প্রবন্ধ ।। একজন সংগ্রামী পুরুষের যাত্রাপথ ।। আবদুস সালাম
ছবিঋন- ইন্টারনেট।
একজন সংগ্রামী পুরুষের যাত্রাপথ
আবদুস সালাম
1935 এর ফেব্রুয়ারি রোম্যাঁ রঁলা সুভাষচন্দ্র কে লিখেছিলেন". But we men of thought most each of us fight against the temptation that befalls in moments of fatigue and unsettledness repairing to a world beyond the battle called God or art or freedom of the spirit of or those distant regions of the mystic soul . For fight we must as our duty lies on this side of the ocean on the battleground of men " । সুভাষ চন্দ্রের মধ্যে মরমিয়া প্রবণতা তিনি লক্ষ্য করেছিলেন। কিন্তু দৃঢ়চেতা আপোষহীন মানসিকতা এবং প্রতিবাদী মানুষটি অনেক দ্বিধা দ্বন্দের পর রঁলা কথিত সংগ্রামকেই মানুষের জন্য এই পথকে তিনি বেছে নিয়েছিলেন। সুভাষচন্দ্র ছিলেন মানুষের জন্য নিবেদিত সংগ্রামী পুরুষ।
বহু ভারতবাসির আশা ছিল সুভাষচন্দ্র আবার দেশে ফিরবেন । তিনিই সর্বভারতীয় বরেন্য নেতা ।তবু স্বাভাবিকভাবেই বাঙ্গালীদের কাছে তিনি সর্বাধিক প্রিয় । দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ শেষ হলো। খন্ডিত হলো ভারতবর্ষ ,কিন্তু নেতাজি সুভাষচন্দ্র আর দেশে ফিরে এলেন না ।একটি জাপানি প্লেন দুর্ঘটনায় তার মৃত্যু কাহিনী প্রচারিত হয়েছিল বটে কিন্তু অধিকাংশ ভারতবাসীর কাছে তা বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়নি। কারণ সে কাহিনীতে এত বেশি জল মেশানো ছিল যা তাকে অলিক বলেই মনে হয় ।সুভাষচন্দ্রের মত এমন আন্তর্জাতিক বড় মাপের নেতার এমন অকিঞ্চিৎকর পরিনিতি তা কখনই মেনে নেওয়া যায় না । পরস্পর বিরোধী সাক্ষ্য ও গোপনীয়তা করার চেষ্টা হয়েছে বহুভাবে । সেই সব সন্দেহের নিরসন হয়নি। জাপানের রেনকোজি মন্দিরের অস্থিতত্ত্ব অনেকের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়।
তিনি ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্নেহধন্য ও স্বামী বিবেকানন্দের উত্তরসূরী । তিনি ছিলেন তারুণ্যের প্রতীক। তিনি বাঙালি জাতিকে সাহস ও শৌর্যের দীক্ষা দিয়েছেন ।অস্ত্র বিমুখ বাক্যবাগীশ বাঙালি পেয়েছিল একজন উচ্চশিক্ষিত শাণিত বুদ্ধি অশ্বারোহী এবং অস্ত্র সজ্জিত সৈনিক । এমনতর নেতা পেয়ে উজ্জীবিত হয়েছিল বাঙালি জাতি তার বলার অপেক্ষা রাখে না। তিনি হয়ে উঠেছিলেন বাঙালির ঈশ্বর। আমরা ভাবতে শুরু করি যে তিনিই হতে পারেন একমাত্র পরিত্রাতা। তিনিই পারবেন ভারত মাতাকে পরাধীনতার নাগপাশ থেকে মুক্তি দিতে।
তাঁর এই দেবতা হয়ে ওঠা অন্য সংগ্রামী নেতাদের তা মোটেই পছন্দের ছিল না। তিনি যদি বিজয়ী সৈনিক বেশে আমাদের কাছে আসতেন তবে ভারতের ইতিহাস অন্য ভাবে লেখা হতো তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
তথাকথিত সুভাষ বিরোধী লবি তাকে দেশদ্রোহী বলতে ও দ্বিধা করেনি। তাকে কুইসলিং বলতে ও অনেকের মুখ কাঁপেনি। জার্মানির সাহায্য চেয়েছেন এবং জাপানের সঙ্গে মিলিয়েছিলেন হাত। এর জন্য রাশিয়ান পন্থীরা রে রে করে তেড়ে এসেছে গেল গেল করে। তাদের যুক্তি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যদি ইংরেজ তথা মিত্র বাহিনীর পরাজয় হতো তবে কি সুভাষচন্দ্র ভারতে জাপানিদেরকে রাজত্ব করতে দিতেন? স্বর্গের দেবতাকে মাটিতে টেনে এনে অপদস্থ করতে ছাড়েননি আমাদের বিচক্ষণ নেতগণ। হায়রে রাজনীতির বেড়া জাল ,তাকে অজ্ঞাতবাসেই চিরকাল আমরা রেখে দিলাম। কূটনৈতিক চালে তার শেষ গতি বিধির সমস্ত প্রমাণ লোপাট করে দেওয়া হয় ।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষে তার মৃত্যু হয়েছে না হয়নি তাই নিয়ে যতই জল ঘোলা হোক না কেন আমাদের চোখে তিনি চিরকাল যৌবনময় তেজদীপ্ত মূর্তি।
রবীন্দ্রনাথ যাকে দেশনায়ক বলে বরণ করেছিলেন ভাগ্যের পরিহাসে তাকে দেশ ত্যাগ করতে বাধ্য হতে হয়েছিল। মনে প্রশ্ন জাগে তিনি বাঙালি বলেই কি আমাদের এটা পাওনা। চিরকাল ভারতবর্ষের রাজনীতিতে বাঙালি জাতিকে কেউ পছন্দ করে নি, এখন ও করে না ।
কলকাতা থেকে কাবুল, কাবুল থেকে বার্লিন , বার্লিন থেকে সিঙ্গাপুর, সিঙ্গাপুর থেকে কোহিমা এই দুর্গম পথ তার পদ চিহ্ন ধারণ করলো ।এই মহান বীরকে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ আহ্বান জানিয়েছিলেন।
বাস্তবিক ভাবে সুভাষচন্দ্র বসু ওরফে মোহাম্মদ জিয়াউদ্দিন সেদিন ঠিক কোথায় যাচ্ছিলেন এর উত্তর ঐতিহাসিকগণ আজ পর্যন্ত দিতে পারেনি ।একটা লোক এলিগেন রোডের বাড়ি থেকে পালিয়ে গেল পশ্চিম দিকে কাবুল ,আর যখন ফিরে এলো তখন তার দলবল চলছে ইম্ফল, আর তার ঘাঁটি রেঙ্গুন- এটা কি করে হয়? দ্বিতীয় কথা লোকটি কি তবে আন্তর্জাতিক ফ্যাসিষ্ট চক্রান্ত ও আক্রমণের শরীক? এমন একটা কথার গুঞ্জন তখন শোনা গিয়েছিল।
সুভাষচন্দ্র বসুর যাত্রা পথ অনুসরণ করলে আমার দেখা দেখতে পাই লম্বা ওয়ান্ডারার মোটরে চড়ে এলগিন রোড থেকে গভীর রাত্রে বেরিয়ে ,পরের দিন মাঝরাতে পৌঁছালেন গোমো স্টেশনে । সেখান থেকে কালকা মেল দিল্লী। দিল্লী থেকে পেশোয়ার ।পেশোয়া রেলওয়ে স্টেশনে তার জন্য অপেক্ষা করছিলেন উত্তর-পশ্চিম সীমান্তে প্রদেশের ফরওয়ার্ড ব্লক নেতা আকবর শাহ। সীমান্ত পার করে দেওয়ার জন্য তিনি তিনজন ফরওয়ার্ড ব্লক কর্মী নির্বাচিত করে রেখেছিলেন একজন মোহাম্মদ শাহ (সীমান্তের ওপার তার অনেক বেশি জানাশোনা) ,আবাদ খান( উপজাতি অধ্যুষিত এলাকার সব পথ গুলো তার চেনা ), আর একজন হলেন ভগৎ রাম তলোয়ার ( যার দাদাকে বছর দশেক আগে ইংরেজরা ফাঁসি দিয়ে ছিল) । এই তিনজন ফরওয়ার্ড ব্লক কর্মীর সহযোগিতায় সুভাষচন্দ্র আফ্রিদি সীমান্তে পৌঁছাতে সক্ষম হন। সেখান থেকে পায়ে হেঁটে ও টাট্টু ঘোড়া চড়ে, মাল বোঝাই ট্রাকে করে ভগৎ রাম তলোয়ার এর সঙ্গে চলে যান কাবুলের দিকে ।
কলকাতা থেকে কাবুল, মস্কো ,বার্লিন, টোকিও, সিঙ্গাপুর, রেঙ্গুন ,এই দীর্ঘ ছিল তার যাত্রা পথ । কোন পূর্বপরিকল্পিত ছক ছিল না তার হাতে । প্রত্যেক পদক্ষেপে বিপদ ওৎ পেতে আছে । আন্তর্জাতিক সন্ধি বিগ্রহ ঘটনাচক্র অনুসরণ করেই দিক নির্ণয় করতে হয়েছিল তাকে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ইতিহাসে সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত এই বিশ্বযাত্রা।
1936সাল। নাৎসি জার্মানি ঘুরে ভারতে ফিরবার পরে ডক্টর টিয়ারফেল্ডকে স্পষ্ট ভাষায় বলেছিলেন ---" জার্মানির নতুন জাতীয়তাবাদ শুধু যে সংকীর্ণ ও স্বার্থপর তাই নয় তা হলো মদমত্ত।" কিন্তু তার দাদা শরৎচন্দ্র বসুর চোখে সাম্রাজ্যবাদ ও ফ্যাসিবাদের মধ্যে কোন পার্থক্য ছিল না। তাঁর ধারণা ছিল ইংল্যান্ড ও আমেরিকা গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করছে না , লড়াই করছে বিশ্বে প্রভুত্ব স্থাপন করার জন্য। এবং এটাই সঠিক অনুমান ছিল।
এই ব্যাপারে নেহরুর সাথে বসুর শুরু হয় মত বিরোধ। যুদ্ধের সময় এই বিরোধ আরো চরমে ওঠে । বাধ্য হয়ে নেহেরু তখন ঘোষণা করেন "Hitler and Japan must go to hell. I shall fight them to the end and this is my policy. I shall also fight Mr Subhas Bose and his party along with Japan if he comes to India."
আজাদ হিন্দ ফৌজ জাপানি বাহিনীর সঙ্গে ভারতবর্ষে পৌছাবার পর কংগ্রেসের সঙ্গে বিরোধ বাঁধতে পারে এ কথা বুঝে তিনি গান্ধিজির উদ্দেশ্যে রেডিওতে ঘোষণা করেন যে" ইংরেজরা বিতাড়িত হওয়ার পর ভারতীয় জনগণই স্থির করবে কি ধরনের সরকার তারা চায় এবং কে তার নেতা হবে।"
ডক্টর ডার্টের সাক্ষ্য থেকে আমরা জানতে পারি সুভাষচন্দ্র এমন এক ধরনের "সেন্ট্রালাইজড" ও "অথরিটারিয়ান" রাষ্ট্র পরিকল্পনা করেছিলেন যেখানে জাতীয় স্বার্থে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য কিছুটা খর্ব করতে হবে এবং তাতে সেনাবাহিনীর একটা বিশেষ গঠনমূলক ভূমিকা থাকবে ।"এখানে নেতাজির সঙ্গে নেহেরুর মতপার্থক্য স্পষ্ট হয়ে ওঠে । সুভাষ বসুর দাদা শরৎচন্দ্র বসু ছোট ভাইয়ের অপেক্ষা অধিকতর ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ গণতন্ত্রবাদী ছিলেন।
1940সাল। পুনরায় বিশ্ব রাজনীতির ধারা প্রকৃতি লক্ষ্য করে এটা তার ধারণা হয় যে বিদেশি সাহায্য ছাড়া সে সময় ইংরেজদের বিরুদ্ধে পক্ষ ছিল অক্ষত্রয়ী ও সোভিয়েত ইউনিয়ন ।গোপন চুক্তি করে স্তালিন হিটলার তখন লিথুনিয়া, লাটভিয়া, এস্স্টোনিয়া বেসারেবিয়া ইতালি দেশ ভাগাভাগি করে নিয়েছে । জাপান তখনো নামেনি । কিন্তু জার্মানি ও ইতালি ইংরেজদের বিরুদ্ধে লড়ছে ।এইসব অক্ষশক্তি এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ।তাই তাদের কাছ থেকে তিনি সাহায্য পাওয়ার আশা পোষণ করেছিলেন । কিন্তু তিনি এর মধ্যে কোন আদর্শগত মৈত্রী আমদানি করার পক্ষপাতি ছিলেন না। ওই চারটি রাষ্ট্রের আদর্শ যে এক নয় এটা ও তার কাছে স্পষ্ট ছিল। বিশেষ করে সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে অক্ষয়ের আদর্শভেদ সকলেই জানত । কিন্তু অক্ষত্রয়ীর ভিতরেও যথেষ্ট পার্থক্য ছিল। জাপান ফ্যাসিবাদী শক্তি ছিল না এবং জার্মানি বা ইতালি রাষ্ট্রের সঙ্গে তার মূলগত সাদৃশ্য ও ছিল না । সক্রিয় জাতীয়তাবাদ "এশিয়া বাসীদের জন্য এশিয়া "স্লোগান মূলত ছিল ইংরেজ প্রভুত্বের অবসান ঘটানো । আর এটাই ছিল জাপানের মূলমন্ত্র । এদিকে ইংরেজ ও আমেরিকার রেডিও প্রোপাগান্ডায় জার্মানি ইতালি সঙ্গে জাপান কেউ পররাজ্যগ্রাসী যুদ্ধবাজদের শিবিরের ঢুকিয়ে একাকার করে দিতে বদ্ধপরিকর ছিল। কিন্তু সাম্প্রতিক গবেষণায় জানা গেছে এটা বাস্তব ছিল না। জার্মানরা নিজেদের প্রভুত্ব বিস্তারের জন্য যুদ্ধ বাধিয়েছিল। জাপান এ যুদ্ধে যেতে রাজি ছিল না। জাপান তখন শক্তি বৃদ্ধি করে চলেছে ।ভীত হয়ে পড়েছে ইংল্যান্ড ও আমেরিকা । ইউরোপে যুদ্ধ বেধে যাওয়ার ভয়ে এবং চীন জাপান যুদ্ধ লেগে যাবে এই আশংকায় তারা জাপানে তেল আসা বন্ধ করে দেয়। জাপানের সঞ্চিত তেল ফুরোতে শুরু করে। জাপান মরিয়া হয়ে ডাচ ইস্ট ইন্ডিজ অয়েল ফিল্ডগুলো দখল নেওয়ার পরিকল্পনা করে। জাপান বিপদ থেকে বেরিয়ে আসে ও পার্ল হারবার এ হানা দেয়।এর ফলে ইউরোপ থেকে প্রশান্ত মহাসাগর ও এশিয়াতে যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ে। জাপানের মূল লক্ষ্য ছিল ইঙ্গোমার্কিন সাম্রাজ্যবাদের হাত থেকে এশিয়া বাসীদের রক্ষা করা।
ভারতবর্ষের স্বার্থে জাপানের সঙ্গে তিনি গুপ্ত যোগাযোগ বজায় রেখেছিলেন ।কারণ জাপান ইংরেজদের শক্তিশালী শত্রু ।তাই তিনি দেশ থেকে পালাবার আগে জাপানে তিনি যে গুপ্ত দূত পাঠান তার ইংরেজদের হাতে ধরা পড়ায় সেই চাল বানচাল হয়ে যায়। জার্মানিতে পৌঁছে তিনি জাপানের সঙ্গে চীনের বিরোধ বিরোধ মিটিয়ে দেওয়া যায় কিনা তা নিয়ে আলোচনা শুরু করেন ।দুই দেশের আসল শত্রু সাম্রাজ্যবাদ। জাপানের পৌঁছে তিনি দেখলেন ইংল্যান্ড ও আমেরিকার সঙ্গে যুদ্ধে নিরত জাপান চীনের সঙ্গে একটা সমঝোতা করে নিতে আগ্রহী ।কিন্তু তখন ইংরেজ ও আমেরিকানদের সাহায্য নিয়ে প্রাণপণ লড়ছে ।দেখেশুনে সুভাষচন্দ্র ধারণা হলো আমেরিকার সঙ্গে লড়াইয়ে জাপান যদি হেরে যায় তাহলে চীন মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের শিকার হবে তিনি দেখলেন যুদ্ধে যাওয়ার পর জাপানি জাতি ও জাপান সরকার একটা নতুনভাবে ভাবনায় উদ্বুদ্ধ হয়েছে ।এই নবচেতনা "এশিয়াটিক চেতনা" যার বশবর্তী হয়ে জাপান চাই চীনের সঙ্গে ঝগড়া মিটিয়ে নিতে এবংফিলিপিনস ব্রহ্মদেশ এবং ভারতবর্ষকে স্বাধীন সাম্রাজ্য বিরোধী রাষ্ট্র হিসেবে পেতে চাই।
সুভাষচন্দ্র যখন রাশিয়া হয়ে জার্মানি পৌঁছচ্ছেন তখন অত্যন্ত গোপনে রিবেনট্রপ ও মলটোভের মধ্যে কথা বার্তা হচ্ছিল । তিনি বারবার জিজ্ঞাসা করতে লাগলেন জার্মানরা পূর্ব ইউরোপে কি করতে চায়? বিশ্বভাগে তার আপত্তি নেই ,কিন্তু দানিউব উপত্যকা টা তার চাই । হিটলারের মেজাজ চড়তে লাগলো ।এই সবকিছু সুভাষচন্দ্র জানতেন না । তিনি জানতে পারলেন না যে আসলে হিটলারের লড়াই করতে চান ইংরেজদের সঙ্গে নয় রুশদের সঙ্গে ।ইংরেজদের সঙ্গে জার্মানের লড়াই করতে হচ্ছে কিন্তু আসলে তা নয় ।চার্চিল ভারতবর্ষের দখল রাখুক না কেন হিটলার তাতে কোনো আপত্তি নেই বরং যথেষ্ঠ সহানুভূতিশীল । ভারতের জাতীয় স্বাধীনতা পাবার যোগ্যতা অর্জন করতে আরো 100 থেকে 150 বছর সময় লাগবে ইংরেজরা সেখানে নির্বিবাদে রাজত্ব করুক । জার্মানিরা রাশিয়া পেয়ে তাদেরকে" ভারতবর্ষে" বানিয়ে দেবে। ভিতরে ভিতরে সব পরিকল্পনা যখন করা হচ্ছে সুভাষচন্দ্র পক্ষে এতো জানা সম্ভব ছিল না ।তিনি জানতেন না যে হিটলার ও স্টালিনের বিন্দুমাত্র মাথাব্যথা নেই ভারতবর্ষ স্বাধীন হোক বা না হোক ।
কাবুল যাবার সময় সুভাষচন্দ্র বসুর মাথায় ঠিক কী পরিকল্পনা ছিল তা তিনি কোথাও লিপিবদ্ধ করে যাননি। যার সঙ্গে তিনি ছক নিয়ে বিশেষভাবে পরামর্শ করেছিলেন সেই শরৎচন্দ্র বসু ও কাউকে কিছু বলে যাননি। কলকাতা থেকে পালাতে সাহায্য করেছে তার ভাইপো । কিন্তু তাদের কাছে এ সব কথা ভেঙে বলার নয় ।কাবুলের পৌঁছে তিনি যা যা করলেন তা থেকে আন্দাজ করে নিতে হবে তার মাথায় কি উদ্দেশ্য ছিল।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ নিয়ে তার কোন মাথা ব্যাথা ছিল না। তার একটা ই লক্ষ্য ভারতকে স্বাধীন করতে হবে। সুভাষ বসুর কূটনীতির মূল লক্ষ্য ছিল অক্ষত্রয়ী ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে ইংরেজ বিরোধী জোট গড়ে তোলা। সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে অক্ষত্রয়ী মিলে গেলে জাপান নিশ্চিন্তে সিঙ্গাপুরে হানা দিতে পারবে। তাকে রুশ শত্রুর ভয়ে পিছু তাকাতে হবে না। আবার এজন্য জার্মানিকে তৎপর হতে হবে এবং মস্কোকে ঠিক পথে চালিত করতে হবে ।ইংরেজদের বিরুদ্ধে একটা জগৎজোড়া চতুর শক্তি জোট গড়ে উঠবে । জার্মানি, ইতালি ,সোভিয়েত ইউনিয়ন ও জাপানের সহযোগিতায় ব্রিটিশ সাম্রাজ্য ভেঙে পড়বে ভারতবর্ষ স্বাধীন হবে। এই ছিল সুভাষ বসুর স্বপ্ন ।
একই সঙ্গে ইতালিও জার্মান বাহিনী উত্তর আফ্রিকা ও পশ্চিম প্রাচ্য দিয়ে ভারতের দিকে এগিয়ে যাবে আর সিংগাপুর দিয়ে ভারতের দিকে এগিয়ে আসবে জাপানি নৌবহর ।
সুভাষ চন্দ্র দেখলেন ভারতবর্ষ কে স্বাধীন বলে ঘোষণা করার কোন ইচ্ছাই হিটলারের নেই ।তার ইচ্ছে ছিলো কিভাবে রাশিয়া জয় করা যেতে পারে । তিনি দেখলেন কাবুল ও উত্তর পশ্চিম সীমান্তে যে সংগঠন গড়ে তোলার কথা ভেবেছিলেন সেটাও বানচাল হয়ে গেল। এদিকে ভগৎরাম ও ইংরেজ দের হাতে ধরা পড়ে যায় ।প্রাণ বাঁচাতে সে স্বীকার করে নেয় সে নাকি মস্কোর গুপ্তচর। মস্কোর নির্দেশ অনুযায়ী উত্তর পশ্চিম সীমান্তে সুভাষচন্দ্রের সহযোগীদের ধরিয়ে দেয়। ভগৎরামের দল "কীর্তি কিষাণ পার্টি"ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে ভিড়ে যায়। এতে মারাত্মকভাবে তিনি মুষড়ে পড়েন । ইউরোপের প্রচেষ্টা অসফল হওয়ায় সুভাষের নজর পড়লো জাপানের উপর । পূর্ব প্রাচ্যে বাঁধলো যুদ্ধ। সিঙ্গাপুর ও রেঙ্গুন চলে গেল জাপানের হাতে। জাপানিরা হিটলারের কাছে ভারতে ক্রিপস মিশন পৌঁছানোর আগে ভাগে প্রস্তাব দিল জাপান-জার্মানি বাহিনী এগিয়ে এসে ভারত মহাসাগরে মিলিত হওয়া প্রয়োজন। আর প্রয়োজন হলে হিটলার রাশিয়ার সঙ্গে বিবাদ মিটিয়ে ফেলুন । কারণ মিত্রপক্ষকে যুদ্ধে পরাস্ত করতে হলে আগে ভারত মহাসাগরে অক্ষত্রয়ীর মিলিত হওয়া প্রয়োজন। হিটলার কিন্তু এই প্রস্তাবে কান দিলেন না । তার একমাত্র লক্ষ্য রাশিয়া জয় করা ,ব্রিটিশ সাম্রাজ্য ভগ্ন করাটা তার লক্ষ্য নয় ।1942 সালে অক্ষশক্তির মিলিত হওয়ার যে সুবর্ণ সুযোগ এসেছিল তা হারিয়ে গেল।স্তালিনগ্রাডে জার্মান বাহিনী আটকে গেল। জাপানিরা সিংহল আক্রমণ করে ভারতে হানা দেওয়ার যে ছক কষে ছিল তাও ভেস্তে গেল কেননা হিটলার বাহিনী মিশর থেকে ভারত মহাসাগরে এগিয়ে আসতে তৈরি নয় । এই সময়ে" ভারত ছাড়ো " আন্দোলন জোরদার হয় । কিন্তু জাপান ও জার্মান বাহিনী কোন দেশই ভারত আক্রমন করতে প্রস্তুত নয়। সুভাষ বসুর ছক ছিল " বহিঃ আক্রমণ ও ভারতের অভ্যুত্থান " জোড়া আক্রমণ ঘটলে ইংরেজরা পিছু হটতে বাধ্য হবে । এটা ফলপ্রসূ হয়নি বলে তার ক্ষোভ বাড়তে লাগলো । তিনি জাপান পালিয়ে আসতে মনস্থির করেন । কিন্তু আসবেন কি ভাবে ?
অনেক আলাপ আলোচনার পর ঠিক হয় তাকে সাবমেরিন করে পূর্ব প্রাচ্যে পাঠানো যেতে পারে। হিটলার ও সুভাষ এর মধ্যে শেষ সাক্ষাৎ ঘটে। হিটলার সুভাষ কে বলেন জার্মান ডুবো জাহাজ ও উড়োজাহাজ নিয়ে ইংরেজদের উপর বার বার আঘাত হানছে। এর বেশি ভারতের জন্য কিছু করা সম্ভব নয়। তিনি ম্যাপ দেখিয়ে প্রমাণ করে দেন যে ভারত এখান থেকে অনেক দূরে।তাই এর বেশি কিছু করা সম্ভব নয়।
বহু প্রতিক্ষার পর অবশেষে সুভাষচন্দ্র পূর্ব প্রাচ্যে পৌঁছালেন ।আজাদ হিন্দ ফৌজ রওনা দিল ইম্ফলের উদ্দেশ্যে । তখন বড্ড দেরী হয়ে গেছে। জার্মানরা রাশিয়ায় পিছু হটতে শুরু করেছে । প্রশান্ত মহাসাগরে জাপানিরা আমেরিকানদের সাথে পেরে উঠতে পারছেনা । এদিকে ভারত আক্রমন করার কোন প্ল্যান জাপান সরকার তৈরি করেনি। জাপানি বাহিনী ও আজাদ হিন্দ ফৌজ সাময়িক ভাবে অভিযান থেকে পিছু হটতে বাধ্য হলো।
টোকিও তে বসে সুভাষ রাশিয়ার সঙ্গে কথা বলতে শুরু করলেন। তাদের কে বোঝালেন মিত্র পক্ষ ও সোভিয়েত ইউনিয়ন এর স্বার্থ এক নয়।তাই আপনাদের কাছে অনুরোধ আপনারা ভারতের স্বাধীনতার দিকে তাদের ক্ষমতা প্রয়োগ করুন।
জাপান যখন পশ্চাদপসরণ করছে তখন সুভাষচন্দ্র বসুর অনুরোধে আজাদ হিন্দ সরকারের অন্তত সর্বাধিনায়ককে রাশিয়া পৌঁছে দেবার ব্যবস্থা করা হোক। এদিকে রাশিয়া ও জাপান তখন পরস্পরের সঙ্গে লড়াইয়ে ব্যস্ত। তবে জাপানের সেনারা সুভাষচন্দ্র বোস কে শ্রদ্ধা করতেন বলেই শেষ পর্যন্ত তারা রাজি হন । সুভাষচন্দ্র যদি রাশিয়া পৌঁছাতে পারতেন তবে কি হতো বলা মুশকিল। কেননা রুশদের ধারণা ছিল ইংল্যান্ড এর বিরুদ্ধে বিরোধের তলে তলে অন্য কোনো যোগসূত্র আছে। তা না হলে অত সহজে কাবুলে পৌঁছে গেলেন কিভাবে?আর ইংরেজরা ও জেনে শুনে তার পৌঁছে যাওয়া আটকালো না কেন? অনেক প্রশ্ন ঘুরপাক খায়।
বাস্তবিক ভাবে সুভাষচন্দ্র কোন বৃহৎ শক্তির হাতে নিজেকে সমর্পণ করতে চাননি। তিনি তাদের কাজে লাগাতে চেয়েছিলেন মাত্র । তার একটাই উদ্দেশ্য ভারতের মুক্তি । ভারতের মুক্তির জন্য শত্রু পক্ষের বক্তব্য ছিল সুভাষচন্দ্রকে বাইরের শক্তি কাজে লাগাচ্ছে ।আসলে রুশদের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে গেলে তার উল্টোটা চোখে পড়ে। তারা সন্দেহ করছে বাইরের শক্তিগুলো সুভাষচন্দ্র কে কাজে লাগাচ্ছে। এই মত বিরোধ রুখতে সুভাষচন্দ্র মহাত্মা গান্ধীর উদ্দেশ্যে রেডিও ভাষণে বলেছিলেন" On who has stood for national self respect and honour of his life and has suffered considerably in vindicating it, would be the last person in this world to give in to any other foreign power."।
অবশেষে জাপানি প্লেন মাঞ্চুরিয়া নিয়ে যেতে রাজি হলো। পরিকল্পনা ছিল রুশ সেনাবাহিনীর কাছাকাছি প্যারাস্যুট দিয়ে নামবেন। অন্য দিকে আজাদ হিন্দ ফৌজ রেঙ্গুন থেকে পিছু হটে সাইগন আসে। সাইগন থেকে প্লেন রওনা হলো তাইপে। তাইহেকু বিমান বন্দরে 18 আগষ্ট প্লেনের জ্বালানি কম থাকায় জ্বালানি নিতে কিছুক্ষন অপেক্ষা করতে হলো । জ্বালানি ভরে নিয়ে উড়তে যাওয়ার সময় দেখা দেয় বিপত্তি। ইঞ্জিনের সমস্যা থাকায় ভেঙে পড়লো প্লেন।দাউ দাউ করে তা জ্বলে উঠলো । পড়িমরি করে বিমান যাত্রীরা প্লেন থেকে নামতে সবাই ব্যাস্ত। সুভাষচন্দ্র যখন নেমে এলেন তখন মনে হচ্ছিল যেন একটা আগুন মানুষ বেরিয়ে আসছে । সমস্ত শরীর দিয়ে বেরুচ্ছে লকলকে আগুন। তাড়াতাড়ি নিয়ে যাওয়া হলো হাসপাতালে। তখন তার সাথী ছিলেন হাবিবুর রহমান। হাসপাতালে বেডে বলতে লাগলেন জাপানি ভাষায় মিজু,মিজু (মানে জল জল)।
আক্ষেপ করে অতি কষ্ট করে হাবিবুর রহমানকে বারবার বলতে লাগলেন ভারতের স্বাধীনতা না দেখে ই তাকে চলে যেতে হচ্ছে। এটা আমার তথা ভারতবাসীর দুর্ভাগ্য। কিন্তু তিনি দেখতে পাচ্ছেন ভারতের স্বাধীনতা অতি সন্নিকটে...
-------------------------তথ্যসুত্র-
প্রসঙ্গ সুভাষ ( কৃষ্ঞা বসু) আনন্দ পাবলিশার্স
আধুনিক ভারত দ্বিতীয় খণ্ড প্রণব কুমার চট্টোপাধ্যায় (1920-1947) কলকাতা 1999
সুভাষচন্দ্র একটি সংক্ষিপ্ত মূল্যায়ন, পশ্চিম বঙ্গ পত্রিকা (ডিসেম্বর-জানুয়ারী) সংখ্যা 1996-1997