সকালে ঘুম থেকে উঠে সুদীপ্ত বাবুর মনটা খুশিতে ভরে ওঠে।টানা চার দিন প্রবল বর্ষনের পর আজ বেশ ঝলমলে রোদ্দুর।মেঘ মুক্ত গাঢ় নীল আকাশটার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে থাকেন কিছুক্ষণ।সোনালি রোদে ভেজা আকাশটা বড় আনন্দ ঘন আজ।ভাড়ার ফ্ল্যাটটার ছোট্ট ঝুলবারান্দায় দাঁড়িয়ে হাঁক পাড়েন--কল্যাণী--ই--ই ওঠ--ওঠ শিগগির।বারান্দায় এসো একটু।দেখ কি সুন্দর আকাশ!রোদ ঝলমলে।কোথাও মেঘের চিহ্ন নেই।মন জুড়িয়ে যাবে।
চোখ রগড়াতে রগড়াতে সুদীপ্ত বাবুর পাশে এসে দাঁড়ান কল্যাণী।সুদীপ্ত বাবুর স্ত্রী।ত্রিশ পেরোনো চোখে মুখে দৃষ্টি নন্দন লাবন্য।শিক্ষিতা ব্যক্তিত্ব সম্পন্না মহিলা।ঘুম জড়ানো গলায় বলেন--ছুটির দিনেও একটু ভালো করে ঘুমোতে দিলে না তো?মেঘ নেই তো কি?বাতাস কেমন স্যাঁতস্যেঁতে দেখছ না? গা শিরশির করা হাওয়া ও তো হচ্ছে! তিন তলার উপরে হাওয়াটা ও বেশ জোরেই লাগছে গায়ে।টানা বৃষ্টির জের।বিছানা বালিশ সব যেন ভিজে।
--আর কি করা যাবে।এই ছোট্ট শহরটাতে তো নিকাশি ব্যবস্থা তেমন ভালো নয়।প্রায় সব দিকেই কমবেশি জল জমে আছে।তা থাক।আমার ছুটি ও তো প্রায় ফুরিয়ে এল।এ বছর তো ঠাকুর দেখা ভেসে গেল বৃষ্টিতে।আজ সন্ধ্যেয় ছেলেটাকে নিয়ে আমরা বেরুবো।আকাশ যখন পরিষ্কার-----।
--তা ঠিক।দেখতে দেখতে পুজোও তো শেষ।আজ নবমী।কাল থেকেই প্যাণ্ডেল ফাঁকা হতে শুরু করবে।গত বছরও বৃষ্টির জ্বালায় ঠাকুর দেখা হয় নি।নামেই জেলা শহর।লম্বা চওড়ায় যেমন ছোট তেমন লোকজন ও কম।হাতে গোনা কটা ঠাকুর তলা।ছেলেটার আবার ঠাণ্ডা লেগে গেছে কাল থেকে।ওর মনটাও বোধ হয় ভালো নেই।গত বছরের এমনই এক দিনে প্রায় জোর করেই বৃষ্টি মাথায় ও আর ওর বন্ধু পাড়ার ঠাকুর তলায় গেছিল।অবশ্য তখন বৃষ্টি হচ্ছিল না। নিষেধ করেছিলাম।বলেছিলাম একটু পরেই সবাই একসঙ্গে বেরুবো।শোনেনি।আসলে পুজো ফুরিয়ে আসছিল যে! না কি মৃত্যুই ডেকেছিল ওর বন্ধুটাকে----!
---ও সব কথা আর তুলো না কল্যাণী।মন ভারাক্রান্ত হয়।অমন সুন্দর প্রাণ-চঞ্চল ছেলেটা---!কি যেন নাম ছিল? অঞ্জন---অঞ্জন চৌধুরী।পড়াশুনোতেও বেশ ভালোই ছিল।আমাদের অর্কের প্রাণের বন্ধু।যেখানেই যেত দুজনে এক সঙ্গে।এ শহরে আমাদের কেটে গেল প্রায় চার চারটে বছর।যখন প্রথম আসি অর্ক অঞ্জন পঞ্চম শ্রেণির ছিল।অর্কর অষ্টম শ্রেণি হল।অঞ্জনের ও----।কি আর করা যাবে।অমন হঠাৎ মেঘ জমে উঠবে কেউ ভাবতেও পারেনি।টানা বৃষ্টির পর সবাই ভেবেছিল আর হবে না।ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টি পড়তে দেখে ওরা ফিরেই আসছিল বাসায়।হঠাৎ ঝমঝম।কোনো পথ না পেয়ে অঞ্জন দাঁড়িয়ে পড়েছিল উঁচু কৃষ্ণচূড়া গাছটার নীচে।রাস্তার পাশে।কেমন ভাগ্য দেখ।অর্কও দাঁড়াতে পারত।কিন্তু সে অঞ্জনকে নাকি বার বার বলেছিল না থেমে বাড়ি ফিরতে।ভিজে গেলে বাড়ি ফিরে বদলে নেবে জামা প্যান্ট।অঞ্জন যদি শুনতো---!হয়তো ও ভাবে ছেলেটাকে------!সুদীপ্ত বাবুর বুক থেকে বেরিয়ে আসে একটা দীর্ঘশ্বাস।অঞ্জনের বাবা মা চলে গেছে এ শহর ছেড়ে।তুমি জান কি কল্যাণী?
অর্কর মনে আজ আনন্দের বান ডেকেছে।সকালে তার প্রিয় বন্ধু অঞ্জন এসেছিল।একটু দূরেই থাকে অঞ্জন তার বাবা মায়ের সঙ্গে।তার বাবা অর্কের বাবার মতোই জেলাশাসকের অফিসে কাজ করে।কি যেন নামটা?--আনন্দ চৌধুরী।বেশ হাসিখুশি মানুষ।একমাত্র সন্তান অঞ্জন লেখাপড়ায় অর্কর থেকেও ভালো।যদিও তার বাবা অফিসের হেড ক্লার্ক।অর্কর বাবা সেকশন অফিসার।তাতে কি?আনন্দ বাবুর সঙ্গে অর্কর বাবার সম্পর্ক বেশ ভালো।হয়তো অঞ্জনের সঙ্গে তার বন্ধুত্বের জন্যেই।অঞ্জনের মা ও দেখতে কি সুন্দর!যেন লক্ষ্মী ঠাকুর মানুষ হয়ে অঞ্জনের মা।কি সুন্দর হাসি মুখ সব সময়।অর্ক তাঁকে কাকিমা বলেই ডাকে।অঞ্জন ও তার মাকে কাকিমা বলে।অঞ্জন বলে তার মা ও নাকি সাক্ষাৎ সরস্বতী।চলায় বলায় তার স্পষ্ট ছাপ দেখে অঞ্জন।তার মা যেমন অঞ্জনকে ভালোবাসে মন থেকে,তেমনি অঞ্জনের মা ও তাকে খু-উ-উ-ব ভালোবাসে।সব বুঝতে পারে অর্ক।তাদের বাসায় গেলে কত কিছুই তৈরি করে খাওয়ায় দুজনকে।অবশ্য অঞ্জন এলে তার মাও বেশ যত্ন করে।এটা সেটা খাইয়ে তবেই যেতে দেয়।তাদের দুজনের মধ্যে আজ পর্যন্ত কোনো রাগারাগি হয় নি।এক সঙ্গে স্কুল যাওয়া, ফেরা।তার অসুখ বিসুখে অঞ্জনরা সবাই খোঁজ নিতে আসে।অঞ্জনের জ্বর-টর হলে অর্কর সঙ্গে তার বাবা মা ও যায় ও বাসায়।তাদের দুজনকে কেন্দ্র করে তাদের বাবা মায়েদের ও বেশ ভালোই বন্ধুত্ব হয়ে গেছে।আর হবে না-ই বা কেন? দুজনেরই আদি বাড়ি যে বর্ধমান জেলায়!এক দিন তার বাবা আনন্দ বাবুকে বলেছিলেন--আনন্দ বাবু, আমাদের তো বদলির চাকরি।যদি দুজনের আলাদা দু-জায়গায় বদলি হয়ে যায় তো কি হবে?
আনন্দ বাবু বলেছিলেন--করার তো কিছু নেই।হতেই পারে সেটা।কষ্ট হবে কিছুদিন।আপনাদের, আমাদেরও।তার পর আমরা হয়তো মানিয়ে নেব এক সময়।কিন্তু অর্ক-অঞ্জনের কথা ভেবে বেশ আতঙ্কিত হই মাঝে মাঝে।ওদের বন্ধুত্ব যে পর্যায়ে তাতে আমাদের চেয়ে বহুগুণ কষ্ট হবে ওদের।কি ভাবে যে সামাল দেব তখন! একটা কাজ করবেন আপনি।আমিও চেষ্টা করব।যত দিন সম্ভব বদলিটা ঠেকিয়ে রাখতে হবে ওদের মুখ চেয়ে।
বাবা বলেছিলেন--চেষ্টা করব।জেলাশাসক মশাই আমাকে বেশ গুরুত্ব দেন।নির্ভর করেন আমার উপর।কিন্তু তাঁর বদলি হয়ে গেলে---?
---তখন চেষ্টা করবেন আমাদের বদলিটা যাতে একই জায়গায় হয়।--বলেছিলেন আনন্দ বাবু।বাবা মাথা নেড়ে সম্মতি দিয়েছিলেন।
অঞ্জন বলে গেছে আজ রাতের রান্না সন্ধ্যের মধ্যে সেরে তার বাবা মা ঠাকুর দেখতে যাবে তাকে নিয়ে।একই কথা অর্ক ও শুনেছে তার বাবার কাছ থেকে।সে অঞ্জনকে সেটা জানায়।অঞ্জন বলে--বাবা-মাদের বেরুতে রাত আটটা পার হয়ে যাবে।একটা কাজ করি আয়।সন্ধ্যে বেলা তুই আর আমি কাছের প্যাণ্ডেলের ঠাকুরটা দেখে আসি।তা হলে বাবা-মাদের দূরের ঠাকুরগুলো দেখতে নিয়ে যাওয়া যাবে প্রথমে।রাজি হয়ে গেছিল অর্ক।শুধু বলেছিল--এখন এটা বাবা-মাদের বলার দরকার নেই।বেরুবার আগে বললেই হবে।অঞ্জন বলেছিল--ঠিক আছে।
সন্ধ্যার মুখে তৈরি হয়ে অর্ক মাকে বলে সে কাছের প্যাণ্ডেলে যাচ্ছে ঠাকুর দেখতে।
রান্নায় ব্যস্ত মা বাধা দিয়ে বলেন--একা একা যাবি কেন? একটু পরেই তো বেরুব আমরা সবাই।অঞ্জনরাও যাবে।
--আরে---!একা যাব কেন? অঞ্জন ও তো যাবে।ঐ দেখ নিচে তাকিয়ে।অঞ্জন এসে গেছে।
--ও--বুঝেছি বুঝেছি।সকালে দুটোয় তাহলে ঘরে বসে এই পরামর্শই করেছিলে? বেশ, যাও।তবে এক ঘন্টার মধ্যেই ফিরবে কিন্তু।বাবা বাইরে গেছেন।একটু পরেই ফিরবেন।আমারও রান্না প্রায় সারা।এক-দড় ঘন্টার মধ্যেই কিন্তু বেরুবো আমরা।
--ঠিক আছে মা।অঞ্জন ও বলেছে বেশিক্ষণ থাকবে না প্যাণ্ডেলে।
ঘর থেকে বেরিয়ে সিঁড়ি বেয়ে তরতরিয়ে নেমে আসে অর্ক।অঞ্জনকে বলে--চল।এক ঘন্টার মধ্যেই ফিরতে হবে কিন্তু।বাবা মা আমাকে নিয়ে------।
---আরে আমার বাবা মাও বেরুবে।এক সঙ্গেই তো আমরা----।মাও বলেছে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ফিরে যেতে।মার রান্নাও প্রায় শেষ।চল-- চল।আর দাঁড়িয়ে সময় নষ্ট করব না।
প্যাণ্ডেলে তখনও ভিড় জমে ওঠেনি।কাছ থেকেই ঠাকুর দেখছিল দুজন তন্ময় হয়ে।হঠাৎ সচকিত হয়ে ওঠে অর্ক।অঞ্জনের গায়ে একটা ঠেলা দিয়ে বলে--এ্যাই অঞ্জন--গায়ে বৃষ্টির ফোঁটা পড়ল মনে হচ্ছে।অঞ্জন কোন পাত্তা না দিয়ে বলে--দেখ--দেখ অসুরটার হাতের শিরাগুলো কেমন স্পষ্ট করে তৈরী করেছে পোটো।সিংহটারও ভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে জ্যান্ত।বেশ সুন্দরই হয়েছে বল ঠাকুরগুলো?
বৃষ্টির ফোঁটা ঘন পড়তে থাকে।আকাশের দিকে মুখ তুলে তাকায় অর্ক।গাঢ় কালো আকাশ।প্যাণ্ডেলের সব আলো যেন গিলে নিতে ধেয়ে আসছে জমাট মেঘ।অঞ্জনের গায়ে আবার জোরে ঠেলা দেয় অর্ক।বলে--জোরে বৃষ্টি নামবে রে আবার।আর দেরি করিস না।তাড়াতাড়ি বাড়ি চল।ভিজলে বাবা মা বকবে।
এবার অঞ্জন আকাশের দিকে মুখ তুলে দেখে এক দণ্ড।বলে--তাই চল।নতুন জামা প্যান্ট।ভিজে গেলে----!এটা পরেই আজ ঠাকুর দেখতে যাব তো বাবা-মার সঙ্গে।
দ্রুত পা চালায় দুজন বাড়িমুখো।অর্ধেক রাস্তা পার হয়েছে সবে।বৃষ্টির বেগ বাড়ে।জামা প্যান্ট ভিজে যাওয়ার ভয়ে অঞ্জন দৌড়ে রাস্তার পাশের একটা বড় কৃষ্ণচূড়া গাছের তলায় গিয়ে দাঁড়ায়।অর্ক কিছুটা এগিয়ে পিছন ফিরে অঞ্জনকে গাছের তলায় দেখতে পায়।বলে--দাঁড়ালি কেন অঞ্জন? চলে আয়।আর তো খুব দূরে নয় ঘর।ভিজে গেলে ঘরে পৌঁছে জামা প্যান্ট পাল্টে নিলে তো হবে।দেরি করিস না।অঞ্জন নড়ে না গাছের তলা থেকে।অর্ক কয়েক পা এগিয়ে যায় অঞ্জনের দিকে।তখনই এক বিকট শব্দ।চোখ ধাঁধানো আলোয় সব অন্ধকার।ভয়ে আঁধার চোখেই ঘুরে দাঁড়ায় অর্ক।দৌড়ে যায় সামনের দিকে উর্ধ্বশ্বাসে।কিছুদূর গিয়েই মনে পড়ে অঞ্জনের কথা।থমকে যায় অর্ক।ফিরে তাকায় গাছটার তলায়।চোখের আঁধার ততক্ষণে কেটে গেছে তার।রাস্তার আবছা আলোয় অনুভব করে কিছু একটা পড়ে আছে গাছের তলায়।দুরুদুরু করে ওঠে তার বুক।অঞ্জন--এ্যা--ই--অ--ন্--জ--ন--অ--অ----চিৎকার করে ওঠে সে।দুপাশের উঁচু বাড়িগুলোর দেয়ালে প্রতিধ্বনীত হয় সে শব্দ।অঞ্জনের কোন সাড়া নেই।দৌড়ে গাছটার কাছে পৌঁছোয় অর্ক।একটা ঝলসে যাওয়া ছোট্ট দেহ।এটা কি অঞ্জন? হাত দিয়ে নাড়া দিতে যায় সে।ভয়ে কেঁপে ওঠে তার শরীর।উদভ্রান্তের মতো সে দৌড়োতে শুরু করে অঞ্জনদের বাসার দিকে।উঁচু বাড়িটার দোতলায় যে কি ভাবে পৌঁছোল সে নিজেই জানে না।অঞ্জনের মা তখন ঘর বারান্দা করছেন।আনন্দ বাবুকে ডাকছেন ঘন ঘন--এসো--এসো শিগগির।ছেলেটা ভিজে কাদা হয়ে যাবে যে! বলতে বলতে চোখ পড়ে অর্কর দিকে।বলেন--এসে গেছিস তোরা? ভালো করেছিস।জোরেই বৃষ্টি নামবে মনে হচ্ছে।ভিজে গেছিস তো? দাঁড়া তোয়ালেটা আনি।মাথাটা মুছে দিই আগে।অঞ্জন---
--অঞ্জন---ভয়ার্ত কন্ঠস্বর রুদ্ধ হয়ে যায় অর্কর।তার অদ্ভুত ফ্যাকাশে চোখের দিকে তাকিয়ে গুমরে ওঠে অঞ্জনের মায়ের বুক।কাঁপা গলায় তিনি বলেন--অঞ্জন--ক--ই--সে--এ--এ---?
কোনো কথা বলতে পারে না অর্ক।কেবল ইসারায় কিছু বোঝানোর চেষ্টা করে।সে দিকে তাকিয়ে অঞ্জনের মায়ের গলা চিরে বেরিয়ে আসে--অ--ঞ্জ--ন--অ--অ--!কোথায় তু--ই--কো--থা--য়--বা--বা--আ--আ----?
ঘর থেকে দ্রুত বেরিয়ে আসেন আনন্দ বাবু।দুজনকে ওই অবস্থায় দেখতে পান।অর্কর বুক তখন হাপরের মতো ওঠা নামা করছে।বিপদ আঁচ করে বলেন--অঞ্জন কোথায় অর্ক?অর্ক কেবল আঙুল দিয়ে একটা দিক নির্দেশ করে।তার দিক নির্দেশ অনুসরণ করে প্রায় দৌড়ে নিচে নেমে আসেন সকলে।পৌঁছে যান কৃষ্ণচূড়া গাছটার তলায়।গাছটার ডালে ডালে তখনও আগুনের লকলকে শিখা।রক্ত-রাঙা আগুন-শিখা মুহূর্তেই গিলে নেয় আনন্দ বাবুদের সব আনন্দ; স্বপ্ন।ঝলসে দেয় তাদের গোলাপ-কোমল দুটো হৃদয়।তাদের সমবেত কান্নার দমকে জড়ো হয়ে যায় বেশ কিছু লোক।পথ চলতি মানুষ আর প্যাণ্ডেলে আসা লোকজন বৃত্তাকারে ঘিরে ধরে তাদের।বৃত্তের এক কোণে নিথর দাঁড়িয়ে অর্ক। চোখ বেয়ে নেমে আসা জলের ধারায় সবকিছু অন্ধকার হয়ে যায় তার।
রাত কেটে গেছে।আকাশে তখনও কালো মেঘের আনাগোনা।মেঘের ফাঁক গলে সুতোর ঝারির মতো ছুটে আসছে সূর্যের আলো মাটির দিকে।চোখ মেলে তাকায় অর্ক আকাশের দিকে।দুখণ্ড মেঘের ফাঁকে রঙিন জামা প্যান্ট পরা অঞ্জন দাঁড়িয়ে।বিস্ময়ে হতবাক অর্ক।ওখানে অঞ্জন গেল কি করে?ঠাকুর দেখে তারা তো বাড়ি ফিরে আসছিল।তাহলে কি-----?অঞ্জনকে ডাকতে চেষ্টা করে অর্ক।কিন্তু গলা থেকে তার কোন কথা বের হয় না কিছুতেই।অবাক হয়ে যায় অর্ক।তার গলায় কি কিছু হল? খুব বেশি ঠাণ্ডা লেগে গেলে তার কথা প্রায় বন্ধ হয়ে যায় অবশ্য।কিন্তু পুরোপুরি বন্ধ তো হয় না! কোনো পথ না পেয়ে অর্ক হাত তুলে অঞ্জনকে ইসারা করে তার কাছে আসতে।অঞ্জন ইসারা বোঝে।মেঘের ফাঁক গলে নেমে আসতে থাকে সে দ্রুত অর্কের দিকে।কিন্তু হঠাৎই নেমে আসা থামায় অঞ্জন।বলে--না রে অর্ক, আর কাছে যেতে পারব না আমি।গেলেই আমার শরীরের তাপে ঝলসে যাবি তুই।
---কি বলছিস তুই অঞ্জন? শরীরের তাপে----! ঝলসে যাওয়া----! এ সব কি কথা?
---ঠিকই বলছি ভাই।তুই বুঝবি না এসব।
---ঠিক আছে।বুঝবার দরকার নেই।তুই ওখানেই দাঁড়া।আমি যাচ্ছি তোর কাছে।
চমকে যায় অঞ্জন।কেঁপে ওঠে তার গোটা শরীর।চিৎকার করে বলে--না--আ--না--আ--অ--র্--ক--অ--অ--,অ--ম--ন--কা--জ--ক--রি--স--না--আ--আ--! বা--প--দ---ঝ---ল---সে--এ--এ--মৃ--ত্যূ--উ--উ--য--ন্--ত্র--না--আ--আ----!
দূরে সরে যেতে থাকে অঞ্জন।অনেক--অ--নে--ক--দূ--রে।মেঘের ফাঁকে মিলিয়ে যেতে যেতে বলে--দুঃখ করিস না অর্ক।যেখানে আছিস তুই সেখানেই থাক।আমার থাকা মানা।ক--ষ্--ট, ব--ড়--অ--অ--ক--ষ্--ট--অ--অ----!
---দাঁড়া অ--ন্--জ--ন---দাঁ--ড়া--আ--আ--এ--ক--টু--উ--উ--।চ--লে--এ--এ--যা--স--না--আ--আ--ভা--আ--ই--ই--ই---।আ--মি--ই--তো--র--কা--ছে--এ--এ---!
বারান্দায় কল্যাণী দেবীর কানে যায় অর্কর গোঁয়ানি।দৌড়ে ঘরে ঢোকেন তিনি।বিছানায় তখন কি এক ঘোরের মধ্যে হাত পা ছুঁড়ছে অর্ক।কাছে গিয়ে বিছানায় অর্কর পাশে বসেন তিনি।অর্কর গায়ে ঠেলা দিতে গিয়ে চমকে ওঠেন।প্রবল জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে অর্কর গা।তাঁর গলা চিরে বেরিয়ে আসে ভয়ার্ত স্বর--অ--র্--ক--অ--অ--বা--আ--বা--আ--আ--আ--মা--আ--আ--র----!
বারান্দায় দাঁড়ানো সুদীপ্ত বাবু চমকে যান কল্যাণী দেবীর স্বরে।দ্রুত ঘরে ঢুকে তিনি উদ্বিগ্ন স্বরে বলেন--কি হয়েছে কল্যাণী?অমন-----!
কোনো কথা বের হয় না কল্যাণী দেবীর মুখ থেকে।অর্কর মাথাটা কোলে টেনে তার কপালের দিকে ঝুঁকে পড়েন তিনি।সে দিকে তাকিয়ে অর্কর গায়ে হাত দেন সুদীপ্ত বাবু।অবাক বিস্ময়ে বলেন---এ কি! এমন কখন হল? কি করে হল? কেন----!নিবাক কল্যাণী দেবীর চোখ বেয়ে নেমে আসছে জল।অদ্ভুত এক ঘোরের মধ্যে অর্ক বিড়বিড় করে কি যেন বলছে।বোঝা যাচ্ছে না কিছুই।আর কথা না বাড়িয়ে পাশের ঘরে চলে যান সুদীপ্ত বাবু।যত দ্রুত সম্ভব ব্যবস্থা করতে হবে অর্কের চিকিৎসার।বিষয়টা গুরুতর হওয়ার আগেই-------!
================
ছবি- ইন্টারনেট ।
----------------------------
উত্তর ২৪ পরগনা।