ধারাবাহিক উপন্যাস ।। সামান্য মেয়ে( পর্ব- ৪) ।। রনেশ রায়
৪
আত্মঘাত
করোনা আবহাওয়া হালকা হয়েছে। কথা অনুযায়ী নীলু পরিবার পরিজন নিয়ে সুন্দরবন বেড়াতে যাওয়ার পরিকল্পনা করেছে। ঠিক হয়েছে বুড়ির কাকা যে লঞ্চ চালান সে লঞ্চ করে এই নদী বিহার। বুড়িও কাকার সঙ্গে যাবে। সুন্দরবনের বাসিন্দা বলে বুড়ি কাকার সঙ্গে দু'একবার গ্রামের বাইরে সুন্দরবন ভ্রমনেএসেছে । কলকাতাবাসী হলেও নীলু এক আধবার সুন্দরবন বেড়াতে গেছে। সুন্দরবনের কথা উঠলেই ওর ছোটবেলার কথা মনে পড়ে। দাদু মানিমাষ্টার ওপারে মানে বাংলা দেশে সুন্দরবন অঞ্চলের বাসিন্দা। ওখানে উনার মেয়ে হাসির বিয়ে হয়। সেখানেই নীলুর জন্ম। পরবর্তীকালে দেশভাগের পর মানিবাবু এপারে এখনকার বাসস্থানে চলে আসে। তারপরেও কিছুদিন নীলুরা ওখানে থাকে। সেই শৈশবে নীলুর সুন্দরবনের সঙ্গে পরিচয়। এটা তার মাতৃভূমি। পরে ওরা এই বাংলায় কলকাতার কাছে চলে আসে। বাবার ব্যবসা প্রতিপত্তি সবই এখানে। এখন এটাই নীলুদের দেশ। সুন্দরবনের কথা উঠলেই নীলু কিছুটা অতীত সন্ধানী হয়ে ওঠে। বাংলাদেশ থেকে ওরা ৭০-এর দশকের প্রথম দিকে এসেছে। কিন্তু বাংলা দেশে শৈশবেই সুন্দরবনের সঙ্গে তার আলাপ। সেই আলাপ তাকে সুন্দরবন প্রেমিক করে তোলে। পশ্চিমবাংলা ও পূর্ববাংলার মধ্যে দিয়ে উত্তর থেকে দক্ষিণে অববাহিত গঙ্গা ও মেঘনা নদী থেকে বেরোনো শাখা-নদীগুলোর মিষ্টি জলের সঙ্গে সঙ্গম ঘটে চলে দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর থেকে সাঁতরে আসা নোনাজলের। এই দুই বাংলার দক্ষিণ উপকূল ধরে সাগরের মোহনা পর্যন্ত এক জলসাম্রাজ্য গড়ে উঠেছে । সেখানে সৃষ্টি হওয়া অসংখ্য দ্বীপ।
আর দ্বীপের জঙ্গলগুলো নিয়ে সৃষ্টি হয়েছে সুন্দরবন। বহুদিন আগে জলজ আধারে গড়ে ওঠা সুন্দরবন অবিভক্ত ভারতে আয়তনে ছিল ১৬,৭০০ কিমি। আজ কমে দাঁড়িয়েছে ৪,১৮৩ কিমি । এক বিস্তৃত পাড় যে বিস্তীর্ণ অঞ্চলকে আলিঙ্গন করে, জড়িয়ে ধরে তা নিয়েই আমাদের মাতৃভূমি এককালের অখন্ড বাংলা। অবিভক্ত বাংলার দক্ষিনে সাগর তার মোহনা ধরে ভেতরে ঢুকে পূর্ব ও পশ্চিমের মধ্যে এক সেতুবন্ধন গড়ে তুলেছে। তার উপর সৃষ্টি হয়েছিল এক ভাষাভাষী একজাতি আর এক সংস্কৃতির বাংলা। আজ সে দ্বিধাবিভক্ত। আমরা বাঙালি বলে নিজেদের পরিচয় না দিয়ে পরিচয় দিয়ে থাকি হিন্দু বাঙালি আর মুসলমান বাঙালি বলে। সুন্দরবনও ভাগ হয়ে গেছে হিন্দু আর মুসলমানে। কিন্তু রোজই বিরামহীনভাবে এই বিরাট বিস্তীর্ণ জলরাশি জোয়ার ভাঁটার টানে উভয় দেশের উপকূলে আছড়ে পরে, উভয়ের মধ্যে মিলনের বার্তা বহন করে। মানে না মানুষের সৃষ্ট বিভাজন। আবার মেলার জন্য উন্মাদ হয়ে ওঠে।
যারা
আগে যায়নি তারা জানে সুন্দরবন মানে তো বাঘ দেখা। এলেবেলে বাঘ নয় একেবারে রয়াল বেঙ্গল টাইগার।
শোনা যায় কোনো অভিজাত ব্রিটিশ পরিবার সুন্দরবন অভিযানে গিয়ে যে বাঘ দেখে তার মত সুদর্শন
বাঘ আর দুনিয়ায় দেখা যায় না বলে তাদের মনে হয়েছিল । আর এই বাঘ বিশেষ মর্যাদা সম্পন্ন অভিজাত
বাঘ। এই মন মাতানো সুদর্শন বাঘের একটা সুন্দর নাম তারা দেয়--- রয়াল বেঙ্গল টাইগার। বাংলা
দেশের মুকুটে রয়াল বেঙ্গল টাইগার নামে এক নক্ষত্র যোগ হয় । পরে ব্রিটিশ সরকার এই নামের স্বীকৃতি
দেয়। সেই থেকে সুন্দরবন পরিচিতি পায় রয়াল বেঙ্গল টাইগার -এর জন্মস্থান বলে । পৃথিবীর জাদু
ঘরে সেই থেকে সুন্দরবনের বাঘকে সবাই রয়াল বেঙ্গল টাইগার বলে জানে। বিনোদন বিহারের মানচিত্রে
সুন্দরবনের নাম বিশেষ মর্যাদা পায়। তবে এই বাঘ হিন্দুও নয় মুসলমানও নয়। সে বাঙালি বাঘ।
দুদিন আগেই নীলু দাদুর বাড়ি চলে আসে। ওদের পরিকল্পনা দাদু জানে না। কলকাতা থেকে নীলুর বন্ধুরা ওর বোন তার সঙ্গে বৌদি আর বৌদির ছেলে মেয়েকে নিয়ে ক্যানিংয়ে আসবে। সেখানে কাকার লঞ্চ থাকবে। সেখান থেকে ওরা রওনা দেবে। নীলু ওদের সঙ্গে যোগ দেবে। কাকার সঙ্গে বুড়ি থাকবে। এই ব্যবস্থার আয়োজক বুড়ি। ওর কাকার সহযোগিতায় এই ব্যবস্থা। রান্নার লোক বাজার সবই কাকা ব্যবস্থা করেন। কাকা বুড়ির সঙ্গে নীলুর সম্পর্কের ব্যাপারটা জানেন। বুড়ি কাকার খুব আদরের। যা কিছু আবদার তা কাকার কাছে। নীলুর সঙ্গে বুড়ির সম্পর্কে বাবা নারাজ হলেও কাকা উৎসাহী। উনি বুড়িকে বাবার কাছ থেকে আড়াল করে রাখেন। ওদের প্রেমের ব্যাপারে প্রশ্রয় দেন। বুড়ি কাকার বাড়িতে লুকিয়ে নীলুকে একবার নিয়ে গেছে। ওখানে কাকার ছেলে বিলুর সাথে নীলুরও পরিচয় হয়। ওদের নীলুকে ভালো লাগে। নীলুর সরলতা ওদের সবার মন কাড়ে। কলকাতার বিত্তশালী পরিবার সম্পর্কে এই গাঁয়ের মানুষদের যে আড়ষ্টতা ছিল নীলুর সাথে পরিচয়ে সেটা কিছুটা হলেও কেটে যায়। আর দাদুর এখানে নিয়মিত আসায় নীলুও এই গ্রাম্য জীবনের স্বাদ পায়। এখানে এলে অতিতচারী হয়ে ওঠে। শৈশবের দেশের কথা মনে পড়ে।
শীতের সকালে সুন্দরবন অভিযানের দিন চলে এলো। কলকাতা থেকে যারা আসবে সবাই প্রস্তুত। মোটামুটি সবার তাগিদেই একটু আগে আগে সকাল সাড়ে ছটার মধ্যে নিদৃষ্ট করে রাখা বাসে নীলুর বন্ধু পরিজনরা টালিগঞ্জ থেকে রওনা দেয়। হৈ হৈ করতে করতে বাস ক্যানিং পৌছল সাড়ে আটটা নাগাদ। ক্যানিং নেমে সবাই হুটোপাটি। এক দৌড়ে আগে লঞ্চে উঠবে। বাঘ দেখার জন্য ভালো জায়গাটাতো চাই। কিন্তু হায় ! প্রকৃতির বিরূপতায় ভাটার টানে নদী পার থেকে দুরে সরে যায়। সে অপেক্ষা করে যতক্ষণ না জোয়ার আসে। জানা গেল জোয়ার আসবে দশটা নাগাদ। ঘন্টা খানেক দেরী। দশটা নাগাদ জোয়ার এলো। নদী পায়ের কাছে নতজানু হয়ে অতিথিদের স্বাগত জানায় । আমন্ত্রণ করে তার সাম্রাজ্য ভ্রমনে। বর্ষার ভরা যৌবনে মাতলা নদী ভয়ঙ্কর মাতাল। কিন্তু শীতে সে কত শান্ত বিনয়ী -- যেন কলা বউ। সবাই জলের সঙ্গে কলরবে আমন্ত্রণ গ্রহণ করে। দু`দিনের জন্য তার অতিথি । বুড়ির কাকা মানে লঞ্চের সারেংই একটা পাটাতন দিয়ে জল আর ডাঙ্গার মধ্যে সেতুবন্ধন তৈরি করে দেন।
সাবধানে
এক এক করে সবাই লঞ্চে ওঠে। ওখানে বুড়ি রান্নার জায়গায় তত্বাবধানে। লঞ্চ ভাসল মাতলা নদীর
কোলে। উত্তর থেকে দক্ষিন অভিমুখে। চারদিকে তাকালে দেখা যায় শান্ত জলরাশি। তার উপর দ্বীপগুলো
লজ্জায় মাথা তুলে। অনেক জায়গায় দুটো দ্বীপ খুব কাছাকাছি যেন পরস্পর আলাপে ব্যস্ত। তারই
মধ্যে দিয়ে চলেছে নদীর প্রবাহ। নদী যেন খাল হয়ে ঢুকছে। মুখোমুখি কাছাকাছি দাঁড়ানো দ্বীপগুলোর
মধ্যে দিয়ে যাওয়া জলের প্রবাহ নিয়ে তৈরি হয় খাড়ি । খুব অপ্রশস্ত লঞ্চ বা ছিপ নিয়ে খাড়ি
ভ্রমন এক অভাবনীয় অভিজ্ঞতা। নীলুর এ ধরণের ভ্রমণে অভিজ্ঞতা আছে।দুদিন আগেই ওরা খার ভ্রমণ
করেছে। অন্যদের সবার এই অভিজ্ঞতা নেই। এমন কি সুন্দরবনবাসী বুড়িও এ ব্যাপারে কিছুটা আনকোরা
যদিও দু একবার করি ভ্রমণে সে গেছে। তবে কাকার এই জলে ভ্রমণের বিরাট অভিজ্ঞতা অর্জন।
তিনিই লঞ্চ চালাতে চালাতে দ্বীপগুলোর সঙ্গে সকলের পরিচয় করিয়ে দিচ্ছিলেন। হাসিমুখে
সবার প্রশ্নের
উত্তর দিচ্ছিলেন। তবে লঞ্চটা প্রস্তে বেশি হওয়ায় খাড়িতে ঢুকে সেই অসাধারণ অভিজ্ঞতা লাভের
সুযোগ আজের ভ্রমনবিলাসীরা পাবে না। সঙ্গে বাচ্চারা আছে। বাচ্চাদের নিয়ে সেই অভিযান
কিছুটা ঝুঁকি
সাপেক্ষও বটে। লঞ্চটা
একটার পর একটা দ্বীপ পার হয়ে চলেছে। সারেং দ্বীপগুলোর নাম বলে যায়। বাচ্চা বুড়ো সবার নজর দ্বীপে
জঙ্গলে। বাঘ মামা যদি লেখা দেন ! যদি কেন, বাঘ-তো দেখা যাবেই। যত সময় যায় সবাই অশান্ত
হয়ে ওঠে। ফাঁকা দ্বীপগুলোতে জঙ্গলের মধ্যে হরিণ দেখা যাচ্ছে কিন্তু বাঘ ! একটু পরে
পরেই বাচ্চারা
চেঁচিয়ে ওঠে হরিণ হরিণ বলে। সারেং মনে কাকা মজা পায়। স্টিয়ারিং-এ হাত রেখে বলে:
------ চুপ চুপ বাঘ পালিয়ে যাবে, শব্দ কোরো না।
সুনীলের নাতনি বলে, ----- তোমার নামটা ভারী সুন্দর। কে দিয়েছে নামটা?
সঙ্গে সঙ্গে শ্যামার নাতি বলে ------ কি বোকা, কিছু জানে না ! ওটা নাম নয়, যারা লঞ্চ চালায় তাদের বলে সারেং।সারেং বকে ওঠে:
------ ওই দেখ বাঘ পালিয়ে গেল। বলছি না চুপ কর। সারেং এর মুখে কপট হাসি।সবাই চুপ। বাঘ যেন না
পালায় ! সারেং-এর কথা দেববাণী। তার কথা না শোনায় খেসারত দিতে হল। বাঘ দেখা দেওয়ার জন্য
আসছিল। শব্দ শুনে পেছিয়ে গেল। তবে আবার আসবে নিশ্চয়ই।
ধৈর্য অধৈর্যের বাঁধ ভেঙে সময় যায়। লঞ্চ সময়ের সঙ্গে ছুটে চলেছে। জোয়ারের টানে তার গতি যথেষ্ট।
দ্বীপগুলোতে গরান নামে একধরনের গাছের জঙ্গল। ইংরেজিতে একে ম্যানগ্রোভ ( Mangrove ) বলে।
গাছের শাখাগুলো থেকে শিকর মাটিতে ডুবে থাকে। সুন্দরবনে পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে বড় এই ধরনের ঘন
জঙ্গল দেখা যায়। এই জঙ্গলের আড়ালে চড়ে বেড়ায় জন্তু জানোয়াররা। কখন এই আড়াল থেকে বাঘ বেরুবে
তার অপেক্ষায় সবাই। নানারকমের পাখি জঙ্গলের শোভা বৃদ্ধি করছে। নাম জানা না জানা পাখিরা বাঘ না
দেখতে পাবার শোক কিছুটা হলেও মিটিয়েছে। দুপুর গড়িয়ে প্রায় বিকেল। সবাই খেতে যাবে সেই মুহুর্তে
সারেং বলে এদিকে দেখ । দেখা যায় একটা ময়ূর পেখম মেলে নাচের ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে। যেন বলছে আমাকে
দেখো। বাঘের থেকে আমি কম কিসের ! মাথার ওপরে মেঘের ডাক শোনা যাচ্ছে। সূর্য অস্তমিত। একটু পরে দিগন্ত রেঙে উঠবে। আকাশের কালো মেঘ তাকে আলিঙ্গন করবে। এই অপূর্ব পরিবেশে পেখম মেলা ময়ূর দৃষ্টি নন্দন সন্দেহ নেই। সবাই দুচোখ মেলে সেই দৃশ্য উপভোগ করে। ময়ূরের এই স্নিগ্ধ রূপ দেখে
আমাদের অস্থিরতা অনেকটা দূর হয়। ময়ূর দর্শনের পর কিছুটা আত্মতৃপ্তি নিয়ে আমরা খেতে যাই ।
নিশ্চিত বাঘ দর্শন কালকের জন্য তোলা থাকে।
খাওয়া দাওয়া শেষ হতে প্রায় সন্ধ্যে। শীতের ঠান্ডায় সূয্যি মামার বিদেয় আর চাঁদ মামীর ঘরে ফেরার
পালা। আর এগোন চলে না। সামনে একটা দ্বীপের পাড়ে বেশ কয়েকটা লঞ্চ দাঁড়িয়ে। সেখানে আজ
রাত্রিবাস। লঞ্চেই থাকা। পুর্বপরিকল্পনামত কাল সকালে আবার অভিযান শুরু হবে। কাল বঙ্গোপসাগরের
কাছাকাছি যতদুর যাওয়া যায় যাওয়া হবে। ফেরার পথে পাখিরালয়ে সরকারী লজে রাতে থাকার ব্যবস্থা করা
আছে। পরশু গ্রাম আর কয়েকটা রিসার্ভ ফরেস্ট দেখে ফিরে আসা। এই যাতায়াতের পথে কয়েকটা বাঘের
দেখা মিলবে নিশ্চয়ই। এই আশা নিয়ে লঞ্চ পাড়ে এসে নোঙ্গর করে। সারেং মানে বুড়ির কাকা ইতিমধ্যে
কাঁচা কুচোদের কাছে সারেং কাকু হয়ে গেছে। এটাই যেন তার নাম। সবাই তার সঙ্গে আলাপচারিতায় জানতে
পারে যে জলে সারেং হলেও ডাঙ্গায় সে মন্টু মানে বুড়ির কাকা। মন্টু নস্কর। সে যে দ্বীপটায় থাকে তার
নাম বিধবা পাড়া। সকলে উৎসাহী হয়ে ওঠে। কেউ কেউ প্রশ্ন করে:
------- সত্যি কি ওখানে সব পুরুষরাই বাঘের পেটে গেছে ? সারেং-এর উত্তর:
-------- আমি তাহলে কি এখানে ভূত হয়ে এসেছি? আমার স্ত্রী এখনও বিধবা হয়নি। মা মারা গেছেন সধবা
অবস্থাতেই। সবাই লজ্জা পায়। কারও কিছু বলার ভাষা নেই । ওর উত্তরে নিজেদের গবেট মনে হয়। তাও
কে যেন প্রশ্ন করে:
-------
তবে গ্রামটাকে বিধবা পাড়া বলা হয় কেন?
---- বহুদিন আগে কখনো একবার পরপর দুদিন গ্রামে বাঘ পড়েছিল। জনা তিনেক তাতে মারা যায়। তিনজন মহিলা বিধবা হয়। তখন গ্রামে খুব কম লোক থাকত। রটে যায় সব বিবাহিতা মহিলারাই বিধবা হয়ে গেছে।
সেই থেকে গ্রামটার নাম বিধবা পাড়া। সকলের চেতনা ফেরে। বাগ বাজারে আমরাতো কখনই বাঘের দেখা
পাই না, কেস্টপুরে ভগবান কেষ্ট কই? তাও নীলু বলে:
------ আমরা তো কাগজে বাঘের আক্রমনের কথা পড়ি । সেটাতো সবটা মিথ্যে নয়। তোমরা একটা
অনিশ্চয়তার মধ্যে কাটাও নিশ্চয় !
------ হ্যাঁ, অনিশ্চয়তা তো থাকেই। তবে আমাদের অনিশ্চয়তা যতটা বাঘ নিয়ে তার থেকে বেশি খিদে,
রোগ, চিকিৎসা নিয়ে। আমার আপনাদের কাছে একটা প্রশ্ন আছে। নীলু বলে:
------
করুন।
----- আপনাদের এলাকায় রোজ কত মানুষ মানুষকে খাচ্ছে? একজন আরেকজনের পেটে যাচ্ছে?
সকলে চমকে ওঠে! সত্যিই গ্রামে শহরে লোকালয়ে খুন, চুরি, রাহাজানি, ধর্ষণতো রোজের ঘটনা। সকলের
যেন গা সওযা হয়ে গেছে। কতকগুলো হিসেবের মধ্যে থাকে আরও বেশি হিসেব বহির্ভূত। সঠিক উত্তর
দিতে কেউ পারে না। তবে স্বীকার করতে হয়। সারেং বলে বাঘের উৎপাত সেই তুলনায় নগণ্য। এখানে
অনেক বেশি মানুষ মরে না খেয়ে, পুষ্টির অভাবে, চিকিৎসা না পেয়ে। আর কথা বলতে পারি না। প্রসঙ্গ
বদলে সারেং বলে:
------- আপনারা বাঘের সাক্ষাতে এসেছেন। বাচ্চারা খুব আশাবাদী। কিন্তু সত্যিটা হল আমি প্রায় কুড়ি
বছরে এই যাতায়াতের পথে সাত আটবারের বেশি বাঘ দেখিনি। অথচ প্রায় রোজ-ই আসি। আপনাদের
আশা মিটলে সেটা একটা বাড়তি পাওনা। খুব কম লোকের কপালে জোটে।
শীতের ছোট বিকেল পেরিয়ে সন্ধ্যে। আস্তে আস্তে সন্ধ্যে গড়িয়ে রাত, সে অন্ধকারের চাদর বিছিয়ে
দৃষ্টি কেড়ে নিচ্ছে । কিন্তু ভরা পূর্নিমা । অন্ধকারের মধ্যেও জ্যোৎস্নার আলো। আকাশে আলোর
চ্ছ্টা। দিনের সম্রাটের রাজদরবার আজকের মত সমাপ্ত। রাজদরবার থেকে অভাজনরা বিদেয় নিয়েছে ।
সম্রাজ্ঞী প্রবেশ করায় সম্রাট আমাদের দিক থেকে সম্রাজ্ঞীর দিকে মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছেন। সম্রাজ্ঞী
সম্রাটের আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে তার পারিষদ দল নিয়ে রাজপাটের দখল নেন । সম্রাট সরে যান
অন্দরমহলে । রাজকর্ম নয়, নাচে গানে মুখর হয়ে ওঠে সারাদিনের রাজপাটে ক্লান্ত অবসন্ন রাজ
দরবার। সম্রাটের ভ্রূকুটি নয় সম্রাজ্ঞীর উজ্জল হাসি তামাসায় আলোকিত হ`য়ে রাজ দরবার পরিণত
হয় আনন্দ নিকেতনে। সৌরজগতের নক্ষত্ররা পাহারা দেয় এই আনন্দনিকেতন। সেখান থেকে ঠিকরে
আসা আলোয় ঝলমল করছে নদীতট। সামনের দ্বীপটার পেছনটা আলো আঁধারি। লঞ্চ একটা দ্বীপে
হোটেলের সামনে নোঙর করেছে। বাচ্চাদের নিয়ে কেউ কেউ নেমে হোটেলে ঢুকে পড়েছে। বাকিরা লঞ্চে।
কাকা আছেন পাহারায়। সারাদিন বুড়ির কেটেছে অতিথি সেবায় তাদের খাওয়া দাওয়া দেখা শোনায়। নীলুর
সঙ্গে দেখা হলেও কথা তেমন হয় নি। এখন এই সময়। নীলু সুযোগ পেয়ে বুড়িকে নিয়ে লঞ্চের ছাদে এসে
বসেছে। এই আলো আঁধারের রোমান্টিক মায়াবী সন্ধ্যাটা এখন একান্তই ওদের। নিভৃতে জায়গা করে
নিয়েছে। এই স্বর্ণালী সন্ধ্যায় যুগল মিলনের অনাবিল আনন্দের নির্বাক সাক্ষী হয়ে থাকবে কেবল
সৌরজগত। সারেং মানে কাকাও ব্যাপারটা বোঝে। সে তার ঘরে চলে যায়।
বুড়ি এভাবে একান্তে কখনও নীলুকে পায় নি বা নীলু বুড়িকে পায় নি। গ্রামে যখনই নিরালা খুঁজেছে তখনই
একটা ভয় তাড়া করেছে। এই বোধহয় কেউ দেখে ফেলল! বুড়ির বাবা বা নীলুর দাদু বুঝি জেনে ফেলল। এখানে সেই ভয় নেই। কাকা জানলে ভয়ের কিছু নেই। আর নীলুর বন্ধুরা সম্পর্কটা জানে। এ নিয়ে ওরা হাসি তামাসে করবে। ওতে কিছু আসে যায় না। দুজনে এসে ছাদে পাতা বেঞ্চটায় বসে। কিছুক্ষণ কথা বলতে বলতে একজন আরেকজনের গায়ে ঢলে পড়ে। বুড়ি নীলুর বুকে মাথা রেখে। নীলুর ভাবুক মনটা পূর্ণিমার জ্যোৎস্নায় স্নাত, সিক্ত। নদীর ওপর জ্যোৎস্নার আলো যেন ছিটকে আসছে সেই ভাবুক মনে। অতি বাস্তববাদী রোজের টান পোরনে দগ্ধ বুড়ির মনটাও শিশিরে ভিজে স্নিগ্ধ সিক্ত। তারা যেন এক মায়াবী জগতে।নীলু একটা আধটা কবিতা আবৃত্তি করে। বুড়ি গানের কলিতে নিজের এই সন্ধ্যেটাকে ধরে রাখতে চায়। আজ ভার মুক্ত এই সন্ধ্যায় দুজনেই নিজেদের ভবিষ্যৎ যুগল জীবনটাকে ঠিক এমনি জ্যোৎস্নার আলোয় আলোকিত দেখতে চায় যেখানে মধ্যাহ্নের দহন সম্পর্কে কোন তিক্ততা সৃষ্টি করতে পারে না। নীলু তার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার কথা বলে। পরিবারের সব বাধাকে অস্বীকার করে হলেও নীলু বুড়িকে স্বমর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করবে বলে শপথ নেয়। বুড়ি জীবনে এ ধরণের মুহূর্তের কথা ভাবতে পারে নি। সেও নীলুর প্রেমের যথার্থ মর্যাদা দিতে অঙ্গীকারবদ্ধ। নীলুর কথা শুনতে শুনতে বুড়ি তন্দ্রামগ্ন। কখন নীলুর কোলে এলিয়ে পড়েছে।
নীলুর ঠোঁটের তেষ্টা মেটাতে সে উদগ্রীব। এ এক আচ্ছন্ন অবস্থা। প্রেমের এই আচ্ছন্নতা আগে কখনও
ওদের অনুভবে ছিল না। ওরা যেন একটু বেপরোয়া হয়ে ওঠে। এভাবে এক রোমান্টিক আবহে অনেকক্ষন
চলে। দুজনেই যেন এক অজানা জগতে যা তাদের কল্পলোকে বেঁচে থাকে। দুজনে দুজনকে জড়িয়ে সময় কাটে।
হঠাৎই বুড়ি যেন বাস্তবে ফিরে আসে। তার বাবার কথা মনে পড়ে। বাবার ওপর নিধিরামের চাপ ওর বিয়ে
নিয়ে। তাছাড়া নীলুর কাছে শুনেছে তার বাড়ির অবস্থান। আর নীলুর উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ যার সঙ্গে ও
একেবারেই মানানসই নয় এই সমাজের নিয়মে। ওর যেন মনে হয় এই স্বপ্ন আপ্লুতো অবস্থা কখনও
বাস্তবের কঠিন শয্যায় জায়গা করে নিতে পারবে না মানিয়ে চলতে পারবে না। এটা স্বপ্নই থেকে যাবে।
এক কুহেলিকা। এখানে নিজেকে নিবেদন করা মানে আত্মহনন। সে নীলুকে উদ্দেশ্য করে বলে:
------ এই যে পূর্ণিমার জ্যোৎস্নায় চন্দ্রালোকে আলো আঁধার, এক কুহেলিকা, অদ্ভুত সৌন্দর্যরাশি
তার আবেশ এ তো জীবনের একটা দিক। যেটা তোমাদের ভাবনায় এই সুন্দরবন।তোমার উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ
তোমার সামাজিক মর্যাদার সঙ্গে সে মানানসই। মানুষ আর্থিক স্বাচ্ছন্দে থাকলে দিনে রাতে কঠিন
বাস্তবের আগুনে না পুড়লে এই স্বপ্ন দেখা মানায়। কিন্তু জীবনের তো আরেকটা দিক আছে। সে জীবনের
জঠরে ক্ষুধার তাড়না শিক্ষা স্বাস্থ্যের দৈন্যতা। এর ওপর প্রকৃতির রোষ হরবছর ঝড় তুফানের
আক্রমণ। সমুদ্রের আগ্রাসন। যা হলো সুন্দরবনের গ্রামীন গরিবের জীবন। এটাকে আমাদের জীবনে
অস্বীকার করি কি করে?
বুড়ির এত বাস্তবাদীতা এই মুহূর্তে নীলুর ভালো লাগে না। সে বিমর্ষ বোধ করে। এতক্ষণের যে
জ্যোৎস্নার আলো ভাবনার জগতে এক স্নিগ্ধ আলো বর্ষণ করছিল তা যেন নিভে গেল। হলোই বা
আবেগতাড়িত রোমান্টিক ভাবনাটা স্বপ্ন। তা স্বপ্ন হোক না ! ক্ষতি কি? আর স্বপ্ন না দেখলে তো
বাস্তবে তাকে পাবার আকাঙ্খা জন্মায় না। নিরাশবাদের মধ্যে নিমজ্জিত হতে হয়। নীলু আর কথা বাড়ায়
না। তাকে যেন এক হতাশা গ্রাস করে।
পরের দিন সকাল সকাল বেরনো গেল। সবারই উদ্দেশ্য বাঘ দেখা। লঞ্চ থেকে দেখা না গেলেও সংরক্ষিত
জঙ্গলে নিশ্চয়ই দেখা যাবে। ওখানে-তো মানুষ খাঁচায় আর বাঘ ছাড়া। তাই বাঘের অভাব হবে না। আমরা
নেপাধোপানির সংরক্ষিত জঙ্গলে গেলাম। ঘেরা একটা বড় অঞ্চলে আমাদের ঢুকিয়ে দেওয়া হল। সেখানে
একটা উচু টাওয়ার। বেশ কিছুটা দূরে ঘেরার বাইরে একটা ছোট পুকুর। টলটল করছে পরিষ্কার জল। ওটা
নাকি মিষ্টি জল। বাঘ জল খেতে আসবে। আমাদের বাঘ দর্শন সার্থক হবে সন্দেহ নেই। আমরা সবাই টাওয়ারে উঠে অপেক্ষা করছি। এই বুঝি বাঘ আসে। ঘন্টা খানেক কাটার পরও বাঘের দেখা নেই। সারেং
তাড়া মারে লঞ্চে ফেরার জন্য। কার-ও সেদিকে কান নেই, বাঘ না দেখে কেউ যেতে চায় না। এই ভাবে
আরও ঘন্টা খানেক কেটে যায়। সবাইকে নিরাশ হয়ে বাঘ না দেখেই ফিরতে হয়।
বাঘ দেখার খিদে না মিটলেও আজ রাজসিক ভুরিভোজ। বাঘ দেখতে পেলে দুটো মিলিয়ে জমত ভালো। কিন্তু ‘তোমার দেখা নাই, তোমার দেখা নাই’। বাঘ বাদ দিয়ে মুরগির বিরিয়ানি কতটা জমবে বলা শক্ত। বিরিয়ানির সাথে সুন্দরবনের চিংড়ি আছে। এখানে নৌকোয় করে মাছ ধরছিল মৎস জীবিরা। তাদের কাছ থেকে চিংড়ি আর ভেটকি মাছ কেনা হয়েছে। ভেটকি মাছের কাটলেট বাদ পড়বে না। সঙ্গে মিষ্টি আছে। সব মিলিয়ে ব্যাপারটা জবরদস্ত। কিন্তু খাবারের স্বাদের সঙ্গে বাঘ দেখার স্বাদটা যে পাওয়া যাবে না। হতাশ
অনেকে। অবশ্য যাদের কাছে বেড়ানো থেকে পেট পুজোটা বড় তাদের উৎসাহে তেমন ভাটা পড়েনি।
সবাই খেয়ে দেয়ে আবার লঞ্চ থেকে বাঘের অপেক্ষায়। তার মধ্যেই আরো একটা রিসার্ভ ফরেস্ট থেকে
বাঘ দর্শনের অভিযান ব্যর্থ হয়। বিকেল প্রায় গড়িয়ে যায়। আজ হ`ল না। আমরা ফিরে আসছি। লঞ্চ
অনেক দূর চলে এসেছে, জায়গাটা নির্জন। আমরা তাও আশা ছাড়িনি। যতক্ষন শ্বাস ততক্ষন আশ।
আমাদের চোখ আসপাশের ঘন জঙ্গল গুলোর দিকে। যদি তার সাক্ষাত পাওয়া যায় ! অস্তমিত সূর্যের
আলোয় নদীর পাড় জ্বলজ্বল করছে। খুব নিচু গলায় হঠাত সারেং বলে
------ এদিকে দেখ। সবাই তার দেখানো সামনের দ্বীপটায় দেখি কি একটা নড়ে চড়ে বেড়াচ্ছে । সারেং মুখে হাত দিয়ে সবাইকে চুপ থাকার ইঙ্গিত করলো। একেবারে নিশ্চুপ অবস্থা। দেখা যাচ্ছে একটা লম্বা জন্তু
বেরিয়ে আসছে জঙ্গলের আড়াল থেকে। আমাদের লঞ্চটাকে সারেং একটু একটু করে এগিয়ে নিচ্ছে
কোনাকুনিভাবে। আরে এ যে বাঘ ! মামা দর্শন দিতে এসেছেন।একেবারে রয়েল বেঙ্গল টাইগার। গায়ে তার
ডোরা ডোরা দাগ। হৃষ্টপুষ্ট। লম্বায় দশ ফুটের বেশি হবে। সে জল খেতে ব্যস্ত। আমরা ভয়ে মরি। সামনে
এতগুলো মানুষ, সাঁতরে এসে ঘার মটকে দিতে পারে তো ! কিন্তু হাউ মাউ কাউ নেই। তবে কি সে মানুষের
গন্ধ পায় না। আপন মনে জল খাওয়া শেষ হলে দুটো পাক মেরে শরীরটা দোলাতে দোলাতে আবার উঠতে
থাকে। আমাদের প্রতি এত উপেক্ষা কেন ? তবে কি তার উপোস ? না আমরা রোগা পেটকা বলে তার পাতে পড়ার যোগ্য নই।
বাঘ মামা যখন ফিরছে তখন সারেং বলল :
------ ওটা সন্তান সম্ভবা বাঘিনী । বাচ্চা প্রসব করবে কিছুদিনের মধ্যে।
নির্মলের নাতনি উত্তেজিত হয়ে ওঠে। চাপা গলায় বলে:
------ এটা মা বাঘ , তবে নিশ্চয় কাছে কোথাও বাবা বাঘ আছে ! সেটাও দেখা যাবে। আমরা সবাই হেসে
উঠি। কাকা সারেং রসিকতা করে বলে:
------ এটা কি তোমার বাবা যে সবসময় মায়ের পেছনে পছনে ঘুরবে। ওর অনেক কাজ ! কাজ না করলে খাবে কি? তোমার বাবার মত এত টাকা নেই। ও কাজে গেছে। আজ আর দেখা পাবে না। কাল পেতে পার। সাবধানে থাক। আবার তোমাদের গন্ধ পেলে বাঘ এসে যেতে পারে।
সন্ধ্যের মধ্যেই লঞ্চ ফিরে আসে। সবাই ক্যানিং এ নেমে যায়। বুড়ি কাকার সঙ্গে বাড়ি ফেরে।
ক্রমশঃ-----------
================