বিজ্ঞপ্তি
লেখা-আহ্বান-বিজ্ঞপ্তি : মুদ্রিত নবপ্রভাত বইমেলা ২০২৫
নভেম্বর ২১, ২০২৪
ভূতাদর্শঅঞ্জলি দে নন্দী, মমচৌঠা পৌষ জন্ম নিল ছেলেটি। হাওড়ার সালকিয়ার এক নার্সিং হোমে। কয়েকদিন পর বাবা, মা ও ছেলেকে নিয়ে নিজেদের পিলখানার ভাড়া বাড়িতে এলো। নাম রাখল, শ্রী আশিস নন্দী। বাবা শ্রী দেবী প্রসাদ নন্দী ও মা শ্রীমতী সবিতা নন্দী ছেলেকে শুধু দেখতেই থাকে। অপূর্ব সুন্দর তার রূপ। সে বড় হতে থাকে। বসতে শিখল। হামাগুড়ি দিয়ে এগোলো। দাঁড়ালো। হাঁটলো। কথা বলল।হাওড়ারই একটি স্কুলে ভর্তি হল। লেখাপড়া করতে লাগল। প্রতি বছর প্রথম স্থান অধিকার করে নতুন শ্রেণীতে উঠলো। খুব সুনাম আশিস নন্দীর। প্রতি বছর আশিস নন্দীর বাবা ও মাকে বিদ্যালয় থেকে নিমন্ত্রণ করা হয় এবং তাকে প্রথম পুরস্কার দেওয়ার সময় মঞ্চে প্রধান শিক্ষক মহাশয় বাবা ও মাকে ডেকে তাঁর এক পাশে ছেলেকে ও অন্য আরেক পাশে বাবা, মাকে দাঁড় করান আর বলেন, "মা আপনি রত্নগর্ভা। আর বাবা আপনি সৌভাগ্যবান। তাই এরকম সুপুত্র পেয়েছেন।" সমস্ত দর্শকগণ মনের আনন্দে করতালি দেয়।এভাবে সে দশম শ্রেণীর পরীক্ষায় জেলার মধ্যে প্রথম হয়ে পাস করল। বাবা তাকে কলকাতার বিদ্যালয়ে বিজ্ঞান নিয়ে ভর্তি করল। সেখানেও সে প্রথম। বারো ক্লাসের পরীক্ষায় সে খুব ভালো রেজাল্ট করে পাস করল। যে হোস্টেলে সে থাকত সেখানকার সকলেই আশিস নন্দীকে সুসম্ভর্ধনা জানালো।এরপর বাবা ওকে কলেজে ভর্তি করে দিল। গণিতে অনার্স নিল আর পাস সাবজেক্টস নিল, ফিজিক্স ও কেমিস্ট্রি। সে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্কলারশিপ নিয়ে তিন বছর পর পাস করল। স্কলারশিপের টাকায় আশিস মা ও বাবাকে নিয়ে বারাণসী গিয়ে বাবা বিশ্বনাথ দেবের পূজো করল। ছেলের স্কলারশিপের টাকায় মা, বাবা যদি তীর্থ করতে পারে এর থেকে সৌভাগ্যের আর কিই বা হতে পারে?এবার ওর বাবা ওকে এম. এস. সি. পড়ার জন্য চেন্নাই পাঠিয়ে দিল। সেখানে ও স্বর্ণ পদক পেয়ে - প্রথম হয়ে মাষ্টার ডিগ্রী অর্জন করল।এরপর আশিস বাবা, মাকে বলল, " আমি রিসার্চ করতে আমেরিকা যাব। তোমরা অনুমতি দাও!" বাবা, মা দিল।ও আমেরিকায় ডক্টরেট কমপ্লিট করে এরপর পোষ্ট ডক্টরেট করতে নিউজিল্যান্ডে গেল। সেখানে একটি মেয়ের সঙ্গে প্রেম করল। সেও ওখানে পোষ্ট ডক্টরেট করে। এরপর ওরা দুজনে বাবা ও মায়ের কাছে এসে দেখা করল। বাবা ও মা বলল, "বিয়ে করে নিলে ভালই হয়!" তারা রাজি হল। এবার তারা নিউজিল্যান্ডে ফিরে গেল। সেখান থেকে পাত্রীর বাবা, মা ও আরও আত্মীয়দের সঙ্গে করে নিয়ে আশিস ও তার প্রেমিকা ভারতের কলকাতার একটি রিসোর্টে থাকল। বিয়ে হল। এরপর পনেরো দিন এখানে থাকল। তারপর আবার ও দেশে চলে গেল।চার মাস পর হঠাৎ আশিসের ওখান থেকে এক বন্ধু ওর বাবাকে ফোন করে বলল, " আশিস সুইসাইড করেছে।" বাবা তো শুনেই স্তব্ধ। মাকে বলল। মাও পাথরের মূর্তির মত হয়ে গেল। বাবা ও মা সেই বন্ধুকে আর কিছুই বলতে পারল না। কিন্তু সে বলল, " আপনারা কি আসবেন এখানে? আমরা তাহলে আপনাদের জন্য অপেক্ষা করব। না আসলে আমরাই শেষ কৃত্য সম্পন্ন করব।" বাবা বলল, "না।" বন্ধুরা আশিসের দাহ করাল। স্ত্রী মুখাগ্নি করল। এরপর কিছুদিন কাটল। হঠাৎ বৌমা শ্বশুর ও শাশুড়ির কাছে এল। বলল, "আমি আপনাদের সঙ্গে এখানেই থাকব।" নিউজিল্যান্ডের বাসিন্দা এখন থেকে ভারতের, বঙ্গের, হাওড়ার বাসিন্দা হল। মা বুঝল যে তাদের বৌমা অন্তঃস্বত্ত্বা। কয়েক মাস কাটল। যে নার্সিং হোমে আশিস জন্ম নিয়েছিল সেই নার্সিং হোমেই আশিসের পুত্রও জন্ম গ্রহণ করল। তারা তিনজন দেখল যেন অবিকল আশিসই আবার জন্ম নিতে এসেছে। একদম তার মতই দেখতে। ঠাকুমা নাতীর নাম রাখল, শ্রী দীর্ঘায়ু নন্দী।এরপর রোজ রাতে যখন আশিসের বউ ওর ছেলেকে নিয়ে ঘুমোয় তখন মাঝরাতে আশিস রোজ আসে ও ছেলের মাথায় হাত বোলায়। বউ জানতেও পারে না। মা, বাবাও টের পায় না।এভাবেই কাটল অনেক সময়। ছেলে এখন কথা বলতে পারে। মা বলে। বলে ঠাম্মা। দাদু বলে সে। আর আশিসের বউ যখন তার স্বামীর ছবিতে মালা পড়ায় তখন ছেলে কোলে নিয়ে বলে, "দীর্ঘায়ু বল - বাবা আমাকে আশিস দাও!" ছেলে মেয়ের কথা মত তা-ই বলে। রোজ সকালে এ কাজ ওরা করে।শ্বাশুড়ী বৌমাকে বলল, "মা তুমি এবার আবার পড়ালেখা কর। অসম্পূর্ণ পাঠ সম্পূর্ণ কর মা!" বৌমা রাজি হয় না। সে তার সংসার নিয়েই ভালো থাকার চেষ্টা করে।একরাতে আশিস দীর্ঘায়ুর ঘুমন্ত দেহ কোলে তুলে নিয়ে ঘর থেকে বাইরে এল। বাড়ির ছাদে গেল। যে বাড়িটি আশিস যখন আমেরিকায় ছিল তখন বাবা ও মাকে কিনে দিয়েছিল। তখন থেকেই ওরা এখানে থাকে। বেলুড় মঠের কাছেই তিন তলা বিরাট বাড়ি। তো যা হোক - বাবা আশিস ছাদে গিয়ে ছেলেকে জাগলো। ছেলে দীর্ঘায়ু চোখ খুলে দেখল। আশিস বলল, "আমি তোর বাবা।" ছেলে বাবাকে জড়িয়ে ধরল। খানিকটা সময় ধরে তারা ছাদে রইল। এরপর ছেলেকে কোলে তুলে নিয়ে আশিস আবার তার বউয়ের পাশে ঘরের খাটে শুইয়ে দিল। ছেলেকে টা টা করল। ছেলেও বায় বায় করল। ও চলে গেল। যে ঘুমিয়ে পড়ল। পরের দিন সকালে যখন মা, ছেলে ছবির সামনে তখন ছেলে বলল, " মা কাল রাতে আমি বাবার সঙ্গে ছাদে গিয়েছিলাম।" মা বলল, "আবোলতাবোল কথা না বলে রোজ যেমন বল, ঠিক তেমনই বল!" ছেলে তা-ই বলল। এমন সময় ছবির আশিসের চোখের পাতা পড়তে দেখল ওর বউ। আবার দেখল। তিনবার দেখল। তখন সে ছেলেকে জিজ্ঞাসা করল, "তুই সত্যি করেই তোর বাবার সঙ্গে কাল রাতে ছাদে গিয়েছিলিস? বাবা কি তোর সঙ্গে কথা বলেছে। তুই কি বাবাকে ছুঁয়েছিস? সত্যি কথা বল!" সে বলল, "হ্যাঁ!" এবার বৌমা এই আশিসের ছবির চোখের পাতা পড়ার কথা তার শাশুড়ি মাকে জানালো। মা বললেন, "রোজ রাতে তো আশিস এসে আমার সঙ্গে কথা বলে গো বৌমা। আমার আর তোমার শ্বশুরের বিছানায় বসে।" বউটি বলল, "শুধু আমার সঙ্গেই ক্যানো ও কথা বলে না, জানি না।" সে রাতে আশিস বউয়ের সঙ্গেও কথা বলল। বলল, "তুমি পড়ালেখা কমপ্লিট কর।" বউ বলল, "তুমি ক্যানো সুইসাইড করলে, বল!" আশিস বলল, " আমার ব্রেন ক্যান্সার হয়েছিল। তাই।" এবার ও ছেলের সঙ্গে কথা বলে চলে গেল। ওদিকে মা ও বাবার ঘরে ঢুকে তাদের সঙ্গেও কথা বলল। তারপর অন্ধকারে মিলিয়ে গেল।বউ এবার সকলকে নিয়ে নিউজিল্যান্ড চলে গেল। সেখানে ঠাম্মা ও দাদুর কাছে নাতী থাকে। মা ল্যাবে গবেষণা করে সন্ধ্যার পর বাড়ি আসে। এই বাড়িটিও আশিসই কিনেছিল। মাঝে মাঝে মেয়ের ছেলে, নাতীকে দেখতে আসে নানাজী ও নানীজী। ওরা খানিকটা দূরে ওদের বাড়িতে থাকে। এই মেয়ে ছাড়া ওদের আর অন্য কোনও সন্তান নেই তো।ল্যাবে সারাক্ষণ আশিস তার পত্নীকে হেল্প করে। পতি অদৃশ্য দেহে ও পত্নী সশরীরে কাজ করে। দেখতে দেখতে দেখতে স্ত্রীর পোষ্ট ডক্টরেট কমপ্লিট হল।এবার আশিসের ছেলেও স্কুলে ভর্তি হল। সেও তার বাবার মতই খুব ভালো পড়ালেখা করে সুনাম অর্জন করছে। স্কুলে তার মা দীর্ঘায়ুর জন্য খুব সম্মানিতা হচ্ছে।ওদিকে বেলুড় মঠের কাছের ওদের বাড়িটিতে এক আত্মীয়কে বিনা ভাড়ায় এমনিই বাস করতে দিয়েছিল, আশিসের বাবা। নিউজিল্যান্ডে আসার সময় বলে এসেছিল, " পরে এ বাড়িটি আমরা বিক্রী করে দব। এখন তুই থাক।" সে ব্যাচেলর ছেলে, এ বাড়িতে থেকে পড়ালেখা করত। আশিসের মাসতুতো দাদার ছেলে। ওরা খুব গরীব ছিল। হুগলী জেলার এক গ্রাম চৈতন্যবাটীতে থাকত, পরিবারের সদস্যরা। আর এ লেখাপড়ায় ভালো বলে আশিসের বাবা একে এখানে থেকে লেখাপড়া করতে বলেছিল। আর তাছাড়া বাড়িটি তো এমনিই খালি পড়ে থাকত। তার চেয়ে বরং একজনের উপকার হবে।ফোনে আশিসের বাবা ও মায়ের সঙ্গে বেলুড়ের পরশীদের সঙ্গে কথা হয়। একদিন হঠাৎ শুনল যে সেই ছেলেটি নাকি ওই বাড়িটি বিক্রী করার জন্য খরিদ্দার এনে দেখাচ্ছে। এক পড়শী সঙ্গে সঙ্গে সঙ্গে তা দেখেই আশিসের বাবাকে ফোন করে বলল। আশিসের বাবা এই ছেলেটিকে ফোন করল সঙ্গে সঙ্গে সঙ্গে। বলল, " হ্যাঁ রে এ কথা কি সত্যি, তুই নাকি আমাদের বাড়িটি বিক্রীর চেষ্টা করছিস?" সে বলল, " না না না, ভুল খবর।" কিন্তু সত্যিই সে একের পর এক খদ্দের এনে দেখাচ্ছিল। তা হল কি! - এক খদ্দের সেই ছেলেটিকে এডভান্স টাকা যেই দিল ওমনি ওই টাকা হাওয়ায় উড়ে, সোজা সিলিঙে উঠে গিয়ে আটকে গেল। তারপর সেগুলো টুকরো টুকরো টুকরো কাগজের কুঁচোরূপে চারদিকে ছড়িয়ে পড়লো। সেই খদ্দেরের ও সে ছেলেটির মাথায় যেন টুকরো টাকার বৃষ্টি হল। সেই খদ্দের তো পড়ি কি মরি করে, ভয়ে ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়ে পালাল। এরপর সে কথা নিমেষে রটে গেল। তারপর থেকে কেউই আর ওই বাড়িটি কিনতে আসলো না। তবে সেই ছেলেটি কিন্তু নিশ্চিন্তে ওখানে থেকে লেখাপড়া করল। তাকে আশিস কিছুই করে না। কিন্তু তার অসৎ কাজকে বন্ধ করে দিল। আশিস এভাবেই তার পুত্রাদর্শ পালন করে বাবা ও মায়ের বাড়িটি রক্ষা করল। পাড়া পড়শী যখন ওই টাকা বৃষ্টির কথা এমুখ ওমুখ থেকে শুনল তারা বলল, "কই আমরা তো এতোদিন এই বাড়ির আশেপাশে আছি, কখনও তো আশিস আমাদের এতটুকুও ভয় দেখায় নি। তা ছাড়া আমারা কত দিন কত রাত ও বাড়িতে ঢুকেছি, কই কোন সময়ই তো আশিস আমাদের কিছুই করে নি।" তারা আরও বলল, " আমরা আমাদের ছেলে, মেয়েদের বিয়ে পর্যন্ত ওই বাড়ির ছাদে করিয়েছি। ওই বাড়ির ঘরে বাসর রাত হয়েছে। আমরা শুয়েছি। ঘুমিয়েছি। রেঁধে খেয়েছি। কই আশিস তো আমাদের বাধা দেয় নি। সে ছিল সৎ, আদর্শবান, পরোপকারী, জ্ঞানী ছেলে, সে মৃত্যুর পর কখনোই অন্যায় কাজ করতে পারে না। তার থাকে ভালো ছেলে আজ পর্যন্ত আমরা আর একটিও দেখি নি। যত সব আজেবাজে কথা।"এদিকে আশিসের বাবার হার্ট প্রবলেম হল। বৌমা তো খুব ভালো ভালো চিকিৎসক দিয়ে চিকিৎসা করায়। বয়স যে বেশ অনেকটাই হয়েছে। বৃদ্ধ বয়সে পুত্র শোক বুকের হৃদয়ে নিয়ে হৃদয়কে কত কাল আর সুস্থ রাখা যায়! হায় রে, অসহায় পিতা! কয়েক বছর অনেক খরচা করে পুত্রবধূ শ্বশুরমশাইকে এ পৃথিবীতে টিকিয়ে রাখলো। তারপর একদিন হার্টফেল করে মারা গেল। সেদিনটি ছিল আবার আশিসের ওই বেলুড়ের বাড়ি কেনার পর গৃহপ্রবেশের দিন। বহু বছর আগে এই দিনেই আশিস ওই বাড়ীটি কিনে, মা ও বাবাকে নিয়ে ঢুকেছিল ও তারপর থেকে ওখানেই তো তারা থাকত আর এও যখন বিদেশ থেকে দেশে আসতো এখানেই থাকতো। আর এই একই দিনে বাবাও ছেলের কাছে স্বর্গ-প্রবেশ করল। ছেলের আরেক নতুন ঠিকানায় বোধ হয় বাবার নতুন গৃহপ্রবেশ হল।আশিসের সেই সব বন্ধুরা এসে তার মৃতদেহ সৎকার করল। নাতী মুখাগ্নি করল। ঠাম্মা যেন আবার নতুন করে একা হল। পুত্র হারিয়ে একবার একা হয়েছিল। আবার এখন স্বামী হারিয়ে আরেকবার একা হল।দেখতে দেখতে দেখতে দীর্ঘায়ু বড় হল। সে এখন ক্লাস সেভেনে পড়ছে। ঠাম্মার এবার প্যারালাইসিস হল। সারা শরীর অকেজো। বৌমা এক আয়া রাখলো। সে-ই তার সব কাজ করে দেয়। বৌমা তো এখোনো ল্যাবেই কাটায়, দিনের বেলায়। তাই। সে তো এখন বৈজ্ঞানিক। নাতী তো নিজেই নিজের সমস্ত কাজকর্ম করে নেয়। বাদ বাকি মা করে দেয়।বিছানায় শয্যাশায়ী হয়ে পাঁচটি বছর কাটল। তারপর শ্বাশুড়ী দেহ রাখলো। আয়াকে তাই বৌমা ছাড়িয়ে দিল।ওদিকে দীর্ঘায়ুর নানা ও নানী একা থাকে। তাই ওদেরকে দীর্ঘায়ুর মা এবাড়িতে এনে রাখলো। এরা এখনও নিজেরাই নিজেদের কাজ করে নিতে পারে। তারপর নাতীর কাজও করে দেয়। দরকার হলে মেয়ের কাজও করে। তবে মেয়ে তার মা, বাবাকে দিয়ে করাতে চায় না। সেও আদর্শবতী মহিলা।এখন দীর্ঘায়ু কলেজে পড়ে। সেও তার বাবার মতই অঙ্ক নিয়ে পড়ছে। একদিন নানাজী হঠাৎ করে আর কথা বলতে পারছিল না। তখন সন্ধ্যা। মা ডাক্তার ডাকল। ডাক্তার এসে বললেন, "স্ট্রোক। এক্ষুনি নার্সিং হোমে নিয়ে যেতে হবে।" নাতী তো নিজের বাড়িতে থেকেই পড়ে। সে তো আর বাবার মত হোস্টেলে - দূরে থাকে না। তাই সে এম্বুলেন্স এনে নানাজীকে নিয়ে গেল। মাও সঙ্গে ছিল। ভর্তি করার পর নানীজী ওখানেই থাকত বেশিরভাগ সময়। এক সপ্তাহ পর সে দেহত্যাগ করল।নানীজী ক্যামোন যেন হতাশ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। মুখে কথা নেই। চুপ। এদিকে দীর্ঘায়ু বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র এখন। ফাইনাল ইয়ার চলছে। একরাতে নানীজী খুব জোরে একবার চিৎকার করে উঠলো, "আশিস!" ব্যাস তারপর সব ঠান্ডা। সেও মারা গেল। শেষ ডাক ডেকে সে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করল। এখন বোধ হয় ওরা পাঁচজন স্বর্গে খুব সুখেই আছে!দীর্ঘায়ু এবার ডক্টরেট করতে বাবার সেই জায়গায়, আমেরিকায় গেল। সেখানে তো বাবার সুখ্যাতি শুনে অবাক হল।এবার মা ওকে একদিন ফোন করে বলল, " তুই এবার যখন আমার কাছে আসবি, তখন আমরা দুজনে ইন্ডিয়া যাব। ওই বাড়িটি রিসেল করে আসবো।" দীর্ঘায়ু বলল, "ওকে!"পরের বছর ও মায়ের সঙ্গে বেলুড় এলো। সেখানে তখন ঐ ছেলেটি বউ ও এক মেয়ে নিয়ে আছে। ভালো চাকরিও করে সে। একটি মাল্টি ন্যাশনাল কোম্পানির উচ্চ পদস্থ পদে আছে। বউটিও স্কুল টিচার। মেয়েটিও স্কুলে পড়ে। তো তাদেরকে এরা বলল, "তোমরা যদি এ বাড়িটি কিনতে চাও তো কিনে নিতে পার! না নাও তো অন্য কাউকে আমরা বিক্রী করে দব!" তখন সে ছেলেটি বলল, " ঠিক আছে, আমিই নব!" সঠিক দামে দীর্ঘায়ু বাড়ীটি ওকেই রিসেল করল। পরের দিনের ফ্লাইটে ওরা নিউজিল্যান্ডে আসবে। রাতে ঘুমোচ্ছে। এমন সময় আশিস এলো। স্ত্রীর সামনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তাকে দেখল। এরপর দীর্ঘায়ুর মাথায় হাত বোলালো। ওর ঘুম ভেঙে গেল। বাবাকে জড়িয়ে ধরল। এরপর দাদু, ঠাম্মা, নানাজী, নানীজী সবাই এলো। দীর্ঘায়ু মাকে ডেকে তুলল। সেও দেখলো। সকলেই খুব খুশি হল। কিছু সময় থেকে ওরা চলে গেল।পরের দিন তারা নিউজিল্যান্ডের উদ্দেশ্যে রওনা দিল। সঠিক সময়ে পৌঁছে গেল। কয়েক দিন পর ও আমেরিকা চলে গেল।এবার কয়েক মাস পর, দীর্ঘায়ুর মা তার মা, বাবার বাড়িটিও বিক্রী করে দিল। নিজের স্বামীর বাড়িতে একাই থাকে।দেখতে দেখতে দেখতে দীর্ঘায়ু পি. এইচ. ডি. কমপ্লিট করল। নিউজিল্যান্ডের বাড়ি এলো। এদিকে মাও আর ল্যাবে যেতে ইচ্ছুক নয়। তখন তারা এ বাড়িটিও বিক্রী করে দিল।মা ও ছেলে আমেরিকায় গিয়ে বাংলো কিনলো। আমেরিকাতেই দীর্ঘায়ু এবার পোস্ট ডক্টরেট করল।এই সময় মা তার জন্য আমেরিকায় বসবাসকারী এক ভারতীয় পাত্রীর সঙ্গে বিয়ে পাকা করল। সে আশিসের বন্ধুর কন্যা। ওদের বিয়ে হল।বিয়ের তিন বছর পর ওদের একটি পুত্র সন্তান জন্ম নিল। হুবহু আশিসের মত দেখতে। দীর্ঘায়ুর মা তো তাকে বুক থেকে নামায় না। আর ছেলে ও বৌমা গবেষণার কাজে সারাদিন ব্যস্ত থাকে। সন্ধ্যার পর বাড়ি আসে। দীর্ঘায়ুর ছেলের নাম রেখেছে ওর ঠাম্মা, "শ্রী নবাশিস নন্দী।"একরাতে ঠাম্মা নবাশিসকে নিয়ে ছাদে ঘুরছে তখন আশিস এলো ও বলল, " একবার আমার কোলে নাতীকে দাও!" দিল। ও কোলে নিয়ে খুব আদর করল। ঠাম্মার চোখের জলে গাল ভিজল। কিছু পরে আশিস নবাশিসকে ঠাম্মার কোলে দিয়ে চলে গেল। আকাশে পূর্ণিমা চাঁদ অপেক্ষা করছিল। আশিস চাঁদে চলে গেল। নবাশিসকে কোলে নিয়ে ঠাম্মা বলল, "এসো এসো এসো সুন্দর, তুমি চাঁদ! আমার নাতীর কপালে চুমু দিয়ে যাও!"এরপর কেটে গেছে অনেকগুলো বছর। নাতী স্কুলে ভর্তি হয়েছে। এক এক এক করে অতিক্রম করে, সে এখন বেশ উঁচু ক্লাসে উঠলো।। সেও দাদু, বাবার মতই লেখাপড়া করে খুব বিখ্যাত হল। শুধু লেখাপড়াই নয়, সে খুব ভালো আঁকে। আবার গানও গায় খুবই ভালো। নাচেও। ব্যাটমিন্টন খেলে। সব দিক দিয়ে সে খ্যাত।যখন সে নাইনে উঠল তখন তার ঠাম্মা ব্রেন ক্যান্সারে মারা গেল। শুধু সে-ই স্বর্গে যেতে বাকি ছিল। সবাই এখন একজোট হল সেখানে। আশিস বোধ হয় এতদিনে শান্তি পেলো। এখন বাবা, মা ও সে থাকে। আমেরিকার বাড়িতে একদিন সবাই মিলে নবাশিসের জন্মদিন পালন করছে। তখন রাত এগারোটা হবে। হঠাৎ বাড়ির ছাদে একটি অদ্ভুৎ আওয়াজ হল। নিমন্ত্রিত লোকজন ও ওরা তিনজন ছাদে ছুটে গিয়ে দেখল যে একটি বিরাট প্যাকিং বক্স পড়ে আছে। বার্থডে বয় সেটি খুলল। সকলে দেখল যে তার মধ্যে একটি রুপোর পেন। তার মধ্যে কালি ভরে কাগজের ওপরে লিখতে হয়। সেই পেনটি যেই ও হাতে নিল ওমনি তাই রুপোর নিবটি বলে উঠলো, " আমি আশিসের খুব প্রিয় ছিলাম। আমাকে ব্যবহার করে তুমি বিশ্ব বিখ্যাত হতে পারবে। আমাকে দিয়ে তুমি অনেক বই লিখো! সেই বইগুলো বিশ্বের সেরা বই হবে। আমাকে আমার প্রিয় আশিস বাবু শ্রী সরস্বতী দেবী মায়ের পূজোর দিনে কিনে এনে পূজো করেছিল। আর সেদিন মা নিজে হাতে আমাকে স্পর্শ করেছিলেন।" ওরা তখন সেটি নিয়ে ছাদ থেকে নিচে নেমে এলো। বার্থডে পার্টি হয়ে গেল। তারপর দিন থেকে সে কাগজে লিখতে শুরু করল। লেখকের নিজের অজান্তেই যেন পেন আপনিই এগোতে লাগলো। অন্য কোনো এক শক্তি যেন ওটাকে চালাচ্ছে। পাতার পর পাতা লেখা হল। ছয় মাস পর মোট তিনটি বই লেখা হয়ে গেল।লেখক সেই পাণ্ডুলিপি নিয়ে প্রকাশকের কাছে গিয়ে দেখালো। তিনটি বই হল। সারা জগতে তার সৃষ্টি ছড়িয়ে পড়লো।এরপর আরও লেখা চলতেই থাকলো.....হঠাৎ সেই পেনটি একদিন খারাপ হয়ে গেল। নিব ভেঙে গেল। তখন সে সেটি রেখে দিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে...... এমন সময় সে স্বপ্নে দেখলো যে পেনটিকে যেন নিজে নিজেই উড়ে উড়ে উড়ে বেলুড় মঠে ঢুকে গেল। শ্রী রামকৃষ্ণ পরম হংস দেবের শ্রীপদে গিয়ে পড়ল। আর সেটি পুনরায় ঠিক হয়ে গেল এবং ফের লিখতে পারলো। স্বপ্ন ভেঙ্গে গেল। নবাশিস তার মা ও বাবাকে এই স্বপ্নের কথা বলল। তারপর তারা সবাই ভারতের, বঙ্গের বেলুড় মঠে এসে সেই পেনটিকে ঠাকুরের মূর্তির পাদপদ্মে রাখলো। কিছুক্ষণ পর সেটি সে তুলে নিল। পেনের ঢাকনা খুলে দেখলো যে নিবটি ঠিক হয়ে গেছে। সেটি আবার লিখছে। এরপর ওরা আবার আমেরিকার বাড়িতে এলো। আবার অনেক বই লিখলো........===================
পি-১১৪
পি এক্সটেনশন।মোহন গার্ডেন।উত্তমনগর।নতুন দিল্লী - ১১০০৫৯