Click the image to explore all Offers

নিবন্ধ ।। মহাসপ্তমী : নবপত্রিকা : নবদুর্গা : মহাস্নান ।। রীতা রায়


 
মহাসপ্তমী : নবপত্রিকা : নবদুর্গা : মহাস্নান

রীতা রায়

কৈলাশে হৈ চৈ.. সাজো সাজো রব..
মা দুর্গা ছেলেমেয়েদের তদারকি করছেন.. তাড়াতাড়ি কর.. ওদিকে ঢাকে কাঠি পড়ে গেছে। বাহনেরাও কে কোন দিকে আছে... খোঁজ খোঁজ তাদেরকে। কার্তিকের আলসেমি কাটিয়ে তৈরী হতে অনেক দেরি, লক্ষ্মী-সরস্বতীর পছন্দসই সাজুগুজু করতে সময় লাগবে। গণেশ বাবাজী শুঁড়টা খুলে রেখেছিলো.. সেটা আবার ইঁদুরে কেটেছে.. তারও মেরামতি চলছে।
মা দুর্গার অস্ত্রগুলোতে জং ধরেছে.. সেগুলো পালিশ করতে পাঠানো হয়েছে। দশটা হাত তো নয়.. সবই অজুহাত। দশ হাতে অস্ত্র ধরে দাঁড়িয়ে থাকো ওই পাজি অসুরটার দিকে তাক করে। ছাড়া পেলেই সে আবার কোন কান্ড ঘটায়। সুতরাং মা দুর্গার সাজতেও সময় লাগবে।

   -- ওরে গণেশ! তুই বরং 'কলাবৌ'কে নিয়ে আগে চলে যা। তোদের পূজোতো আগে হবে.. আমাদের একটু পরে গেলেও চলবে।

   --  কলাবৌ? সে তো পার্লারে গিয়ে ফেসিয়াল করছে।

  -- সে কী রে? ওর মুখটা দেখবে কে শুনি? ঘোমটা মুখে দাঁড়িয়ে থাকা ছাড়া আর কী কাজ?

সরস্বতী টিপ্পনি কাটলো। অমনি লক্ষ্মী বলে উঠলো -- কলাবৌ বলেছে, ওকে নাকী পচা নোংরা নদী পুকুরের জলে চুবিয়ে স্নান করাতে নিয়ে যায় তাতে তার মুখে হাতে ৱ্যাস বেরোয়.. তাই আগে থেকে মেকআপ করে নিচ্ছে, যাতে ত্বকের ক্ষতির সম্ভাবনা কম হয় !

  -- ওরে, যা রে গণেশ.. তাড়াতাড়ি কলাবৌকে সঙ্গে নিয়ে যা নইলে দেরি হয়ে যাবে। মহাসপ্তমীর আলো ফুটতে আর দেরি নাই।

...........................................................

একটু মজা করলাম। হ্যাঁ, আজকাল ঠাকুর দেবতাদের নিয়েও সবাই মজা করে থাকে । পুরাণ সম্পর্কে খুব একটা ধারণা না নিয়েই বর্তমান সমাজ ব্যবস্থার সমীপে সব ফেলে দিচ্ছে। কেউ কেউ কলাবৌকে নিয়ে কী সব বিশ্লেষণ দিচ্ছে। বলছে.. কলাবৌ নাকী গণেশ-এর বৌ। ঋদ্ধি ও সিদ্ধি নয়। কলাবৌকে অবহেলা করা হয় সস্তা সাদা লালপেড়ে শাড়ি পরিয়ে এককোনে দাঁড় করিয়ে রেখে যেমন বাড়ির বৌয়েদের অবহেলা করা হয়।
বাড়ির বউরা সব জায়গাতেই উপেক্ষিত সে স্বর্গ হোক বা মর্ত্য! শিক্ষিত মেয়েদের এরকমই ধারণা। আবার গ্রামের সাধাসিধে মেয়েরা কলাবৌ'কে মা দুর্গার ননদ ভাবে। সেজন্য তাকে আগে যেমন তেমন পূজা দিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হয় আর সে বাড়ি গিয়ে দুর্গার নামে শিবের কাছে নালিশ জানাই.. তাতে রেগে গিয়ে চারদিনের দিন শিবঠাকুর এসে মা দুর্গাকে তাঁর ছেলেমেয়েসহ বাপের বাড়ি থেকে নিয়ে চলে যান ।

লোককথার অন্ত নেই। মানুষের মুখ বন্ধ করবে কে? আর আধুনিক মানুষের অর্ধজ্ঞান বড় ভয়ঙ্কর। সোশ্যাল মিডিয়ায় একবার বলা হয়ে গেলেই সেটা কয়েক মুহূর্তে লক্ষ লক্ষ মানুষের কানে পৌঁছে যায়। ভাইরাল জ্বরে জর্জরিত আজকের আধুনিক সমাজ।


মহাসপ্তমী! অর্থাৎ নবপত্রিকার ঘটস্থাপন । শারদীয়া দুর্গাপূজার এটাই আসল পূজা। মণ্ডপে সাজানো ঠাকুরতো দর্শনীয় মাত্র। আসল কথা নবপত্রিকায় নয়টি অতি প্রয়োজনীয় গাছের পূজা। সনাতন শাস্ত্রে সব সময় গাছকে প্রাধান্য দেওয়া হয়ে থাকে। তারই একটি উদাহরণ 'নবপত্রিকা'। নবপত্রিকায় দেবী দুর্গার নয়টি স্বরূপকে অধিষ্ঠাত্রী দেবী হিসেবে পূজো করা হয়। কৃষিজ ছাড়া মনুষ্য জীবন অচল তাই মা দুর্গার নবরাত্রি উদযাপন। সপ্তমীর সকালে নয়টি গাছের সম্মিলিত রূপকে দেবী হিসেবে বরণ করা হয় এবং মহাদশমীর দিন এর মন্ত্রপুত বিসর্জনের মাধ্যমে দুর্গাপূজার সমাপ্তি ঘটে।
কী এই নবপত্রিকা? একটু বিস্তারিত জানি।

মহাসপ্তমীর প্রারম্ভিক অনুষ্ঠান হল নবপত্রিকা ও মহাস্নান। নবপত্রিকা হল নবদুর্গা। নবপত্রিকা শব্দটির আক্ষরিক অর্থ নটি গাছের পাতা। তবে বাস্তবে নবপত্রিকা নটি পাতা নয়, নটি উদ্ভিদ। এই উদ্ভিদের মধ্যে লতা, গুল্ম, মূল, বৃক্ষ সবই রয়েছে। এগুলি হল -
১. কদলী বা রম্ভা (কলা),
২. অপরাজিতা,
৩. হরিদ্রা (হলুদ),
৪. জয়ন্তী,
৫. বিল্ব (বেল),
৬. দাড়িম্ব (দাড়িম),
৭. অশোক,
৮. মানকচু,
৯. ধান

গণেশের ডান পাশে 'নবপত্রিকা' স্থাপন করা হয়। একটি সপত্র কলাগাছের সঙ্গে অপর আটটি সমূল সপত্র উদ্ভিদ একত্র করে একজোড়া বেল সহ শ্বেত অপরাজিতা লতা দিয়ে বেঁধে লালপাড় সাদা শাড়ি জড়িয়ে ঘোমটা দেওয়া বধূর আকার দেওয়া হয়। তারপর তাতে সিঁদুর দিয়ে সপরিবার দেবীপ্রতিমার ডান দিকে দাঁড় করিয়ে পূজা করা হয়। প্রচলিত ভাষায় নবপত্রিকার নাম 'কলাবউ'।

                       নবপত্রিকার নয়টি উদ্ভিদ আসলে দেবী দুর্গার নয়টি বিশেষ রূপের প্রতীকরূপে কল্পিত হয়। এই নয় দেবী হলেন রম্ভাধিষ্ঠাত্রী ব্রহ্মাণী, কচ্বাধিষ্ঠাত্রী কালিকা, হরিদ্রাধিষ্ঠাত্রী উমা, জয়ন্ত্যাধিষ্ঠাত্রী কার্তিকী, বিল্বাধিষ্ঠাত্রী শিবা, দাড়িম্বাধিষ্ঠাত্রী রক্তদন্তিকা, অশোকাধিষ্ঠাত্রী শোকরহিতা, মানাধিষ্ঠাত্রী চামুণ্ডা ও ধান্যাধিষ্ঠাত্রী লক্ষ্মী। এই নয় দেবী একত্রে "নবপত্রিকাবাসিনী নবদুর্গা" নামে "নবপত্রিকাবাসিন্যৈ নবদুর্গায়ৈ নমঃ" মন্ত্রে পূজিতা হন।

                        মহাসপ্তমীর দিন সকালে পুকুরে বা নদীতে মহাস্নান অনুষ্ঠান হয়।পুরোহিতসহ একজন নবপত্রিকা, একজন দেবীর ঘট, একজন গণেশ পঞ্চঘট নিয়ে সেখানে যান। ঢাক ঢোল শঙ্খ উলুধ্বনি ও আন্তরিক সহকারে শাস্ত্রবিধি অনুযায়ী স্নান করানোর পর নবপত্রিকাকে নতুন শাড়ি পরানো হয়। তারপর পূজামণ্ডপে নিয়ে এসে দেবীর ডান দিকে একটি কাষ্ঠসিংহাসনে স্থাপন করা হয়।পূজামণ্ডপে নবপত্রিকা প্রবেশের মাধ্যমে দুর্গাপূজার মূল অনুষ্ঠানটির প্রথাগত সূচনা হয়। নবপত্রিকা প্রবেশের পর দর্পণে দেবীর মহাস্নান করানো হয়। এরপর বাকি দিনগুলিতে 'নবপত্রিকা' প্রতিমাস্থ দেবদেবীদের সঙ্গেই পূজিত হতে থাকেন ।

            দুর্গাপূজার একটি বিশেষ অনুষ্ঠান হল মহাস্নান। মহাসপ্তমীর দিন নবপত্রিকা স্নানের পর মহাস্নান অনুষ্ঠিত হয়। মহাষ্টমী ও মহানবমীর দিনও পূজার মূল অনুষ্ঠান শুরুর আগে মহাস্নান অনুষ্ঠিত হয়।
দুর্গাপ্রতিমার সামনে একটি দর্পণ অর্থাৎ আয়না রেখে সেই দর্পণে প্রতিফলিত প্রতিমার প্রতিবিম্বে বিভিন্ন জিনিস দিয়ে স্নান করানো হয়। মহাস্নানের সময় শুদ্ধজল, নদীর জল, শঙ্খজল, গঙ্গাজল, উষ্ণ জল, সুগন্ধি জল, পঞ্চগব্য, কুশ ঘাসের দ্বারা ছেটানো জল, ফুলের দ্বারা ছেটানো জল, ফলের জল, মধু, দুধ, নারকেলের জল, আখের রস, তিল তেল, বিষ্ণু তেল, শিশিরের জল, রাজদ্বারের মাটি, চৌমাথার মাটি, বৃষশৃঙ্গমৃত্তিকা, গজদন্তমৃত্তিকা, বেশ্যাদ্বারমৃত্তিকা, নদীর দুই তীরের মাটি, গঙ্গামাটি, সব তীর্থের মাটি, সাগরের জল, ঔষধি মেশানো জল, বৃষ্টিজল, সরস্বতী নদীর জল, পদ্মের রেণু মেশানো জল, ঝরনার জল,পঞ্চ কষার জল ইত্যাদির সহস্রধারা দিয়ে মা দুর্গাকে স্নান করানো হয়। তারপর সমস্ত দেবদেবীকে আবাহন করে শুরু হয় মহা সপ্তমীর মহাপূজা।

এই হলো 'নবপত্রিকা' তথা 'কলাবৌ' কথন। কলাবৌ তুচ্ছতচ্ছিল্য করার বিষয় নয়। নবপত্রিকা হল দুর্গাপূজার আসল পূজা, এটা ছাড়া দুর্গাপূজা অসম্পূর্ণ।

----------------------------------------------------------

রীতারায়
মহেশমাটি রোড, মালদা
পশ্চিমবঙ্গ, ভারত
পিন - ৭৩২১০১
মোঃ ৭৬০২৪৮২০৮২


 

Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.