লেক্স সব কথা বলেই যাচ্ছে তখন থেকে ! দেখো, সমাধি এসে গেছে ।"
পার্থ অবাক হয়ে দেখে, কখন তারা পুকুর ছাড়িয়ে, স্কুল পিছনে ফেলে, একেবারে ধানক্ষেতের মুখে এসে পড়েছে ! ধানক্ষেতের আলের ডান দিকে সবুজের মাঝে হঠাৎ একটা বাদামি মোটা কান্ড উঠে গেছে, একটা বাবলা গাছ সম্ভবতঃ । গাছটার সামনে শালিক আর ঘুঘুপাখি উড়ছে গোটাকয়েক । তনু সেদিকেই আঙুল তুলে দেখাচ্ছে । রজত, তনুকে অনুসরণ করে পার্থও আলপথে নেমে পড়ে, গলায় ঘন্টা বাঁধা দু-তিনটে ছাগলের সাথে ।
রজত, পার্থ আর তনুকে নিয়ে নিচে নেমে যায় । চারিদিকে বাতাসে সবুজ ধানে ঢেউ খেলছে । জায়গাটায় অল্প জল জমে । মাঝে মাঝে দূরে দূরে দু-একটা বক এসে বসছে আবার উড়ে যাচ্ছে । ও-পাশের আলে একটা মোটাসোটা গরু থপ্ করে এক তাল হেগে দেয়, সঙ্গে সঙ্গে কোথা থেকে এসে হাজির হয় এক বৃদ্ধা । কেমন যেন বেঁকে বেঁকে হাঁটছে ! পিঠে উঁচু হয়ে আছে কুঁজের মতো কী যেন - তাই বোধহয় । একটা বড়ো কচু পাতায় গোবরগুলো হাতে করে তুলে নিয়ে, বৃদ্ধা এদিকেই তাকায় । তারপর রজতকে প্রশ্ন করে, "হ্যাঁ গা দোকানি, বাড়িতে লোক এয়েচে বুঝি ?"
"হ্যাঁ এই বাবু এসেছেন । আর এই মেয়েটাকে চিনলে না ? তোমাদের চন্দ্রবাবুর মেয়ে গো ।"
"ওমা ! কত বড়ো হয়ে গেচে গো দিদিমুনি !" বলে একগাল হেসে বুড়ি প্রায় লাফ দিয়ে আল থেকে রাস্তায় উঠে, মুহূর্তে ভ্যানিস হয়ে গেলো । পার্থ মনে মনে ভাবলো, বাজারে রজতের শাড়ির দোকানে একটিবার যেতে হবে ।
রজত গাছটার গায়ে হাতের ভর রেখে উদাস সুরে বললো, "গাছটা চিনতে পারছেন ? এটা বাবলা গাছ । নন্দকাকা, অর্থাৎ কিনা যার কাছে আমি ছেলেবেলা থেকে বা, বলা ভালো জন্ম থেকে বড়ো হয়েছি আর কিছুটা মানুষও হয়েছি, অবশ্য যদি তাকে ‘মানুষ-হওয়া’ বলা যায়; সেই নন্দকাকা এইখানেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছিলো । সেদিন সকাল দশটা নাগাদ আমরা এই বাবলাতলায় ছায়ায় বসে রোদের মধ্যে ধান ঝাড়া দেখছিলাম । বোধহয় ডিসেম্বর মাস ছিলো সেটা ! তখন আমার বয়স খুবই অল্প । নন্দকাকার বুকে কফ্ জমেছিলো, বসে বসে খুব কাশছিলো, আসলে মা না থাকলে সেই ভোর থেকে মাল খেতো তো খুব । আমার ছোট্ট হাতটা গালে-কপালে ছোঁয়াতেই বুঝেছিলাম, জ্বর এসে গেছে । এইসব ব্যাপারে খুব চাপা ছিল তো, তাই কাউকেই কিছু বলতো না । জ্বর গায়ে ঠায় রোদ্দুরে বসেছিলো । তখন আমারও বোঝার বয়স হয় নি । টিফিন কেরিয়ারে করে দুটো খাবার পৌঁছে দেবে নিতাইদা, সেটা একটা কারণ হতে পারে, এখন আর মনে নেই । নন্দকাকা আমার মা-কে ‘অভাগী’ বলতো, মেয়ের মতোই রেখেছিলো নিজের কাছে । নন্দকাকার সেই অভাগা মেয়েই আমার মা, মিত্তির বাড়িতে মায়ের নাম নেওয়া বারণ । কেন, সে প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করবেন না, আমি বলতে পারবো না । আমাকে নন্দকাকা শিখিয়েছিলো শিস্ দিতে, আমি আপন মনে শিস্ দিচ্ছিলাম । তারপর দেখি বুড়োর মাথা আপনা থেকেই আমার কাঁধের উপর ঢলে পড়লো । আমি প্রথমে বুঝতে পারি নি । ক্ষেত-মজুররা ছুটে এলো সব, খুব হইহই হলো কিছুক্ষণ । তারপর ওরাই বডি তুলে নিয়ে চলে গেলো । আমি সাথে সাথে গেছিলাম বটে, নদীর চরের ওদিকের শ্মশানে । দাহ দেখলাম, কিন্তু দূরে গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে । সেই প্রথম মৃত্যু দেখলাম । এদিকে খাবার তো জোটে না । আমরা তিনজন তো নন্দকাকার আস্তানায় ভূতের মতো থাকতাম । আমাদের মানে আমার আর মায়ের এই সুন্দরপুরে ঢোকা নিষেধ ছিলো । নন্দকাকার ওই আস্তানার হদিশ জানতো কেবল নিতাইদা আর কৃষ্ণ মিত্তির নিজে । তাও মেজদা-কে জানতে দেবে না বলে কতো ফন্দি-ফিকির করতে হতো নিতাই দা-কে । সেদিনটা কোনোমতে গেলো, নিতাইদা খাবার নিয়ে আসতে পারলো না । তখন খিদের জ্বালায় আমিই বাধ্য হয়ে লুকোনো আস্তানা ছেড়ে সুন্দরপুরের বাদায় ঢুকে পড়লাম । বাবুদের ছেলেরা তখন ক্রিকেট খেলছিলো । খবর পেয়ে কৃষ্ণবাবু এলেন । পরে জানলাম, নিতাইদার খুব জ্বর হয়েছিলো । তারপর থেকেই এই মিত্তির বাড়িতে আছি আমি ।" - একটানা কথাগুলো বলে, রজত গাছের গায়ে একটা জায়গায় আঙুল দিয়ে দেখালো । পার্থ দেখতে পেল, লেখা আছে - SM.. তার মনে প্রশ্ন জাগলো, কিন্তু কী ভেবে সে কিছুই বললো না । 'S' কেন ? 'M' -ই বা কেন ? তবে কি মিত্তির ? মনে মনে চমকে উঠলো পার্থ । তাদের নাতিদীর্ঘ ছায়া তখন পায়ের কাছে লুটোচ্ছে, মাথার উপর চড়া রোদ ।
পার্থ প্রশ্ন করলো, “তোমার মা-কে তো দেখলাম না রজত ?”
রজত প্রশ্নটা শুনে, যেন মজা করছে, এমনভাবে চাপাস্বরে বললো – “মা আছে । তবে লুকোচুরি খেলছে ।”
ঠিক এই সময় একটা ফতুয়া-পরা লম্বা লোক তামাক খেতে খেতে আলের উপর থেকে চেঁচিয়ে বলল, "ফের মেয়েটার সাতে ঘুরতিচি রজত ? ছোটো বাবুরে বলতিচি দাঁড়া ।"
তনুশ্রীর ফরসা মুখটা সাথে সাথে কালো হয়ে যায় । পার্থ লক্ষ্য করে, রজতের চোয়াল শক্ত হয়ে উঠলো । তারপর একটা শ্বাস ছেড়ে কিছুটা নরম হয়ে, সে পার্থর দিকে তাকিয়ে হেসে বললো, "মন্ডলদা । এই পাড়ার নামকরা কিপটে । বাগানের সুপুরি আর ডাব গাছের গায়ে নিজের নাম খোদাই করে রাখে । এমনই ওঁচা, নিজের বাড়ি বামুন পুজো করতে এলেও বোধহয় তাকে পুরো প্রণামী দেয় না । মিত্তির বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়, বলে বাবুর কাছে আমার নাম করে চেয়ে নিও । এইরকম চিজ্ । আসলে বোধহয় ছোড়দার চর, মেয়ের উপর নজর রাখতে লাগিয়েছে ওকে । যেমন বাপ, তেমনি ব্যাটা ।"
আহত গলায় তনু বলে ওঠে, "আহ্ টমদা ! ফের ওভাবে কথা বলেছো বড়োদের নিয়ে !"
এরপর আর গল্প জমে না । তিনজনে মাটির রাস্তায় উঠে পড়ে, মিত্তিরবাড়ি-মুখো হাঁটতে থাকে ।
*** *** *** *** *** *** *** *** *** *** *** ***
"আজ আমরা এখানে জড়ো হয়েছি আমাদের নবতম প্রচেষ্টা, আমাদের নবযুবশক্তি ক্লাবের নবতম উদ্যোগ, নবযুবশক্তি ষান্মাসিক পত্রিকার শুভ উদ্বোধনে । মনে রাখবেন বন্ধুগণ, আমরা একটি এমন প্রচেষ্টায় সম্মিলিত হয়েছি, এমন একটি সংকল্প আমরা নিয়েছি, যা কিনা ভবিষ্যতে বৃহত্তর একটি আন্দোলনে পরিণত হবে । আজ বাঙালির সংস্কৃতি, এই গ্রামজীবনের সংস্কৃতি, নষ্ট হয়ে যেতে বসেছে । কেন ? কারণ জানবেন বন্ধুগণ, আর কিছুই না... কুশিক্ষা, অশিক্ষা, নাগরিক ভোগবাদ । আগেকার দিনে বাবা-মায়েরা ছেলেমেয়েদের শিক্ষা দিতেন, প্রকৃত শিক্ষা । ছেলেমেয়েরাও তাঁদের পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করতো নিঃসঙ্কোচে । তখন বড়োরা আশীর্বাদ করে কী বলতেন ? বলতেন, বাবা মানুষ হও... মানুষের মতো মানুষ হও.. । আর আজ ? আজকের বাবা-মায়েরা ছেলে-মেয়ের হাত হাঁটু অব্দি নামার আগেই ধরে ফেলেন । বলেন - ডাক্তার হও, ইঞ্জিনিয়ার হও । জন্মদিনে রাশি রাশি উপহারে শিশুরা চাপা পড়ে যায় । জানবেন বন্ধুগণ, একদিন এইসব বাবা-মায়েদেরই বৃদ্ধাশ্রমে ঠাঁই হয় ।" - একটানা বলে গিয়ে একটু থামলো শ্রীকান্ত মিত্র । চল্লিশ অতিক্রান্ত সূর্যকান্ত মিত্রের একমাত্র ছেলে, স্নাতক পাঠরত শ্রীকান্ত ।
ওরকম একটা অদ্ভুত ব্যাখ্যা শুনেও উপস্থিত শ্রোতাদের মধ্যে, বিশেষত সামনের সারি থেকে জোর হাততালি হলো দেখে, পার্থ অবাক হয়ে গেল । পার্থর সারিতে দু'জনের পরেই একটা সবুজ প্লাস্টিকের চেয়ারে বসে মাথা নাড়তে দেখা গেল সূর্যকান্ত মিত্রকে । সূর্যকান্ত গলায় একটা সোনার চেন পরেন, এই প্রথম খেয়াল করলো পার্থ । দেখতে পেলো কারণ, ভদ্রলোক প্রায়ই ঝুলন্ত চেনটাকে ডান হাতের দুটো আঙুলে নিয়ে পাকান, আবার ছেড়ে দেন, আবার পাকান, বোধহয় মুদ্রাদোষ । পার্থর কাঁধে এইসময় একটা টোকা পরলো, তাকাতেই দেখলো নবকান্তবাবু তার দিকেই তাকিয়ে হাসছেন । বললেন, "আমাদের বাট্টু, এই সেদিনও কোলে চড়ে ঘুরতো, আজ কেমন বক্তৃতা দিচ্ছে দেখেছো ?"
"ও ! শ্রীকান্ত বাবুর ডাক নাম বাট্টু বুঝি ?"
"হ্যাঁ হে ! তা আবার বাবু কেন ? তোমার চেয়ে অনেক ছোটো । সবে একুশ । স্বাস্থ্য ভালো, কারণ ব্যায়াম সমিতিতে নাম লিখিয়েছে বছর দুই হলো... বুঝলে কিনা ? তুমি বাট্টু বলেও ডাকতে পারো.. পাড়ায় সবাই ওই নামেই ডাকে ।"
"কিন্তু আমি তো পাড়ার কেউ নই জ্যেঠামশাই । সূর্যবাবু যে ঘন্টা খানেক আগেই বললেন, "আমি আউটসাইডার ।"
"আহা... ওসব কথা ধরতে আছে ? নামে সূর্য তো.. তাই বোধহয় তেজ একটু বেশি । সে যদি তেজের কথাই বলো… বলবো, তাও যদি তুমি রাধাকান্তকে দেখতে..." বলে কী যেন ভেবে সহসা থেমে গেলেন নবকান্তবাবু । তারপর বললেন, "বাট্টুকে বলে রেখেছি, তোমার শোয়ার ব্যবস্থা ওই যতীন রায়ের বাড়িতে দোতলায় হয়েছে । আমার সব বুঝিয়ে বলা আছে । তুমি শহরের বাসিন্দা, যদি মশা কামড়ায়, তাই মশারিও রাখা আছে । চিন্তা কিছুই নেই । লাগলে রাতে মশারি খাটিয়েই শুয়ো । বাট্টুই তোমাকে নিয়ে যাবে এই অনুষ্ঠান শেষ হলেই । মায়ের আরতি দেখে তারপর যেওখন । ও হ্যাঁ... ভুলেই গেছিলাম.. আজকে তো সেসবে অনেক রাত হবে ! তুমি বরং যতীনদের বাড়িতেই চলে যাও । ওখানেই সন্ধিপূজা দেখে নেবে ।"
"আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ ।" - নিরুপায় পার্থ বললো । সত্যিই রাত এগারোটা, সাড়ে এগারোটা পর্যন্ত জেগে এই বাড়িতে বসে থাকা সম্ভব নয়, উচিতও নয় । দুপুরের কথাটা মনে পড়তেই কেমন আহত অনুভব করে পার্থ । রজতদের সাথে বেড়িয়ে, ফিরে এসে দুপুরের খাবারটা জ্যাঠামশাই অর্থাৎ নবকান্ত ঘোষের তত্ত্বাবধানে ভিতর-বাড়ির খোলা উঠোনে আরো অনেকের সাথে পংক্তিভোজনে বসেছিলো পার্থ । মাজা মেঝের উপর পাতা পুরোনো আমলের টেবিল-চেয়ারে বুবুনের পাশে বসে, মধ্যাহ্ন-ভোজন সেরেছিল সে । নুন-লেবু সহযোগে নিতাইদা ও এক বৃদ্ধার পরিবেশনে ভাত, ডাল, শুক্তো, পনীরের তরকারি (যারা মাংস খাবে না, মূলতঃ তাদের জন্য), চিকেন আর চাটনি - প্রতিটা রান্নাই ভালো ছিলো । নবকান্তবাবুও তাদের সঙ্গেই বসে খাচ্ছিলেন আর গল্প করছিলেন । শক্ত জিনিস খেতে ভদ্রলোকের বেশ কষ্ট হয় বোঝা যাচ্ছিলো, তাই একটু ধীরেসুস্থে খান তিনি । ডাল, পনীর ওনার জন্য পারফেক্ট । ভদ্রলোক বলছিলেন, গোষ্ঠ মেলার সময় কেমন যাত্রা হয় ! সেই বিকেল থেকে লোকে ইঁট পেতে রাখে, সারারাত যাত্রা দেখবে বলে । তবে সেই ট্র্যাডিশন নাকি ক্রমশ বদলাচ্ছে ! ইদানিং গোষ্ঠমেলাতে গাজন বা, যাত্রা দেখার আগ্রহ চোখে পড়ার মতো কমে যাচ্ছে । তার জায়গা দখল করছে ডিভিডি চালিয়ে, পর্দা লাগিয়ে সিনেমা দেখানো । 'লাল বাদশা', 'ফাটাকেষ্ট' 'তুফান' বা, 'কহো না পেয়ার হ্যায়' চালিয়ে দিলে গ্রামের লোক এখন অনেক বেশি বিনোদন খুঁজে পায় । দুনিয়াটা সত্যিই বদলাচ্ছে, তিনি আক্ষেপ করছিলেন । পার্থ তখন বলেনি, কিন্তু সে মনে মনে জানে, দুদিন পর কেউ ডিভিডিতেও সিনেমা দেখবে না । ইন্টারনেটের স্পিড বাড়ালে, আর ভালো নেট-পরিষেবা পেলে, গ্রামের লোকও যা দেখার এরপর মোবাইলেই দেখবে । আর দেখবে ঘরে বসেই, কোনো গোষ্ঠমেলাতে আসতে হবে না - এই ভবিতব্য । এইসব কথা বলতে বলতেই তাদের খাওয়া হয়ে যায় এবং প্রায় সকলের শেষে পার্থ হাত ধুতে যখন বারান্দায় নেমে এসে দাঁড়িয়েছে, তখনই তার চোখ পড়ে, সিমেন্ট বাঁধানো কমন উঠোনের উল্টোদিকে একটা ইজি চেয়ারে বসে কৃষ্ণকান্ত মিত্র তার দিকে চেয়ে রয়েছেন । মানুষটা সম্পর্কে তার মধ্যে একটা কৌতুহল তৈরি হয়েই ছিলো, তখন তাঁকে ওইভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে পার্থ স্বভাবতই এগিয়ে যায় তাঁর কাছে । গলায় যতটা সম্ভব বিনয় এনে সে জিজ্ঞাসা করেছিলো, "কিছু বলবেন ?"
"দেখ তো… বালতিগুলো সব ভর্তি আছে ? খালি থাকলে, একটু মগটা নিয়ে কল থেকে জল এনে ভরে দাও তো ।" - তাঁর সামনেই সারি দিয়ে রাখা চার-পাঁচটা বালতির দিকে তাকিয়ে, অম্লানবদনে বলেছিলেন ভদ্রলোক । বলাইবাহুল্য পার্থ কী বলবে, কী করবে বুঝে উঠতে পারেনি । অপ্রস্তুত হয়ে গিয়েছিলো একেবারে । বুঝেছিলো ভদ্রলোকের সম্পর্কে যা রটনা, তার কিছুটা হলেও বাস্তব । কিন্তু বলেছেন যখন তখন কিছু তো একটা করতেই হয়, নেহাত মামুলি কাজ । তাই সে ভদ্রলোকের দেখিয়ে দেওয়া একটা লাল রঙের ছোটো মগ নিয়ে, এগিয়ে গিয়েছিলো উঠোনের এক কোণে বাঁধানো কলতলায় । যখন সে মগে জল ভরছে কল পাম্প করে, তখনই সে একটা বিকট হাঁক শুনতে পায় - "বলি এটা হচ্ছে কী শুনি ?" আওয়াজটার উৎস সন্ধান করতে গিয়ে সে দেখতে পায়, সূর্যকান্ত এসে দাঁড়িয়েছেন কৃষ্ণকান্ত মিত্তিরের গায়ের কাছে । আর হাঁকটাও পার্থকেই উদ্দেশ্য করে । তখন তিনি ফের বললেন, "হ্যাঁ হ্যাঁ, আপনাকেই বলছি, এটা কী হচ্ছে জানতে পারি ?"
“আসলে উনি একটু বালতিগুলো ভরে দিতে বললেন তো, তাই !” – থতমত খেয়ে জানিয়েছিলো পার্থ ।
"ঘরে আগুন দিতে বললে, তাই দেবেন ? একটা মাথা-খারাপ বুড়ো লোক কী বললো না বললো, আপনি চলে গেলেন জল ভরতে ? ঘটে কি কিস্যু নেই ?"
"দেখুন, আপনি অযথা উত্তেজিত হচ্ছেন..." - বলতে চাচ্ছিলো অপমানিত পার্থ, কিন্তু তাকে থামিয়ে দিয়েই সূর্যকান্ত মাঝপথে বলে উঠেছিলেন, "আপনি আউটসাইডার, সে কথাটা মনে রাখবেন ! বাড়ির ভেতরের ব্যাপারে নাক গলাবেন না ! দরদ দ্যাখাচ্ছে !" - পার্থকে ধমকে দিয়ে, যেন কিছুই হয় নি, এমন একটা ভাব করে তিনি বৃদ্ধ কৃষ্ণকান্তকে ইজি চেয়ার থেকে তুলে নিয়ে ভিতরের ঘরে চলে গেলেন । তারপর নবকান্ত বাবুই তাকে সেই হতবুদ্ধি অবস্থা থেকে উদ্ধার করেছিলেন । কেবল ছোট্ট করে হেসেছিলেন নবকান্ত ঘোষ, তার কাঁধে হাত দিয়ে সরিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন, মুখে বলেননি কিছুই ।
এদিকে ততক্ষণে শ্রীকান্তর বক্তৃতা অন্য দিকে মোড় নিয়েছে, "নবযুবশক্তি পত্রিকা গোষ্ঠী আজ একটা বৃহত্তর কর্মকাণ্ডের পরিকল্পনা নিয়েছে আপনারা জানেন । যেখানে যত প্রতিভা নিজেদের প্রকাশের পথ পাচ্ছে না, তাদের পথ দেখাবে যুবশক্তি । পাশ্চাত্যে আপনারা জানেন, মডেলিংয়ে, নাচে-গানে আগ্রহী মেয়েদের প্রতিভা বিকাশের সুযোগ না দিয়ে, তাদের অর্থ আর খ্যাতির লোভ দেখিয়ে একদল অসাধু ব্যবসায়ী তাদের শোষণ করে । আমরা এইসব প্রতিভাদের পাশে আছি নিঃস্বার্থভাবে । আজ আমরা বুক ঠুকে বলতে পারি, পশ্চিমবঙ্গের কোথাও এমন কোনো পত্রিকা নেই, যারা নাচ-গান-সাহিত্যচর্চা-মডেলিং-ছবি আঁকা-রূপচর্চা সবকিছুকে একই আঙিনায় নিয়ে আসতে পেরেছে । আমরা পেরেছি । আমাদের পত্রিকার ব্যাক কভারে আপনারা দেখবেন, আমাদেরই গ্রামের দুই প্রতিভাবান মেয়ের ফটোশ্যুটের ছবি । এরকম আমরা আরো করবো পরে.. জানি আপনাদের সাথে পাবো.. সেই ভরসা রাখি । বাঙালির সংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে রাখার, তার নিজস্বতা অনুসন্ধানের এই প্রয়াসে আগ্রহী যুবশক্তিকে আপনারা ছড়িয়ে দিন, সেই সঙ্গে নিজের নিজের পাড়ায়, পরিচিতজনেদের মধ্যে খুঁজে বের করুন উৎসাহী ছেলেমেয়েদের, তাদের নিয়ে আসুন আমাদের এই মঞ্চে । আমাদের ভবিষ্যতে শর্ট ফিল্ম মেকিংয়ের ওয়ার্কশপ করারও আগ্রহ আছে বন্ধুরা, যদিও আমি এই মুহূর্তে এই বিষয়ে তেমন কিছু জানি না । কিন্তু আমরা আমাদের মধ্যে পেয়েছি কলকাতার স্বনামধন্য শর্টফিল্মমেকার পার্থ ভট্টাচার্যকে । আশা করি তাঁর থেকে আমরা এই বিষয়ে কিছু শিখতে পারবো ।" - বলেই শ্রীকান্ত সোজা তর্জনী তুলে পার্থর দিকে ইঙ্গিত করে, দেখা যায় অনেকেই মুখ ঘুরিয়ে তাকে দেখছে, অনেকে হাততালিও দেয় । পার্থ এরকম অবস্থায় কখনও পড়ে নি, সে স্বপ্নেও কখনও নিজেকে স্বনামধন্য ভাবতে পারে নি, কী করবে সে বুঝে উঠতে পারে না, তবে মনে মনে কিছুটা 'ধন্য' বোধ না করে, পারে না ।
শ্রীকান্ত অবশ্য অপ্রতিরোধ্য, "আমরা স্বপ্ন দেখি, বাঙালি সংস্কৃতিকে আবার সেই আগের জায়গায় ফিরিয়ে নিয়ে যাব । কিন্তু কী এই সংস্কৃতি ? সংস্কৃতি তাই যা আমাদের ধারণ করে রাখে । আমাদের ঐতিহ্য, আমাদের নিজস্বতাই আমাদের সংস্কৃতি । আপনারা রাজা রামমোহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের কথা জানেন । তাঁরা যখন সতীদাহ প্রথা রদ করেছিলেন বা, বিধবাবিবাহ প্রবর্তন করেছিলেন, তখন কিন্তু তাঁরা তাঁদের মতামতের স্বপক্ষে যুক্তি তথ্য প্রমাণ সংগ্রহ করেছিলেন পিছনে ফিরে গিয়েই । আমাদের প্রাচীন সমস্ত শাস্ত্র থেকেই কিন্তু তারা তাদের তথ্য প্রমাণ সংগ্রহ করেছিলেন । এই শিক্ষা কি আমরা ভুলে যাবো ? সুতরাং বন্ধুগণ এই সংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে রাখতে চাইলে, আমাদের নিজেদের অতীত ঐতিহ্য সম্পর্কে সচেতন হতে হবে । কাজটা সহজ নয় বন্ধুগণ । সবথেকে বড় সমস্যা হচ্ছে আমাদের হাতের এই মুঠো ফোনটি । ওটি যে কী বিষ, তা বলে বোঝানো যাবে না । ছোটো ছোটো ভাইবোনদের মাথা খারাপ করে দিতে ওর জুড়ি মেলা ভার । তাই বলবো আপনারা সতর্ক থাকুন আর পারলে এই মোবাইল সংস্কৃতি যতটা পারেন, বর্জন করুন । আমাদের পরিকল্পনা রয়েছে আগামী সপ্তাহে আমরা একটি সাহিত্য আড্ডা পরিচালনা করবো, তখন কিন্তু কেউ দূরে সরে থাকবেন না । আপনারাই আমাদের সম্পদ, আপনারা ছাড়া এই সমিতি, এই ক্লাব, এই গোষ্ঠীর কোনো অস্তিত্ব নেই । তাই বন্ধুগণ, সাংস্কৃতিক পাঁচিল তুলতে আবার পড়াশোনা শুরু করুন । কোনো পরীক্ষার জন্য নয় । অনেক বড়ো একটা লড়াইয়ে নামার প্রস্তুতি হিসেবে, এক অর্থে সেটাও পরীক্ষা । আমরা 'হাই হ্যালো শুক্রিয়া থ্যাংক ইউ' সংস্কৃতিকে বর্জন করবোই বন্ধুগণ । তাই আমরা সামনের সপ্তাহ থেকে সাহিত্য আড্ডার ব্যবস্থা করছি । সাহিত্য আড্ডায় কোনোদিন বঙ্কিমচন্দ্র, কোনোদিন রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টির কোনো একটি ধারা, বিষয় হিসেবে রাখবো । মনে করুন, সামনের সপ্তাহের আড্ডায় বিষয় রাখা হলো রবীন্দ্রনাথের গান । এবার আপনারা আপনাদের মনের অনুভূতি, রবি ঠাকুরের গান নিয়ে ভালোলাগা-মন্দলাগার কথা ভাগ করে নিতে পারবেন সবার সাথে । কিন্তু উপস্থিত থাকতে হবে এবং কথাও বলতে হবে । তখন কিন্তু কোনো 'না' শুনবো না । মনে রাখবেন, শুনলেও কিন্তু অনেক কিছু শেখা যায় । আপনাদের সকলকে অংশ নিতে হবে এবং কথা বলতে হবে সেই বিষয় নিয়ে, প্রস্তুত হোন, তৈরি থাকুন, প্রতিদিন পড়াশোনা করুন ।..."
দর্শকাসনে একটা ফিসফাস শুরু হল এই কথা শুনে । বোঝাই যায় পড়াশোনা করতে বলায়, জনতা কিঞ্চিৎ ভয় খেয়েছে । শ্রীকান্ত মিত্তির অবশ্য ভড়কে যাওয়ার বান্দা নয় । আবার গুছিয়ে শুরু করে, "আজ আমাদের লড়াই কতটা কঠিন, আপনাদের আচরণেই বোঝা যাচ্ছে । তাই আমাদের প্রথম লড়াই নিজেদের সাথে । আত্মশক্তিকে জাগিয়ে তুলুন বন্ধুগণ, এছাড়া কোনো পথ নেই । আজ গ্রাম ছেড়ে সকলে শহরে চলে যাচ্ছে, একদিন আমাদের এই পাড়ায় এত ছোটো ছোটো ছেলে ছিলো, বাবা-কাকার কাছে শুনেছি মাঠে সকলের খেলার জায়গা হতো না । আর আজ ? পাড়াকে পাড়া ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে । কেন ? ভাবুন... ভাবুন.. কেন ? এভাবে চললে গ্রামের সামনে অসহায় আত্মসপমর্পণ ছাড়া আর কোনো পথ থাকবে না । মনে রাখবেন, পাশ্চাত্য সংস্কৃতিকে পুরোপুরি বর্জন করতে সক্ষম হয়েছিলেন বলেই কিন্তু বঙ্কিমচন্দ্র হতে পেরেছেন বঙ্কিমচন্দ্র আর রবীন্দ্রনাথ ও রবীন্দ্রনাথ হতে পেরেছেন ।..."
পার্থ ভাবলো, কেলেঙ্কারি করেছে ! বঙ্কিমচন্দ্র আর রবীন্দ্রনাথ পাশ্চাত্য সংস্কৃতিকে পুরোপুরি বর্জন করেছিলেন ? বঙ্কিমের প্রথম উপন্যাস 'রাজমোহনস্ ওয়াইফ' তো ইংরেজিতেই প্রকাশিত হয় । তাছাড়া তাঁর বাংলা উপন্যাস চর্চার শুরু তো টমাস হার্ডি, ওয়াল্টার স্কটের প্রভাব থেকেই, এরকমটাই সে জানে । একগাদা লোকের সামনে অকালপক্কের মতো এসব কি বলছে শ্রীকান্ত মিত্তির ? জেরেমী বেন্থাম, জন স্টুয়ার্ট মিল, Auguste Comte প্রভৃতিদেরও যথেষ্ট প্রভাব বঙ্কিমের দর্শনে ছিলো বলেই সে জানে । আর বরীন্দ্রনাথ প্রাচ্য-পাশ্চাত্যের মধ্যে অভাবনীয় মিলন ঘটিয়েছিলেন একথা কেই বা না জানে ? রবি ঠাকুরের গানগুলিই তো তার প্রমাণ ।
এদিকে ততক্ষণে দুর্গা প্রতিমার সামনে উপস্থিত শ্রীকান্ত সারি সারি প্লাস্টিকের চেয়ারে বসা জনা তিরিশ দর্শকদের তথা শ্রোতাদের শপথবাক্য উচ্চারণ করতে পীড়াপীড়ি শুরু করেছে । ভাবটা এমন, শপথ নিতেই হবে । অতএব একটা সম্মিলিত উচ্চারণ গমগম করে ওঠে আটচালায় জমজমাট সভাতে । তাই দেখে পার্থর সুকুমার রায়ের সেই পংক্তিগুলো মনে পড়ছিলো, "রামগরুড়ের বাসা / ধমক দিয়ে ঠাসা, / হাসির হাওয়া বন্ধ সেথায় / নিষেধ সেথায় হাসা ।"
সেসব নাটকীয় মুহূর্ত শেষ হলে, শ্রীকান্ত নবকান্তবাবুকে সামনে ডেকে নিয়ে, পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করলো, নিজের বাবাকে কিন্তু একবারও মঞ্চে ডাকলো না । নবকান্তবাবু আর গ্রামের একমাত্র বয়েজ্ স্কুলের প্রধান শিক্ষক জ্যোতির্ময়বাবু নতুন পত্রিকার মোড়ক খুলে শুভ উদ্বোধন করলেন । তারপর পার্থকে আরেকবার অবাক করে দিয়ে শ্রীকান্ত ডেকে নিলো রজতকে, সে এতক্ষণ কোথায় ছিল কে জানে ! জানা গেল, সেই নাকি পত্রিকার চমৎকার প্রচ্ছদখানি এঁকেছে । বাব্বা কত গুণ ছেলেটার ! আর অদ্ভুত ব্যাপার, সূর্যকান্তদের প্রজন্ম রজতকে যতটা অপছন্দ করে, ঠিক ততটাই তাকে ভালোবাসে এই শ্রীকান্ত, তনুদের প্রজন্ম - এইটুকু সময় এখানে এসেও পার্থ এটুকু খেয়াল করেছে । রজত কে ? সেই সকাল থেকে সে যে ছেলেটাকে দেখেছে হাসিমুখে সারাক্ষণ কাজ করতে, তার সাথে দুঃখগুলো ভাগ করে নিতে, অনেকের নানা বিদ্রুপেও এতোটুকু বিরক্ত না হতে, অথচ যে পিছনে ফিরলেই একটা চাপা ফিসফিস শুরু হচ্ছে, সেই হচ্ছে রজত । পাড়ায় অনেকেই আড়ালে রজতের নামে একটা আপত্তিকর কথা বলে, শুনেছে পার্থ । বলে, রজত ‘বেজন্মা’ । পার্থ নিজে যতটুকু বুঝেছে, রজত হচ্ছে মিত্তির বাড়ির আশ্রিত । আর একটা জিনিস পার্থ খুব ভালোমতোই বোঝে, গ্রামের লোক কাউকে সহজে ক্ষমা করেনা, সহজে কোনো কিছু ভুলে যায় না । এদের জীবনে ঘটনার আবর্ত কম বলেই বোধহয়, এরা সাংঘাতিক স্মৃতিধর ! এবার দেখা যাক, বাকিটা ক্রমশ প্রকাশ্য ।
*** *** *** *** *** *** *** *** *** *** *** ***
বিকেল হয়ে গেলো । পত্রিকা প্রকাশ হয়ে গেছে, সভা ও শেষ হয়েছে । উপস্থিত সমস্ত গ্রামবাসীরা একে একে ফিরছেন । প্রত্যেকের হাতে একটি করে পত্রিকা । পার্থও এক কপি পত্রিকা পেয়েছে । এ-ফোর সাইজের মামুলি সাদা পাতায় কালো অক্ষর । বোঝাই যাচ্ছে নিজেরাই প্রিন্ট আউট বের করে নিয়েছে । কিছু হাতে আঁকা ছবিও আছে । কোন প্রকাশনা সংস্থা থেকে যে এটি ছাপানো হয়নি, সেটা পত্রিকা হাতে নিয়েই বেশ বোঝা যায় । শুধু উপরের কভারটা রঙিন, মোটা কাগজের কভারটা লুজ পাতাগুলোর উপরে রেখে স্টেপল করে দেওয়া হয়েছে, মানে একেবারেই কাঁচা কাজ । সূচিপত্রে চোখ বুলিয়ে সে দেখতে পেলো, নবকান্ত ঘোষেরও একটি লেখা আছে, গল্প । পরে বসে পড়তে হবে, ভাবলো পার্থ । সে যখন পত্রিকাটা নিয়ে ব্যস্ত, ঠিক তখনই তার বাম কাঁধের উপর কেউ একটা হাত রাখলো ।
"দুঃখিত আপনি মনোযোগ দিয়ে পত্রিকাটা দেখছিলেন, আপনার মনোযোগে বিঘ্ন ঘটালাম । আশাকরি আমাদের উদ্যোগ খুব খারাপ হয়নি । আমি শ্রীকান্ত মিত্র, কলেজে লোকে ছাত্রনেতা বলে দুর্নাম রটায় । তো আজ অধমের উপরে দায়িত্ব বর্তেছে যে, আপনাকে যতীন্দ্রনাথ রায়ের বাড়িতে পৌঁছে দিতে হবে । তা এখনই কি রওনা দেবেন ?"
"হ্যাঁ তা রওনা দেওয়া যেতেই পারে । পুকুরের ওপারেই তো ?"
"হ্যাঁ পুকুরের ওপারেই । খুব বেশি দূরে না । কিন্তু পুকুরের বাঁদিকের রাস্তাটা ধরবো না আমরা । ডান দিক দিয়ে একটু ঘুরে যাবো । পুকুরটাতো একেবারে কানায়-কানায়… সকালে দেখেছেনই । তাই বাঁদিকের ওই পায়ে চলা পথটায় অন্ধকারে না যাওয়াই মঙ্গল ।"
পার্থ ততক্ষণে শ্রীকান্তর সঙ্গে পূজামণ্ডপ তথা আটচালা ছেড়ে বেরিয়ে এসেছে । বাইরেটা সত্যিই অন্ধকার হয়ে গেছে । আর চারপাশে ঝাঁকে ঝাঁকে মশা । ও এতক্ষণ আলোয় ছিল বলে বুঝতে পারেনি কখন সন্ধ্যা নেমেছে ! মশা অবশ্য দু-একটা কামড়াচ্ছিলো মাঝেসাজেই, কিন্তু এখানে বাইরেটায় একেবারে রাবণের বংশ ! পুকুরের ঠিক পাড়েই একটা বিরাট বড়ো ছাতিম গাছ । আর গাছটার ঠিক নিচেই মাটির উপরে কিছু একটা ঢিবি-মতো উঁচু হয়ে আছে । জিনিসটা সম্ভবত পাথরের । আটচালার প্রবেশপথে একটা টিউব লাগানো, তারই আলোয় আবছা দেখা যাচ্ছে । এটা সে সকালবেলায় খেয়াল করেনি ।"
পার্থ সেদিকে শ্রীকান্তর দৃষ্টি আকর্ষণ করে প্রশ্ন করে, "ওটা কী ?"
"ওহ্ ওটা ? চলুন হাঁটতে হাঁটতে বলছি । আসলে আমাদের এই পুকুরটা অনেক পুরোনো । ছেলেবেলায় দেখেছি, যখন পুকুরটা সেঁচা হতো, তখন নীচ্ থেকে কত কী কুড়িয়ে পাওয়া যেতো ! আমাদের ক্রিকেট খেলতে গিয়ে হারিয়ে যাওয়া কতো ক্যাম্বিসের বল আমরা পরে পেয়ে যেতাম, তখন অবশ্য বলগুলোর খুবই করুণ দশা, ছাল-চামড়া উঠে যেত । পুকুরে জল না থাকলে ঘাটের সিঁড়িতে অনেক খুচরো পয়সাও পাওয়া যায় । তবে আমি যখন খুব ছোটো, বোধহয় বছর তিনেক বয়স, তখন একবার পুকুর সেঁচা হয়েছিলো । আর সেবার পুকুরের ওই বাঁ দিকে বেশ খানিকটা মাটি কাটা হয়েছিল । ওই জায়গাটা আগে অগভীর ছিলো । সেবারে পুকুর কেটে, ওই দিকটাতে কাঠের কয়েকটা মোটা গুঁড়ি পুঁতে, বালির বস্তা দিয়ে দেওয়া হয়েছিলো । তবে সে তো অনেক দিন আগের কথা ! এখন আবার ভেঙে যাচ্ছে ওদিকটা, সারাই করতে হবে । যাইহোক যেটা বলছিলাম, সেবারে পুকুর কাটাতে গিয়ে নীচ্ থেকে পাওয়া গিয়েছিলো গোটা চারেক বড়ো বড়ো পাথরের চাঁই, তারই একটা পড়ে আছে আমাদের এই ছাতিম গাছের তলায় । তবে ওগুলোকে ঠিক পাথরের চাঁই বলা যায় কিনা একটু সন্দেহ আছে, কারণ এবড়োখেবড়ো বা, অসমান নয় পাথরগুলো । অতদিন জলের তলায় ছিল বলে শ্যাওলাতে ঢাকা ছিলো, তারপর সেগুলোকে তোলা হলে শ্যাওলা পরিষ্কার করানো হলো । চারটে পাথর চারদিকে ছড়িয়ে গেলো, একটা এই সুন্দরপুরে রইলো, একটা গেলো পাশের গ্রাম হরিণঘাটায়, আর একটা গেলো বাঁশপোতায় । এই তিনটের ক্ষেত্রে কমন ব্যাপার হলো, এই প্রত্যেকটা পাথরই বর্তমানে রয়েছে কোনো না কোনো মন্দিরের কাছে । যেমন মনে করুন, আপনি যদি গোষ্ঠ-র সময় আসেন, তাহলে দেখবেন গোষ্ঠতলায় যে মঞ্চ রয়েছে, সেখানে এই গ্রামের এবং আশপাশের বেশ কয়েকটি গ্রামের ঠাকুর এসে বসে । এই যতীনদাদুদের শ্যামসুন্দরের কথাই ধরুন না, গোষ্ঠ মঞ্চে শ্যামসুন্দর গিয়ে বসেন একেবারে শেষে আবার সকলের আগে চলে আসেন । ওনাদের মন্দিরের ঠিক কাছে যদিও পাথরটা নেই, রয়েছে আমাদের এদিকটায় – পুকুরের এপার আর ওপার । হরিণঘাটায় রয়েছে শ্যাম-রাই, ওই মন্দিরের পাশে একটা পাথর রয়েছে । আবার বাঁশপোতায় গোপীনাথ-রাধারানীর মন্দিরের পাশেই রয়েছে আরেকটা পাথর । এবারে বলুন আপনি সদানন্দ মিত্রের নাম শুনেছেন কিনা ?"
"না মানে আমি তো ঠিক..." – অনুমান করলেও, পার্থ সেটা স্বীকার করে না । দেখাই যাক্, শ্রীকান্ত কী বলে – ভাবে পার্থ ।
"আচ্ছা বুঝেছি, শোনেননি । বা শুনলেও হয়তো মনে করতে পারছেন না । তো সদানন্দ মিত্র হলেন আমার ঠাকুর্দার খুড়তুতো ভাই । ভালো ছবি আঁকতেন । উনি মারা গিয়েছেন তাও অনেক বছর হলো, গ্রামের একেবারে শেষপ্রান্তে যেখানে উনি থাকতেন আর কি, ঠিক সেইখানে আর একটা মন্দির আছে । নন্দদুলাল-এর মন্দির । গোষ্ঠতলায় নন্দদুলাল-কেও আনা হয় । কিন্তু জায়গাটা একেবারেই অরক্ষিত । ওইখানে আরেকটা পাথর ছিলো, এখন আর নেই । থাকবেই বা কী করে ? উনি মারা যাবার পরে দেখার কেউ ছিলো না । মন্দিরে তালা চাবি পড়ে যায়, কিন্তু পাথরতো থাকে খোলা জায়গায় বাইরে । ফলে যা হবার, চুরি হয়েছিলো ।"
"বুঝলাম ! আচ্ছা কী আছে ঐ পাথরে ?"
"কী আছে বলতে... কতকগুলো নকশা কাটা আছে । আমি সেই কবে দেখেছি, এখন আর ভালো মনে নেই । ছোটোবেলায় একবার আমরা পাড়ার ছেলেরা মিলে গরমের ছুটিতে ছাতিম গাছতলায় পাথরটা তুলতে খোঁড়াখুঁড়ি করেছিলাম । আসলে মাটিতে গেঁথে বসে গেছে তো অনেকটা ! তখন বোধহয় আমি ক্লাস ফাইভে বা, সিক্সে পড়ি । পাথরটা কিন্তু বেশ বড়ো, মানে মাটির উপরে যতটা দেখা যাচ্ছে তার তিনগুণ আছে মাটির তলায় চাপা । খোঁড়াখুঁড়ি করে আমরা অনেকটাই তুলে ফেলেছিলাম । অনেক আঁজি আঁজি নকশা কাটা ছিলো, এটা মনে পড়ে । কিন্তু সেই অর্থে কোনো সংখ্যা বা অক্ষর ছিলো বলে মনে পড়ছে না । তাহলে হয়তো কিছু জানা যেতো । কিন্তু পুরো পাথরটা আমরা তুলতে পারিনি । কারণ তার আগে দাদাই, মানে কৃষ্ণকান্ত মিত্র ব্যাপারটা ধরে ফেলেন এবং যথারীতি আমাদের কাজ বকাবকি করে পন্ড করে দেন । বলেছিলেন আমরা নাকি ঐতিহ্য নষ্ট করছি ! ভাবুন দেখি ! কোনো কিছু জানার চেষ্টা কবে থেকে ঐতিহ্য নষ্ট করা হলো ?" - কথাগুলো একটানা বলে গিয়ে হাসতে হাসতে শ্রীকান্ত বলে উঠলো, "তাইজন্যেই শেষমেষ ঐতিহ্য বাঁচাবার লড়াইতে নেমেছি ।"
পার্থ মুখে কিছু বললো না, কিন্তু পাথরটার প্রতি কৌতূহল বোধ করছিল সে । না জানি ওই পাথরের নীচে কী রহস্য চাপা পড়ে আছে ! কিন্তু তার পক্ষে এখন তো সেভাবে কিছুই করা সম্ভব নয় ।
নীরবতা ভঙ্গ করলো শ্রীকান্তই, "দাদা ! বলছি... আপনি আমাদের পাশে থাকবেন তো ?"
"কীসের কথা বলছেন ?"
যতীন রায়ের দালানে পৌঁছে সদর দরজায় থমকে দাঁড়িয়ে শ্রীকান্ত বললো, "আমাকে প্লিজ 'আপনি' বলবেন না । আমি আপনার থেকে বয়সে অনেক ছোটো । আমি বলতে চাইছিলাম সভাতে আপনাকে জিজ্ঞাসা না করেই একটা দায়িত্ব আপনার ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়েছি । কিছুই না, সামনের রবিবার তো একাদশী পড়েছে, আপনাকে শুধু একটু আটকে রাখব একটা দিন । আমি শুনেছি আপনি দশমীর ভাসান দেখেই ফিরে যাবেন ! যদি আর একটা দিন থেকে যান, তাহলে সব ব্যবস্থা আমি করে দেবো । আপনার কোনো অসুবিধা হবে না । আপনি শুধু ওই সাহিত্য আড্ডায় উপস্থিত থেকে শর্ট ফিল্ম বানানোর ব্যাপারে আজকাল যে হুজুগ চলছে, সেটা নিয়ে একটু আলোকপাত করবেন । থাকবেন তো দাদা ?"
পার্থ কী বলবে, ঠিক বুঝে পায় না । সরাসরি 'না' বলাটা অভদ্রতা হয়ে যাবে ! তাহলে উপায় ? পার্থ শুধু জোর করে মুখে হাসি টেনে এনে বলে, "আচ্ছা দেখছি ! আসলে অফিসে কামাই হলে বড্ড মাইনে কাটে, ছুটি তো শেষ হয়ে যাবে !"
"তা ঠিক্, তা ঠিক্ ! তাহলে আপনাকে জোর করাটা উচিত হবে না ! সেক্ষেত্রে আপনার ফোন নাম্বারটা যদি একটু আমাকে দেন, তাহলে আমি আপনার সাথে হোয়াটসঅ্যাপে যোগাযোগ রাখতে পারি । পরে কখনো নিশ্চয়ই আপনার সময় সুযোগ হবে... এইটুকুই অনুরোধ ।" – কথাগুলো বলে একটু থেমে শ্রীকান্ত বললো, “একটা কথা বলি… বাবার নিতান্তই অনিচ্ছা রয়েছে বলে, আপনাকে কিছুটা বাধ্য হয়েই পড়শীর বাড়ি পাঠাতে হলো । আপনি প্লিজ কিছু মনে করবেন না । আসলে আমি বাবার সাথে কখনও তর্কে যাই না । কিন্তু এই রায়-বাড়ির লোকজনদেরও সুবিধের ভাববেন না ! বড়োলোক কেউ হয় খেটে, আর কেউ পা চেটে । আমরা প্রথমটা, আর এই রায়-বাড়ির লোকেরা দ্বিতীয়টা, সেই প্রপিতামহের আমল থেকে । রেষারেষি থেকেই তো এদের এই দুর্গা পুজোর শুরু । সেসময় শুনেছি দুই পরিবারের মুখ-দেখাদেখি পর্যন্ত বন্ধ ছিলো, অবশেষে নবকান্ত ঘোষ আর যতীন রায়ের চেষ্টায় মিলমিশ হয়েছে ।” – কথাগুলো বলে সে মৃদু হেসে থামলো ।
এই আকস্মিক ক্ষোভ প্রকাশের পরেও পার্থর মনে হলো, ছেলেটা নিতান্তই ভদ্র । চমৎকার গুছিয়ে কথা বলে, বাংলা ভাষাটার উপর যথেষ্ট দখল আছে - এই জিনিসটা ক্রমশই দুর্লভ হয়ে পড়ছে ! শ্রীকান্ত তাকে একটা অনুরোধ করছে ! তাই ফোন নম্বরটা পার্থ শ্রীকান্তকে দিয়েই দেয় । নিজের ফোনে নাম্বারটা তুলে নিয়ে শ্রীকান্ত বললো, "চলুন, ভিতরে যাই । একটা মাথার বালিশ, একটা পাশের বালিশ আর একটা গায়ে দেবার চাদর হলেই আপনার হয়ে যাবে আশা করি । ও হ্যাঁ মশারিটা, ওটাও বলে দিতে হবে । চলুন যাই ।" - বলতে বলতেই পার্থকে নিয়ে সে দালানে প্রতিমার সামনে এসে দাঁড়ায় । দশ-বারো ধাপ সিঁড়ি দিয়ে উঠেই বড়ো চৌকিতে প্রতিমা, মিত্তির বাড়ির চেয়ে একটু বেশি ঝলমলে, সন্দেহ নেই ! সিংহটা যেন অনেকটা ঘোড়ার মতো দেখতে আর প্রতিমার পিছনের কাঠামোটা তিন ভাগে ভাগ করা মনে হয় । চালচিত্র বা প্রতিমার সাজসজ্জা একেবারেই অন্যরকম । বিশেষ করে মুকুটগুলো প্রত্যেকটি অসামান্য, একেবারে ঝলমল করছে । এবং লক্ষণীয় উপরে একটি ঝাড়বাতিও রয়েছে ।
*** *** *** *** *** *** *** *** *** *** *** ***
যে ঘরে পার্থর শোবার ব্যবস্থা হয়েছে, সেই ঘরে পার্থর এক সঙ্গীও জুটেছে । ইনি যতীন রায়ের কাকার ছেলে, অর্থাৎ সম্পর্কে তাঁর ভাই, কিন্তু দুজনের বয়সের বিরাট তফাৎ । লালমাধব রায়ের ছেলে, মনোজিৎ রায় ওরফে মন্টু বাবু । ভদ্রলোক কলকাতায় কোন্ কারখানায় কাজ করেন, উদয়াস্ত খাটতে হয়, অথচ রোজগার কম । অষ্টমীর দিনও ডিউটি সেরে দু'দিনের ছুটিতে বাড়ি চলে এসেছেন, হাবভাব দেখে মনে হচ্ছে শুধু খেয়ে, শুয়ে, ঘুমিয়ে ছুটি কাটাতে চান । তাঁর অনুরোধেই পার্থকে নিজের হ্যান্ডিক্যাম থেকে কিছু ভিডিও, যা সে টুকটাক সারাদিনে তুলেছে, মন্টুবাবুকে দেখাতে হয়েছিলো । তিনি ভিডিও দেখতে দেখতেই নানান চরিত্র সম্পর্কে কমেন্ট্রি করে যাচ্ছিলেন । অবশ্যই এই চরিত্ররা অনেকেই পার্থর অপরিচিত এবং বেশিরভাগই মিত্র বাড়ির কারো না কারো রিলেটিভস্ । ভদ্রলোকের পরনিন্দা-পরচর্চার লোভ আছে, বোঝাই যায় । ভুঁড়ির নিচে লুঙ্গিটা একটু আলগা করে দিয়ে, পাশাপাশি বিছানা থেকে পার্থর বিছানায় মশারির মধ্যে চলে এসে তিনি হ্যান্ডিক্যামে ভিডিওগুলো দেখছিলেন । সহসা চন্দ্রকান্ত মিত্তিরের স্ত্রী, অনুশ্রী দেবীর সঙ্গে একজন লম্বা-চওড়া, জোয়ান চেহারার লোকের কিছুটা আড়ালে কথা বলার ভিডিও দেখে মন্টুবাবু বগল চুলকে মন্তব্য করলেন, "যেখানে মিস্ট্রি আছে, জানবেন হিস্ট্রিও আছে ।"
"মানে ?" – বিস্মিত পার্থর মুখ দিয়ে কথাটা বেরিয়ে যায় ।
"মানে আর কিছু নয় মশায় ! বুঝতে পারছেন না, এদের মধ্যে একটা ইন্টু-মিন্টু চলছে । কানাঘুষো শুনেছিলাম, আজকে স্বচক্ষে দেখলাম । তা আপনি মশাই এরকম একটা দৃশ্য সরাসরি শ্যুট করে ফেললেন ? এই গুহ্য দৃশ্যটি তোলবার সময় দেখতে পায় নি আপনাকে ? মহিলা কিন্তু খুব সতর্ক, এ কথা জানবেন । ঘাগু মাল ।"
"আসলে কি জানেন, এই ভিডিওটা আমি ঠিক খেয়াল করে তুলিনি ! এখন মনে পড়ছে, তখন কেউ একটা কিছু বলছিলো, সম্ভবত তনুশ্রী আর রজত কথা বলছিলো, আমি সেদিকে তাকিয়ে ছিলাম । হ্যান্ডিক্যামটা হাতে ধরা ছিলো বলে ভিডিওটা কখন আমার অজান্তেই শ্যুট হয়ে গেছে !"
"তাই বলুন ! ঈশ্বরের মার কেওড়াতলা পার !"
এহেন পরিস্থিতিতে পার্থ কী বলবে বুঝতে পারে না ! পার্থর অবস্থা বুঝে ভদ্রলোক বোধহয় তার উপর কিছুটা মায়া করেই অন্য প্রসঙ্গ তোলেন, - "ওহ্… শুনুন মশাই একটা কথা বলি । আমার জন্ম কিন্তু এক দুর্যোগের রাতে । আর সেই দুর্যোগের সঙ্গে জড়িত একজনের সাথে আজ আপনাকে দেখেছি, এই ভিডিওতেও একটু আগে দেখলাম । কে বলুন তো ?"
"অনুমান করতে পারি, রজতের কথা বলছেন আপনি । কিন্তু দুর্যোগ টুর্যোগের ব্যাপারে আমি কিছুই জানি না ।"
"আরে...এ.. ! এ দুর্যোগ সে দুর্যোগ নয় । মানে আমি বলতে চাইছি, এ কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ নয় । যে রাতে আমার জন্ম, সেই রাতে আমাদের বাড়িতে চুরি হয়েছিল । বরাবর এরকমটাই শুনেছি । কিন্তু সে রাতে শুধু চুরিই হয়নি, আরও বড়ো একটা ক্রাইম ঘটেছিল । রেপ মশাই রেপ । আমাদের বাড়ির পাশের গলিতে, ভাবতে পারেন ? সুন্দরপুরে ভদ্রলোকের পাড়ায় এরকম ঘটনা ?"
"ওসব বুঝি কোনো ভদ্রলোকের পাড়ায় হয় না ?" - পার্থ কিছুটা বিচলিতমুখেই প্রশ্নটা করে বসে ।
"হয় না-ই তো... ওই ঘটনার আগেও ওর'ম কিছু শুনি নি, পরেও না । সবচেয়ে বড় কথা যে ঘটিয়েছিলো, তার নাম শুনলে আপনি চমকে যাবেন মশাই । রাধাকান্ত মিত্তির মশাই, রাধাকান্ত মিত্তির ।"
"মানে ! কৃষ্ণকান্তবাবুর বড়ো ছেলে ? বলেন কী ?"
"বাবু ? তেখচ্চর, বোকাচোদাটা বাবু কবে হলো ? বরাবরের হারামি শালা বুড়োটা । আর তেমনি ছিলো তার ছেলেটা । ওই রাধাকান্তর কথা বলছি আরকি । কিন্তু এখনো আসল সারপ্রাইজটা তো বলিইনি । এটাও অবশ্য প্রমাণের অভাবে একটু চেপেই রয়েছে এতদিন, তবে রিউমার হলো, ওই রজতটা আসলে কৃষ্ণকান্তের নাতি, রাধাকান্তর ছেলে, তবে বিশুদ্ধ নয়, পাপ । কী বুঝলেন ? গোদা বাংলায়, মালটা বেজন্মা ।"
মন্টুবাবুর কথা শুনে পার্থ স্তম্ভিত হয়ে তাঁর মুখের দিকে চেয়ে থাকে ।
ক্রমশঃ-------------
অনন্ত ভালোলাগা... কলম জারি থাকুক।।
উত্তরমুছুনআমার কিন্তু কৃষ্ণকান্তবাবুর চরিত্রটা দারুন লাগছে।
উত্তরমুছুন