Click the image to explore all Offers

রহস্য গল্প ।। The case of Matchbox ।। মৌসম সামন্ত

দ্য  কেস অফ্‌ ম্যাচবক্স 
(The case of Matchbox) 
 
মৌসম সামন্ত

পর্ব ১


"তখন সুপ্রিম কোর্ট ছিলো এই কলকাতায়, ফোর্ট উইলিয়ামে। সেখানে যিনি প্রধান বিচারপতি ছিলেন, স্যার এলিজা বারওয়েল ইম্পে, তার হরিণ পোষার শখ ছিলো খুব। তারই উদ্যোগে তার বাসভবনের কাছে হরিণ রাখার জন্য একটা বনভূমি তৈরী করা হয়। হরিণ রাখা হতো বলে সেই জায়গার নাম হয়েছিলো ডিয়ার পার্ক। আর তাই থেকে এই রাস্তার নাম হলো পার্কস্ট্রিট।"

পার্কস্ট্রিট মেট্রো থেকে নেমে একটু হেঁটে আমরা রাসেল স্ট্রিট ধরে এগোচ্ছিলাম। সবে সবে বড়দিন পার হয়েছে কালকে। এখনো এখানের প্রত্যেকটা রাস্তা রংবেরঙের সব বেলুন আর ক্রিসমাস-ট্রিতে সাজানো। গাড়ি ঢুকতে দিচ্ছে না। বেজায় ভিড়। এবছর শীতটাও জব্বর পড়েছে। সেই শীতের আমেজ গায়ে মেখে উৎসবের আনন্দে লোকজন নেমে পড়েছে রাস্তায়।

আমরা যাবো তেইশের-দুই মিডলটন রো-তে একটা ফ্ল্যাটে। জটাদার পরিচিত। আমি ঠিক চিনি না। শুনলাম কোনো এক অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান ফ্যামিলি। কিছু একটা খুনের ব্যাপার ঘটেছে। ডিটেলস জানি না এখনো আমরা। সন্ধ্যেবেলা একটা ফোন পেয়েই জটাদা বেরিয়ে পড়লো আমাকে নিয়ে। পথিমধ্যে এই পুরোনো কলকাতার গল্প বলছিলো।

আমি জিজ্ঞাসা করলাম, "সেই হরিণ এর পার্ক এখন আর নেই ?"


"না," জটাদা বললো, "সে তো প্রায় আড়াইশো বছর আগের কথা। আমরা যেখানে যাচ্ছি, মিডলটন রো, সেইখানেই ছিলো স্যার এলিজা ইম্পের বাসভবন। এই এলিজা ইম্পে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি থাকাকালীন তাঁরই নির্দেশে মহারাজা নন্দকুমারের ফাঁসি হয়। পরে তাই নিয়ে অনেক জলঘোলা হয় এবং এলিজা ইম্পেকে ক্ষমতা থেকে সরে যেতে হয়। হরিণগুলোকে তখন শিকার করে ফেলা হয়, কিছু কিছু হয়তো পালিয়ে যায়। এইখানে প্রচুর কবরস্থান তৈরী হয় তারপর। আস্তে আস্তে গাছপালা কেটে ফেলা হতে থাকে। শেষপর্যন্ত সেই পার্কের আর অস্তিত্বই রইলো না।"
"মহারাজা নন্দকুমারের কথা আমি সম্ভবত পড়েছি। পলাশীর যুদ্ধের সময় উনি সেখানে যুক্ত ছিলেন
 কি ?"

"একদম কারেক্ট। উনি প্রথমে মুর্শিদাবাদ রাজবাড়ীর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, পরে ইংরেজদের সঙ্গে হাত মেলান। ইংরেজরা তাকে উঁচু পদে বসায়। কিন্তু নতুন পদে বসে তিনি ওয়ারেন হেস্টিংসের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ আনেন। এই ওয়ারেন হেস্টিংস আবার ছিলেন বিচারপতি এলিজা ইম্পের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। সহপাঠী। অতএব দুয়ে দুয়ে চার হয় এবং বিচারে নন্দকুমারকেই উল্টে দোষী সাব্যস্ত করা হয়। নন্দকুমারের বিরুদ্ধে সাক্ষী জোগাড় করা হয় এবং তার ফাঁসি হয়। তখনকার প্রভাবশালী ব্যক্তিরা অনেক চেষ্টা করেও তার ফাঁসি আটকাতে পারেননি। পুরোনো কলকাতার এই এরিয়াগুলোতে ভালো করে দেখলে দেখবি, সেই সময়ের একটা ছাপ এখনো যেন চোখে পড়ে। চলে আয়, আমরা পৌঁছে গেছি।"


দুইদিকে দুটো উঁচু বিল্ডিংয়ের মাঝখানে ছোট্ট জমির উপর তিনতলা একটা ফ্ল্যাট। দেখলে বোঝা যায় বাড়িটার বেশ বয়স হয়েছে। জরাজীর্ণ হাল। সদর দরজা ভেজিয়েই রাখা ছিলো। আমরা সিঁড়ি বেয়ে সোজা দোতলায় উঠে এলাম। জটাদা কলিং বেল টিপলো। নেমপ্লেটে দেখলাম লেখা আছে, স্যামুয়েল জন ডিসুজা।
বেলের আওয়াজ শুনে যিনি আমাদের দরজা খুলে দিলেন, তিনিই সম্ভবত মিস্টার ডিসুজা। বেশ লম্বা হাইট, পঞ্চাশের কাছাকাছি বয়স। নীল রঙের একটা স্যুট পরে আছেন। দরজা খুলে তিনি আমাকে চিনতে না পারলেও জটাদাকে দেখে হাত মেলালেন, "আসুন মিস্টার মিত্র।"


ঘরে ঢুকে বোঝা গেলো এখানে একটা শোকের আবহ চলছে। সামনের ঘরেই একটা সোফায় বসলাম আমরা। মিস্টার ডিসুজা আলাপ করিয়ে দিলেন ঘরের বাকিদের সাথে। মিসেস ডিসুজা ছিলেন সেখানে, ঘরোয়া চুড়িদারে কিচেনের কাছে দাঁড়িয়ে ছিলেন। এক যুবক বসে ছিলো আমাদের উল্টোদিকে, একটু চাপা গায়ের রঙ। জটাদা হাত বাড়াতে সেও করমর্দন করে বললো, "নাইস টু মিট ইউ।"


"এর নাম অ্যালিস্টার।" ডিসুজা সাহেব পরিচয় করালেন। "আমার মেয়ের সাথে এনগেজমেন্ট হয়েছে গত মাসে, হি ইজ কাইন্ড অফ আ মেম্বার অফ দিস ফ্যামিলি নাউ।"


"আচ্ছা, বসুন মিস্টার ডিসুজা।" জটাদা নিজেও সোফায় বসতে বসতে আমাকে দেখিয়ে বললো, "এ আমার দূর সম্পর্কের এক ভাই, ঋভু। আমার সবসময়ের সঙ্গীও বলতে পারেন।"


আমি একটু ঝুঁকে ওনাদের সাথে করমর্দন করলাম। তারপর জটাদার পাশে বসে পড়লাম। জটাদা মিস্টার ডিসুজার উদ্দেশ্যে বললো, "ফোনে আপনি কিছু একটা খুনের কথা বলছিলেন -"।


"হ্যাঁ।" ডিসুজা সাহেব একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, "ভেরি স্যাড ইনসিডেন্ট। এই বাড়ির একতলায় একটি ফ্যামিলি থাকে। তাদের ১০ বছরের একটা মেয়ে কাল আমাদের এখানে মারা গেছে। ইফ দ্য রিপোর্ট ইজ টু বি বিলিভ্ড, ইট ইজ আ কেস অফ পয়জনিং। বিষক্রিয়ায় মৃত্যু।"


আমি আমার ডায়েরিটা খুলে নোট নিতে শুরু করলাম। ডিসুজা সাহেব সেইদিকে একবার দেখে নিয়ে পুরো ঘটনাটা যেভাবে বর্ণনা করলেন, আমি সংক্ষেপে সেটা লিখছি।


মিস্টার ও মিসেস ডিসুজার একটিই মাত্র কন্যা, নাম মারিয়া। গতকাল ছিলো ২৫ শে ডিসেম্বর, এবং মারিয়ার জন্মদিন। সেই উপলক্ষ্যে একটা ঘরোয়া পার্টির আয়োজন করা হয়েছিলো। সামান্য কিছু লোকজন এসেছিলো। মারিয়ার দু-তিনজন বন্ধু আর মিস্টার ডিসুজার এক পারিবারিক বন্ধু। পার্টির মুডেই ছিলো সবাই। নাচ-গান চলছিলো। রাত্রি সাড়ে আটটা নাগাদ জন্মদিনের কেকটা কাটা হয়। তার একটু পরেই হঠাৎ নিচের ফ্ল্যাটের বাচ্চা মেয়েটি অসুস্থ হয়ে পরে। মাটিতে শুয়ে পরে সে। তাকে ধরাধরি করে তুলে নিয়ে গিয়ে বিছানায় শুইয়ে দেওয়া হয়। সঙ্গে সঙ্গে ডাক্তারকেও ডাকা হয়। আধঘন্টার মধ্যে ডাক্তার চলে আসেন। মেয়েটির আর কোনো হুঁশ ছিলো না। ডাক্তার এসে তাকে মৃত বলে ঘোষণা করেন। তারপর পুলিশ আসে।


"বিষক্রিয়ায় ব্যাপারটা কখন জানা যায় ?" জটাদা জিজ্ঞাসা করলো।


"আজ বিকেলের দিকে।" মিস্টার ডিসুজা বললেন, "অফিসিয়াল পোস্ট মর্টেম রিপোর্ট এখনো আসেনি, কিন্তু বিকেলে পুলিশ এসে সবকিছুর স্যাম্পেল নিয়ে গেলো ফরেনসিকের জন্য। ওরাই বলাবলি করছিলো যে পোস্ট মর্টেমে নাকি বিষ পাওয়া গেছে শরীরে। আমি তারপর অনেক ভাবনা-চিন্তা করে আপনাকে ফোন করলাম।"


কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে জটাদা বললো, 'আপনি কি এই ভয় পাচ্ছেন যে পুলিশ হয়তো আপনাদেরকে হ্যারাস করতে পারে, যেহেতু মেয়েটি আপনাদের বাড়িতেই কিছু খেয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলো। আর তাই আপনি আমাকে -।"

মিসেস ডিসুজা এসে এই সময় আমাদের সবার জন্য চা দিয়ে গেলেন। চায়ের কাপ হাতে তুলে নিয়ে মিস্টার ডিসুজা বললেন, "না মিস্টার মিত্র। আমি আপনাকে সেই জন্য ডাকিনি। ইট ইজ নো ডাউট আ স্যাড ইনসিডেন্ট। পুলিশ সেটার তদন্ত করছে করুক। কিন্তু আমার ধারণা এই খুনটা ভুল করে হয়েছে।"


জটাদা ভুরু কুঁচকে শুনছিলো। কিছু বললো না। মিস্টার ডিসুজা নিজেই আবার বলতে শুরু করলেন, "ভেবে দেখুন, একটা দশ বছরের বাচ্চা মেয়েকে কেউ কেন মারতে চাইবে ? কী লাভ ? হয়তো খুনটা অন্য কাউকে করাটা উদ্দেশ্য ছিলো। বাচ্চা মেয়েটা ভুল করে তার শিকার হয়েছে।"


"আপনার কি মনে হয় খুনটা আপনাকেই করতে চেয়েছিলো কেউ ?" জটাদা এতক্ষণে জিজ্ঞাসা করলো।


"পসিবল।" মিস্টার ডিসুজা চায়ে চুমুক দিয়ে বললেন, "আপনি তো জানেন আমাদের পৈতৃক বাড়ি বিডন স্ট্রিটে। ওখানে আমাদের বাড়ি ও আশেপাশের বেশ কয়েকটা পুরোনো বাড়ি ভেঙে একটা শপিং মল উঠছে। তাই এখানে আমরা শিফট করেছি কয়েক বছরের জন্য। শপিং মল তৈরী হলে ওখানে আমরা একটা ছোট দোকান পাবো, ১৮০ স্কোয়ার ফুটের। আর শপিং মলের পিছনে রেসিডেন্সিয়াল ফ্ল্যাট তৈরী হবে, সেখানেও দুটো ফ্ল্যাট আমরা পাবো। প্রোমোটারের সাথে এইরকম চুক্তি হয়ে আছে। কিন্তু ওখানকার বাজারে আগুন লাগার পর থেকে সেসব কাজ বন্ধ হয়ে গিয়ে এখন ওমনিই পড়ে আছে। কবে যে আবার কাজ শুরু হবে, কবে আদালতের ছাড়পত্র পাওয়া যাবে, কেউ জানে না। প্রোমোটারকে আমাদের পাওয়ার অফ অ্যাটর্নি দেওয়া আছে। এখন আমার অবর্তমানে আমাদের জায়গাটার পুরো দখল প্রোমোটার নিতে পারবে। কে জানতো যে আগুন লেগে পুরো জিনিষটা এইভাবে পিছিয়ে যাবে। এই প্রোমোটার ভদ্রলোক আমাদের এলাকায় বেশ পরিচিত। অত্যন্ত খারাপ লোক, রাজনৈতিক মহলে বিশাল হাত আছে। তাকে আমার একটুও বিশ্বাস হয় না। সেইজন্য চিন্তা হচ্ছে যে এই খুনটা আসলে অন্য কিছুর কভার-আপ নয় তো ?"


"আপনারা এই বাড়িতে আছেন কতোদিন হলো ?"


'এই তো, গত বছর জুলাই মাসে আমরা আসি এখানে। দেড় বছর হলো ধরুন।"


জটাদা একটু ভেবে নিয়ে বললো, "কালকের পার্টিটা কি এই ঘরেই হয়েছিলো ?"


অ্যালিস্টার উত্তর দিলো, "হ্যাঁ, এটাকেই আমরা সাজিয়ে নিয়েছিলাম। আর ডিনারের ব্যবস্থাটা ওই ওই-দিকটায় ছিলো।" ডাইনিংয়ের একটা কর্নার দেখালো অ্যালিস্টার।


"ডিনার তখনো শুরু হয়নি বললেন, তাই তো ?"


"না, কেক কাটা হয়েছিলো সবে। কোল্ড ড্রিঙ্কস ছিলো। আর চিকেনের একটা স্টার্টার। ডিনার করেনি কেউ তখনো। ইন ফ্যাক্ট, ওই ঘটনার পর পুরো পরিবেশটাই পাল্টে যায়। গেষ্টরাও আস্তে আস্তে চলে যেতে থাকে। সমস্ত খাবারই শেষমেশ নষ্ট হয়। ডিনার করার মতো পরিস্থিতিই ছিলো না।"

"অর্থাৎ আপনার কথামতো ডিনার থেকে বিষক্রিয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই, তাই তো ?"


"সেরকমই তো মনে হয়।" ডিসুজা সাহেব উত্তর দিলেন, "এক ওই কেক। কিন্তু কেক তো আমরা সবাই খেয়েছি অল্পবিস্তর। কেউ তো অসুস্থ হইনি। আর চিকেন ললিপপ বা কোল্ড ড্রিঙ্কস ছিলো। সেও তো সবাই ভাগ করেই খাওয়া হয়েছে। মনে করুন যে বোতল থেকে কোল্ড ড্রিঙ্কস নেওয়া হয়েছে, সবই দু'লিটারের বোতল ছিলো। সেটা থেকে অন্যরাও খেয়েছে। সেখানে একজনেরই বিষক্রিয়া হলো, অন্যদের কিছু হলো না - এই ব্যাপারটা বেশ অদ্ভুত। পুলিশ অবশ্য আজ সব কিছুরই স্যাম্পেল নিয়ে গেছে। ফরেনসিক টেষ্টে ধরাই পড়বে যদি কিছু থেকেও থাকে।"




"আচ্ছা, কেকটা কোথা থেকে আনা হয়েছিলো ?"




অ্যালিস্টার বললো, "এই তো, কাছেরই একটা দোকান থেকে, আমিই অর্ডার দিয়েছিলাম। ২৫ শে ডিসেম্বরের সময়, বুঝতেই পারছেন কেকের কীরকম চাহিদা থাকে। তাই তিন-চারদিন আগে থেকেই অর্ডার দেওয়া ছিলো। সন্ধ্যে আটটার মধ্যে ডেলিভারি দেবার কথা। গাড়িঘোড়ার জন্য আসতে লেট হচ্ছিলো। আমি দু'বার দোকানে ফোনও করেছিলাম। ওরা বললো, বেরিয়ে গেছে কেক নিয়ে। সাড়ে আটটা নাগাদ এলো ফাইনালি।"




"আর বাকি খাবার-দাবার, যেমন চিকেন ললিপপ ?"




"চিকেন ললিপপ সামনেই মোড়ের একটা দোকান থেকে কিনে আনা হয়েছিলো। আর বাকি ডিনারের ব্যবস্থা বাড়িতেই হয়েছিলো।"




জটাদা চায়ের কাপ শেষ করে টেবিলের উপর নামিয়ে রেখে ডিসুজার উদ্দেশ্যে বললো, "আপনি অযথা ভয় পাবেন না। আমি দেখছি ব্যাপারটা। যদি এই ব্যাপারে আর কিছু আপনার বলার থাকে তাহলে আমাকে জানাতে পারেন।"




ডিসুজা সাহেব একটু কিন্তু-কিন্তু করে বললেন, "একটা ব্যাপার... এমন কিছু নয় অবশ্য... কিন্তু জিনিষটা মনের মধ্যে খচ করে আছে।"




"কী ব্যাপার ?"




"একটা সিগারেট কেস।"




"সিগারেট কেস ?" জটাদার সাথে সাথে আমিও উৎকর্ণ হলাম। ডিসুজা বলতে লাগলেন, "সিগারেট রাখার একটা কাঠের বাক্স। বহু পুরোনো, আমাদের বাড়িতে পৈতৃক আমল থেকেই ছিলো। জিনিষটা এমনি দামি কিছু না। কিন্তু আমার খুব প্রিয় ছিলো, জানেন। কালকের ঘটনার পর থেকে সেটা আর পাচ্ছি না। এই ঘরেই রাখা ছিলো, ওই ফ্রিজের মাথায়। রাত্রিবেলা দেখি আর নেই। তারপর ঘরে অনেক খোঁজাখুঁজি করা হলো, কোথায় গেলো কে জানে! কেউ নিয়ে গেলো কিনা -। কিন্তু সামান্য একটা কাঠের বাক্স, তাও পুরোনো, কে নেবে ? ব্যাপারটা সামান্যই, কিন্তু মনের মধ্যে খটকা বেঁধে আছে। আপনি বলতে বললেন, তো এইটার কথা মনে এলো।"




"কত বড়ো হবে বাক্সটা ? মানে, মাপটা।" জটাদা জানতে চাইলো।




"তা, ধরুন প্রায় তিন ইঞ্চি বাই পাঁচ ইঞ্চি হবে। ছোটই, খুব বড়ো কিছু নয়। দাঁড়ান, ছবি দেখাই।" এই বলে ডিসুজা সাহেব ভিতরের ঘরের উদ্দেশ্যে বললেন, "বেটা মারিয়া, ওই ছবিটা এদের একবার দেখাও তো, সিগারেট কেসের ছবিটা -।"




ঘরের দরজায় পর্দা টাঙানো ছিলো। বাইশ-তেইশ বছরের এক যুবতী ডিসুজা সাহেবের ডাকে বেরিয়ে এলো। বেশ ছিমছিমে সুন্দরীই বলা যায়। মেয়েটি সম্ভবত মোবাইল নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, কারণ তার হাতে ধরা মোবাইলের স্ক্রিন দেখলাম অন আছে।




"এই যে আমার মেয়ে, মারিয়া -।" ডিসুজা সাহেব আলাপ করিয়ে দিলেন, তারপর জটাদাকে দেখিয়ে মেয়েকে বললেন, "ইনিই মিস্টার মিত্র, তোমাকে বলেছিলাম না ? ওনাকে একবার তোমার মোবাইল থেকে আমার ওই সিগারেট কেসের ছবিটা দেখাও তো।"




মেয়েটি জটাদার উদ্দেশ্যে দু'হাত নমস্কার করে বললো, "আপনিই কি বিখ্যাত সেই ফেলুদার -।"




জটাদা উত্তরে হাত জড়ো করে বললো, "নমস্কার। আমার নাম প্রজ্জ্বল মিত্র। হ্যাঁ, প্রদোষ মিত্র আমারই বাবার নাম। উনি একটা কার অ্যাক্সিডেন্টে মারা গেছেন বেশ কিছু বছর হলো। আপনি ছবিটা বরং আমাকে হোয়াটসঅ্যাপ করে দিন।"




জটাদার কথা শেষ হতেই আমি হোয়াটসঅ্যাপ নাম্বারটা বলে দিলাম মেয়েটিকে। জটাদা ডিসুজাকে বললো, "কাল যারা যারা পার্টিতে ছিলেন, তাদের একটা লিষ্ট আমাকে পাঠিয়ে দেবেন প্লিজ।"




"শিওর। পুলিশও তাদের সবাইকে জিজ্ঞাসাবাদ করছে শুনলাম।"




"ঠিক আছে, রুটিন কাজটা পুলিশ করুক। আমি দরকার হলে ওদের সাথে যোগাযোগ করে নেবো। আরেকটা কথা -নিচের যে পরিবারের মেয়েটি মারা গিয়েছে, তাদের সাথে একবার যদি -।"




"হ্যাঁ হ্যাঁ, নিশ্চয়ই, চলুন চলুন।" ডিসুজা সাহেব আগ্রহের সাথে আমাদেরকে নিচে নিয়ে গেলেন। তখনও আমরা জানি না যে কীসের খোঁজে নেমে কী খুঁজে পেতে চলেছি আমরা।


 



 পর্ব ২


বাড়িটার সত্যিই জরাজীর্ণ অবস্থা। মেরামতি করা দরকার। বিশেষ করে একতলাটাই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত মনে হলো। সিঁড়ির প্লাষ্টার উঠে গিয়ে অধিকাংশ জায়গায় ইঁট বেরিয়ে পড়েছে। একতলায় মুখোমুখি দুটি ঘর। পিছনের দিকের অংশটা ভাঙাচোরা জিনিষে ভর্তি, দেখলে বোঝা যায় বহুদিন বন্ধই পড়ে আছে। একটা দেওয়ালও কিছুটা ভেঙে পড়েছে দেখলাম আমরা। বাড়ির সামনের দিকের ফ্ল্যাটটিতে একটি পরিবার থাকে। কিন্তু ভিতরে কোথাও আলো জ্বলছিলো না। যেন সব নিঝুমপুরী। দরজায় বেল দেওয়ার একটু পরেই আলো জ্বলে উঠলো। মধ্যবয়সী এক ভদ্রলোক দরজা খুললেন। ভাঙা চোয়াল, বিমর্ষ মুখ, কোটরগত দুটি চোখ। চেহারায় ক্লান্তির ছাপ স্পষ্ট। ইনিই যে মৃতার বাবা, তা আর বলে দিতে হয় না।


ভদ্রলোকের নাম সনৎ সেন। বয়স চল্লিশ-বেয়াল্লিশ হবে। গায়ে হালকা একটা পাঞ্জাবি, তার উপরে চাদর। দু'পাল্লার দরজাটা খুলে সেটারই একটা পাল্লার উপর ঠেস দিয়ে কোনোমতে দাঁড়ালেন তিনি। একমাত্র মেয়ের মৃত্যুতে ভেঙে পড়া খুবই স্বাভাবিক। হয়তো সকাল থেকে বিভিন্ন জনকে নানান বর্ণনা দিতে দিতে ক্লান্তও। ডিসুজা সাহেব ছিলেন আমাদের সাথে। তিনি জটাদার আসল পরিচয় না দিয়ে কায়দা করে বললেন, "এনারা একটা সিকিউরিটি এজেন্সির লোক। আসলে ভাবছি বাড়িতে একটা পাহারা রাখবো। কাল যা হয়ে গেলো, তারপর তো আর এভাবে থাকা যায় না।"


ভদ্রলোক কিছু বললেন না, আমাদেরকে একবার দেখলেন শুধু। জটাদা জিজ্ঞাসা করলো, "আপনি, আপনার মিসেস আর আপনাদের মেয়ে - এই তিনজনেই কি থাকেন এই ফ্ল্যাটে ?"


সনৎবাবু একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, "আসুন -।"


দরজাটা ছেড়ে কাছেই রাখা একটা টুলের উপর ধপ করে বসে পড়লেন ভদ্রলোক। চোখের দৃষ্টি যেন শূন্য।


ঘরের ভিতর ঢুকে খুব অস্বস্তি হচ্ছিলো আমাদের। ভিতরের দিকের ঘর থেকে একটা চাপা কান্নার আওয়াজ ভেসে আসছে। অত্যন্ত শোকসন্তপ্ত পরিবেশ।


একসময় সনৎবাবু কিছুটা যেন অস্ফুটেই জটাদার প্রশ্নের উত্তর দিতে মুখে খুললেন। গলাটা ধরা ধরা। বললেন, "তিনজন আর রইলাম কোথায়। মেয়েটা তো চলেই গেলো। আজ থেকে আমরা শুধুই দু'জন।"


জটাদা কিছুটা স্বান্তনা দেওয়ার সুরে বললো, "হ্যাঁ, আমরা শুনলাম। আমি সত্যিই খুব দুঃখিত সনৎবাবু এই বাড়ির এই মর্মান্তিক খবরে। এতো অল্প বয়সে... কী নাম ছিলো যেন আপনার মেয়ের ?"


ভদ্রলোক একটু নিজেকে সামলে নিয়ে জটাদার দিকে এবার তাকালেন। "ভালো নাম অহনা, ডাক নাম ছিলো পিউ। কিন্তু আপনারা দাঁড়িয়ে রইলেন কেন, বসুন -।" ভদ্রলোক ডাইনিং টেবিল-লাগোয়া চেয়ারের দিকে ইঙ্গিত করে বললেন। এই ঘরটা দেখলাম বাইরের বসার ঘর কাম খাওয়ারও জায়গা। ঘরে খুব কম পাওয়ারের একটা হলুদ আলো জ্বলছিলো, কেমন মরা-মরা।


জটাদা হাত জড়ো করে বললো, "না আরেকদিন আসবো নাহয়, আজ আর বসবো না। আপনাদের মনের অবস্থা ঠিক কীরকম এই মুহূর্তে, সেটা বুঝতে পারছি। এখনো বডি হাতে পাননি মনে হয়।"


"পুলিশ বলেছে কাল-পরশু পোস্ট মর্টেমের রিপোর্ট আসবে হয়তো। এলে তবেই ছাড়বে। যা কিছু কাজকর্ম সব তার পরেই হতে পারবে।"


"অফিস থেকে এখন ছুটি নিয়ে নিয়েছেন তো ?"


"হ্যাঁ, সে তো এখন যাচ্ছিই না। এক দু'সপ্তাহ পরে দেখা যাবে।"


"সরকারি ?"


"আমার ডিউটি ন্যাশনাল লাইব্রেরিতে। ওই একটা অস্থায়ী পোস্টে আছি আর কি।"


"আচ্ছা, আমরা তাহলে আজকে চলি।" বেরিয়ে আসার আগে ভদ্রলোকের কাঁধে একটা হাত রেখে বললো জটাদা, "আপনার সঙ্গে পরে কথা হবে।"


"তারপর ? তারপর কী হলো ?" অতিশয় আগ্রহের সঙ্গে জিজ্ঞাসা করলো পিঙ্কি।


কাল বাড়ি ফিরতে ফিরতে রাত বারোটা প্রায় বেজে গিয়েছিলো। দুর্গাপুজো হোক কি ক্রিস্টমাস, কলকাতার রাস্তায় আগে গাড়িঘোড়াগুলো বন্ধ হয়ে যায়। সকালে ঘুম থেকে উঠেই দেখি পিঙ্কি এসে হাজির। কালকে ওকে মেসেজ করেছিলাম। কিন্তু সাতসকালেই এসে হাজির হবে ভাবিনি। ব্রাশও করেনি নাকি।


"তারপর আর কী, আমরা বেরিয়ে এলাম।" আমি আঙুলের কর গুনে বললাম, "আপাতত যে ক'জনের সাথে আমাদের আলাপ হয়েছে, বলছি। সনৎবাবু ও তার স্ত্রী, সনৎবাবুর মেয়ে পিউ, যে মারা গেছে। মিস্টার ডিসুজা, ওনার স্ত্রী, ওদের একমাত্র মেয়ে মারিয়া। মারিয়ার সঙ্গে এনগেজমেন্ট হয়েছে যার, তার নাম অ্যালিস্টার। ব্যাস।"


"ঈশ, কাল বন্ধুদের সঙ্গে বেরিয়ে গিয়ে আমি কতকিছু মিস করেছি। এই কেসটাতে আমি শুরু থেকে থাকতেই পারলাম না।" পিঙ্কির গলায় আফশোস ঝরে পড়লো।


আমি বললাম, "আরে তুই চিন্তা করছিস কেন। কেস তো এখনো কিছুই শুরু হয়নি। এটা খুনের কেস, নাকি চুরির কেস, নাকি দুটোই - সেটাই তো প্রথমে বুঝতে হবে।"


চুরির কথা শুনে সিগারেট কেসের কথাটা পিঙ্কির মনে পড়লো। বললো, "হ্যাঁ হ্যাঁ, ওই ছবিটা কই দে তো দেখি, ওই বাক্স না কী।"


আমি জটাদার মোবাইলে মারিয়ার পাঠানো ছবিটা খুলে পিঙ্কিকে দিলাম। তারপর খোকনদাকে ফোন করে তিনটে চা উপরে পাঠাতে বললাম।


জটাদা সিগারেট হাতে ঘরে পায়চারি করছিলো। কপালে বেশ কয়েকটা ভাঁজ। যেন কিছু হিসেব করছে। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, "কী বুঝছো - কেসটা সিম্পল না কমপ্লেক্স ? খুনের সাথে চুরিটা কি জড়িত মনে হয় ?"


জটাদা প্রথমে কোনো উত্তর দিলো না। তারপর খোলা জানলা দিয়ে তাকিয়ে দূরের বিল্ডিংগুলো দেখতে দেখতে কিছুটা যেন আপনমনেই বললো, "আমরা যখন একতলার ঘরে ঢুকলাম, খুব কম পাওয়ারের একটা হলুদ আলো জ্বলছিলো।" তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বললো, "ঋভু তোর মনে আছে ?"


"হ্যাঁ, মনে আছে।" আমি বললাম, "আলো তো জ্বলছিলোই না মনে হয়, দরজা খোলার আগে উনি আলো জ্বালালেন। এতো বড়ো শোকের মধ্যে আছেন ওনারা, আলো জ্বালাননি হয়তো আর সন্ধ্যের পরে।"


খোকনদা এই সময় এসে আমাদের চা দিয়ে গেলো। আমি চট করে উঠে মুখটা ধুয়ে এসে বসলাম। পিঙ্কিকে বললাম, "তুই কী দেখছিস বলতো তখন থেকে মোবাইলে ?"


"হুম, দেখছি বাবা, ভালো জিনিষই দেখছি। জটাদা এই দ্যাখো, তোমার মারিয়া ম্যাডাম তো ইন্সটাতে বেশ জনপ্রিয় গো। মডেলের পোজে কত ফটো পোষ্ট করেছে। রীতিমতো ঘন্টায় ঘন্টায় পোষ্ট মারে দেখছি।"


"তাতে কী হলো ?" আমি খোঁচা মেরে বললাম, "তোর মতো ভূতনী তো নয়। দেখতে সুন্দর, তাই পোষ্টায়। সুন্দর মুখের জয় সর্বত্র, শুনিসনি ?"


"অ্যাই তুই আমাকে ভূতনী বলবি না। একদম বলবি না। টেস্টলেস একটা অকাল কুষ্মান্ড কোথাকার। তুই আর কী বুঝবি। আমার হলো গিয়ে ন্যাচারাল বিউটি।"


"হ্যাঁ, ওই মরুভূমি অঞ্চলের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের মতো।"


পিঙ্কি রাগের চোটে হাতের সামনে আজকের খবরের কাগজটা পেয়ে ওইটাই ছুঁড়ে মারলো আমার দিকে। বললো, "রাস্কেল -।"


"এই তোরা ঝগড়া করিস না।" জটাদা বিছানার উপরে বসে চায়ে চুমুক দিয়ে বললো, "ঋভু, খবরের কাগজটায় দেখ তো কিউরেটর বা পুরোনো শৌখিন সামগ্রীর কোনো বিজ্ঞাপন চোখে পড়ে কিনা। থাকলে, নাম আর অ্যাড্রেসটা নোট করে নিস।"


আমি কাগজটা খুলে দেখতে থাকলাম। পিঙ্কি বললো, "জটাদা, এই মিস্টার ডিসুজাকে তুমি কীভাবে চেনো ? উনি যা বলছেন, সেটা সত্যি বলছেন কিনা -।"


"মিস্টার ডিসুজা ইতিহাসের অধ্যাপক। বাবার একটা কেসে হেল্প করেছিলেন একবার। সেই থেকে ডিসুজাদের ফ্যামিলির সাথে আমার বাবার পরিচয় ছিলো। বাবার কাছে শুনেছিলাম।" জটাদা সকালের চায়ে চুমুক দিয়ে বললো। "আর তাছাড়া উনি মিথ্যে বলতে চাইলে তো পুলিশকেই বলতে পারতেন। খামোখা আমাকে এর মধ্যে জড়িয়ে নিজের বিপদ বাড়াবেন কেন। তবে সন্দেহের ঊর্ধ্বে কেউই নয় যদিও।"


"তাহলে কি ওনার আশঙ্কাটা সত্যি ? মানে ওনাকে কেউ খুনের চেষ্টা করছে ? সেটা কি সেই প্রোমোটার বা তারই কোনো লোক হতে পারে ?"


"হতে নিশ্চয়ই পারে।" সংক্ষিপ্ত উত্তর দিলো জটাদা।


"উফ, বলো না তাহলে আমাদের পরবর্তী প্ল্যানটা কী ?"


"তোর ঘটনাস্থলে উপস্থিত থাকতে না-পারার দুঃখটা হয়তো আজই ঘুচে যাবে। আমি একবার ফোন করে অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিয়ে নিই, দাঁড়া।"


জটাদা ফোন করলো কাউকে। সে রিসিভ করলো। আমরা ওপাশের কথা শুনতে পাচ্ছিলাম না। জটাদা তাকে বললো, "গুড মর্নিং, আমি প্রজ্জ্বল মিত্র বলছি। ওদিকের খবর সব ভালো তো ?.... আচ্ছা, আজ বিকেল চারটের সময় আমরা এলে অসুবিধা হবে ?.... কিছু জিজ্ঞাসাবাদ করার ছিলো.... না, সবাইকেই লাগবে.... হ্যাঁ, বিশেষ কিছু না, একটু সবার সাথেই কথা বলার দরকার.... ঠিক আছে, তাহলে ছ'টার দিকে গেলে ?.... ওকে, তাহলে আমরা ছ'টার সময় যাচ্ছি... ধন্যবাদ।"


"কোথায় যাচ্ছি আমরা ?" কৌতূহলের সঙ্গে জিজ্ঞাসা করলো পিঙ্কি।


"স্যার এলিজা ইম্পের ডিয়ার পার্কে।" হেয়াঁলি করে বললো জটাদা।


"মানে ?"


আমি খোলসা করলাম, "মধ্য কলকাতার মিডলটন রো। সেখানে একসময় একটা ডিয়ার পার্ক ছিলো। ডিসুজা সাহেব যেখানে এখন থাকেন।" তারপর জটাদার উদ্দেশ্যে বললাম, "একটাই বিজ্ঞাপন খুঁজে পেলাম। আইস স্কেটিং রিং-এ আজ বেলা বারোটার সময় এক্সিবিশান কাম নিলাম হবে, পুরোনো বনেদি কিছু জিনিষের। তার মধ্যে বেশ কিছু কালেকশান আইটেম থাকছে। প্রবেশ অবাধ।"


"গুড। তাহলে বারোটার সময় ওখানে গিয়ে সন্ধ্যের মুখে মুখে আমরা পার্কস্ট্রিট চলে যেতে পারবো।" জটাদা বললো।


"কিন্তু তুমি কি সন্দেহ করছো যে ওই পুরোনো সিগারেট রাখার বাক্সটা চোরেরা নিলামে বিক্রি করার চেষ্টা করবে ?"


"না। সিগারেটের বাক্সটা সম্ভবত এখনো ওই বাড়িতেই আছে, বাইরে যায়নি। ঋভু, মোবাইলের ছবিটা জুম করে দেখ তো কোনো কিছু ছোট লেখা দেখতে পাস কিনা। কোনো নাম বা আর কিছু।"


"আমি দেখছি।" তৎপর পিঙ্কি সঙ্গে সঙ্গে বললো। আমাকে কিছু করতে হলো না। ও-ই জুম করে দেখে আবিষ্কার করলো, "এই তো। সাল লেখা আছে। নাম কোনোকিছু লেখা নেই। সাল লেখা আছে একটা - সতেরোশো ছিয়ানব্বই।"


"১৭৯৬ ? মাই গুডনেস!" আমি বিস্মিত হয়ে বললাম, "এ তো দুশো বছরেরও বেশি পুরোনো। এর দাম নিশ্চয়ই অনেক হবে।"


"ইয়েস।" একটা সিগারেট ধরিয়ে জটাদা বললো, "এখন জানতে হবে, এই সুপ্রাচীন জিনিষটার কথা কে কে জানতো।"


"কিন্তু খুনের সাথে এই বাক্সটার কী সম্পর্ক ? মানে আমি বলতে চাইছি, এই বাক্সটার জন্য বাচ্চাটাকে মারার তো কোনো মানে হয় না।"


"তা হয় না। আবার হতেও পারে। ধর বাচ্চাটা এমন কিছু হয়তো দেখে ফেলেছিলো, যার মূল্য তাকে দিতে হলো। তবে এটা একটা সম্ভাবনা মাত্র। আসল ঘটনা অন্যরকমও হতে পারে। ভাবতে হবে রে।"


"আরিব্বাস, আমি কী পেলাম দ্যাখো- দ্যাখো জটাদা", পিঙ্কি উত্তেজিতভাবে মোবাইলটা নিয়ে এলো আমাদের কাছে। "এই দ্যাখো, মারিয়া ম্যাডামের বার্থডে পার্টির ভিডিও। লাইভ পোস্ট করেছে।"


আমরা ঝুঁকে পড়ে দেখলাম। সত্যিই মারিয়ার বার্থডে পার্টি। কেক কাটছে মারিয়া, হই-হুল্লোড় চলছে। কিন্তু ডেটটা খেয়াল করে আমি বললাম, "ধুস, এটা পুরোনো ভিডিও। গত বছরের ভিডিও। তুইও যেমন।"


"ও সরি। সরি।" পিঙ্কি বললো।


জটাদা পিঙ্কির হাত থেকে মোবাইলটা নিয়ে ভিডিওটা মনোযোগ সহকারে দেখছিলো। পিঙ্কি আমাকে প্রশ্ন করলো, "খুনটা হলো কীভাবে সেটা কিছু বুঝতে পারলি তোরা ? মানে বিষ ছিলো কীসে ? বাচ্চা মেয়েটা যা খেয়েছে, বাকিরাও তো সেসব খেয়েছে। তাহলে ?"


আমি বললাম, "হয়তো বিষটা অল্প মাত্রায় ছিলো। বাকিদের তেমন এফেক্ট করেনি, ওই মেয়েটা বাচ্চা বলে ওর উপর বেশি এফেক্ট করেছে।"


জটাদার দৃষ্টি দেখলাম আবার দূরের বিল্ডিংগুলোর দিকে চলে গেছে। কপালে অনেকগুলো ভাঁজ। বললো, "ফরেনসিক রিপোর্ট এলেই সেটা বোঝা যাবে, কোনো খাবারে বিষ ছিলো, নাকি বিষ বাইরে থেকে শরীরে প্রয়োগ করা হয়েছে।"



 পর্ব ৩




আইস স্কেটিং রিং থেকে বেরোতে বেরোতে প্রায় বিকেল সাড়ে তিনটে বেজে গেলো। রাস্তার উল্টোদিকেই একটা রেস্টুরেন্টে ঢুকে আমরা লাঞ্চটা সেরে নিচ্ছিলাম।




পিঙ্কির নাকি আজ ডায়েটিং আছে। তাই বিশেষ কিছু খাবে না। একটা পেল্লাই মাপের ডবল স্কুপ আইসক্রিম নিয়েছে শুধু। জটাদা চিকেনের একটা আইটেম নিয়েছে, যেটা দুজনে শেয়ার করে নেবো। তার সঙ্গে ওর জন্য রুটি, আর আমার ফ্রায়েড রাইস।




"তোর এই ডায়েটিং এর ব্যাপারটা আমি বুঝলাম না। রোজ নতুন একটা কিছুর শখ চাপে মনে হয় তোর ঘাড়ে।" খেতে খেতে পিঙ্কিকে বললাম আমি। "দিন কে দিন যা মোটা হচ্ছিস, আইসক্রিম খাওয়াটা কমা এবার। ডায়েটিং এ আইসক্রিম খায়, এরকম মেয়ে আমি বোধহয় আমার চোদ্দ পুরুষে দেখিনি।"




"তোর চোদ্দ পুরুষের নাম বলতে পারবি ?" পিঙ্কি আইসক্রিমের উপরটা আস্বাদে চাটতে চাটতে বললো। জটাদা দেখি হাসছে।




"কেন পারবো না ?" আমি বললাম। "আমি ঋভু। একটা পুরুষ হলো। আমার বাবা -"




"তুই পুরুষ ? আচ্ছা, ঠিক আছে, ধরলাম পুরুষ, তারপর বল। বলে যা -।"




"তুই কী বলতে চাইছিস ?"




"তুই বাকি তেরো পুরুষের নাম বল দেখি আগে।"




"আমার বাবা নলিনীচরণ রায়, তার বাবা দুর্গাচরণ রায়, তার বাবা শ্যামাচরণ রায়, এরকম আছে।"




"এরকম আছে ?"




"আছে। তোকে কেন বলতে যাবো সব নাম ?"




"তাহলে আমার আইসক্রিম খাওয়া নিয়েও বলবি না। আমি অন্য মেয়েদের মতো নই। আমি এক্সেপশনাল। বুঝলি ? বুঝলেন বাবা ঋভুচরণ ?"




"অ্যাই, একদম আমার নাম নিয়ে এরকম - জটাদা তুমি কিছু বলো তো ওকে।"




জটাদা খাওয়া থামিয়ে উত্তর দিলো, "বলছি। প্রায় তিনশো বছর আগে, বঙ্গীয় রাঢ় অঞ্চলের প্রসিদ্ধ ব্রাহ্মণ ছিলেন চন্ডিচরণ রাই। তার পুত্র পদ্মলাভ রাই, এবং পদ্মলাভ রাইয়ের পুত্র হলেন আমাদের নন্দকুমার। যার কথা ঋভুকে সেদিন বলছিলাম। বুঝলি পিঙ্কি ? সেও কিন্তু চরণ থেকেই শুরু। খুঁজলে দেখা যাবে হয়তো আমরা মহারাজা নন্দকুমারের বংশধরের সাথে বসেই লাঞ্চ করছি আজকে।"




জটাদার বর্ণনা শুনে পিঙ্কি তো হেসে লুটোপুটি। আমি বললাম, "তুমি এসব ছাড়ো তো। জটাদা, আজ এক্সিবিশানে আমরা যখন ঘুরে ঘুরে এটা-ওটা দেখছিলাম, তুমি দেখলাম কয়েকজনের সঙ্গে একটা কিছু নিয়ে আলোচনা করছিলে।"




"হ্যাঁ, আমি জানার চেষ্টা করছিলাম যে এরকম দু'শো বছরের পুরোনো একটা সিগারেট কেস এখন কীরকম দাম হতে পারে। মানে এখানে নিয়মিত আসে বা নিলামে অংশগ্রহণ করে, এমন কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে তাদের কাছ থেকে একটা আন্দাজ পাওয়ার চেষ্টা করছিলাম।"




"কী জানতে পারলে ?"




চিকেনের একটা পিস মুখে পুড়ে দিয়ে জটাদা বললো, "যা বুঝলাম, ওরকম একটা কাঠের বাক্সের দাম খুব বেশি হলে আট-দশ হাজারের বেশি পাওয়া যাবে না।"




"এতো কম ? ওই অতো দিনের পুরোনো একটা জিনিসের দাম মাত্র দশ হাজার টাকা ?" আমি বেশ অবাক হলাম।




"হ্যাঁ। তুই হয়তো ভেবেছিলিস লক্ষ লক্ষ টাকা দাম হবে ওটার। আমিও ভেবেছিলাম। কিন্তু মনে একটা সন্দেহ ছিলো। সেটা যাচাই করে নেবার জন্যই তো এই নিলামঘরে আজ ঢুঁ মারা।"




"তাহলে এখন ব্যাপারটা কী দাঁড়ালো ?" পিঙ্কি জিজ্ঞাসা করলো।




"ব্যাপারটা তাহলে এই দাঁড়ালো যে -" জটাদা খোলসা করে বললো, "এই খুনটা যদি ওই সিগারেটের বাক্সের জন্যই হয়ে থাকে, তাহলে ওটা কোনো মামুলি বাক্স নয়। ওটার পিছনে আরও কোনো কাহিনী আছে, যা হয়তো মিস্টার ডিসুজা নিজেও জানেন না।"




ডিসুজা সাহেবের বাড়িতে আমরা পৌঁছালাম সন্ধ্যে ঠিক ছ'টা বাজতে দশ। আমাকে ওনারা কালকেই দেখেছিলেন। জটাদা আজ পিঙ্কির সাথে ওনাদের আলাপ করিয়ে দিলো। তারপর কাজ শুরু করে দিলো। আমরা বসলাম ভিতরের দিকের একটা ঘরে। ঘরের একটা দেওয়াল জুড়ে বিশাল বড়ো মা মেরীর ছবি।




ডিসুজা বললেন, "আপনি সবাইকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে চান, তাই তো ?"




"হ্যাঁ, আপনাকে দিয়েই শুরু করা যাক। বাকিদের একটু বাইরে অপেক্ষা করতে বলুন।"




মিসেস ডিসুজা বাইরের ঘরেই ছিলেন। ঢোকার সময় মারিয়াকে দেখতে পাইনি আমরা। ঘরে অন্য কেউ বলতে অ্যালিস্টার ছিলো। সে বেরিয়ে যাওয়ার পর জটাদা ডিসুজাকে বললো, "আপনার ওই কাঠের সিগারেট কেস, যেটা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না - সেটার সম্বন্ধে কে কে জানতো বলে আপনার ধারণা ?"




"জানতো কেউ কেউ । এই বাড়ির তো সবাই জানে।"




"এই বাড়ির সবাই মানে অ্যালিস্টারকে ধরে ?"




"হ্যাঁ, অবশ্যই। এমনি যে কখনো ওর সঙ্গে আলোচনা হয়েছে সিগারেট কেস নিয়ে, সেরকম তো মনে পড়ে না। তবে ও মনে হয় জানতো যে এটা অনেক দিনের পুরোনো জিনিষ। মানে জানাটাই স্বাভাবিক আরকি। আর আমাদের বিডন স্ট্রিটের বাড়ির লোকজন জানতো। আমার ছোটবেলার কয়েকজন বন্ধুও জানতো, মানে যাদের যাতায়াত ছিলো বাড়িতে। তবে তাদের সঙ্গে এখন আর যোগাযোগ বিশেষ নেই।"




"আপনার কোনো এক বন্ধুস্থানীয় এসেছিলেন না পরশুদিন পার্টিতে ?"




"হ্যাঁ, তীর্থঙ্কর ব্যানার্জি। মৌলানা আজাদের ফিজিক্সের প্রফেসর। বন্ধু মানে একরকম আমার কলিগ, কলেজে প্রফেসারি করতে গিয়েই আলাপ হয়। তার তো জানার কথা নয় যে আমার বাড়িতে সুপ্রাচীন কোনো জিনিষ আছে।"




"আপনি কখনো বাইরে নিয়ে যেতেন না বাক্সটা ?"




"না, না। সিগারেট তো সিগারেটের প্যাকেটেই থাকে। ওটা জাষ্ট একটা শখের জিনিষ।"




"বাক্সটা এমনিই ফ্রিজের মাথায় রাখা ছিলো বললেন। তো কেউ যেতে আসতে কখনো নিয়ে নিতেও তো পারে। বিশেষ করে এই বাড়ির সিকিউরিটি বলে কিছুই তো নেই দেখলাম।"




"আমাদের ফ্ল্যাটের দরজা সবসময় বন্ধই থাকে। কেউ এসে ওরকমভাবে নেবে কীভাবে ? আমাদের কখনো মনে হয়নি সেকথা। যে আসবে, সে তো আমাদের পরিচিত কেউই হবে। তবে এখন অবশ্য জিনিষটা চুরি যাওয়ার পর সত্যিই আফশোষ হচ্ছে।"




"আচ্ছা, আপনার প্রোমোটার, মানে যিনি ওই শপিং মলটা তৈরী করছেন, ওনার সাথে আপনার কখনো বাকবিতন্ডা বা কিছু ঝামেলা কখনো -"




ওদের কথোপকথনগুলো শুনে বিশেষ বিশেষ অংশ আমি খাতায় নোট করছিলাম। পিঙ্কি পুরোটা রেকর্ডিং করে নিচ্ছিলো অডিওতে।




ডিসুজা বললেন, "ওনার নাম বিজয় পোদ্দার। আমি বরাবরই পুরোনো জিনিষের কদর করতে ভালোবাসি। এই যে আমাদের বাড়িটা, বিডন স্ট্রিটে, সেটার লাগোয়া আরো অনেকগুলো বাড়ি নিয়ে ছিলো একটা মার্কেট। নিচটা মার্কেট, উপরে আমরা যারা বাসিন্দা ছিলাম আরকি। পুরোনো বাড়ির একটা গন্ধ আছে, জানেন। তাদের ইঁটের গায়ে গায়ে কত কাহিনী লেখা থাকে। ওই বাড়িতেই আমরা ছোট থেকে বড়ো হয়েছি। আমার তো সেসব ভেঙে ফেলার ইচ্ছাই ছিলো না। কিন্তু যাইহোক, একা প্রতিবাদী হলে তো আর চলে না এযুগে। বাকিরা যখন মত দিলো, আমিও রাজি হয়ে গেলাম ফ্ল্যাট তোলার ব্যাপারে। একটা করে দোকানও পাচ্ছিলাম প্রত্যেকে। কিন্তু দোকানের মাপ নিয়ে একবার একটা বচসা মতন হয়েছিলো। প্রোমোটার সরু গলির মতো একফালি একফালি দোকান দিচ্ছিলো আমাদের। বড়ো বড়ো দোকান ঘর সব চড়া দামে বিক্রি করবে বাজারে। আচ্ছা বলুন তো, ১২০ স্কোয়ার ফিট দোকানে দাঁড়াবো কোথায় আর মাল রাখবো কোথায় ? এ তো আর মুদিখানার দোকান নয়! সেই নিয়ে মিটিং ফিটিং করে শেষে ১৮০ স্কোয়ার ফিটে রাজি হয়। তারপর তো সেসব মিটমাট হয়েই যায়। আর কোনো সমস্যা হয়নি কখনো।"




"আপনার পাওয়ার অফ অ্যাটর্নি বললেন ওনাকে দেওয়া আছে। অর্থাৎ উনি আপনার হয়ে ওই প্রপার্টি অন্য কাউকে বিক্রি করতে পারেন ?"




"হ্যাঁ, উনি চাইলে অন্য কাউকে বিক্রিও করতে পারেন, বা ওখানে ফ্ল্যাট বা অন্য যেকোনো কনস্ট্রাকশান করতে পারেন।"




জটাদা এবার অন্য প্রসঙ্গে গেলো, "সনৎবাবুকে আপনার কেমন লোক মনে হয় ?"




"খুবই ভদ্রলোক। এখানে আমরা তো সবে সবে এসেছি। ওনারা এখানে অনেকদিন আছেন। আমাদের সঙ্গে বেশ ভালো সম্পর্ক। পিউ, নিচের ঘরের বাচ্চাটার নাম পিউ, সে তো সারাদিন আমাদের ঘরেই থাকতো। মেয়েটার কথা ভাবলে এতো খারাপ লাগছে মিস্টার মিত্র, কী বলবো। সনৎবাবু ও তার মিসেস তো নাওয়া-খাওয়া ছেড়ে আছেন একরকম। আরো খারাপ লাগছে এটা ভাবলে যে হয়তো আমাদের উপর কারুর আক্রোশের কারণে ওই বাচ্চাটা মারা পড়লো। নাহলে একটা বাচ্চাকে এইভাবে বিষ খাইয়ে খুন করে কার কী লাভ হতে পারে ? পুলিশ কতটা কী করবে আমার কোনো ভরসা নেই, কিন্তু আমি আপনার ওপর ভরসা করছি মিস্টার মিত্র। ক্রিমিনালগুলো যাতে ধরা পড়ে, আপনি সেই ব্যবস্থা করুন প্লিজ।"




"আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করবো মিস্টার ডিসুজা। আপনি বাইরে গিয়ে অ্যালিস্টারকে একটু পাঠিয়ে দেবেন।"




ডিসুজা বেরিয়ে যেতে অ্যালিস্টার এসে জটাদার মুখোমুখি চেয়ারটায় বসলো। জটাদা বললো তাকে, "আপনার সম্পর্কে একটু যদি বিস্তারিত বলেন আমাদেরকে।"




"আমার ফুল নেম অ্যালিস্টার নিকোল ব্যাপ্টিস্টা। আপনি আমাকে অ্যালিস্টার বলেই ডাকতে পারেন। চেতলা অগ্রণী ক্লাব আছে জানেন তো, বাঙালিদের দুর্গাপুজোর জন্য ফেমাস। তার পাশের রাস্তাতেই আমাদের বাড়ি। আর নিউ মার্কেটের কাছে একটা দোকান আছে আমাদের, ঘর সাজানোর জন্য বিভিন্ন অ্যান্টিক জিনিষের দোকান। পারিবারিক বিজনেস। ব্যবসার কাজ বাবাই দেখভাল করেন মেইনলি। আমিও বসি মাঝে মাঝে।"




আমি খেয়াল করলাম, অ্যান্টিক জিনিষের দোকান শুনে জটাদার ভুরুটা একটু কুঁচকালো। তারপর জিজ্ঞাসা করলো, "মিস মারিয়ার সঙ্গে আপনার কিভাবে আলাপ ?"




"ফেসবুকের মাধ্যমে। ফেসবুকেই আমাদের প্রথম পরিচয় হয়। টু ইয়ার্স অ্যাগো। তারপর আমরা মিট করি। এই ফ্যামিলির সাথে আলাপ হয়। অ্যান্ড দেন ওয়ান ডে উই ডিসাইডেড টু সেটল ডাউন।"




"ঠিক আছে। ঘটনার দিন, অর্থাৎ পরশু দিন, পার্টিতে যখন নিচের তলার বাচ্চা মেয়েটা অসুস্থ হয়ে পড়ে, আপনি তখন কোথায় ছিলেন বা ঠিক কী করছিলেন মনে করে বলতে পারবেন ?"




"আমি... তখন, আমি একটা লাইট ঠিক করছিলাম। ব্যালকনিতে যে এলইডিগুলো লাগানো হয়েছিলো, তার মধ্যে একটা দেখি জ্বলছে না। সেটার তার লুজ হয়ে গেছে কিনা আমি চেক করছিলাম। হঠাৎ পিছনে হুড়োহুড়ি শুনে তাকিয়ে দেখি পিউকে ধরাধরি করে ঘরের ভিতর নিয়ে যাচ্ছে সবাই। এটার পাশের রুম, মানে মারিয়ার রুমে। আমিও তখন ওখান থেকে ভিতরে গেলাম। সঙ্গে সঙ্গে ডাক্তারকে আমিই ফোন করি।"




জটাদা একটু ভেবে নিয়ে বললো, "আচ্ছা - মিস্টার ডিসুজার যে সিগারেট কেসটা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না, সেটা যে দু'শো বছরেরও বেশি পুরোনো, সেটা আপনি আগে জানতেন ?"




অ্যালিস্টার সোজা হয়ে উঠে বসলো। মুহূর্ত কয়েক পরে বললো, "হ্যাঁ, জানতাম। কিন্তু কী জানেন, এই কলকাতায় প্রচুর বাড়িতে এরকম অনেক জিনিষ পাবেন যা একশো-দু'শো বছরের পুরোনো। ওটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। বয়স দিয়ে জিনিষের দাম হয় না। আমরা তো এসবের ব্যবসা করি, আমরা জানি। দাম হয় কোন ব্যক্তির নাম তার সঙ্গে যুক্ত হয়ে আছে, সেই হিসাবে। এই ধরুন, একটা চেয়ার, একশো বছরের পুরোনো। কত দাম হবে তার ? ভালো কাঠ হলে চার হাজার কি পাঁচ হাজার। এইবারে যদি বলা হয় যে রবীন্দ্রনাথ টেগোর ওই চেয়ারটিতে বসতেন, তাহলেই তার দাম লক্ষ টাকা পার হয়ে যাবে।"




"বুঝতে পারছি।"




"ওসব সিগারেট কেস-টেস ফালতু। কেউ তুলে নিয়ে গেছে বা ঘরেই হয়তো আছে কোথাও, পরে ঠিক পাওয়া যাবে। ডিসুজা স্যার খামোখা ওটা নিয়ে চিন্তা করছেন। মার্ডারের সাথে ওই বাক্সের কোনো সম্পর্ক নেই। আপনি একটু বোঝান স্যারকে। দেখুন, পুলিশ তো ইনভেস্টিগেশন করছে। জানাই যাবে কে বা কারা খুনটা করেছে। আপনার কাজ হচ্ছে মিস্টার ডিসুজাকে বোঝানো যে সিগারেটের বাক্সের সাথে এই কেসের কোনো সম্পর্ক নেই। ব্যাস।"




"আমার কাজটা প্লিজ আমাকেই বুঝে নিতে দিন মিস্টার অ্যালিস্টার নিকোল ব্যাপ্টিস্টা।" কঠিন স্বরে বললো জটাদা, "আপনি এখন যেতে পারেন, আর হ্যাঁ - মিস মারিয়াকে একটু এই ঘরে পাঠিয়ে দিলে ভালো হয়।"



পর্ব ৪




"পরশুদিনের ঘটনার কথা আমরা কয়েকবার শুনেছি আপনার বাবার কাছে। তবু আপনার কাছ থেকে একবার বিশদে জানতে চাই ঠিক কী কী ঘটেছিলো সেদিন।" মারিয়ার উদ্দেশ্যে বললো জটাদা।




একটা হলুদ রঙের চুড়িদার পড়েছিলো ডিসুজা সাহেবের মেয়ে। জটাদার প্রশ্ন শুনে একটু কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে মুখ খুললো, "পরশুদিন আমার তিনজন বন্ধু এসেছিলো। রিয়া, অদৃজা আর সোহেল। তিনজনে একসঙ্গেই এসেছিলো। ওরা আসার পর পার্টি শুরু হয়। পিউ তো আমাদের সঙ্গে সঙ্গেই ছিলো। বড়োদিনটা আমাদের জন্য খুব আনন্দের একটা উৎসব। তার উপর বার্থডে মিলে প্রতি বছরই এই দিনটা খুব হ্যাপিলি কাটে। কিন্তু সেদিন কী যে ছিলো ভাগ্যে। আমরা কেক কাটলাম। আমি কেক কেটে কেটে সবাইকে দিচ্ছিলাম। পিউকেও আমি একটা টুকরো কেটে দিই প্লেটে। আমার বন্ধুরা তো আমার মুখে মাখাবে বলে ক্রিম জড়ো করছিলো। আমি জানতাম। আগে থেকে রেডি ছিলাম। এই সময় হঠাৎ দেখি পিউ যেন মাথা ঘুরে পড়ে গেলো মেঝেতে। ছটফট করছিলো কেমন। কী হলো কী হলো বলতে বলতে দেখি চোখ বন্ধ করে ফেলেছে। ওকে সঙ্গে সঙ্গে কোলে করে তুলি আমরা। তুলে আমার ঘরে নিয়ে গিয়ে ফ্যানের তলায় শুইয়ে দেওয়া হয়। আমি সোহেলকে বলি মিউজিক সিস্টেমটা বন্ধ করতে। অ্যালিস্টার ডাক্তারকে ফোন করলো সঙ্গে সঙ্গে। বোতল থেকে জল নিয়ে জল খাওয়ানোরও চেষ্টা করি আমি পিউকে। কিন্তু তার কোনো সাড়া পাচ্ছিলাম না। আমার তো ভয়ে হাত-পা কাঁপছিলো। ওর মা নিচে ছিলেন, উনি ছুটে এলেন উপরে। কী করা উচিত, কিছু বুঝেই পাচ্ছিলাম না আমরা। শেষে ডাক্তারবাবু এসে দুঃসংবাদটা দিলেন। আমরা একটা ট্রমার মধ্যে পড়ে গেছিলাম বিশ্বাস করুন, এতো আনন্দের একটা অনুষ্ঠান এতো দ্রুত একটা শোকের পরিবেশে পরিণত হবে, কল্পনা করা যায় না জাষ্ট।"




মারিয়া থামতেই জটাদা বললো, "তারপর আপনারা পুলিশকে খবর দিলেন। আর আপনার বন্ধুরাও একে একে আপনাকে বলে বিদায় নিলো, তাইতো ?"




"ওদের দোষ দিই না। এই পরিস্থিতিতে ওরাই বা কী আর করতো। পার্টিটাই পুরো স্টপ হয়ে গেলো তো। ওরা তারপরে নিয়মিত যোগাযোগ রেখেছে, রোজ ফোন করেছে। থানায় গিয়ে দেখাও করেছে প্রত্যেকে। পুলিশই সবাইকে ডেকেছিলো।"




"আচ্ছা মিস মারিয়া, আপনি একটু ভালো করে ভেবে দেখুন তো, সেদিন পিউ কি এমন কিছু খেয়েছিলো যেটা অন্যরা কেউ খায়নি, অন্তত সেই সময় খায়নি ?"




"এটা তো আমরা সারা দিন-রাত ধরে ভেবে চলেছি। কিন্তু বিশেষ কিছুই তো পিউ আলাদা করে খায়নি, আলাদা কিছু তো ছিলোও না। স্টার্টার ছিলো, কোল্ড ড্রিঙ্কস, কেক, এইসবই তো।"




"না ধরুন ওর জন্য কোনো ওষুধ, বা বিশেষ বোতলের জল।"




"না, সেরকম কিছুই ছিলো না। জলের জন্য তো কাপ রাখা ছিল, কাগজের কাপ। অ্যাকোয়াগার্ড থেকে নিয়ে খাওয়া। আলাদা জল তো নয়। অথচ ওর পয়জনিং হলো, কিন্তু বাকিদের কিছু হলো না। কী করে সম্ভব, কিছুতেই ভেবে পাচ্ছি না।"




জটাদা মারিয়ার দিকে তাকিয়ে থাকলো একটু। তারপর বললো, "আচ্ছা ওই প্রসঙ্গ বাদ দিন। আপনার বাবার যে সিগারেট কেসটা হারিয়েছে, সেটার সম্বন্ধে আপনার বন্ধুদের মধ্যে কেউ জানতো ?"




"সবাই-ই জানতো। বাবার সিগারেট কেস আমার বন্ধুদের মধ্যে জনপ্রিয়। আমিই পোষ্ট করেছিলাম ওটা, আমার সিগারেটখোর বেশ কয়েকজন বন্ধুকে ট্যাগও করেছিলাম। সে দু'বছর আগের কথা।"




"কিন্তু ওটা যে বহু পুরোনো দিনের অ্যান্টিক জিনিষ, সেটা কি জানতো সবাই ?"




"তা জানি না। তবে অতো কেউ মাথা ঘামাবে বলে মনে হয় না। একটা স্টাইলিশ জিনিষ, এই আরকি। আর পুরোনো হলেও বা, অ্যালিস্টার তো বলছিলো যে ওসবের দাম চার-পাঁচ হাজার হবে বড়ো জোর। সেরকম দামি কিছু তো নয়। আর তাছাড়া, বাবার একটা অ্যান্টিক জিনিষের জন্য পিউকে খুন করারই বা কী যুক্তি আছে ?"




"না, তা তো নেই। আচ্ছা, আপনার ঘরটা, মানে যেখানে পিউকে শুইয়ে রাখা হয়েছিলো, সেটা একটু দেখতে পারি ?"




একটু কিন্তু-কিন্তু করেও মারিয়া জবাব দিলো, "ঠিক আছে, আসুন।"




মেয়েরা বড়োই কৌতূহলী প্রাণী। মিসেস ডিসুজা বোধহয় দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে আমাদের সব কথা শুনছিলেন। আমরা ঘর থেকে বেরোতে যাবো, সেই সময় তিনি দেখলাম দ্রুত সরে গেলেন সেখান থেকে। আমি পিঙ্কির দিকে তাকালাম একবার। দেখলাম ব্যাপারটা ওরও দৃষ্টিগোচর হয়েছে।




জটাদা মারিয়ার সঙ্গে ওর ঘরে ঢুকে চারপাশটা দেখলো একবার। মিনিট দু'য়েক পরে বেরিয়ে এলো। পিঙ্কিও গিয়েছিলো ওর সাথে সাথে। আমি ডাইনিংয়ে বসেছিলাম। মিস্টার ডিসুজা কিছু একটা লিখছিলেন ডায়েরিতে। আমাকে দেখে বললেন, "খেলাধুলো করো ?"




আমি বললাম, "ওই আর কি। একটু-আধটু।"




"কী খেলো ? ক্রিকেট ?"




"ক্রিকেটও খেলা হয়। কখনো বা ভলিবল।"




"খেলবে। নিয়মিত খেলাধুলোর চর্চাটা রাখবে। তোমাদের তো গুন্ডা-বদমাশদের সঙ্গে লড়াইটা হলো কাজ। নিয়মিত খেলাধুলোর চর্চা থাকলে দেখবে, শরীরটা খুব ফিট থাকবে।"




"আমাদের কাজটা তো শারীরিক নয় মিস্টার ডিসুজা।" জটাদা মারিয়ার ঘর থেকে বেরিয়ে ডাইনিংয়ে আসতে আসতে বললো, "আমাদের কাজটা মগজাস্ত্রের। মূলতঃ মাথার কাজ।"




"সেটা তো ঠিক মিস্টার মিত্র। কিন্তু কী জানেন, শরীর ফিট - তো মাথাও ফিট। মাথাকে যদি শরীর নিয়ে মাথা ঘামাতে হয়, তাহলে অন্য ব্যাপারে মাথা লাগাবেন কীকরে ?"




"তা অবশ্য মন্দ বলেননি।" জটাদা একটু হেসে বললো।




মিসেস ডিসুজা আমাদের সবার জন্য চা আর একটা প্লেটে অনেকরকম কুকিজ নিয়ে এলেন। কুকিজ পিঙ্কির ভীষণ পছন্দ। ও আমার পাশেই এসে বসেছিলো। কুকিজ দেখে ছোঁ মেরে তুললো দেখলাম।




আমি চাপাস্বরে বললাম, "আজ তোর ডায়েটিং না ?"




ততোধিক চাপাস্বরে জবাব দিলো মেয়ে, "ছিলো। এখন নেই।"




একটা চায়ের কাপ তুলে নিয়ে জটাদা বললো, "আচ্ছা মিসেস ডিসুজা, ঘটনার দিন যখন পিউ অসুস্থ হয়ে পড়ে, আপনি তখন ঠিক কোথায় ছিলেন বা কী করছিলেন, মনে করে বলতে পারেন ?"




"আমি... কেক কাটা হয়ে যাবার পর আমি কিচেনে গিয়েছিলাম। উনি চা খেতে চেয়েছিলেন একবার, তাই চা বানাচ্ছিলাম। হঠাৎ মারিয়া চিৎকার করে ডাকে আমাকে, মা এসো তো দ্যাখো তো কী হয়েছে -। সেই শুনে আমি গ্যাসটা কমিয়ে রেখে ওদিকে যাই। গিয়ে তো দেখি পিউ অজ্ঞান। কী থেকে যে হলো কে জানে।"




"পিউর বাবা মানে সনৎবাবু, বা ওদের ফ্যামিলির সাথে আপনাদের খুব হৃদ্যতা শুনলাম।"




"হ্যাঁ, হৃদ্যতা আছে। মেয়েটা তো আমাদের ভীষণ ভালোবাসতো। রাত্তিরবেলা পর্যন্ত প্রায়ই থাকতো এখানে। স্কুল থেকে ফিরেই আগে উপরে উঠে আসবে।"




"আর ওনাদের ফ্যামিলি ?"




"সনৎবাবু খুব ভালো। ওনার মিসেস কিন্তু খুব নোংরা। ঘরদোর দেখবেন কেমন করে রেখেছে। মনের দিক থেকে ভালো মানুষ হতে পারে, কিন্তু কীভাবে যে থাকে। আমি পারতপক্ষে ওদের ঘরে ঢুকতাম না। ওরাও কমই আসতো। মেয়েটা আসতো শুধু।"




"পার্টির দিন ওনারা ছিলেন এখানে ?"




"পিউর বাবা বোধহয় এসেছিলেন, কেক কাটার সময়। ওর মা নিচেই ছিলো। পরে খবর পেয়ে উনিও ছুটে আসেন।"




ডিসুজা সাহেবের উদ্দেশ্যে বললো জটাদা, "আচ্ছা, অ্যালিস্টারকে দেখছি না।"




"ও তো বেরিয়ে গেলো -। বললো কাজ আছে কিছু। আপনার কি ওর সাথে কথা বলতে লাগবে আরও ? ফোন করতে পারি বললে।"




"না না, আজ থাক। অসুবিধা নেই। তা... আপনার ব্যালকনিটা কিন্তু দেখছি ভারী সুন্দর।"




চায়ের কাপটা হাতে নিয়ে জটাদা সামনের ব্যালকনির দিকে গেলো। বললো, "যদিও গ্রিল আছে, কিন্তু বাইরেটা চমৎকার দেখা যায়।"




আমরা যেখানে বসে আছি, সেখান থেকে অবশ্য ব্যালকনি দিয়ে উল্টোদিকের কয়েকটা বিল্ডিং ছাড়া আর কিছুই চোখে পড়লো না। জটাদা দেখলাম ওখানে গিয়ে চারপাশ নিরীক্ষণ করছে। তারপর পিছন ফিরে মিস্টার ডিসুজাকে বললো, "এখানেই এলইডি লাগানো হয়েছিলো, অ্যালিস্টার বলছিলো। বোধহয় কোনো একটা এলইডি জ্বলছিলো না।"




"তা হবে। অ্যালিস্টারই বলতে পারবে, ওই সাজিয়েছিলো সব।"




মিসেস ডিসুজা উত্তর দিলেন, "না না, ঠিকই। একটা লাইটে কিছু প্রবলেম হচ্ছিলো বার বার।"




এই সময় হঠাৎ উপর থেকে বিকট একটা শব্দের জগঝম্প শুরু হলো যেন। প্রাশ্চাত্য রক সংগীতের সুর। জটাদা ব্যালকনি থেকে উঁকি মেরে শব্দের উৎস সন্ধান করে সোফার কাছে ফিরে এলো আবার। ফিরে এসে প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে তাকালো ডিসুজা সাহেবের দিকে। তিনি বললেন, "আমাদের উপরের তলার প্রতিবেশী। তিন-চারটে ছেলে ভাড়া থাকে মেসের মতো করে। কখন আসে, কখন যায়, কী করে, কে জানে। মাঝে মাঝেই সারারাত পার্টি চলে ওদের। এই এখন যেমন শুনছেন।"




সোফায় বসে জটাদা জিজ্ঞাসা করলো, "মোট কটা ফ্যামিলি আপনারা থাকেন বলুন তো এইখানে ?"




"নিচে সনৎবাবুরা থাকেন। ওখানে তো আর কেউ থাকে না। দোতলার দুটো ফ্ল্যাট মাঝখান থেকে জুড়ে নিয়েছি আমরা। দোতলার পুরো অংশটা নিয়ে আমরাই আছি। ছেলেদের মেসটা উপরে, তিনতলার সামনের দিকে। আর তার উল্টোদিকে, মানে তিনতলার পিছনদিকের ফ্ল্যাটে থাকেন মিস্টার দত্ত। সুদর্শন দত্ত। এমনি ভালো মানুষ। সাতে-পাঁচে থাকেন না। অফিস-টফিস নিয়ে বিজি থাকেন খুব। এখন অবশ্য তিনি এখানে নেই, সপ্তা দু'য়েক হলো দিল্লি গেছেন অফিসের কাজে। সামনের মাসে নাকি ফিরবেন।"




"মেসটিতে ক'জন ছেলে থাকে জানেন ?"




"কয়েকটা ছেলে থাকে। ক'জন থাকে ঠিক, তাও আমরা জানি না।" ডিসুজা সাহেব বললেন।




মিসেস ডিসুজা যোগ করলেন তার সাথে, "প্রায়ই দেখি নতুন ছেলে আসে, এ আসে তো সে যায়। আমাদের সাথে বা পিউদের সঙ্গে খুব একটা আলাপ-পরিচয় নেই ওদের কারুর। মেয়ে নিয়ে সংসার, বুঝতেই পারছেন। আমরা মিশি না বেশি।"




"পরশুদিনের পার্টিতে তার মানে ওরা কেউ ইনভাইটেড ছিলো না, তাই তো ?"




"না না, প্রশ্নই ওঠে না।" ডিসুজা উত্তর দিলেন।




চা শেষ করে জটাদা বললো, "আমাদের যা যা জানার প্রয়োজন ছিলো সেসব মোটামুটি কমপ্লিট। যাওয়ার পথে সনৎবাবুর সঙ্গে একবার একটু কথা বলতাম, যদি ওনাকে পাওয়া যায় তো।"




"আচ্ছা, চলুন আমি দেখছি। উনি তো সর্বক্ষণ পুলিশ আর হসপিটাল নিয়ে ছোটাছুটি করছেন।"




আমরা সিঁড়ি দিয়ে নামছি। সেই সময় সনৎবাবু দেখলাম উপরে উঠছেন। চেহারা উশকোখুশকো। সিঁড়ির অল্প আলোয় মুখটা খুব মলিন দেখাচ্ছিলো। ওনার উপর দিয়ে যে ঝড় বয়ে যাচ্ছে, বোঝাই যায়। আমাদেরকে দেখে সনৎবাবু একটু থমকে দাঁড়ালেন। তারপর ডিসুজাকে বললেন, "এখন আবার গিয়েছিলাম, বুঝলেন। হসপিটাল থেকে কাল সকালেই পোস্ট মর্টেম রিপোর্ট পাওয়া যাবে বললো। বডিও কাল দিয়ে দেবে।"




"আচ্ছা, ভালো খবর তাহলে। একটা চিন্তা দূর হলো।" ডিসুজা সাহেব বললেন, "আমরা সবাই আছি, আপনি একদম চিন্তা করবেন না। কালই যখন পাওয়া যাবে রিপোর্ট, আপনি এখন বরং একটু বিশ্রাম নিন।"




"হ্যাঁ, এখন থেকে তো বিশ্রাম নেবারই জীবন। কাল বডি পেলে দাহটা সম্পূর্ণ করা আরকি। মেয়েটাকে নিয়ে কত স্বপ্ন ছিলো, সব শেষ। সব শেষ।"




মানুষ যখন অত্যন্ত প্রিয়জনকে হারিয়ে ফেলে, তাকে বোধহয় কোনো স্বান্তনাই দেওয়া যায় না। একটুক্ষণ নীরব রইলো সবাই। তারপর জটাদা বললো, "আমাকে ক্ষমা করবেন সনৎবাবু, এই পরিস্থিতিতে আপনাকে কিছু জিজ্ঞাসা করাটা হয়তো ঠিক নয়। তবু দুটো প্রশ্ন ছিলো। যদি আপনি অনুমতি দেন।"




সনৎবাবু কিছু বললেন না। তাকিয়ে রইলেন শুধু। একটু অপেক্ষা করে জটাদা বললো, "ঘটনার দিন আপনি কি ওইখানেই ছিলেন ? মানে দোতলায় ? ঘটনাটা কি আপনার সামনেই ঘটে ?"




"না, আমি নিচে গিয়েছিলাম। কেক কাটা হলো। আমার মিসেস তো আসেনি। মারিয়া আমাকে একটা প্লেট দিয়ে তাতে কেক তুলে দিয়ে বললো, কাকু আপনি নিচে কাকিমাকে একটু দিয়ে আসুন প্লিজ। আমি সেটা নিয়ে নিচেই গিয়েছিলাম। ফিরে এসে দেখি এই ব্যাপার। পিউ অজ্ঞান হয়ে পড়েছে, ওকে শুইয়ে রেখে ডাক্তারকে খবর দেওয়া হয়েছে। আমি আবার নিচে গিয়ে আমার মিসেসকে ডেকে আনলাম তখন।"




"আপনি যখন গিয়েছেন-এসেছেন, দোতলার ফ্ল্যাটের দরজা কি লক করা ছিলো, নাকি খোলাই ছিলো ? মনে আছে আপনার ?"




"তা - মনে হয় খোলাই ছিলো সেইসময়।" আমতা আমতা করে মনে করার চেষ্টা করলেন সনৎবাবু। "তবে বেশি সময়ের ব্যাপার তো নয়। আমি গিয়েছি আর এসেছি।"




"কীরকম কাকতালীয় ব্যাপার দেখুন, সেইদিনই আবার মিস্টার ডিসুজার একটা কাঠের সিগারেট কেস চুরি যায়, মানে যেদিন পিউ এর সাথে দুর্ঘটনাটা ঘটে।" কথাটা বলে জটাদা তীক্ষ্ণ চোখে সনৎবাবুর প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করতে থাকলো।




"হ্যাঁ, শুনলাম।" সনৎবাবু ঘাড় নাড়লেন, "উনি কালকেই বলছিলেন। অনেক পুরোনো বনেদি জিনিষ নাকি। কখনো সেভাবে লক্ষ্য করে তো দেখিনি। কিন্তু এখান থেকে কে নেবে ?"




"নিয়েছে কেউ, শুধু সেটা আমাদের জানা নেই আরকি। আচ্ছা সনৎবাবু, অসংখ্য ধন্যবাদ আপনাকে। আশা করি পুলিশ একটা সুরাহা করতে পারবে এই ঘটনার। মিস্টার ডিসুজা, আমরা চলি তাহলে আজকে। একটু সাবধানে থাকবেন। এখানে আবার একটা চুরির চেষ্টা হতে পারে।"




"আবার ?" আতঙ্কিত ডিসুজা প্রশ্ন করলেন।




"আমার তাই মনে হয়। যে লোক এসবের নেপথ্যে রয়েছে, তার উদ্দেশ্য হয়তো পুরোপুরি সফল হয়নি। তাই আবার সে আসতে পারে। তবে চিন্তা করবেন না, প্রাণনাশের কোনো সম্ভাবনা আপাততঃ দেখছি না।"




রাস্তায় নেমেই জটাদা একটা সিগারেট ধরালো। তারপর আমরা কিছুটা এগোনোর পর হঠাৎ বললো, "আয় তো দেখি।" এই বলে ও রাস্তা পার হয়ে গেলো।




ওর পিছু পিছু আমরাও চললাম। রাস্তা পার হয়ে জটাদা উল্টোদিকে চললো, ডিসুজা সাহেবের বাড়ির দিকে। আমরা কিছু বুঝলাম না। কিছুটা যাওয়ার পর ডিসুজাদের বাড়িটা এলো। রাস্তার উল্টোদিক থেকে দাঁড়িয়ে জটাদা ভালো করে দেখতে থাকলো। আর সিগারেটের ধোঁয়ার কুন্ডলী পাকাতে থাকলো বাতাসে।




ডিসেম্বরের রাত, বেশ ঠান্ডা বাইরে। পিঙ্কি ওর হুডির টুপিটা তুলে কান চাপা দিলো দেখলাম। আমিও মাফলারটা পেঁচিয়ে নিলাম ভালো করে। এখান থেকে দেখলে ডিসুজাদের ব্যালকনিটা চোখে পড়ে। একটা আলো জ্বলছে ব্যালকনিতে।




পিঙ্কি চাপা গলায় জিজ্ঞাসা করলো আমাকে, "কী দেখার চেষ্টা করছে তোর দাদা, বুঝতে পারছিস কিছু ?"




"কী জানি। ব্যালকনি থেকে কেউ ঢুকতে পারে কিনা সেটাই হয়তো -।"




"কিন্তু ব্যালকনি তো গ্রিল দিয়ে ঘেরা।"




জটাদা আশপাশটা একবার ভালো করে লক্ষ্য করে নিয়ে বললো, "চল, যাওয়া যাক।"




"কোথায় ?" আমি জিজ্ঞাসা করলাম।




"নিজ নিকেতনে। ব্যাক টু হোম।"






সেদিন বাড়ি ফিরে তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়া হলো। মাঝরাত্রে ঘুমটা কেন জানিনা হঠাৎ ভেঙে গেলো। পাশে তাকিয়ে দেখলাম জটাদা নেই। চট করে উঠে আমি দরজার পাল্লাটা ঠেলে বাইরে উঁকি মেরে দেখি জটাদা ধীর পায়ে ছাদে পায়চারি করছে। হাতে জ্বলন্ত সিগারেট।




 পর্ব ৫




জটাদার ডাকেই ঘুম ভাঙলো সকালবেলা। "খবর আছে রে। উঠে পড়। মিস্টার ডিসুজা ফোন করেছিলেন।"




আমি বিছানায় উঠে বসে বললাম, "কী ব্যাপার ?"




"পোস্ট মর্টেম রিপোর্ট দিয়েছে আজ সকালে। কজ অফ ডেথ ইজ পয়জনিং। পেটে সায়ানাইড পাওয়া গেছে।"




"সায়ানাইড ? সে তো মারাত্মক বিষ! আর কিছু বলেছে রিপোর্টে ?"




"না। কিন্তু লালবাজারের একজন অফিসার, ধৃতিমান চ্যাটার্জি, আমার পরিচিত। আমার ক্লাসমেট ছিলো। আমি তাঁকে ফোন করেছিলাম কালকে। ফরেনসিক রিপোর্টের জন্য।"




"তারপর ?"




"জোগাড় করে দিয়েছে।"




"কী বলছে ফরেনসিক রিপোর্টে ?"




জটাদা একটু যেন হেসে বললো, "কী আর বলবে! ফরেনসিক রিপোর্ট অনুযায়ী কোথাও কোনো বিষ পাওয়া যায়নি।"




"বিষ পাওয়া যায়নি ?"




"না। কেক, কোল্ড ড্রিঙ্কস বা অন্য কোনো স্যাম্পেলেই সায়ানাইড বা ওইজাতীয় কোনো বিষ ছিলো না। অথচ পোস্ট মর্টেম রিপোর্ট বলছে পেটে আর্সেনিক পাওয়া গেছে।"




শুনে একটু হতাশই হলাম আমি। বললাম, "তাহলে কোনো খাবার থেকে বিষক্রিয়া হয়েছে, এই থিওরিটা খুব একটা ধোপে টিঁকছে না। পয়জনিং তাহলে হলো কীভাবে ?"




"আসল খাবারে বিষ না থাকলেও, বিষ অনেক ভাবেই একজনের খাবারে মিশিয়ে দেওয়া যেতে পারে।" জটাদা ঘরের মধ্যে পায়চারি করতে করতে বললো, "কিন্তু মোটিভ ? মোটিভ কি ?"




আমি ফোনটা তুলে পিঙ্কিকে একটা মেসেজ করে দিলাম, "কথা আছে, চলে আয়।" পিঙ্কিদের বাড়িটা এখান থেকে তিনটে বাড়ি পরেই। মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই চলে এলো সে। বাড়ির ফ্রক পরেই চলে এসেছে। ঘরে ঢুকেই বললো, "কী ব্যাপার ?"




জটাদার কাছ থেকে শোনা খবরগুলো আমি জানালাম। পিঙ্কি সব শুনে বললো, "আচ্ছা, আমি কাল বাড়ি ফিরে একটা কথা ভাবছিলাম সারারাত। কাল অ্যালিস্টার নামের লোকটা বলছিলো যে ওদের অ্যান্টিকের দোকান আছে একটা। আর মিস্টার ডিসুজার যে সিগারেট কেসটা চুরি গেছে, সেটাও অ্যান্টিকের। তাহলে... অ্যালিস্টার কি জড়িত থাকতে পারে এই চুরিতে ?"




আমার মাথায় অন্য একটা কথা ঘুরছিলো। একটু ভেবে আমি বললাম, "আচ্ছা... এটা তো মারিয়ার জন্মদিন ছিলো। এই দিনটাকেই বেছে নেবার কী কারণ ? তাহলে... এমন কি হতে পারে যে মারিয়ার উপরেই হয়তো কারুর কোনো আক্রোশ ছিলো, আর তাকেই খুন করার চেষ্টা করা হয়েছিলো তার জন্মদিনের পার্টিতে ? কেকের মধ্যে কিছু মিশিয়ে দিয়ে ?"




জটাদা আরো দু'বার ঘরের এমাথা ওমাথা করার পরে ঘুরে দাঁড়ালো হঠাৎ। বললো, "সেটা হলেও ব্যাপারটা অতো সহজ নয় রে ঋভু। কেকের মধ্যে বিষ পাওয়া যায়নি। ফরেনসিক বলছে কোনো খাবারেই বিষ মেশানো ছিলো না। তার মানে পটাশিয়াম সায়ানাইড বা সোডিয়াম সায়ানাইড, কিছু একটা আলাদা করে দেওয়া হয়েছে ভিকটিমকে। এখন ধন্ধটা হলো, মারিয়াকেই যদি টার্গেট করা হয়ে থাকে তোর কথামতো, তো পিউ কে কেন সায়ানাইড দেওয়া হলো ? আর পিউকেই যদি টার্গেট করা হয়ে থাকে, তাহলে সেটার মোটিভ কী... এটাই প্রশ্ন।"




"সেটা ঠিক। টার্গেট যদি মারিয়া হয়, তাহলে মারিয়ার খাবারেই তো মেশাতো।" বলতে বাধ্য হলাম আমি।




"আপাততঃ আজকের প্ল্যান কী জটাদা ?" পিঙ্কি একটু পরে জিজ্ঞাসা করলো।




"রেডি হয়ে নে তোরা। দশটার মধ্যে আমাদের বেরোতে হবে। উত্তর কলকাতাটা একটু ঘুরে আসা যাক।"




আমি বললাম, "উত্তর কলকাতা ? দাঁড়াও, এক সেকেন্ড। আমি আন্দাজ করি। মিস্টার ডিসুজার সেই পরিচিত প্রোমোটারের সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছি কি আমরা ?"




"একদম কারেক্ট।" জটাদা চায়ের কাপ শেষ করে বললো।




গাড়িতে যেতে যেতে আমি মনে মনে ঘটনাস্থলের চরিত্রগুলোকে সাজাবার চেষ্টা করছিলাম। বাড়ির একতলায় সামনের দিকে থাকেন সনৎবাবু। পিছনের দিকে একটা খালি ফ্ল্যাট। দেওয়াল ভাঙা। দোতলায় মিস্টার ডিসুজা ও তার ফ্যামিলি। তিনতলার সামনের দিকে একটা ছোট মেস। তিনতলার পিছনের দিকে থাকেন সুদর্শন দত্ত। তিনি বর্তমানে দিল্লিতে গিয়েছেন। এছাড়া আছে অ্যালিস্টার, মারিয়ার হবু বর। আমি ভেবে দেখলাম, যদি মোটিভকে আপাততঃ সরিয়ে রাখি, তাহলে সেদিন যারা যারা পার্টিতে উপস্থিত ছিলো, তাদের প্রত্যেকেরই খুনের সুযোগ ছিলো। যদিও সনৎবাবু নিজের মেয়েকেই খুন করবেন, এটা ভাবা যাচ্ছে না। ওনাকে বাদ দিয়ে বাকি সবাইকেই সন্দেহ করা যায়, যারা যারা ওইদিন উপস্থিত ছিলেন। আবার মোটিভ দেখতে গেলে, এদের কারুরই কোনো জোরালো মোটিভ খুঁজে পাওয়া যায় না, কেন দশ বছরের একটা বাচ্চাকে খুন করতে হবে।




এই সময় পিঙ্কি প্রস্তাব দিলো, "আচ্ছা জটাদা, একটা গেম হয়ে যাক ?"




"কীরকম গেম ?"




পিঙ্কি বসেছে গাড়ির সামনের সীটে। আমি আর জটাদা পিছনে। পিঙ্কি ঘাড়টা ঘুরিয়ে বললো, "আমি দুটো করে অপশন দেব, তোমাকে তার থেকে একটা চুজ করতে হবে। এমনি গেম। তুমি যেটা খুশি বলতে পারো, তোমার পছন্দমতো।"




"ঠিক আছে, বল।" জটাদা বললো।




মোবাইল দেখে দেখে পিঙ্কি বলতে লাগলো, "সত্যজিৎ রায় না মৃনাল সেন ?"




"অবশ্যই সত্যজিৎ রায়। একাধারে বহু গুনের সমাহার। শুধু সিনেমাই নয়, সাহিত্য-সংগীত-অঙ্কন, সব মিলিয়ে ওইরকম বহুমুখী প্রতিভা সত্যিই বিরল।"




"আচ্ছা, পলাশ ফুল না শিউলি ?"




"শিউলি। শিউলির সাথে পুজোর অদ্ভুত একটা গন্ধ জড়িয়ে থাকে।"




"বই না পিডিএফ ?"




"বই।"




"লুঙ্গি না পাজামা ? এটা পাজামা হবে আমি জানি, ছাড়ো। এইটা বলো, মোমো না রোল ?"




জটাদা একটু ভেবে বললো, "দু'টোর কোনোটাই নয়। ফুচকা।"




"আচ্ছা, লস্যি না আইসক্রিম ?"




"দু'টোই চলবে। না, লস্যি।"




"থিমপুজো না একচালা ?"




"থিম। এখানে ড্রপ করে দিন দাদা।"




উবের ড্রাইভার আমাদের নামিয়ে দিলো বিডন স্ট্রিটে। নেমে জটাদার পিছু পিছু আমরা চলতে লাগলাম।




জটাদা বলছিলো, "কীরকম অদ্ভুত যোগাযোগ দ্যাখ। আমরা এখন যেখানে আছি, তার কাছেই হচ্ছে বিডন পার্ক। যেটার এখন নাম হয়েছে রবীন্দ্র কানন। আর ওইখানেই ছিলো মহারাজা নন্দকুমারের বাসভবন। যেটা পরবর্তীতে তাঁর জামাই জগৎচন্দ্র রাই, ও তারপর তাঁর পুত্র মহানন্দ রাইয়ের বাসভবন হয়।"




"নন্দকুমার তার মানে কলকাতার লোক ছিলেন ?" জিজ্ঞাসা করলাম আমি।




"না। নন্দকুমারের আদি বসতবাড়ি ছিলো বীরভূম ও মুর্শিদাবাদে। তখন কলকাতা সবে সবে তৈরী হচ্ছে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর খাতায় বঙ্গদেশের পোশাকি নাম ছিলো বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি। মুর্শিদাবাদ ছিলো তখন তার রাজধানী। কিন্তু কলকাতার গুরুত্ব ক্রমেই বাড়তে থাকায় এখানেও একটি বাসভবন তৈরী করে রাখেন নন্দকুমার। দাঁড়া, আমরা মনে হয় প্রোমোটারের অফিসের কাছাকাছি পৌঁছে গেছি।"




খুঁজে পেতে কিছুক্ষণের মধ্যেই আমরা সেই অফিসের হদিশ পেয়ে গেলাম। একটা গলির ভিতর অফিসটা, পোদ্দার অ্যাসোসিয়েটস। দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকে দেখা গেলো চওড়া টেবিলের একধারে মধ্যবয়সী এক অবাঙালি ভদ্রলোক বসে আছেন। সামনে প্রচুর কাগজপত্র আর ফাইলের পাহাড়। সামনেই একটা কাঠের ফলকে ভদ্রলোকের নাম লেখা আছে, বিজয় পোদ্দার।




জটাদা তার কার্ডটা বার করে এগিয়ে দিলো। বললো, "নমস্কার পোদ্দারবাবু। আমার নাম প্রোজ্জ্বল মিত্র। প্রাইভেট ইনভেস্টিগেটর। মিস্টার স্যামুয়েল ডিসুজার একটা কেসের ব্যাপারে আপনার সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছিলাম।"




"প্রাই-ভেট ডি-টেক-টিভ।" ভদ্রলোক হাসি হাসি মুখে চিবিয়ে চিবিয়ে কথাগুলো বললেন। কথা বলার ভঙ্গিমা দেখে আমার মাথা গরম হয়ে গেলো। ডিসুজা ঠিকই বলেছিলেন। এই মানুষটার তমিজ জানা নেই একটুও।




"তা আমি আপোনার কীভাবে হেল্প কোরতে পারি বোলুন ? আর এই দোঠো কি আপোনার অ্যাসিস্ট্যান্ট আছে ?" শেষের ইঙ্গিতটা আমার আর পিঙ্কির উদ্দেশ্যে।




ভদ্রলোকের মুখে ভীষণ শয়তানি একটা হাসি সবসময় যেন ঝুলে আছে। পান-দোক্তা কিছু একটা খাচ্ছেন, আর চিবিয়ে চিবিয়ে কথা বলছেন। "বাংগালীদের কী আছে না, ডিটেকটিভ নিয়ে খুব ইয়ে আছে জানেন। বোমকেস বাবু, ফেলুবাবু, কিরীটি বাবুর গোলপো, যোতো গোয়েন্দা গোলপো আছে, সব এই বাংগালীদের মধ্যে খুব ফেমাস আছে।"




জটাদা একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসে পড়লো। দেখাদেখি আমরাও বসলাম। জটাদা ওই লোকটার কথাগুলোকে একটুও পাত্তা না দিয়ে সরাসরি কাজের কথায় চলে গেলো, "দেখুন পোদ্দারবাবু, মিস্টার ডিসুজা যেখানে থাকেন, পার্কস্ট্রিটের ফ্ল্যাটে, ওখানে তিনদিন আগে একটা মার্ডার হয়ে গেছে। একটা বাচ্চা মেয়ে, দশ বছর বয়স। এ কেস অফ পয়জনিং। সেই ব্যাপারে আপনার সঙ্গে কিছু কথা ছিলো।"




"আমার সুঙ্গে কোথা বলে কী কোরবেন ? আমি মানুস মারি না মিস্টার -"। এই অবধি বলে তিনি আবার জটাদার দেওয়া কার্ডটা দেখলেন। বললেন, "মিত্র - মিস্টার মিত্র। মানুস তো মারি না আমি। মানুস চাইলে মারতে পারি, কিন্তু সেটা আমার বেওসা নয়। আমার হলো কনস্ট্রাকশানের বিজনেস। বুঝলেন কি না ? আমার সুঙ্গে কোথা বলে আপনি কী জানবেন ?"




"আমার কাছ থেকে শোনার আগে আপনি কি খুনটার কথা জানতেন পোদ্দারবাবু ?" জটাদা কঠিন গলায় বললো। কিন্তু তিনি সেই আগের মতোই হাসিমুখে উত্তর দিলেন, "জানতাম না। আপোনার কাছ থেকে জেনে নিলাম। হয়ে গেলো। বাচ্চি মরি হ্যায় না ? বহুত দুখ হুয়া। আমার বুকে খুব দুঃখ হলো সুনে। অউর কুছ জানতে চান ?"




"হ্যাঁ, জানতে চাই। আপনি সবার কাছ থেকে প্রথমে জমির জন্য পাওয়ার অফ অ্যাটর্নি নিয়ে নিলেন। তার ঠিক পরেই বাজারে আগুন লাগলো। কাজ বন্ধ হয়ে গেলো। এতদিন পার হয়ে গেলো, কনস্ট্রাকশান কিছুই হলো না। আপনার প্ল্যানটা ঠিক কি ?"




জটাদার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে পান চিবোতে চিবোতে কিছুক্ষণ দেখলেন পোদ্দারবাবু। তারপর বললেন, "মিষ্টি-টিষ্টি কিছু খাবেন ? ফার্স্ট টাইম এলেন আমার অফিসে।" আমাদের দিকেও তাকালেন তিনি।




জটাদা উত্তর দিলো, "না। আপনি আমার প্রশ্নের সোজাসুজি উত্তর দিলেই আমরা কৃতার্থ হবো।"




"দেখুন ডিটেকটিভবাবু, আমার বিজনেসের বিপারে আপোনাকে তো আমি কিছু বোলবো না। যেটার জন্য আপোনাকে লাগানো হয়েছে, সেইটা নিয়েই ভাবুন। ওন্য কুনো বিপারে নাক গোলাতে গেলে নাক কিন্তু কেটে যাবে। সাবধান। আর ইতো কষ্ট করে এসেছেন, একটু চা তো খেয়ে যান। বাচ্চি কে লিয়ে দুধ মাঙবায়ে ক্যায়া ?"




"ওঠ তোরা।" জটাদা চেয়ার ছেড়ে উঠতে উঠতে বললো। অতঃপর তিনজনে বেরিয়ে এলাম আমরা।




"ভীষণ অভদ্র লোক একটা।" পিঙ্কি বললো বাইরে এসে।




সেন্ট্রালের দিকে হেঁটে যাচ্ছিলাম আমরা। জটাদার মুখটা বেশ গম্ভীর হয়ে রয়েছে। চোয়াল দু'টো শক্ত। কিছু চিন্তা করছে।




আমি বললাম, "অভদ্র এবং অশিক্ষিত। কীরকম চিবিয়ে চিবিয়ে কথা বলছিলো। মিস্টার ডিসুজা একদম ঠিক বলেছেন। লোকটাকে দেখলেই মনে হয় জঘন্য।"




"আবার চা অফার করছে! আমার ইচ্ছা করছিলো এক কাপ গরম চা নিয়ে ওরই মাথায় ঢেলে দিতে। আমাকে বাচ্চি বললো কোন সাহসে!"




"ও কিন্তু খুনের ব্যাপারটা মনে হয় আগে থেকেই জানতো। একটুও অবাক হলো না শুনে।"




"একদম ঠিক।" পিঙ্কি আমার কথায় সমর্থন জানালো। "একদম গভীর জলের মাছ, দেখলেই বোঝা যায়। কথা বলছে হেসে হেসে, কিন্তু শয়তানের গাছ একখানা।"




"খুনটা হয়তো ও-ই করিয়েছে লোক দিয়ে। উদ্দেশ্য ছিলো ডিসুজাকে মারা। কিন্তু প্ল্যান-এর ভুলে বাচ্চাটা বেঘোরে মারা যায়।" আমি বললাম।




"খুবই হতে পারে। জমিগুলো হাতিয়ে নেবার জন্য ডিসুজা এবং আরও যারা যারা আছে, তাদেরকে সরিয়ে দেবার প্ল্যান হয়তো। তুমি কি বলো জটাদা ?"




জটাদা এতক্ষণে মুখ খুললো। বললো, "এরা যে ক্লাসের লোক, তাতে বিষ দিয়ে পয়জনিং করে কাউকে মারার শিল্প এদের ধাতে সইবে না। খুন করতে হলে সবার নাকের ডগায় লাশ ফেলে দিয়ে চলে যাবে। এতো কসরৎ করবে না। আচ্ছা আমাদের তো ফেরার জন্য একটা কিছু ধরতে হবে। দু'টোর মধ্যে একটা চুজ কর তুই এবার - মেট্রো না গাড়ি ? উবের না ওলা ?"



 পর্ব ৬




পরদিন সকালে জটাদা একাই বেরোলো। বললো ন্যাশনাল লাইব্রেরিতে একবার যাবে, পুরোনো কলকাতার উপর একটু নাকি পড়াশুনো করতে হবে। আমি বুঝলাম না এই কেসের সাথে তার কোনো সম্পর্ক আছে নাকি আলাদা ব্যাপার।




সন্ধ্যের পর জটাদা ছাদেই পায়চারি করে বেড়ালো। ঘন ঘন সিগারেট টানছে, খুব অন্যমনস্ক আর ভীষণ কোনো চিন্তায় মগ্ন আছে মনে হলো। জটাদার এই রূপটা আমি চিনি, তাই ওকে বেশি ঘাঁটালাম না। আমি বরং পিঙ্কিকে দাবা খেলার নিয়মগুলো বোঝাচ্ছিলাম। যতবার বোঝাই, ততবারই দেখি ভুলে যায়। শেষমেশ ওইসব তুলে রেখে দিয়ে দু'জনে কয়েক দান লুডো খেলে সময় কাটালাম। রাত্রে খাওয়ার সময়ও জটাদা সেদিন বেশি কথা বললো না।




তার পরের দিন অর্থাৎ শুক্রবার সকালে আমরা আবার হানা দিলাম মিডলটন রো-এর বাড়িতে। যেতে যেতে জটাদা গল্প বলছিলো।




"কলকাতার নাম কিন্তু চিরদিন কলকাতা বা ক্যালকাটা ছিলো না। পলাশীর যুদ্ধের আগে একবার সিরাজউদ্দৌলা ইংরেজদের পরাজিত করে কলকাতা দখল করেন। এবং যে ওয়ারেন হেস্টিংসের নাম আমরা ইতিহাস বইতে পড়ি, সেই ওয়ারেন হেস্টিংসকে সেই সময় জেলে বন্দিও করেন সিরাজউদ্দৌলা। সিরাজের বয়স তখন সবে তেইশ। কিন্তু বুদ্ধি ও পরাক্রমে ইংরেজদের দমন করে রেখেছিলেন তিনি। ফলতা তখন ছিলো গঙ্গার বুকে ছোট্ট একটা গ্রাম। ইংরেজরা পালিয়ে গিয়ে সেইখানে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছিলো। কলকাতা দখল করলেও কলকাতায় থাকার অভিপ্রায় সিরাজের ছিলো না। তিনি তার অনুগত মানিকচাঁদের হাতে কলকাতার ভার দিয়ে মুর্শিদাবাদে ফিরে যান। কিন্তু যাবার আগে তার দাদু আলিবর্দী খাঁর নামের অনুকরণে কলকাতার নাম পাল্টে তিনি রাখেন আলিনগর।"




"কলকাতার নাম আলিনগর ?" পিঙ্কি অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলো।




"হ্যাঁ। কিছুদিনের জন্য কলকাতা আলিনগর বলেই পরিচিত ছিলো। তবে বেশিদিন স্থায়ী হয়নি সেই নাম। মানিকচাঁদ অতি সহজেই ইংরেজদের কাছ থেকে ঘুষ নিয়ে কলকাতার দখল আবার ইংরেজদের ফিরিয়ে দেন। আর তার সাথে সাথে ভারতবর্ষে ইংরেজদের প্রতিপত্তি আটকাবার শেষ সুযোগটাও আমাদের হাতছাড়া হয়ে যায়। এরপর পলাশীর একটা সাজানো যুদ্ধ ও সিরাজউদ্দৌলার পরাজয়ের কাহিনী আমরা সবাই জানি।"




"আর ওয়ারেন হেস্টিংসের কী হলো ? তিনি ছাড়া পেলেন জেল থেকে ?" আমি জিজ্ঞাসা করলাম।




"হ্যাঁ। লর্ড ক্লাইভ তখন ছিলেন দক্ষিণ ভারতে। বেঙ্গল প্রেসিডেন্সিতে ইংরেজদের শোচনীয় অবস্থার কথা শুনে তিনি কোম্পানির ফৌজ নিয়ে এসে ওয়ারেন হেস্টিংসকে উদ্ধার করেন। শুনলে অবাক হবি, এই ওয়ারেন হেস্টিংসই ছিলেন সেই ব্যক্তি যিনি ভগবৎ গীতার প্রথম ইংরেজি অনুবাদও লিখেছিলেন।"




"তাই নাকি ?" আমি সত্যিই আশ্চর্য হলাম শুনে।




"ইয়েস। ওয়ারেন হেস্টিংস তার সমসাময়িক অন্যান্য ইংরেজ শাসকদের তুলনায় বোধহয় একটু ভালো লোকই ছিলেন। তার বিরুদ্ধে অভিযোগও অবশ্য অনেক ছিলো, কিন্তু আপাততঃ আমরা মনে হচ্ছে আমাদের গন্তব্যস্থলে এসে পড়েছি।"




মিস্টার ডিসুজাকে আগে থেকেই বলা ছিলো। তিনি বাড়িতেই ছিলেন। আমরা সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠবার সময় দেখলাম একতলায় সেন পরিবারের ফ্ল্যাটের দরজা যথারীতি বন্ধ। দোতলায় সিঁড়ির মুখে কিছু জুতো খোলা, যার পাশে আমরাও আমাদের জুতো খুলে রেখে ঢুকলাম। ঢোকার সময় লক্ষ্য করলাম জটাদা নিচু হয়ে ওই জুতোগুলোর ওখান থেকে কিছু একটা কুড়িয়ে নিলো। নিয়ে পকেটে রাখলো।




"তদন্ত কতদূর এগোলো মিস্টার মিত্র ?" আমাদের আপ্যায়ন করে বসিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন ডিসুজা সাহেব। এক নতুন ভদ্রলোককে ঘরে দেখতে পেলাম। আমাদের মুখোমুখি উল্টোদিকের সোফায় বসে ছিলেন তিনি। তিরিশ-বত্রিশ বছর বয়স হবে। বেশ স্লিম চেহারা। সাদা শার্টের উপর মেরুন রঙের সোয়েটার। দেখে বেশ মার্জিত ও রুচিশীল বলেই মনে হলো।




"কাজ অনেকটাই এগিয়েছে।" জটাদা বললো, "খুনের রহস্য উদ্ধার হোক না-হোক, আশা করছি আপনার চুরি যাওয়া সিগারেট কেসটা অন্তত খুব শীঘ্রই আপনাকে ফেরত দিতে পারবো।"




"ভেরি গুড, ভেরি গুড। শুনে খুশি হলাম। ওটা আমার বাবার বাবার আমল থেকে কি তারও আগে থেকে আছে আমাদের বাড়িতে। হয়তো এমন বিশেষ কিছু নয়, কিন্তু তবুও একটা দামি স্মৃতি তো -।"




জটাদা নতুন লোকটির উদ্দেশ্যে বললো, "আপনাকে তো ঠিক চিনতে পারলাম না।"




ভদ্রলোক একটু উঠে হাতটা জটাদার দিকে বাড়িয়ে বললো, "আমার নাম সুদর্শন দত্ত। এই এর উপরে মানে তিনতলাতেই আমার ফ্ল্যাট। আপনার কথা এইমাত্র বলছিলেন মিস্টার ডিসুজা।"




জটাদা প্রত্যুত্তরে করমর্দন করে বললো, "আচ্ছা, বসুন বসুন। আপনার সামনের মাসে আসার কথা ছিলো শুনেছিলাম। দিল্লি গিয়েছিলেন তো আপনি ?"




"হ্যাঁ, কাজ হয়ে গেলো তাড়াতাড়ি। তাই চলে এলাম।"




"যাক আপনার সঙ্গে দেখা হয়ে ভালো লাগলো।"




ডিসুজা সাহেব যোগ করলেন, "আজই ফিরেছেন। এই একটু আগে। উনি উঠছিলেন তখন, আর আমিও নামছি। সিঁড়িতে ওনার সঙ্গে দেখা। ওনাকে ডেকে এনে বলছিলাম সব কথা।" আমি লক্ষ্য করলাম ভদ্রলোকের পাশে একটা চওড়া ব্রিফকেস মেঝেতে দাঁড় করানো রয়েছে। ফিরে এসে এখনো ঘরে ঢোকেননি সম্ভবত।




"কী সাংঘাতিক অবস্থা মশাই!" সুদর্শনবাবু বিস্ময়ের সাথে জটাদার দিকে তাকিয়ে বললেন, "একের পর এক কীসব ঘটে গেছে শুনলাম। এখানে কি আর থাকা যাবে না শান্তিতে ? প্রথমে খুন। তারপর চুরি। তাও কী, না একটা সিগারেট রাখার বাক্স। ডিসগাস্টিং!"




"সিগারেটের বাক্স বলে অবহেলা করবেন না সুদর্শনবাবু।" জটাদা বললো, "ওটা হয়তো কোনো বিশেষ একটা বাক্সও হতে পারে।"




"মানে ?" সুদর্শনবাবুর সাথে সাথে ডিসুজাও করলেন প্রশ্নটা।




"না মানে এতো দিনের পুরোনো জিনিষ। ওটার গায়ে তো সতেরোশো খিষ্টাব্দের একটা সাল লেখা আছে।"




"হ্যাঁ, সতেরোশো ছিয়ানব্বই।" ডিসুজা বললেন, "কিন্তু আপনি কীকরে জানলেন ?"




"বাক্সের যে ছবিটা আপনার মেয়ে পাঠিয়েছিলেন, সেটা জুম করে দেখলেই পড়া যাচ্ছে। আচ্ছা ওটার কোনো ইতিহাস জানেন ? মানে ওটা আপনাদের কাছে কবে কীভাবে এলো, সেই ব্যাপারে কিছু ?"




"না, আমি তো কিছু শুনিনি। বিডন স্ট্রিটে আমাদের পৈতৃক বাড়িতে এরকম অনেক জিনিষ ছিলো। সময়ের সাথে সাথে অনেক জিনিষই ভেঙেচুরে নষ্ট হয়ে যায়। এই কাঠের বাক্সটা কোনোভাবে এতোদিন টিঁকে গেছে। বাই দ্য ওয়ে, শুনলাম আপনারা কালকে বিডন স্ট্রিটে পোদ্দারবাবুর অফিসে গিয়েছিলেন ?"




"হ্যাঁ, ওনার সাথে একটু আলাপ করে এলাম। ভদ্রলোকের আতিথেয়তার বহর দেখে বুঝলাম আপনি কিছু ভুল বলেননি।"




"কেন ? আপনাকে কিছু উল্টোপাল্টা থ্রেট দিয়েছে নাকি ? বলুন আপনি, আমি ওই পাওয়ার অফ অ্যাটর্নি এখনই ক্যানসেল করে দেব। লোকটা একদম সুবিধের নয়।"




"আরে না না। সাপের ল্যাজে পা দিলে সাপ একটু ফোঁ করে উঠবে সেটাই তো স্বাভাবিক। ওই নিয়ে আপনি চিন্তিত হবেন না। কিন্তু খবরটা আপনাকে কে দিলো ?"




"পোদ্দারবাবু নিজেই ফোন করেছিলেন। আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন এখানে কী হয়েছে ইত্যাদি। নাউ আই অ্যাম গেটিং ডাউটফুল যে এটা ওনারই কাজ কিনা।"




মিসেস ডিসুজা এইসময় ডাইনিংয়ে ঢুকলেন। তার হাতে মিষ্টির প্লেট সাজানো। সেন্টার টেবিলে সেসব রেখে তিনি একটা করে প্লেট এগিয়ে দিলেন আমাদের দিকে। জটাদা বললো, "এসবের কোনো প্রয়োজন কিন্তু ছিলো না। কেন আবার কষ্ট করে -।"




"হোক। অল্পই তো মিষ্টি। না করবেন না একদম।"




আমি হাত বাড়িয়ে একটা সন্দেশ তুলে নিলাম প্লেট থেকে। ইয়া বড়ো তালশাঁস সন্দেশ। দারুন খেতে। পিঙ্কিকে চোখের ইশারায় বোঝালাম, খেয়ে দ্যাখ, ভালো খেতে। সে এক টুকরো শুধু ভেঙে খেলো। মিষ্টি জিনিষটা খুব একটা পছন্দ নয় এই মেয়ের।




সুদর্শনবাবু জটাদাকে জিজ্ঞাসা করলো, "আপনার কী মনে হচ্ছে, খুনের ব্যাপারে... বিষক্রিয়াতেই মৃত্যু, নাকি - অন্য কোনো ব্যাপার ?"




"পোস্ট মর্টেম রিপোর্টে ভুল আছে বলছেন ?"




"না না, তা নয়। মানে, মিস্টার ডিসুজা বলছিলেন যে পোস্ট মর্টেম রিপোর্টে বিষক্রিয়া লেখা থাকলেও কোনো খাবারেই বিষ খুঁজে পাওয়া যায়নি। তাহলে বিষ এলো কীভাবে ? সেটা জানতে পারলে আমরাও একটু সতর্ক থাকতে পারি আরকি। একাই থাকি। হুটহাট রেস্টুরেন্ট থেকে এরকম খাবার দাবার তো প্রায়ই আনাতে হয়। সেটাই চিন্তা।"




জটাদা প্লেট থেকে একটা তালশাঁস তুলে নিয়ে মুখে ঢুকিয়ে দিয়ে বললো, "আপনি একা মানুষ। কোনো ঝুট-ঝামেলায় নেই। আপনার ভয়ের তো কোনো কারণ দেখছি না। আর তাছাড়া রেস্টুরেন্ট থেকে আনা খাবারে তো সত্যিই কোনো টক্সিক কিছু ছিলো না। অতএব আপনি নিশ্চিন্তে খাবার অর্ডার করুন, অতো দুশ্চিন্তা করবেন না। তবে এখানে থাকাকালীন কখনো অস্বাভাবিক কিছু দেখলে আমাকে বা মিস্টার ডিসুজাকে জানাবেন। হয়তো আমাদের কাজে লেগে যাবে সেটা।"




"হ্যাঁ, হ্যাঁ, নিশ্চয়ই। নিশ্চয়ই। আচ্ছা যাক, কিছুটা রিলিভড হলাম তাহলে।" ভদ্রলোক যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন। বললেন, "আমি তাহলে এখন যাই মিস্টার ডিসুজা, ঘরটার কী হাল দেখি গিয়ে।"




ডিসুজা তৎক্ষণাৎ বললেন, "হ্যাঁ হ্যাঁ, যান। কিন্তু মিষ্টি পড়ে রইলো তো সব।"




"আরেকদিন হবে প্লিজ। এতোটা রাস্তা এসে বেশ টায়ার্ড এখন -।"




"আচ্ছা, আচ্ছা, ঠিক আছে। আপনাকে অনেকক্ষণ আটকে দিলাম, ভেরি সরি। যান আপনি ফ্রেশ হয়ে নিন।"




"না না, সে কী আছে। প্রতিবেশীদের খোঁজখবর তো রাখতেই হবে। আচ্ছা মিস্টার মিত্র, চলি তাহলে। আবার দেখা হবে।"




জটাদা প্রত্যুত্তরে হাত জড়ো করে নমস্কার জানালো।




সুদর্শনবাবু ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যেতে ডিসুজা সাহেব জটাদাকে বললেন, "ওহ, ভালো কথা, আপনার পারিশ্রমিকের ব্যাপারটা -।"




"সেসব পরে হবে। কাজটা সম্পূর্ণ হোক আগে। তারপর। আমি অ্যাডভান্স কিছু নিই না।"




"বেশ।" ডিসুজা বললেন, "এদিকে তো আজ একটা কান্ড ঘটে গেছে এখানে।"




"কী হয়েছে ?"




"ভোরের দিকে নাকি চোর এসেছিলো আজকে। আমি ইচ্ছা করেই সুদর্শনবাবুর সামনে বললাম না। উনি খুন-টুনের কথা শুনে অলরেডি একটু ঘাবড়ে আছেন। আরো ভয় পেয়ে যাবেন আজকের কথা শুনলে।"




আমি নড়েচড়ে বসলাম। জটাদা আগ্রহ নিয়ে তাকালো ডিসুজার দিকে। "চোর এসেছিলো ?"




"হ্যাঁ। আপনার ভবিষ্যৎবাণী যেন অক্ষরে অক্ষরে মিলে গেলো। আপনি বলেছিলেন যে আবার চুরির চেষ্টা হতে পারে। আর হলোও ঠিক তাই।"




"কী চুরি হলো এবার ?"




"সেটাই তো বোঝা যাচ্ছে না। মানে সেরকম কিছু চুরি হয়নি। তখন ভোর পাঁচটা কি সাড়ে পাঁচটা হবে। আলো ফোটেনি তখনো। সনৎবাবু ঘরে শুয়ে ছিলেন। উনি নাকি শুনতে পান পাশের ভাঙাচোরা ফ্ল্যাটে কেউ যেন ঢুকেছে। জিনিষপত্র ঘাঁটাঘাঁটি করছে। ভয়ে উনি আর দরজা খোলেননি। কিন্তু উৎকর্ণ হয়ে শুনেছেন। বেশ আধ ঘন্টা মতন চোর সব আঁতিপাতি করে খুঁজে চলে যায়। কী খুঁজছিলো ওই পোড়ো ঘরে, কে জানে! ওখানে চুরি করার উপযুক্ত কিছু আছে বলেও তো মনে হয় না। আবার নাকি দেওয়াল ঠুকে ঠুকে দেখছিলো। মানে সনৎবাবু তাই বললেন আমাকে সকালবেলা। আমার অবশ্য চোরের আওয়াজে ঘুম ভাঙেনি।"




"আচ্ছা, তাই বলুন। আপনি সনৎবাবুর কাছ থেকে শুনেছেন। আমি ভাবলাম এই ঘরে চোর ঢুকেছিলো।"




"না, না। নিচের ওই ভাঙা ঘরটায়।"




"কেমন আছেন সনৎবাবু ? ওনার মেয়ের পারলৌকিক কাজকর্ম -।"




"বডি তো দিয়ে দিয়েছিলো পরশুদিনই। আপনাকে ফোনে তো বললাম। দাহ-টাহ সেইদিনই হয়ে গেছে সব। সামনের সপ্তাহে কাজ। বিমর্ষ হয়ে আছেন ওনারা। একমাত্র মেয়ে ছিলো তো। কষ্ট তো হবেই। আমাদেরই মনে পড়লে খারাপ লাগছে এতো।"




"বুঝতে পারছি। ইশ্বর ওনাদের সহায় হোক।"




পিঙ্কি এই সময় উঠে মারিয়ার ঘরে গেলো। ও দেখলাম মারিয়ার সাথে বেশ ভাব জমিয়ে নিয়েছে। ওর সাথে ওর ঘরে বসে ওর সাজের জিনিসপত্র ঘেঁটে দেখছিলো। ডাইনিং থেকে শুনতে পাচ্ছিলাম টুকটাক ওদের কথাবার্তা। এই মেয়েটাকে জটাদা যে কী আক্কেলে গোয়েন্দাগিরিতে নিয়েছে!




ডিসুজা সাহেব আবার বললেন, "আমার মিসেস বলছিলেন, অপঘাতে মৃত্যু হলে সেই আত্মা নাকি মৃত্যুর জায়গায় আবার ফিরে আসে। আমার ওসবে বিশ্বাস হয় না অবশ্য। কিন্তু আজকের ঘটনাটা বড়ো অদ্ভুত। ওই খালি ঘরে চোর কেন ঢুকবে ? কী খুঁজছিলো দেওয়ালে হাতুড়ি মেরে ? কী জানি। আত্মা-প্রেতাত্মার ব্যাপার যদি হয় -।"




জটাদা হাসতে হাসতে বললো, "দেখুন আত্মা-প্রেতাত্মা যদি আসে তো আমি কিছু করতে পারবো না। কিন্তু মানুষ যারা এসবের পিছনে আছে, তাদের পরিচয় আমি আপনাকে দু'য়েক দিনের মধ্যেই দিয়ে দিতে পারবো আশা করি।"




ডিসুজা বললেন, "এই কারণেই তো আপনার উপর আমার এতো ভরসা। আপনার বাবার সাথে আমার পরিচয় ছিলো। অনেক জটিল জটিল কেস সল্ভ করেছেন উনি। এখন আপনার উপর দায়িত্ব। দেখা যাক আপনি সেই দায়িত্ব কতটা সফলতার সঙ্গে পালন করতে পারেন। একটা কথা আছে মিস্টার মিত্র। বাপ কা বেটা, আর সিপাহী কা ঘোড়া। যদিও কখনো কখনো সেটা ফলে না, এমনও দেখা গেছে হিস্ট্রিতে।"




"আপনি তাহলে এক কাজ করুন।" জটাদা বেশ প্রত্যয়ের সঙ্গে বললো, "পরশুদিন, মানে আগামী রোববার, সবার ছুটির দিন। ওইদিন আপনি আবার একটা ঘরোয়া পার্টির আয়োজন করুন এখানে। পার্টি কিছু না, আমরা এই কেসটার পর্যালোচনা করবো। সেইদিনই আশা করছি সব সত্য উন্মোচন করতে পারবো। আপনাদের ফ্যামিলির সবাই, অ্যালিস্টার, আর সনৎবাবু উপস্থিত থাকলেই হবে। সুদর্শনবাবুও ফিরে এসেছেন, তো ওনাকেও আমন্ত্রণ জানিয়ে রাখবেন। আর বাইরের কাউকে লাগবে না। সময় সন্ধ্যে সাতটা।"




"ঠিক আছে। তাই হোক তাহলে।"




"আর হ্যাঁ, সেদিন আপনার মেয়ের জন্য বার্থডে কেকটা কোথা থেকে যেন অর্ডার করা হয়েছিলো ?"




"এই তো, কাছেই - ড্রিমল্যান্ড কনফেকশনারিজ। বেশ বড়ো দোকান, ওদের হোম ডেলিভারি আছে। ফোনেও অর্ডার নেয়।"




"আপনারা প্রায়ই ওখান থেকে অর্ডার করেন কি ?"




"হ্যাঁ, তা তো করাই হয়। কেন বলুন তো ?"




"কারণ আছে। আপনি অ্যালিস্টারকে বলবেন ওখানেই আবার একটা বার্থডে কেক অর্ডার করে রাখতে। রবিবার সাতটার সময়েই ডেলিভারি দিতে বলবেন।"




"তাই হবে। কিন্তু একটা প্রশ্ন আছে মিস্টার মিত্র। খুনটা কি সত্যিই আমার ওই সিগারেট কেসের জন্য হয়েছিলো ?"




"পরশুদিন সবকিছুই জানতে পারবেন। তবে একটা কথা আমি আপনাকে এখনই কনফার্ম করতে পারি। আপনার অনুমান একদম নির্ভুল। খুনের টার্গেট বাচ্চা মেয়েটা সত্যিই ছিলো না। ওটা অ্যাক্সিডেন্টালি হয়ে যায়। টার্গেট অন্য কেউ ছিলো।"



পর্ব ৭




এই অঞ্চলে আমরা এর আগে দু'বার এসেছি, দু'বারই সন্ধ্যের পর। আজ দিনের বেলায় আসার ফলে চারপাশের পরিবেশটা ভালো করে দেখা যাচ্ছিলো।




ডিসুজা সাহেবের বাড়ি থেকে বেরিয়ে মোবাইলে রাস্তার ম্যাপটা খুললো জটাদা। আমি বললাম, "তুমি কি সব রহস্যের সমাধান করে ফেলেছো নাকি ইতিমধ্যেই ?"




"না।" সংক্ষিপ্ত উত্তর পেলাম।




"তাহলে ? মানে আমি বলতে চাইছি, তুমি তো ডিসুজাকে মিটিং ডাকতেই বলে দিলে একরকম। কিন্তু পরশুদিনের মধ্যে যদি সব জট ছাড়ানো সম্ভব না হয় ?"




জটাদা দেখলাম আজকে নতুন একটা রাস্তা ধরলো। পার্কস্ট্রিটের দিকে না গিয়ে আমরা উল্টোদিকে যাচ্ছি। যেতে যেতেই জবাব দিলো জটাদা, "বাবার সাথে তুলনা করলেন মিস্টার ডিসুজা। ঝট করে তাই চ্যালেঞ্জটা নিয়েই ফেললাম। হয় পরশু দিনের মধ্যে রহস্যের সমাধান হবে, নয়তো গোয়েন্দাগিরিতে ইতি টেনে রেল কিংবা ব্যাংকের কোনো চাকরির পরীক্ষায় বসে যাবো।"




"মানে ফেলুদা ভার্সেস জটাদা এবার ?" আমি মজা করে বললাম।




"ঈঈঈঈ- তাহলে তোমার মার্ডার হয়ে যাবে আমার হাতে।" পিঙ্কি চেঁচিয়ে বললো জটাদাকে, "তুমি গোয়েন্দাগিরি ছেড়ে দিলে আমাদের অ্যাডভেঞ্চারের কী হবে ? ধ্যাৎ, ওসব চলবে না। একদম চলবে না। তুমি ঠিক সব সল্ভ করে ফেলবে, আমি জানি।"




আমি জিজ্ঞাসা করলাম, "আচ্ছা আমরা যাচ্ছি কোথায় সেটা বলবে ? ফেরার রাস্তাটা এদিকে তো নয়।"




"আমরা যাচ্ছি ড্রিমল্যান্ড কনফেকশনারিজ। সামনের গলিটা পেরিয়ে ডানহাতে গেলেই দোকানটা পড়ার কথা।" জটাদা বললো। তখন আমি বুঝলাম কেন ম্যাপটা দেখছিলো ও।




হিসেবমতো পেয়েও গেলাম আমরা দোকানটা। দোকানের নামের মতোই দোকানটা বেশ বড়ো আর সাজানো-গোছানো। বেশ কাটতি আছে বোঝাই যায়। জটাদা সোজা গিয়ে ক্যাশ কাউন্টারে নিজের কার্ডটা দিলো।




"প্রজ্জ্বল মিত্র। প্রাইভেট ইনভেস্টিগেটর। কয়েকদিন আগে এখান থেকে কেক নিয়ে গিয়ে সেই কেক খেয়ে একটা বাচ্চা মারা গেছে। আপনি জানেন ?"




ভদ্রলোক সম্ভবত ম্যানেজার গোছের কেউ হবেন। তিনি কেসটা সম্বন্ধে জানেন বোঝা গেলো। বললেন, "পুলিশ তো এসেছিলো। আমাদের সঙ্গে কথাও বলে গেছে একবার। এখন আবার কেন ? আর কেক খেয়ে মারা গেছে আপনাকে কে বললো ?"




"আপনি জানেন কিনা জানি না। গতকাল ফরেনসিক টেষ্টে কেকের স্যাম্পেল থেকে পয়জন পাওয়া গেছে।" দেখলাম বেমালুম একটা মিথ্যে কথা বলে দিলো জটাদা। তাতে অবশ্য কাজও হলো। ভদ্রলোক একটু উৎকণ্ঠিত হলেন শুনে। বললেন, "আমাদের কেক থেকে ?"




"ফরেনসিক তো তাই বলছে। সেটা আপনারাই মিশিয়ে থাকুন বা অন্য কেউ। পুলিশ কেস ফাইল তৈরী করছে। এখন এই দোকান সিল হতে হয়তো বেশি বাকি নেই। অর্ডার এসে যাবে আজকালের মধ্যে।"




"দাঁড়ান, দাঁড়ান, আপনি বরং আমাদের মালিকের সঙ্গেই কথা বলে নিন। আমি ফোন করে দিচ্ছি।"




দোকানের মালিক এলে জটাদা তাকে যথাসম্ভব সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিয়ে দু'টো ছেলের নাম আর ফোন নাম্বার নিয়ে নিলো। এই ছেলে দু'টোই ডেলিভারি দেয় বাড়ি বাড়ি। সব শেষ করে আমরা দুপুর আড়াইটে নাগাদ বাড়ি ফিরলাম।




খাওয়া-দাওয়ার শেষে জটাদা দেখলাম কালীপ্রসন্ন মিত্র মজুমদারের লেখা 'উত্তর কলকাতার বনেদীয়ানা' নামে বড়ো একটা বই নিয়ে তার পাতা ওলটাতে শুরু করলো। বইটা মনে হয় সেদিন ন্যাশনাল লাইব্রেরি থেকে নিয়ে এসেছে। পিঙ্কি গেছে ওর ক্যারাটে ক্লাসে। নতুন ভর্তি হয়েছে ক্যারাটেতে। মাঝে মাঝেই পিঙ্কির একটা করে নতুন শখ চাপে, আর সেটাতে ভর্তি হয়। ওর বাবা ইনকাম ট্যাক্সের বড়ো অফিসার। অগাধ টাকা-পয়সা। যাইহোক, আমি এই সুযোগে লেপ মুড়ি দিয়ে বেশ একটু ঘুমিয়ে নিলাম। ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখলাম, প্রোমোটার বিজয় পোদ্দারের বার্থডে পার্টি হচ্ছে ঘটা করে। আমরা নিমন্ত্রিত হয়ে গেছি সেই পার্টিতে। পিঙ্কি একটা কেক কাটছে বিজয় পোদ্দারের নামে। আর অ্যালিস্টার একটা ছোট্ট কাঠের শৌখিন বাক্স থেকে মাথা বার করে বলছে, এইসব কেকের দাম মাত্র চার হাজার কি পাঁচ হাজার টাকা হবে।




সন্ধ্যেবেলা পিঙ্কির চিৎকারে ঘুম ভাঙলো। উঠে দেখি কখন অন্ধকার হয়ে গেছে। অবেলায় ঘুমানোর জন্য মাথাটা ভার করে ছিলো। জটাদা তখনো টেবিলে বসে বইয়ের পাতায় নিমগ্ন। শুধু টেবিল ল্যাম্পটা জ্বেলে নিয়েছে।




ঘরে পা দিয়েই পিঙ্কি বললো, "এই যে জটাদা, নাও - তোমার ফ্যান ফলোয়ার্স আরেকটা বেড়ে গেলো। মারিয়া তোমাকে স্টক করছে। তোমাকে ফলো করছে, তোমার অনেক পুরোনো একটা পোস্টে লাইক মেরেছে দেখলাম।"




জটাদা বইয়ের পাতা থেকে মুখ তুলে কেমন যেন অন্যমনস্কভাবে তাকালো পিঙ্কির দিকে। পিঙ্কির কথাটা আদৌ শুনেছে কিনা বোঝা গেলো না। এক মুহূর্ত ওর দিকে তাকিয়ে থেকে বললো, "জগৎচন্দ্র রাই এর ছেলে মহানন্দ রাই। নাম শুনেছিস ?"




"না।" হতভম্ব পিঙ্কি উত্তর দিলো।




"মহানন্দ রাইয়ের প্রপৌত্র হলো দুর্গানাথ। আর তার ছেলে দেবেন্দ্রনাথ রাই। এরাই হলো কুঞ্জঘাটার রাজপরিবারের বংশধর। আজ থেকে প্রায় একশো বছর আগে এই পরিবারের কলকাতায় পাকাপাকিভাবে বসবাস শুরু হয়। বুঝলি ? ভীষণ ইন্টারেস্টিং। এই দেবেন্দ্রনাথ ম্যাজিস্ট্রেট পদে ছিলেন। কলকাতায় থাকাকালীন তাঁর বাড়িতে একবার বড়োসড়ো একটা চুরির ঘটনা ঘটে।"




"এক সেকেন্ড। এগুলো সব ওই বইটাতে লেখা রয়েছে ?" হাই তুলতে তুলতে জিজ্ঞাসা করলাম আমি।




"সব এখানে নেই। কিছু এখানে আছে। কিছু আমি অন্য জায়গায় পেয়েছি।"




"ওই যে কোন একটা রাজপরিবার না কী বললে, যেখানে চুরির ঘটনা ঘটেছিলো - সেই সময়েই কি চুরি যায় কাঠের ওই সিগারেট কেস, আর হাত ফেরত হয়ে ডিসুজা ফ্যামিলিতে আসে ?"




"সম্ভবত তাই। দাঁড়া তোদের দেখাই বাক্সটা।"




জটাদা কথাটা শেষ করতে না-করতেই ড্রয়ার খুলে একটা কাঠের সুদৃশ্য বাক্স বের করলো। আমরা তো দেখে অবাক। এটা কোথায় পেলো ও ? পুরো বাক্সের গা-জুড়ে কী সুন্দর নকশা কাটা। ছবিতে যেমন ছিলো, ঠিক তেমনি। কিন্তু আরো উজ্জ্বল, আরো অপূর্ব দেখতে।




"এটা কি অরিজিনালটাই ?"




"হ্যাঁ। একদম অরিজিনাল। পালিশটা এতোদিনে একটু নষ্ট হয়ে গেলেও, দুশো বছরের ধাক্কা ভালোই সামলিয়েছে কাঠটা।"




আমি আর পিঙ্কি পাল্টাপাল্টি করে বাক্সটা নিয়ে খুলে দেখলাম। একসাথে চোদ্দ-পনেরোটা সিগারেট আরামসে রাখা যাবে এতে। এতোদিনের পুরোনো একটা জিনিষ হাতে ধরছি, ভাবতেই কেমন শিহরণ লাগছিলো।




"তুমি এটা পেয়ে গেছো, জানিয়েছো ডিসুজাকে ?"




"না।" জটাদা বললো, "সব রহস্যের উন্মোচন হবে রোববার। তার আগে আমার আর একটু কাজ বাকি আছে।"




"শুধু এই বাক্সটার জন্য নিশ্চয়ই খুন করবে না কেউ।" আমি সন্দেহ প্রকাশ করলাম। "খুনের কেসটা তাহলে হয়তো আলাদা, কী বলো ?"




জটাদা বললো, "খুব সাধারণ বাক্স এটা নয় ঋভু। বাক্সের ভিতরে যে কাঠের পাটাতনটা আছে, সেটাকে চাপ দিয়ে দ্যাখ, বাক্সের নিচের অংশটা আলাদা করে ফেলা যায়।"




"তাই নাকি ?" আমি একটু চেষ্টা করতেই দেখলাম জটাদা ঠিকই বলেছে। বাক্সের নিচের অংশটা খুলে এলো।




পিঙ্কিও তারপর হাতে নিয়ে জিনিষটা ভালো করে দেখলো। বললো, "অদ্ভুত তো। সিগারেটের জন্য এরকম বাক্স কেউ কেন বানাবে ? এটা তার মানে সাধারণ কোনো সিগারেট কেসই নয়।"




কী মনে হতে আমি বললাম, "এটা সিগারেট কেসই। কিন্তু তার সাথে লাগানো একটা ছোট্ট জায়গা। এর মধ্যে সোনা বা হীরের মতো কিছু লুকিয়ে রাখা যায়। সেরকম কিছু লুকিয়ে রাখা ছিলো হয়তো।"




"একদম কারেক্ট।" জটাদা উৎফুল্ল হয়ে বললো, "কোনো জিনিষ লুকিয়ে রাখার পক্ষে এটা দারুণ একটা জায়গা। কেউ সন্দেহই করবে না যে এর মধ্যে অন্য কিছু আছে। বুঝলি পিঙ্কি, এখন আমাদের ফোনে যেমন প্যাটার্ন লক থাকে, পাসওয়ার্ড দেওয়া থাকে, এইটা হলো তখনকার দিনের ওই পাসওয়ার্ড। কোনো মূল্যবান জিনিষ এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় নিয়ে যাবার জন্য একদম আদর্শ। ধর যদি চুরি-ডাকাতি হয়ে জিনিষটা অন্য কারুর কাছে যায়, তবুও সে জানতে পারবে না কী লুকানো আছে।"




"কোথায় খুঁজে পেলে এটাকে ?" আমি জানতে চাইলাম।




"ওই একটু তস্করবৃত্তির সাহায্য নিতে হয়েছে আরকি। চোরের উপর বাটপারি।" জটাদা ইঙ্গিতপূর্ণ একটা হাসি দিয়ে বললো, "যেখানে দেখিবে ছাই, উড়াইয়া দেখো তাই, পাইলেও পাইতে পারো -।"




"- অমূল্যরতন।" বাকিটা আমি জটাদার সঙ্গে একসুরে বললাম।




পিঙ্কি জিজ্ঞাসা করলো, "আচ্ছা, তুমি কি এটাকে খালি অবস্থাতেই পেয়েছো নাকি কিছু ছিলো এর ভিতরে ?"




"কিছু নিশ্চয়ই ছিলো। কিন্তু আমি যতক্ষণে খুঁজে পেয়েছি, ততক্ষণে জিনিষটা সরিয়ে ফেলা হয়েছে।"




"উফ্ফ সাংঘাতিক ব্যাপার তো!" বাক্সটা জটাদার হাতে ফিরিয়ে দিলো পিঙ্কি।




"কিন্তু কী ছিলো ? দু'শো বছর আগের একটা বাক্সে... কী থাকতে পারে... সেটাই ভাবতে হবে। আর সেটা এখন কোথায় আছে, সেটাও তো রহস্য।" জটাদা দেখলাম চেয়ারে বসে আবার গভীর চিন্তায় ডুবে গেলো।




"তুমি ভাবো তাহলে।" পিঙ্কি খাটে উঠে এসে বসলো। আমাকে বললো, "কী করলি রে বিকেলবেলা ? পড়ে পড়ে শুধু ঘুমালি ?"




"আরে ঘুমের মধ্যে এমন বিদঘুটে স্বপ্ন দেখছিলাম যে কী বলবো। তুই ক্যারাটে থেকে ফিরে কী করলি বল, পড়তে বসেছিলিস ?"




"ধুর। পরীক্ষার আগে পড়বো, এখন কেন ? আমি একটা ক্যালিগ্রাফি করেছি, দেখবি ?"




"ওই নকশা করে নাম লেখা তো। কই দেখা। ফরওয়ার্ড কর।"




"দেখে প্রশংসা করবি। নাহলে এই তিনতলা থেকে ছুঁড়ে তোকে নিচে ফেলে দেব। আর প্রশংসা করলে তোর নাম দিয়েও একটা করবো এটার পরে।" ছবিটা আমাকে পাঠিয়ে দিয়ে বললো পিঙ্কি।




আমি দেখলাম। বেশ সুন্দর করেছে। ওর ভালো নাম প্রিয়াঙ্কা। সেটাই ইংরাজীতে সুন্দর করে লিখেছে। নামের ইংরাজী অক্ষরগুলো সবই যেন কোনো নৃত্যরতা নারীর আদলে আঁকা। আবার দুটো 'a' অক্ষর যেন দুটো ঘুঙুরের মতো করে সাজিয়ে রাখা আছে। 'n' অক্ষরটা দেখতে অনেকটা তবলার মতো। আর 'i' এর মাথায় ফুটকির জায়গায় একটা ছোট্ট লাল গোলাপ বসানো। খুবই আকর্ষণীয় কাজ। হাতের কাজগুলো ভালোই পারে মেয়েটা। খুব সুন্দর আলপনাও দিতে পারে পিঙ্কি।




জটাদা ব্যস্ত জানি। তবু আমি ওকে ডেকে বললাম, "এক সেকেন্ড দ্যাখো জটাদা, কেমন সুন্দর ক্যালিগ্রাফি বানিয়েছে।"




জটাদা দূর থেকে ডিজাইনটা একবার দেখেই মুখ নামিয়ে নিলো। তারপর হঠাৎ উঠে এসে আমার হাত থেকে মোবাইলটা নিলো। নিয়ে ভালো করে আবার দেখলো। তখনই অদ্ভুত একটা খুশির ঝলক দেখলাম ওর মুখে। ছবিটা দেখতে দেখতে পিঙ্কিকে বললো, "তুই ভীষণ উপকার করলি রে পিঙ্কি।"




"কেন, কী করলাম আমি ?"




জটাদা অতঃপর ব্যাখ্যা করলো। যদিও তার অর্থটা আমাদের কাছে যথারীতি অধরাই রয়ে গেলো। বললো, "ব্যাপারটা আমার মাথাতে কিছুতেই আসছিলো না। বুঝতে পারছিলাম ছকটা। কিন্তু ঠিক ধরতে পারছিলাম না। এখন তোর ক্যালিগ্রাফি দেখে পুরো ছবিটা একদম ক্লিয়ার হয়ে গেলো। এইবারের কেসটা তোর দৌলতেই উৎরে গেলো মনে হচ্ছে।"




জটাদার কথায় পিঙ্কি হতভম্ব হয়ে গেলো। বললো, "সল্ভ করে ফেললে তুমি এইটা দেখে ?"




সেকথার সরাসরি কোনো উত্তর না দিয়ে জটাদা হাতের দু'টো চেটো ঘষতে ঘষতে আনন্দে ছড়া কাটলো, "যতই পাকাও না তুমি জট, জটাদার কাছে সব জটই নটঘট। পার্কস্ট্রিটের রহস্য এইবারে সমাপ্ত।" তারপর আমাকে বললো, " ঋভু, চা বল তো একটা করে। খোকনদাকে বল বেশ কড়া করে তিন কাপ চা পাঠাতে।"




আমরা তো কিছুই বুঝলাম না, ক্যালিগ্রাফি থেকে কী খুঁজে পেলো জটাদা। কিন্তু এখন জটাদাকে প্রশ্ন করাটা বৃথা জানি। সেই রোববারের আগে কিছুই সে বলবে না।



 পর্ব ৮




শনিবার দিনটা জটাদা বাইরে বাইরেই কাটালো প্রায়। আর আমি একটা সুদোকু নিয়ে সারাদিন ধরে লড়ে গেলাম। এমনকি পিঙ্কির কলও রিসিভ করিনি যতক্ষণ না পুরো সুদোকুটা সল্ভ হয়েছে। বিকেলের দিকে জটাদা ফিরলো এবং আবার বইয়ের পাতায় ডুবে গেলো। আগামীকালের প্রস্তুতি হয়তো। কেন জানি না, আমার মন বলছিলো সবকটা সূত্র এখনো হয়তো ঠিক ঠিক সমাধান হয়নি। আর আমি মনেপ্রাণে চাইছিলাম যাতে সমাধান পাওয়া যায়। তাই ওকে একবারও বিরক্ত করলাম না।




রবিবার সন্ধ্যেবেলা আমরা পৌঁছে গেলাম ডিসুজাদের বাড়ি। ঘড়িতে ঠিক তখন সাতটা বাজে। মিসেস ডিসুজা আমাদের দরজা খুলে দিলেন। দরজার বাইরেই অনেকগুলো জুতো দেখেছিলাম। ঘরে ঢুকে দেখলাম ঘরে প্রায় সবাই উপস্থিত।




"আসুন মিস্টার মিত্র। আপনার অপেক্ষাতেই আছি সবাই।" সাদরে আমাদের অভ্যর্থনা জানালেন ডিসুজা সাহেব। তিনি অ্যালিস্টারের সাথে সোফার একদিকে বসে ছিলেন। সোফার অন্যদিকে বসেছেন সুদর্শনবাবু আর নিচের তলার সনৎবাবু।




"বাহ্, আপনারা সবাই এসে পড়েছেন দেখছি। খুব ভালো।" সোফায় বসতে বসতে জটাদা বললো। আমরা তিনজন মাঝের সোফাটাতে গিয়ে বসলাম। ঘরে শুধু মারিয়াকে দেখতে পেলাম না। আমরা গিয়ে বসতেই ডিসুজা সাহেব মেয়েকে ডাকলেন ভিতরের ঘর থেকে।




সুদর্শনবাবু একটু উঠে জটাদার সঙ্গে করমর্দন করলেন। বললেন, "আমার তো আজই আবার ধানবাদের জন্য বেরিয়ে যাবার কথা ছিলো। আজ এখানে তো কাল সেখানে পাঠায় অফিস থেকে, কী বলবো - ঘুরিয়ে মারে আরকি। বিকেলের ব্ল্যাক ডায়মন্ডে যাবার কথা। কিন্তু সেদিন আপনার সঙ্গে আলাপ হয়ে এতো ভালো লাগবো, আর এখানের ব্যাপারগুলো সম্বন্ধে জানাও দরকার।"




"সেকি ? আপনার তো তাহলে ট্রেনের টিকিটটা নষ্ট হলো।" জটাদা বললো।




"সে অফিস বুঝবে। আমার কী। রাত্রের মুম্বাই মেলটা ধরে নেবো। আমি একদম রেডি হয়েই নেমেছি। এখান থেকে সোজা হাওড়া। ন'টার মধ্যে বেরোলে ধরে নিতে পারবো।"




সনৎবাবুকে দেখলাম সেইরকমই শুকনো মুখ-চোখ। শোকটা এখনো হয়তো পুরোপুরি কাটিয়ে উঠতে পারেননি। ইতিমধ্যে মারিয়া এসে একটা চেয়ারে বসলো। মিসেস ডিসুজা মেয়ের কাছেই একটা টুলে বসলেন। সবার চোখ, বলাই বাহুল্য, জটাদার উপরেই নিবদ্ধ। আমার আর পিঙ্কির মনের অবস্থাও একইরকম। অর্থাৎ অনেক প্রশ্ন তখন মনের মধ্যে। এবং তাদের উত্তর জানবার অপেক্ষা।




জটাদা সবার দিকে একবার তাকিয়ে নিয়ে কথা শুরু করলো, "মিস্টার ডিসুজার অনুরোধে আপনারা সবাই আজ এখানে উপস্থিত হয়েছেন। তার জন্য আপনাদের প্রত্যেককে অনেক ধন্যবাদ জানাই। আমাদের আলোচ্য বিভিন্ন মানুষের মধ্যে প্রোমোটার বিজয় পোদ্দার বর্তমানে এই ঘরে নেই। কিন্তু তার খুব একটা দরকারও নেই। আমি ওনার সঙ্গে আলাপ করে যতটা বুঝেছি, উনি নিজে কোনো ব্যাপারে হাত কলুষিত করেন না। ওনার লোক আছে। গুন্ডাবাহিনী আছে হয়তো। প্রয়োজনমতো তারা যেকোনো দুষ্কর্মই করতে পারে। কিন্তু তার সেইসব গুন্ডারা সূক্ষ্ম কোনো শৈল্পিক কাজের ধার ধারবে বলে মনে হয় না। ছুরি-বন্দুক-বোমাই হলো তাদের প্রথমতম পছন্দের অস্ত্র। অতএব, এই খুনের ব্যাপারে, মানে পিউর মৃত্যটাকে আমি খুন বলেই সাব্যস্ত করছি - সেই ব্যাপারে বিজয় পোদ্দারের যুক্ত থাকার সম্ভাবনা কম। ওনার সাথে দেখা করার পরেই তাই আমি ওনাকে সন্দেহের লিষ্ট থেকে সরিয়ে দিই। এই ব্যাপারে আমরা পরে আরো বিশদ আলোচনায় আসবো। আগে সেদিনের ঘটনার একটু পর্যালোচনা করা যাক।"




এরপর জটাদা সনৎবাবুর উদ্দেশ্যে বললো, "আমার খুব খারাপ লাগছে যে আমরা শত চেষ্টা করেও যে বাচ্চাটা মারা গেছে, তাকে ফিরিয়ে আনতে পারবো না। সেটা আমার সাধ্যের বাইরে। কিন্তু অন্তত তার মৃত্যুটা কীভাবে হলো, কেনই বা হলো - সেটা জানাটা আমাদের কর্তব্য। আমি সেই কাজটুকুনিই আজ করবো সনৎবাবু।"




একটু থেমে জটাদা আবার বললো, "সেদিন ঠিক কী কী ঘটেছিলো, বা কোথায় কী হয়েছিলো, তা আমি ছাড়া এই ঘরে উপস্থিত আরেকজন ব্যক্তিও জানেন। হয়তো আমার চেয়ে একটু বেশিই ভালো জানেন। তার পরিচয় আমরা একটু পরে জানবো। যাইহোক, আমি আমার মতো করে ঘটনাগুলো বলার চেষ্টা করছি।"




ঘরের মধ্যে তখন অদ্ভুত এক নীরবতা। অ্যালিস্টার এতক্ষণ ঝুঁকে বসে জটাদার কথা শুনছিলো। এখন দেখলাম সোফার উপর হেলান দিয়ে দু'টো হাত মাথার পিছনে রেখে বসলো।




"ঘটনার দিন, অর্থাৎ গত ২৫শে ডিসেম্বর, আপনারা প্রত্যেকেই এখানে উপস্থিত ছিলেন। একমাত্র সুদর্শনবাবু, আপনি সেদিন এখানে ছিলেন না।"




"হ্যাঁ, আমি তখন দিল্লিতে। ফিরে এসে শুনলাম এসব কথা।"




জটাদা বলতে থাকলো। "সেদিন মিস মারিয়ার জন্মদিন উপলক্ষ্যে একটা কেক আনানো হলো। কোল্ড ড্রিঙ্কস এবং চিকেনের স্টার্টার ছিলো। কেক কাটা হলো। খানাপিনা গান-বাজনা চলছিলো। তারপরেই হঠাৎ পিউ অসুস্থ হয়ে পড়ে। পরে জানা যায়, ইট ওয়াজ আ কেস অফ পয়জনিং।"




"রাইট মিস্টার মিত্র।" ডিসুজা সাহেব যোগ করলেন।




"এই কেসের সমাধান করতে নেমে, সবচেয়ে বেশি আমাকে ভাবিয়েছে দু'টি বিষয়। এক, খাবারে বিষ মেশানোর পদ্ধতি। আর দু'ই হলো, পিউকে টার্গেট করার কারণ। ফরেনসিক রিপোর্ট অনুযায়ী, কোনো খাবারে বিষ পাওয়া যায়নি। তাহলে বিষ এলো কীভাবে ? কখন, কীভাবে এবং কীসে মিশিয়ে দেওয়া হলো বিষ ? এইটাই সমাধান করা যাচ্ছিলো না। এবং আমার বলতে দ্বিধা নেই, যে এই কাজ করেছে, তার মাথা ভীষণই তুখোড়। সে এমন পদ্ধতি অবলম্বন করেছে যে খাবারে বিষ মেশানো সত্ত্বেও তা ফরেনসিক রিপোর্টে ধরা পড়েনি। এখানে একটা কথা বলে রাখা ভালো, আমি হয়তো এই বিষ মেশানোর রহস্যের সমাধান করতেই পারতাম না যদি না আমার এই ক্ষুদে সহকারীটি আমার সঙ্গে থাকতো। এর নাম প্রিয়াঙ্কা। ওর দেখানো পথেই আমি শেষ পর্যন্ত এই রহস্যের সমাধান খুঁজে পাই।"




জটাদার এই কথা শুনে সবার চোখ চলে গেলো পিঙ্কির উপর। আর সে তো লজ্জা-লজ্জা ভাব করে বসে রইলো। কী বা করবে বেচারা। সে নিজেও তো জানে না, আর আমিও জানি না যে সে কীভাবে সমাধানে সাহায্য করলো। কিন্তু জটাদা নিজেই একটু পরে সব খোলসা করে দিলো।




ইতিমধ্যে একবার ডোরবেল বাজতে শোনা গেলো। অ্যালিস্টার উঠে দেখতে গেলো কে এসেছে। তারপর একটা বড়োসড়ো কেকের বাক্স নিয়ে ভিতরে এলো। বোঝা গেলো যে দোকান থেকে অর্ডারমতো কেকের ডেলিভারিটা দিয়ে গেলো। জটাদার অনুরোধে অ্যালিস্টার কেকের বাক্সটা সেন্টার টেবিলের উপর রেখে সবার সামনে সেটাকে খুললো। ভিতরে সুন্দর একটা চকোলেট কেক দেখা গেলো। উপরে মারিয়ার নাম লেখা আছে।




জটাদা বলতে লাগলো। "দেখতে খুব নিরীহ একটা কেক। কিন্তু বিষ দেওয়া হয়েছিলো এই কেকের ভিতরেই। আপনাদের হয়তো মনে হতেই পারে যে সেই কেক খেয়ে অন্য কেউ তো অসুস্থ হয়নি। এমনকি ফরেনসিক রিপোর্টেও বলছে কেকের স্যাম্পেলে কোনো বিষ ছিলো না। তাহলে ? ঠিক এই প্রশ্নটারই আমি উত্তর পাচ্ছিলাম না। কেকের প্রতি আমার সন্দেহ গাঢ় হয় যখন জানতে পারি যে অনুষ্ঠানের বেশ কয়েকদিন আগেই কেকের অর্ডার দেওয়া হয়ে গিয়েছিলো। অর্থাৎ আততায়ীর সুযোগ ছিলো কেকের ব্যাপারে কোনো প্ল্যান করার। সেই সময়টা ছিলো। কিন্তু কেকে বিষ দেওয়া হলো তো ফরেনসিকে ধরা পড়লো না কেন ? কারণ কেকের স্যাম্পেলে কোনো বিষ ছিলো না। বিষ শুধুই ছিলো পিউ যে টুকরোটা খেয়েছিলো, সেটাতে। কীভাবে ? বলছি সেটা। কেকের দোকান থেকেও কোনো বিষ দেওয়া হয়নি। সেটা সম্ভবও ছিলো না। বিষ দেওয়া হয়েছে কেক দোকান থেকে বের হয়ে যাবার পর, এবং এখানে এসে পৌঁছনোর আগে। ইঞ্জেকশান করে তাতে সায়ানাইড পুশ করা হয়েছিলো বলেই আমার ধারণা। আপনার নিশ্চয়ই মনে আছে মিস্টার ডিসুজা যে, কেকটা আসতে কিছুটা দেরী হয়েছিলো সেদিন। দেরীর কারণ কিন্তু যানজট নয়। ড্রিমল্যান্ড কনফেকশনারিজ এখান থেকে খুব বেশি দূরে নয়। আর বাইকে করে গলি ধরে এলে কোনো যানজটের মুখে পড়ার কথাও নয়। দেরী হয়েছিলো কারণ কেকটা এখানে এসে পৌঁছোবার আগে অন্য জায়গায় গিয়েছিলো।"




"মাই গুডনেস!" বিস্ময়ে বলে উঠলেন মিস্টার ডিসুজা।




"কাকতালীয়ভাবে দু'দিন আগে আমার এই সহকারী, মানে প্রিয়াঙ্কা, ওর নামের একটা ক্যালিগ্রাফি আমাদেরকে দেখায়। সুন্দর নকশা করে লেখা নাম। যেমনটা আমরা কেকের উপর লেখা দেখতে পাই। এই কেকটার উপরে যেমন রয়েছে। ভালো করে লক্ষ্য করে দেখুন, মিস মারিয়ার নামের মধ্যে i অক্ষরের উপর ডট বা বিন্দুর জায়গায় সুন্দর করে একটা চেরি ফল বসানো। সেদিনের কেকটাও এই একরকমই ছিলো তো ?"




"একদম এই ডিজাইনটাই ছিলো। বোধহয় একই লোক বানিয়েছে।" মিসেস ডিসুজা বললেন।




"আর এইরকম একটা চেরি ফল ছিলো তাতে ?"




"হ্যাঁ।" জবাব দিলো মারিয়া। "আমি ওই পিসটা মনে হয় পিউকে দিয়েছিলাম। ওহ গড!" দু'হাতে নিজের মাথাটা চেপে ধরে বসলো মারিয়া।




তার দিকে ফিরে জটাদা বললো, "আপনার রুমে সেদিন দেখেছিলাম একটা কাঁচের বয়ামে অনেকগুলো চেরি রাখা আছে। আগের বছর আপনার জন্মদিনের ভিডিওটাও আমি দেখেছি। আপনি চেরি খেতে খুব ভালোবাসেন, তাই না মিস মারিয়া ?"




মিসেস ডিসুজা উত্তর দিলেন, "হ্যাঁ - চেরি তো ওর খুব ফেভারিট।"




"গুড। আর এই তথ্যটা কিন্তু আততায়ীর জানা ছিলো। আততায়ীর উদ্দেশ্য ছিলো এখানে একটা মারাত্মক ঘটনা ঘটিয়ে বিশৃঙ্খলা তৈরী করা, যাতে সেই ফাঁকে তিনি এইটা হাতিয়ে নিয়ে যেতে পারেন। কেক খেয়ে মারিয়া বা অন্য যে কেউ অসুস্থ হয়ে পড়লেই ওনার উদ্দেশ্য সাধিত হতো। ঘটনাচক্রে পিউ তার শিকার হয়ে পড়ে।"




কথা শেষ করতে করতে জটাদা কাঁধের ব্যাগ থেকে সেই কাঠের বাক্সটা বার করে ডিসুজা সাহেবের দিকে এগিয়ে দিলো। বললো, "দেখুন তো, এটাই আপনাদের পারিবারিক সিগারেট কেসটা কিনা।"




ডিসুজা যারপরনাই অবাক হয়ে বললেন, "আরে বাহ্! আপনি তো সত্যি সত্যিই এটা উদ্ধার করে ফেলেছেন। চমৎকার। হ্যাঁ, এটাই সেই সিগারেট কেসটা। কিন্তু এটাকে আপনি পেলেন কোথায় ?"




জটাদা একটু হেসে উত্তর দিলো, "আপনাদের বাড়িতেই চরম অবহেলায় পড়ে ছিলো। আমি কুড়িয়ে নিয়েছি শুধু। আমাকে ক্ষমা করবেন মিস্টার ডিসুজা, সেদিন সনৎবাবু যে চোরের আসার কথা আপনাকে বলেছিলেন, সেই চোর আর কেউ নয়। এই প্রজ্জ্বল মিত্র। আমিই এসেছিলাম সেদিন ভোরবেলা। নিচের ওই ভাঙা ঘরটাতে ঢুকে সামনেই কয়েকটা ইঁটের পিছনে এটাকে পড়ে থাকতে দেখি।"




"এক সেকেন্ড।" এতক্ষণে আবার সোজা হয়ে বসলো অ্যালিস্টার। জিজ্ঞাসা করলো, "এই বাক্সটা হাতিয়ে নেবার জন্যই খুনের পরিকল্পনা করা হয়েছিলো, এই রাবিশ থিওরি আপনি দিচ্ছেন। আবার বলছেন এটা নাকি ওই ভাঙা ঘরে এমনি পড়ে ছিলো ? মানেটা কী ? তাহলে এটা হাতালো কেন কেউ ?"




জটাদা হয়তো এই প্রশ্নটারই অপেক্ষা করছিলো। সবার সামনে সে বাক্সটার নিচের পাটাতনে চাপ দিয়ে আলগা অংশটা খুলে ফেললো। বললো, "এটাকে দেখে যেমন খুব সাধারণ বাক্স বলেই মনে হয়, এটা আদতে তা কিন্তু নয়। এর মধ্যে একটা ছোট্ট গোপন কুঠুরি আছে। তাতে ছোট কোনো জিনিষ সহজেই লুকিয়ে রাখা যায়। খুব দামি কোনো জিনিষ এখানে লুকোনো ছিলো। এবং সেটার জন্যই এই খুন ও বাকি সবকিছু। জিনিষটা এখান থেকে সরিয়ে নেবার পর খালি বাক্সটা এমনি ফেলে দেওয়া হয়েছিলো।"




আবার সেই আগের মতোই নীরবতা ঘরে। সবাই বিস্ফারিত চোখে জটাদার হাতে ধরে রাখা খোলা বাক্সটাই দেখছিলো। মিস্টার ডিসুজা প্রথম নীরবতা ভঙ্গ করলেন, "ওখানে কী ছিলো সেটা আমরা জানতে পারি কি ?"




জটাদা সরাসরি এই প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে উঠে দাঁড়ালো। আর দু'টো হাত প্যান্টের পকেটে ঢুকিয়ে ঘরের মধ্যে পায়চারি করতে করতে বলতে লাগলো ইতিহাসের এক রোমাঞ্চকর কাহিনী।




"এই বাক্সের প্রকৃত রহস্য জানতে হলে আমাদের চলে যেতে হবে আড়াইশো বছর আগে। তখন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি পুরোদমে চেষ্টা করছে বণিকের মানদণ্ডকে এই দেশে রাজদণ্ডে পরিণত করার। ইংরেজদের সঙ্গে পলাশীর যুদ্ধে সিরাজউদ্দৌলার পরাজয় হয়, এবং মীরজাফরকে পুতুল হিসেবে বাংলার মসনদে বসায় ইংরেজ সরকার। এসবই ইতিহাসে আমরা পড়েছি। ইতিমধ্যে ইংরেজ শাসক ওয়ারেন হেস্টিংসের সঙ্গে ইগোর লড়াইতে জড়িয়ে পড়েন মহারাজা নন্দকুমার।




"নন্দকুমারের সাথে হেস্টিংসের ঝামেলার সূত্রপাত হয় মুন্নি বেগমের আমলে। মুন্নি বেগম ছিলেন মীরজাফরের দ্বিতীয় স্ত্রী। আদতে উত্তরপ্রদেশের বাঈজী বাড়ির মেয়ে মুন্নি অল্প বয়সে বিভিন্ন মজলিসে নাচ-গান করেই জীবিকা নির্বাহ করতেন। আসতে আসতে নিজের ক্ষমতায় উন্নতি করতে করতে একসময় মুর্শিদাবাদ রাজবাড়ীর বউ হিসেবে প্রবেশ করেন এবং মীরজাফরের মৃত্যুর পর তাঁর নাবালক ছেলেদের মসনদে বসিয়ে কার্যত রাজ্যপাট নিজেই দখল করেন। তখন এই নন্দকুমার তাঁর নিজের ছেলেকে মুন্নি বেগমের অধীনে প্রধান সচিবের পদে বসানোর জন্য ওয়ারেন হেস্টিংসকে ঘুষ দেন। ঘুষের পরিমাণ ছিলো সেই আমলের কয়েক লক্ষ টাকা। নন্দকুমারের সেই ছেলের নাম ছিলো গুরুদাস। এই অবধি সব ঠিকই ছিলো। কিন্তু সমস্যা হলো মুন্নি বেগমের সাথে তৎকালীন বিখ্যাত জমিদারনী রাণী ভবানীর সুসম্পর্ক ছিলো, আর এই রাণী ভবানীর সঙ্গে নন্দকুমারের ছিলো দীর্ঘকালীন শত্রুতা। সেখান থেকেই ক্রমশ ফাটল চওড়া হতে থাকে এবং নন্দকুমার একসময় হেস্টিংসের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ আনেন ইংরেজদের বড়কর্তাদের কাছে। প্রমাণস্বরূপ তিনি নিজেরই ঘুষের বৃত্তান্ত ও তার রশিদ দাখিল করেন, সঙ্গে অন্যান্য আরো কিছু ঘুষ নেবার অভিযোগ।




"কিন্তু ইংরেজ কর্তাদের অধীনে সেই কেসের কখনোই সুবিচার হয়নি। বিচারে বিশাল পক্ষপাতিত্ব করা হয় এবং নন্দকুমারকেই উল্টে দোষী সাব্যস্ত করা হয়। শেষ পর্যন্ত সতেরোশো পঁচাত্তর সালে ফাঁসির সাজা হয় মহারাজা নন্দকুমারের।




"এইখানে উল্লেখযোগ্য একটা কথা বলে রাখা ভালো। নন্দকুমার ছিলেন লর্ড ক্লাইভের বেশ পছন্দের পাত্র। ভারতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে প্রতিষ্ঠিত করে বিভিন্ন রাজ্যের প্রভাবশালী মহলের সাথে কৌশল খাটিয়ে এদেশে ইংরেজদের উপনিবেশ তৈরী করার স্থপতি ছিলেন এই লর্ড ক্লাইভ। তাঁকে এদেশে ইংরেজ শাসনের পথপ্রদর্শক বলা যায়। তিনি ওয়ারেন হেস্টিংসকেও খুব স্নেহ করতেন। সিরাজউদ্দৌলার আমলে হেস্টিংস যখন জেলে বন্দি হন, এই লর্ড ক্লাইভই ব্রিটিশ সৈন্য নিয়ে এসে তাঁকে উদ্ধার করেন। কিন্তু পরবর্তীকালে হেস্টিংসের কিছু কিছু দুর্নীতির কথা ক্লাইভের কানে আসে। তিনি তখন তার বিশ্বস্ত নন্দকুমারের হাত দিয়ে হেস্টিংসকে একটি চিঠি লেখেন। হয়তো হেস্টিংসকে তার দুর্নীতির ব্যাপারে সতর্ক করেই লিখেছিলেন তিনি। এই চিঠির কথা ইতিহাসে কিছু জায়গায় উল্লেখ থাকলেও, অরিজিনাল চিঠিটা কিন্তু পাওয়া যায়নি। এমনকি হেস্টিংস সেই চিঠিটা আদৌ কোনোদিন পেয়েছিলেন কিনা, সেটাও জানা যায় না। হতে পারে নন্দকুমার চিঠিটা হেস্টিংসকে দিয়েছিলেন। হতে পারে তিনি দেননি, হেস্টিংসের দুর্নীতির বিরুদ্ধে ওটাই চরম প্রমাণ হতে পারে কল্পনা করে তিনি সেটা নিজের কাছে হয়তো রেখে দিয়েছিলেন।




"যাইহোক, ৫ই অগাস্ট, সতেরোশো পঁচাত্তর সাল। নন্দকুমারের ফাঁসি হয়ে যায়। তখন তাঁর বয়স সত্তর বছর। ফাঁসির ঠিক কয়েক ঘন্টা আগে নন্দকুমার শেষবারের মতো একবার তাঁর জামাই জগৎচন্দ্র রাইয়ের সঙ্গে দেখা করেন। কিছু গোপনীয় জিনিষ তিনি জগৎচন্দ্রকে দিয়ে যান। ইতিহাসের পাতায় তার স্পষ্ট উল্লেখ নেই। কিন্তু অনেকেরই অনুমান, বিচার সংক্রান্ত কিছু গোপনীয় দলিল বা প্রমাণপত্রই হতে পারে সেই জিনিষ যা তিনি তাঁর ছেলেকেও বিশ্বাস করে দিয়ে যেতে পারেননি, দিয়ে গিয়েছিলেন তাঁর একমাত্র জামাইকে।




"ইংরেজ আদালতে বিচারের নামে যে প্রহসন চলছিলো, নন্দকুমার তা সম্যক উপলব্ধি করেছিলেন। এবং তিনি জানতেন যে এই গোপনীয় দলিল সামনে এলে ইংরেজ শাসক সেটাকেও অনায়াসে গিলে নেবে, তার কোনো দাম দেবে না। তাই তিনি সেটা তাঁর পরবর্তী প্রজন্মকে দিয়ে যেতে চেয়েছিলেন যাতে ভবিষ্যৎ সময় তার সঠিক মূল্যায়ন ও নিরপেক্ষ বিচার করে।"




জটাদা একটু থামলো। থেমে ফ্রিজের পাশে রাখা জলের বোতল থেকে দু'ঢোঁক জল খেয়ে নিলো। তারপর আবার বলতে শুরু করলো, "এর পরের কাহিনী সামান্যই। আর সেটা হুবহু জানাও এখন সম্ভব নয়। কিছু আমি পড়েছি, কিছু কল্পনায় মেলানোর চেষ্টা করেছি। নন্দকুমারের মৃত্যুর কিছুদিন পর তাঁর পুত্র অর্থাৎ গুরুদাসও মৃত্যুবরণ করেন। তিনি ছিলেন নিঃসন্তান। অতএব নন্দকুমার এবং গুরুদাসের সমস্ত সম্পত্তি ও জমিদারির মালিকানা বর্তায় নন্দকুমারের জামাই জগৎচন্দ্রের উপর। নন্দকুমারের কলকাতায় যে বসতবাড়ি ছিলো, অধুনা বিডন স্ট্রিটে, সেটিও জগৎচন্দ্রের অধিকারে আসে। জগৎচন্দ্র একটি কাঠের সুদৃশ্য সিগারেট কেস বানিয়েছিলেন। সেটি তিনি সর্বদা নিজের কাছে রাখতেন। সেই সিগারেট কেসটির একটি বিশেষত্ব ছিলো যে এটিতে একটি গোপন চেম্বার ছিলো এবং সেখানে কোনো জিনিষ লুকিয়ে রাখা যেত। আমার অনুমান ডিসুজা ফ্যামিলির সিগারেট বাক্সটিই ছিলো জগৎচন্দ্রের সেই সিগারেট কেস কারণ ইতিহাসের পাতায় সেই সিগারেট কেসের উল্লেখ থাকলেও, তার পরিণতি সম্বন্ধে কিছু জানা যায় না।




"জগৎচন্দ্রের মৃত্যুরও প্রায় একশো বছর বাদে তাঁর ফ্যামিলি যখন কলকাতায় পুরোপুরি সেটেল্ড, সেই সময় তাদের বাড়িতে একটা বড়সড় চুরি হয়ে যায়। কীভাবে সেই চুরি হয়েছিলো সেটা জানা না গেলেও, ওই অঞ্চলেই ডিসুজা পরিবারের আদিবাড়ি ছিলো এবং হাতফেরতা হয়ে সিগারেট কেসটা এসে পড়ে ডিসুজা ফ্যামিলিতে। তখন থেকেই সেটা ডিসুজা পরিবারের সম্পত্তি হয়ে রয়ে যায়। এবং এই এতো যুগ ধরে এটা অজানাই রয়ে যায় যে জগৎচন্দ্র সেই সিগারেট কেসটিতে কী লুকিয়ে রেখেছিলেন যা সম্ভবতঃ নন্দকুমার মৃত্যুর আগে জগৎচন্দ্রকে দিয়ে যান।"




জটাদা এসে আবার সোফায় আগের জায়গায় বসে পড়লো। বললো, "আমার বক্তব্যের অনেকটা অংশই প্রায় অনুমান। এই সিগারেট কেসটিই সেই সিগারেট কেস কিনা তার প্রমাণ তখনই পাওয়া যাবে যখন আমরা এর মধ্যে লুকিয়ে রাখা জিনিষটা পাবো।"




"সেটা কি আপনি পেয়েছেন ?" ডিসুজা সাহেব প্রশ্ন করলেন।




"না, পাইনি। এখনো পাইনি। কিন্তু আমি সম্ভবতঃ জানি জিনিষটা কোথায় থাকতে পারে।" তারপর জটাদা সুদর্শনবাবুর উদ্দেশ্যে বললেন, "আপনি এখান থেকেই একেবারে রাত্রের ট্রেন ধরবেন বলে স্যুটকেস নিয়ে রেডি হয়েই নেমেছেন, তাই না ?"




হঠাৎ এই প্রশ্ন কেন, সেটা সুদর্শনবাবুও বুঝলেন না মনে হলো। আমরাও বুঝলাম না। আমি দেখলাম সুদর্শনবাবুর পাশে একটা ব্রিফকেস দাঁড় করানো। বাইরে কোথাও গেলে তিনি ওটাই নিয়ে যান সম্ভবতঃ। তাই জটাদা এই প্রশ্নটা করেছে।




সুদর্শনবাবু উত্তর দিলেন, "হ্যাঁ, একেবারে স্যুটকেসটা গুছিয়ে নিয়েই নামলাম। ডিনারটা শুধু হাওড়া থেকে প্যাক করে নেবো। কিন্তু আপনি যা সব তথ্য দিলেন, একদম লোমহর্ষক মশাই!"




অ্যালিস্টার এই সময় প্রশ্ন করলো, "মিস্টার মিত্র, আপনি সেই ব্রিটিশ আমলের সাথে এই বাড়ির বা এই ফ্যামিলির লিঙ্কটা পেলেন কীভাবে ? পুরোটাই আপনার কল্পনা নাকি এর বাস্তব ভিত্তি কিছু আছে, সেটা বলবেন কি ?"




"আছে।" বললো জটাদা। ব্যাপারগুলো খুব স্পষ্ট করে কোথাও লেখা না থাকলেও ন্যাশনাল লাইব্রেরিতে বাংলার নবাবী আমলের বইপত্তর পড়ে বেশ কিছু তথ্য আমি পেয়েছি। সেখানে এই সিগারেট কেসটিরও উল্লেখ আছে কিছু জায়গায়। তখন ছবি তোলার ততো রেওয়াজ ছিলো না। কিন্তু বর্ণনা যেমনটি আছে, তার সাথে এই বাক্সের নকশা অনেকটাই মিলে যায়। আর এই মিলের কথা জানাটা এখানে সবচেয়ে সহজ ছিলো কার পক্ষে ? সনৎবাবু, আমি ন্যাশনাল লাইব্রেরিতে যোগাযোগ করে আপনার সম্বন্ধে খোঁজ নিয়ে জানতে পারি যে গত ছয় মাস যাবৎ আপনাকে নবাবী আমলের বেশ কিছু বইপত্র বাঁধাই ও রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিলো। সেটা কি সত্যি ?"




সচকিত হয়ে সবার সম্মিলিত কৌতূহল গিয়ে পড়ে সনৎবাবুর উপর। ভদ্রলোককে দেখে ভাবাই যায় না যে তিনি এতোকিছুর পরিকল্পনা করতে পারেন।




জটাদার প্রশ্নের উত্তরে সনৎবাবু একটু সম্মতিমূলক ঘাড় নাড়লেন শুধু। তারপর মাথা নিচু করে বসে রইলেন। ডিসুজা সাহেব একরাশ বিরক্তি ও বিস্ময় ঝরিয়ে বললেন, "সনৎবাবু... আপনি ?! আপনিই করলেন এটা ?"




"উতলা হবেন না।" জটাদা হাত তুলে ডিসুজাকে থামালো। "সনৎবাবু বাক্সটার ব্যাপারে পড়াশুনো করতে থাকেন কয়েক মাস ধরে এবং আমার মতোই ওনার মনে সন্দেহ দানা বাঁধে যে এই বাক্সে কিছু দামি জিনিষ হয়তো লুকানো আছে। বাক্সটার প্রতি ওনার আগ্রহ এবং লোভ বাড়তে থাকে। তিনি ওটাকে হস্তগত করার অভিপ্রায় পোষণ করতে শুরু করেন ঠিকই। কিন্তু খুনের পরিকল্পনা তিনি করেননি।




"ইঞ্জেকশান দিয়ে বিষটা ঢোকানো হয়েছিলো কেকের উপরে সাজিয়ে রাখা চেরি ফলটাতে। কেকের মধ্যে বিষ ছিলো না, এবং সেই কারণেই ফরেনসিক রিপোর্টেও কোনো বিষের অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। চেরিটা যদিও মারিয়ার নিজেরই খাবার সম্ভাবনা বেশি ছিলো, কিন্তু সেটা অন্য কারুর কাছেও যেতে পারতো। যদি সনৎবাবুই বিষের প্ল্যান করতেন, তিনি নিশ্চয়ই ওই পার্টিতে সেদিন নিজের মেয়েকে থাকতে দিতেন না বা অন্ততঃ তাকে এখানে একা রেখে নিচে স্ত্রীর কাছে মুহূর্তের জন্যেও চলে যেতে পারতেন না। খুনের পরিকল্পনা তিনি করেননি। তিনি শুধুই সুযোগমতো সিগারেট কেসটা নেবার কথা ভেবেছিলেন। খুনের পরিকল্পনা যার, তিনি সেদিন এই ঘরেই ছিলেন না। আর সেটাই তার মস্ত বড়ো অ্যালিবাই। কি আমি ঠিক বলছি তো সুদর্শনবাবু ?"




সবার চোখ এবার গিয়ে পড়লো নিপাট ভালোমানুষের মতো বসে থাকা সুদর্শন দত্তর উপর। তিনি ঘাবড়ে গিয়ে এদিক ওদিক সবাইকে দেখে বললেন, "সে কি, আমি কী করে জানবো - আপনি... আপনিই তো বলবেন। আমি থোড়াই কিছু জানি সেদিন কী হয়েছিলো।"




"ও হ্যাঁ, আপনি তো তখন এই শহরেই ছিলেন না। দিল্লি গিয়েছিলেন তার কয়েক দিন আগে।"




"হ্যাঁ।" হাঁফ ছেড়ে যেন বাঁচলেন সুদর্শনবাবু। কিন্তু সেটা ক্ষণিকের জন্যই।




জটাদা বললো, "এটাতে অবশ্য কিছু মিথ্যা নেই। আপনি সত্যিই ঘটনার কয়েক দিন আগে দিল্লি যান। আপনার কাছে নিশ্চয়ই নিজের নামে বুক করা সেই টিকিটটা আছে। হয়তো দিল্লির কোনো হোটেলের বিলও আছে যা আপনার কলকাতায় সেই সময় অনুপস্থিত থাকার জোরালো প্রমাণ হিসাবে কাজ করবে। কিন্তু সুদর্শনবাবু, আমার চোখকে ফাঁকি দেওয়া যে অতো সহজ কাজ নয়।




"সেদিন আপনি যখন দিল্লি থেকে ফিরলেন, বাইরে আপনার জুতো দেখেই আমার সন্দেহ হয়েছিলো। একজন মানুষ যিনি দিল্লি থেকে এতোটা রাস্তা সফর করে আসছেন, তার জুতো এতো চকচকে কীকরে থাকে ? পয়েন্ট নাম্বার ওয়ান। পয়েন্ট নাম্বার টু - আপনার জুতোর নিচে একটা কাগজের টুকরো লেগে ছিলো। এই যে - আমি সেটা কুড়িয়ে নিয়েছিলাম।"




জটাদা কথা বলতে বলতে বুকপকেট থেকে একটা কাগজের স্লিপ বার করে টেবিলের উপর রাখলো। "এটা দাস লন্ড্রির স্লিপ। স্লিপে ফোন নাম্বারও দেওয়া আছে। এই দাস লন্ড্রিটা এই রাস্তারই শেষ প্রান্তে, আপনারা হয়তো চেনেন।"




"হ্যাঁ, ওইদিকে একটা লন্ড্রি আছে তো। দাস লন্ড্রিই হবে মনে হয় নামটা।" মিসেস ডিসুজা সমর্থন করে জানালেন।




জটাদা সুদর্শনবাবুকে জিজ্ঞাসা করলো, "যে মানুষ দিল্লি থেকে ফিরছেন দশ-বারোদিন পরে, তার পায়ের জুতোয় কীকরে এখানের একটা লন্ড্রির স্লিপ আটকে থাকে সুদর্শনবাবু ?"




সুদর্শনবাবু এক মুহূর্ত থেমে তারপর শান্তস্বরেই বললেন, "আপনি কী বলছেন আমি কিন্তু বুঝতে পারছি না মিস্টার মিত্র। লন্ড্রির দোকানের স্লিপ সিঁড়িতেই কোথাও হয়তো পড়ে ছিলো। পায়ের তলায় একটা দোকানের স্লিপ পাওয়া গেছে বলে আপনি প্রমাণ করতে চাইছেন যে এইসব প্ল্যান আমার করা ? কোনো মানে আছে এইসব কথার ?"


"না, আমি আপনাকে শুধু এটাই বলছিলাম যে আমার মনে সন্দেহটা কখন কীভাবে এলো। পুলিশের কাছে আপনার বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড়ো প্রমাণ দেবে এক - এই সামনের রাস্তার ঠিক উল্টোদিকে এই বাড়ির মুখোমুখি যে হোটেল, পার্ক গেস্ট হাউস, সেখানের ম্যানেজার। আপনি বিপ্লব অধিকারী নামে কোনো একজনের ভুয়ো আধার কার্ড ব্যবহার করে সেখানে দিন দশেকের জন্য একটা রুম ভাড়া নিয়েছিলেন। নাম না মিললেও, ওই গেস্ট হাউসের ম্যানেজার আপনাকে চাক্ষুষ আইডেন্টিফাই করতে পারবে পুলিশের সামনে। আর দু'নম্বর হলো, এই তিনতলার মেসের ছেলেরা। ওদের মধ্যে সাব্বির আর রৌনক বলে দু'টো ছেলের সাথে আলাপ করে জেনেছি যে ওরা এর মধ্যে আপনাকে গভীর রাতে একবার-দু'বার আপনার ফ্ল্যাটে ঢুকতে বেরোতে দেখেছে, যখন এই বাড়ির বাকি বাসিন্দারা ঘুমিয়ে থাকে। আপনি আমাকে বোঝান সুদর্শনবাবু, আপনি দিল্লিতে থেকে থাকলে আপনার ফ্ল্যাটে কে যাতায়াত করলো ? কে হোটেলের ঘর ভাড়া নিলো এখানে দশ দিনের জন্য ?"


জটাদার এই লাস্ট কথাগুলোর পরে দেখলাম সুদর্শনবাবু একদম গুটিয়ে গেলেন। মুখ-চোখ তার সাদা হয়ে গেছে।


"আপনি ছকটা ভালোই কষেছিলেন। বৈধ টিকিট কেটে দিল্লিতে গিয়ে সেখানে বড়ো কোনো হোটেলে নিজের নামে ঘর বুক করে রেখে স্ট্রং একটা অ্যালিবাই তৈরী করে রাখলেন যে আপনি কলকাতাতেই ছিলেন না খুনের সময়। বাস্তবে আপনি চুপি চুপি কলকাতায় চলে এসে এখানে আস্তানা গাড়েন। এই বাড়ির ঠিক উল্টোদিকের গেস্ট হাউসে। যাতে ওখান থেকে এই ঘরের ড্রয়িং রুমটা পরিষ্কার দেখা যায়। যাতে ঘটনার দিন আপনি এই ঘরে চোখ রাখতে পারেন এবং সবাই যখন পিউকে নিয়ে ব্যস্ত, সেই সময় আপনি এসে সিগারেট কেসটা যাতে হাতিয়ে নিয়ে চলে যেতে পারেন। কিন্তু আপনার সেই সাজানো প্ল্যানে বাধা হয়ে দাঁড়ালেন সনৎবাবু। মারিয়া যে চেরি খেতে ভালোবাসে, সেটা আপনি জানতেন। চেরিতে সায়ানাইড পুশ করার জন্য ডেলিভারি দেওয়ার যে ছেলেটিকে টাকার লোভ দেখিয়ে আপনি হাত করেছিলেন, তাকে আমার অনুরোধে পুলিশ আজ অলরেডি নিজেদের হেফাজতে নিয়ে নিয়েছে। আমি তো বলতেই ভুলে গেছিলাম, সেও হতে পারে আপনার বিরুদ্ধে জোরালো তিন নম্বর সাক্ষী।"
সুদর্শনবাবু এবার আর কোনো গত্যন্তর না দেখে দু'হাতে নিজের মুখটা ঢেকে শুধু বসে রইলেন।

জটাদা ডিসুজা সাহেবের উদ্দেশ্যে বললো, "সুদর্শনবাবু কীভাবে এই বাক্স এবং তার ইতিহাস সম্পর্কে জেনেছিলেন, সেটা আমি জানি না। তবে অনেক পড়াশুনো করতে হয়েছে ওনাকেও, সেটা নিশ্চিত। তারপরেই অ্যাকশন প্ল্যান তৈরী করেন উনি। মারিয়ার জন্মদিনের পার্টিটা ওনাকে একটা দারুণ সুযোগ এনে দেয়। সুদর্শনবাবু টার্গেট করেছিলেন মারিয়াকেই। কারণ ওর কিছু হলে আপনারা সবচেয়ে বেশি ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়তেন। দেখুন, এই ড্রয়িং রুমে কাউকে ভালো করে শোয়াবার জায়গা কিন্তু নেই। কেউ গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে এখানে যাহোক করে না বসিয়ে ভিতরের বড়ো ঘরে বা বিছানার উপর নিয়ে যাওয়াটাই স্বাভাবিক। সেটাই অনুমান করে সুদর্শনবাবু এই ঘরের ঠিক মুখোমুখি ঘরটা ভাড়া নেন হোটেলে। ওই হোটেলের ম্যানেজার আমাকে টেস্টিফাই করেছেন যে দোতলার ওই নির্দিষ্ট রুমটি নেওয়ার জন্য বিপ্লব অধিকারী ওরফে আমাদের সুদর্শনবাবু ওনাকে পীড়াপীড়ি করেছিলেন। ওনার বক্তব্য অবশ্য ছিলো যে ওই রুমটা রাস্তার পাশে, হাওয়া বাতাস ভালো খেলবে। কিন্তু আসল উদ্দেশ্য ছিলো ঘটনার দিন ব্যালকনি পার করে এই ঘরে চোখ রাখা। বিষাক্ত চেরি ফলটা মারিয়ার বদলে পিউয়ের প্লেটে গেলেও তাতে সুদর্শনবাবুর প্ল্যান একটুও কাঁচেনি। তিনি যখনই দেখলেন আপনারা সবাই পিউকে ধরে নিয়ে ভিতরের ঘরে গিয়ে ঢুকলেন, তিনি চটজলদি রাস্তা পার করে এবাড়িতে চলে এলেন। পার্টি চলাকালীন ফ্ল্যাটের দরজা খোলাই ছিলো। কোনোভাবে যদি তিনি কারুর চোখে পড়েও যান, কোনো অসুবিধা নেই। প্ল্যান ক্যানসেল করে তিনি ভালোমানুষ সেজে যেতে পারবেন, কারণ তিনি এই বাড়িতেই থাকেন। এবং তখন গল্প দিতে পারবেন যে তিনি এই সবে দিল্লি থেকে ফিরলেন।"


"যেমন ভাবা, রাস্তা পার করে এবাড়িতে চলে এলেন সুদর্শনবাবু। সিঁড়ি দিয়ে হয়তো ওপরেও উঠেছিলেন। কিন্তু ভিতরে ঢুকতে তিনি পারলেন না। কারণ তখন সেখানে উপস্থিত ছিলেন সনৎবাবু। তিনি সম্ভবতঃ তার মিসেসকে কেকের প্লেটটা তখন দিয়ে এসে এই ঘরে ঢুকে দেখেন সবাই ভিতরের ঘরে জটলা করেছে। কেন-কী ব্যাপার সেসব না ভেবেই তিনি এই সুযোগের সদ্ব্যবহার করলেন ফ্রিজের মাথা থেকে কাঠের সিগারেট কেসটা সরিয়ে নিয়ে। ওটা নিয়েই তিনি আবার নিচে চলে যান। এবং সেটাকে নিজের ঘরে লুকিয়ে রেখে আবার উপরে উঠে আসেন। এসে পিউর অবস্থা দেখে তিনি সত্যিই বিচলিত হয়ে আবার নিচে যান ওনার মিসেসকে ডেকে আনার জন্য। ওনার এই বারংবার আসা-যাওয়ার কারণে সুদর্শনবাবুর প্ল্যান পুরো চৌপাট হয়ে যায়। তাকে হোটেলে ফিরে যেতে হয় খালি হাতে।"

"সিগারেট কেসটা তাহলে মিস্টার দত্ত নেননি ?" খুবই অবাক হয়ে প্রশ্নটা করলো অ্যালিস্টার।


"না। জিনিষটা সনৎবাবুর কাছেই গচ্ছিত রয়ে যায়। একমাত্র সন্তানের মৃত্যুশোক বুকে চেপে রেখেই তিনি নিজেদের ভবিষ্যতের কথা ভেবে আড়ালে কাজ গোছাতে থাকেন। বাক্সটা নিয়ে একটু নাড়াচাড়া করতেই তিনি ওটার কলকব্জার ব্যাপারটা ধরে ফেলেন এবং ওতে লুকিয়ে রাখা জিনিসটাও খুঁজে পান। অতঃপর বাক্সটা তিনি ওই নিচের ভাঙা ফ্ল্যাটটাতে ফেলে দেন। সম্ভবতঃ তিনি চেয়েছিলেন যে আপনারা ওটা যাতে আবার খুঁজে পান। মিস্টার ডিসুজার ক্ষতি করবার অভিপ্রায় ওনার ছিলো না, শুধু আসল জিনিষটা উনি হস্তগত করতে চেয়েছিলেন। এবং করেওছিলেন।


"সনৎবাবুর উপর আমার প্রথম দিনেই সন্দেহ হয় ওনার ঘরে ঢুকে। আমরা ভিতরে ঢুকে দেখেছিলাম একটা খুব হালকা হলুদ বাল্ব জ্বলছে। ওরকম ছোট বাল্ব এখনকার দিনে আর কে ব্যবহার করে ? এখন তো এলইডি ছাড়া কিছু কিনতেই পাওয়া যায় না দোকানে। ওরকম ছোট নাইট বাল্ব পাওয়া যায় জিরো পাওয়ারের। কিন্তু সেগুলো লোকে শোবার ঘরেই লাগায়। ডাইনিং বা ড্রয়িং রুমে ওরকম আলো দেখে আমার মনে সন্দেহ বাসা বাঁধে। উনি হয়তো চাননি কেউ ওনার ঘরে এসে খুব বেশি এদিক-ওদিক দেখুক। হলুদ আলো এমনই হয় যে তাতে পুরোনো দিনের হলদে হয়ে যাওয়া কাগজ কিন্তু চট করে বোঝা যায় না। আমি জানি না জিনিষটা তিনি ঘরের মধ্যে কোথায় লুকিয়ে রেখেছিলেন, কিন্তু সেটা যদি কাগজ জাতীয় কিছু হয়, আমি আশ্চর্য হবো না। আর কাগজ জাতীয় কিছু হলে সেটা কোনো গুরুত্বপূর্ণ চিঠিও হতে পারে।"


কথার মধ্যে কিছুটা রহস্য রেখে দিয়ে জটাদা থামলো। আমার মাথার মধ্যে যেটা ঘুরছিলো, সেটা আমি বলেই ফেললাম। "ওয়ারেন হেস্টিংসকে লেখা লর্ড ক্লাইভের সেই চিঠিটা ?"

ঠোঁটের কোণে হাসিটা তখনও একটু ধরে রেখে জটাদা বললো, "আমারও তাই অনুমান। কিন্তু সেটা আমাদের চেয়ে ভালো বলতে পারবেন সনৎবাবু।"


সনৎবাবু এমনিতেই ভীষণ ভেঙে পড়েছিলেন। এখন তিনি ডিসুজার দিকে ফিরে দুই হাত জড়ো করে শুধু বললেন, "আমাকে ক্ষমা করুন মিস্টার ডিসুজা।"


ডিসুজা সাহেব কিছু বললেন না। কোনো উত্তর দিলেন না সনৎবাবুকে। ভীষণ রাগ ও বিরক্তি হলে মানুষের যেমন মুখের ভাব হয়, তেমনি চুপ করেই রইলেন। সনৎবাবু আবার বললেন, "চিঠিটার কথা আমি আগে থেকেই অনুমান করেছিলাম। এবং সেটা পাবার পর আমি বুঝতে পারি সেটার ঐতিহাসিক মূল্য কতটা। আপনি বিশ্বাস করুন আমি আপনাকে পুরো ব্যাপারটা খুলেই বলবো বলে ভেবেছিলাম। বিবেকের দংশনে মরে যাচ্ছিলাম আমি। কিন্তু সত্যি কথাটা জানতে পারলে আপনি আমার সম্বন্ধে কী ধারণা করবেন, সেই ভেবেই বলে উঠতে পারিনি। যখন স্থির করলাম আপনাকে বলেই দেবো -"


"ঠিক তখনই জিনিষটা আপনার কাছ থেকে হাতছাড়া হয়ে গেলো।" সনৎবাবুর কথাটা সম্পূর্ণ করলো জটাদা।

"হ্যাঁ, কিন্তু আপনি কীকরে জানলেন ?" অবাক হলেন সনৎবাবু।


"খুব সহজ। সিঁড়িতে উঠতে গিয়ে আপনার ড্রয়িং রুমে দেখলাম টিমটিমে সেই হলুদ লাইট পাল্টে সাধারণ এলইডি লাগানো হয়েছে। তাইতেই বুঝতে পারলাম যে জিনিষটা আপনার ঘর থেকে সরিয়ে ফেলা হয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, কোথায় সরানো হয়েছে ?"


জটাদা এবার ডিসুজা সাহেবের দিকে তাকিয়ে ব্যাখ্যা করতে লাগলো, "আপনার মনে আছে মিস্টার ডিসুজা, পরশুদিন ভোরবেলা সেই চুরির কথা ? সেদিন যখন আমি এসে ভাঙা ঘরটা থেকে কাঠের বাক্সটা উদ্ধার করলাম, তখন ইচ্ছা করেই দেওয়ালের বিভিন্ন জায়গায় ঠোকাঠুকি করে সনৎবাবুর মনে একটা চুরির ভয় আনার চেষ্টা করেছিলাম। কারণ তা নাহলে তার ঘরে ঢুকে জিনিষটা খোঁজার জন্য তল্লাশি চালানো আমার পক্ষে সম্ভব ছিলো না। সদ্য সদ্য তার মেয়ে মারা গেছে। এখন সনৎবাবুকেই দোষী সাব্যস্ত করে তার ঘরে ঢুকে খোঁজাখুঁজি করাটা, কোনো প্রমাণ ছাড়াই, আমি করে উঠতে পারতাম না। আপনারা কেউই হয়তো সেটা সমর্থন করতেন না। তাই ঘুরপথে ওনাকেই বাধ্য করতে হলো জিনিষটা লুকোনো জায়গা থেকে বের করে আনার জন্য। উনি বুঝলেন যে চিঠিটার জন্য ওনার ঘরে পুলিশ বা আর কেউ সার্চ করতে আসলেও আসতে পারে। ভয় পেলেন উনি। জিনিষটা হারানোর থেকেও বড়ো ভয় যেটা উনি পেলেন সেটা হলো এই চুরির ব্যাপারে ওনার যুক্ত থাকার প্রমাণ এভাবে ঘরে রেখে দেওয়া।


আমি ভেবেছিলাম তিনি হয়তো জিনিষটা এই বাড়ির বাইরে কোথাও রেখে আসবেন। পরিচিত কারুর জিম্মায়। সেই হিসাবে এই বাড়ির উল্টোদিকে ওইদিনই আমি চব্বিশ ঘন্টার জন্য একটা ছেলেকে পাহারায় বসাই। কিন্তু তার কাছ থেকে রিপোর্ট পাই যে সনৎবাবু আর বাড়ির বাইরে বেরোননি। তাহলে জিনিষটা তিনি কোথায় পাঠালেন ঘর থেকে ?


ভাগ্যের কি পরিহাস দেখুন। সনৎবাবু কিন্তু জানতেন যে সুদর্শনবাবু সত্যিই দিল্লিতে গেছেন। এবং সামনের মাসের আগে ফিরবেন না। তাই সুদর্শনবাবুর ঘরটিকেই উনি এই বাড়ির সবচেয়ে নিরাপদ জায়গা হিসাবে মনে করলেন। বাড়িতে সার্চ করা হলেও সুদর্শনবাবুর ঘরে ওনার অনুমতি ব্যতিরেকে ওনার অনুপস্থিতিতে পুলিশ ঢুকবে না। আমি ঠিক ঠিক জানি না সনৎবাবু কীভাবে ওনার ঘরে চিঠিটা লুকিয়ে রেখেছিলেন ওইদিন। কিন্তু কল্পনা করতে পারি, উনি হয়তো তিনতলায় গিয়ে সুদর্শনবাবুর ঘরের দরজার তলার সামান্য গ্যাপটা দিয়ে চিঠিটা ঠেলে ভিতরে ঢুকিয়ে দিলেন। আর একটা সুতো তার সঙ্গে বেঁধে বাইরে অব্দি রাখলেন যাতে সহজেই সেটাকে টেনে নিতে পারেন বাইরে থেকে। কী, আমি ঠিক বলছি কি সনৎবাবু ?"


সনৎবাবু অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে জটাদার দিকে মুখ তুলে তাকালেন। শুধু বললেন, "ঝাঁটার কাঠি। সুতো নয়। একটা ঝাঁটার কাঠি ওটার সঙ্গে আটকে রেখেছিলাম, যাতে কাঠিটা ধরে টানলেই ওটা বাইরে চলে আসে।"


"যাইহোক -" জটাদা আবার বললো, "সনৎবাবু জিনিষটা নিরাপদ জায়গায় রেখে তো এলেন। সেটা ধরা পড়লেও তার নিজের ধরা পড়ার সম্ভাবনাও আর রইলো না। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে সেইদিনই ফিরে এলেন সুদর্শন দত্ত। তিনি সম্ভবতঃ আন্দাজ করেছিলেন যে সনৎবাবু নিজের ঘরে লুকিয়ে রেখেছেন চিঠিটা। তার কী উদ্দেশ্য ছিলো বলতে পারবো না। তিনি বিফল মনোরথ হয়ে সব প্রচেষ্টা ছেড়ে দিয়েছিলেন নাকি সনৎবাবুর কাছ থেকে জিনিষটা আবার হাতানোর পরিকল্পনা নিয়েছিলেন, আমার জানা নেই। সম্ভবতঃ দ্বিতীয়টাই। কারণ তা না হলে তিনি ফিরে আসার পর মিস্টার ডিসুজাকে বোঝানোর চেষ্টা করতেন যে জিনিষটা সনৎবাবুই নিয়ে থাকতে পারেন। তা তিনি করেননি। কিন্তু এর পরের কাহিনীটা আপনারা ভাবুন শুধু। সুদর্শনবাবু ফিরে এসে নিজের ঘরে ঢুকেই দেখেন তার সামনেই পড়ে আছে কোটি টাকা মূল্যের সেই সম্পদ যেটার আশা তিনি প্রায় ছেড়েই দিয়েছিলেন। যার জন্য এতোকিছু প্ল্যান করে এগোলেন তিনি, শেষমেশ সেটা নিজের মুঠোয় পেয়েও গেলেন। কপাল প্রসন্ন হলে যা হয়।"


সুদর্শনবাবু বসেছিলেন দরজার সবচেয়ে কাছাকাছি। ঠিক এই মুহূর্তে হঠাৎই তিনি আচমকা সোফা থেকে উঠেই ব্রিফকেসটা নিয়ে দৌড়ে যাওয়ার চেষ্টা করলেন দরজার দিকে। আমি সময়মতো আমার পা-টা একটু এগিয়ে দেওয়ায় হোঁচট খেয়ে উনি হুমড়ি খেয়ে পড়লেন মেঝের উপর। আর অ্যালিস্টার দেখলাম সঙ্গে সঙ্গে উঠে ওনার উপর চেপে বসে গলাটা ঠেসে ধরলো। বললো, "মিস্টার মিত্র, আপনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ এই রাস্কেলটাকে ধরিয়ে দেবার জন্য। মানুষকে বাইরে থেকে দেখে সত্যিই চেনা যায় না।"


জটাদা উঠে গিয়ে ব্রিফকেসটা তুললো। তারপর সুদর্শনবাবুকে জিজ্ঞাসা করলো, "আপনি কি এটার লক নাম্বারটা বলবেন নাকি আমাদের কষ্ট করে ভেঙে দেখতে হবে মিস্টার দত্ত ?"

কোনোক্রমে অস্ফুটে বললেন সুদর্শনবাবু, "থ্রি- ফোর- ফাইভ।"


ব্রিফকেসটা খুলতে সেটা থেকে বেরোলো ভাঁজ করা একটা কাগজ। বেশি বড়ো নয়। ভাঁজগুলো সাবধানে খোলার পর সেটা একটা খাতার পাতার সাইজ হলো। লালচে হলুদ রঙের বহু পুরোনো দিনের কাগজ, দেখেই বোঝা যায়। জটাদা সেটা সবার উদ্দেশ্যে মেলে ধরে বললো, "আজ থেকে প্রায় আড়াইশো বছর আগে লেখা লর্ড ক্লাইভের চিঠি। অমূল্য এক সম্পদ। নিলামে এর দাম কোটি টাকারও বেশি হতে পারে।" চিঠির একদম নিচে রবার্ট ক্লাইভ বলে করা সইটাও দেখালো জটাদা।


আমাদের কাজ আর বেশি বাকি ছিলো না। ডিসুজাদের ফ্ল্যাট থেকে চলে আসার আগে জটাদা ডিসুজা সাহেব আর অ্যালিস্টারকে বললো, "আমার কর্তব্য এইটুকুই ছিলো। আপনারা বাকিটা দেখে নিতে পারবেন আশা করি। লোকাল থানায় আমি খবর দিয়েই রেখেছি। আপনারা যোগাযোগ করে নিলেই হবে। আর হ্যাঁ, সনৎবাবু লোভ করে একটা অন্যায় করে ফেলেছেন। তার জন্য উনি অলরেডি যে শাস্তি পেয়েছেন, তার পরিমাপ হয় না। ওনার মেয়ের মৃত্যুর কথাটা মাথায় রেখে পারলে ওনার ব্যাপারটা আর থানায় না হয় নাই বা জানালেন। জানবেন, অনুশোচনার চেয়ে বড়ো শাস্তি আমাদের দেশের আদালত দিতে পারবে না।"


রাস্তায় নেমে জটাদা একটা সিগারেট ধরালো। পিঙ্কি এতক্ষণে মুখ খুললো। বললো, "কী দারুণ একটা কেস সল্ভ করলে গো তুমি জটাদা। প্রথমে সুদর্শন দত্ত, তারপর সনৎ সেন, তারপর আবার সুদর্শন দত্ত - মানে চোরের উপর বাটপারির উপর চোর। উফ। বিশাল ব্যাপার।"


জটাদা সিগারেটে একটা টান দিয়ে সেটার ধোঁয়াটা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ছেড়ে দিয়ে বললো, "তুই হয়তো এখনের ঘটনাগুলোই ভাবছিস। কিন্তু ভেবে দেখ, চিঠিটা লর্ড ক্লাইভ লিখেছিলেন ওয়ারেন হেস্টিংসের দুর্নীতি ও টাকা চুরির বিষয়ে। সেটা নন্দকুমার একরকম প্রায় চুরি করেই নিজের কাছে রাখেন। সেই চিঠি নন্দকুমারের ফ্যামিলির কাছ থেকে ডিসুজাদের ফ্যামিলিতে চলে আসে, সেও এক চোরের হাত ধরেই। মানে, ভেবে দেখতে গেলে, এই চিঠির পিছনে চুরির ইতিহাস কিন্তু আজকের নয়, প্রায় আড়াইশো বছরের পুরোনো।"
                                                                    (সমাপ্ত)

====================

 
নাম:- মৌসম সামন্ত (অসুর)
ঠিকানা:- 16, Sankhari tola Street, Kolkata-700014, India

Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.