হারান চন্দ্র মিস্ত্রী
দেশভক্তি কথাটি বহু প্রচলিত। কথাটা শুনেছে বীরেন। কিন্তু, কিভাবে দেশের প্রতি ভক্তি দেখাতে হয় জানে না সে। তার পাড়ার বহু লোক নিজেকে দেশভক্ত বলে দাবি করে। এমনকি তাদের পাড়ার একটি ক্লাবের অনুষ্ঠানে এবছর এক ভদ্রলোক এসেছিলেন। তাঁকে মঞ্চে তুলে গলায় মালা দিয়ে সম্বর্ধনা দেবার সময় তাঁকে দেশভক্ত বলে ঘোষনা করা হচ্ছিল। কেন তিনি দেশভক্ত জানতে ইচ্ছা করে বীরেনের।
বীরেন দেশভক্তের বৈশিষ্ট্য জানতে চায়। কিছুতেই জেনে উঠতে পরে না। পড়া ছাড়া দেশভক্তি বিষয়টি অষ্টম শ্রেণীর এই ছাত্রের মাথায় ঘুরেফিরে উঁকি দেয়। ক্ষুদিরাম, নেতাজী, গান্ধীজীর দেশভক্তির কথা বোঝা যায়। ইতিহাসে তাদের নাম রয়ে গেছে। ক্লাবের মঞ্চে যাঁর গলায় মালা দেওয়া হলো তাঁর তো এখনো মৃত্যুই হয় নি। সে দেশভক্ত হয় কিভাবে?
বীরেনের টিফিনের পয়সা জমে গিয়েছে। এখন একশ বারো টাকা তার হাতে। এক বছর ধরে একশ টাকার নোটটি বয়ে বেড়াচ্ছে। তার ক্লাসের এক সহপাঠী খাতা কিনতে পারছে না পয়সার অভাবে। প্রতিদিন শিক্ষকের কাছে কথা শোনে। তাকে ডেকে নিয়ে বীরেন একটি খাতা কিনে দিল।
খবরটি চাপা রইল না। ছেলেটি আর এক সহপাঠীকে বলতেই কানে কানে কথাটি শিক্ষকদের কানে উঠে গেল। ছাত্র-ছাত্রী এবং শিক্ষক-শিক্ষিকা সবার কাছে বীরেন পরিচিত হয়ে উঠল। একজন শিক্ষক বললেন,"বীরেন শুধু ভালো ছাত্র নয়, সে সহানুভূতিশীল।"
পাড়ায় খেলতে যায় বীরেন। ছুট আর ব্যায়াম করা তার খুব পছন্দ। একদিন সকালে ছুটে সে নদীর কাছে যায়। আবার ছুটতে ছুটতে ফিরছিল। সেইসময় পাড়ার উপেন ঠাকুরদা রাস্তার পাশে বসে কাঁদছিল। তাঁকে দেখে বীরেনের হৃদয় বিহ্বল হয়ে ওঠে। সে শিশুদের কাঁদতে দেখেছে, কিন্তু বয়স্কদের কাঁদতে দেখে নি। সে উপেনকে জিজ্ঞেস করল,"কাঁদছ কেন ঠাকুরদা?"
উপেন বলে,"রাত থেকে পেটব্যথা করছে। ডাক্তারখানায় বাকি পড়েছে। আর বাকি দেবে না। তাই ডাক্তারখানায় যেতে পারছি না।"
বীরেন জিজ্ঞেস করল,"কত টাকা পেলে তুমি ওষুধ আনতে পারবে।"
"পঞ্চাশ টাকা পেলে হবে," বলল উপেন।
"এখানে দাঁড়াও। আমি এক্ষুনি আসছি।" বলে বীরেন ছুটে চলে গেল। কিছুক্ষণ পরে এসে বলল,"ঠাকুরদা এই টাকাটা নাও। ওষুধ এনে খাও। তোমার অসুখ সেরে যাবে।"
উপেন বলল,"আমি তোমার টাকা ফেরত দিতে পরর কিনা জানি না। আশীর্বাদ করি, তুমি ভালো থাকো।" বলে উপেন চলে গেল।
গরিব উপেনের পেটের যন্ত্রণা দূর হয়ে গেল। বীরেনের সাহায্যের কথা উপেন চেপে রাখেনি। ওইতুকু ছেলে তার বিপদে সাহায্য করতে এগিয়ে এলো! ও সমাজসেবী হবে।
গল্পটা পাড়ায় চাউর হয়ে গেল। অনেকে বলল,"এ আর এমনকি ব্যাপার। সামান্য পঞ্চাশ টাকা আমিও দিতে পরতাম।"
উপেন তাদের একজনকে বলেছিল,"দিতে পারতে ঠিকই, দিতে পারনি। সেদিন ভোরে তোমার কাছে ধার চাইতে গিয়েছিলাম। দাওনি। ওই ছেলেটা আমার কাছে উদাহরণ হয়ে রইল।"
এক বুড়ির হাতে লাঠি। আর এক হাতে একটি পলিথিনের প্যাকেটে কয়েকখান জিলাপি। সেদিন ২৩শে জানুয়ারী। বিভিন্ন ক্লাব ও স্কুলে নেতাজীর জন্মদিন পালন করা হচ্ছে। অনুষ্ঠান শেষে চলছে জিলপি বিতরণ। বুড়িও কয়েকখানা ধরে নিয়েছে। একজনের কাছে গিয়ে বুড়ি বলল,"আমাকে পাঁচটা টাকা দেবে। আর মিষ্টি খেতে ভাল লাগে না। আমি মুড়ি খাবো।"
লোকটি তার গায়ের ময়লা কাপড় দেখে বলল,"সরে যা। পাগলীরা কোথা থেকে যে আসে!"
বুড়ি সরে যায়। বীরেন লোকটির কথা শুনে মনে মনে আওড়াল,"পাগলীরা কোথা থেকে আসে?"
বুড়ি বীরেনকে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বলল,"আমাকে একটু মুড়ি খেতে দেবে, বাবা?"
বীরেন ভাবে, তার মা এভাবে কারো কাছে হাত পেতে খায় না। মানুষ কতটা অসহায় হলে তবে অন্যের কাছে হাত পাতে! সে বুড়িকে মুড়ি কিনে দিয়ে বলল,"তোমার কেউ নেই?"
বুড়ি বলল," বাড়িতে আমার ছেলে-বৌমা আছে। আর একটা ছোটো নাতনী। তার জন্য মিষ্টিকটা নিয়ে যাবো। ছেলেটা কাজ করেও সংসার চালাতে পারছে না। তাই আমি ভিক্ষা করি।"
সেদিনের দেশভক্ত ভদ্রলোকের বক্তব্য ঠিক ছিল। তিনি বলেছিলেন, নেতাজী এই স্বাধীনতা চায় নি। ক্ষমতা হস্তান্তর করে আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি। পুরোপুরি যুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা লাভ করলে আমরা আরো বেশি স্বাধীনতার অর্থ বুঝতে পরতাম। আমরা এমন স্বাধীনতা পেলাম যে, দেশের মায়েদের ভিক্ষা করে খেতে হচ্ছে।
সে বুড়িকে একটি বাড়ি দেখিয়ে বলল,"আগামীকাল ওই বাড়িতে আসবে। ওটা আমাদের বাড়ি। তুমি আমাদের বাড়িতে ভাত খাবে।"
বুড়ি বলল,"তোমার অনেক দয়া বাবা।" তার ময়লা হাত বীরেনের গায়ে বুলিয়ে দিয়ে বলল। তারপর সে চলে গেল।
বাড়ি ফিরে বুড়ির করুন অবস্থার কথা ভাবতে লাগল বীরেন। সে ভাবে, সে বড় হয়ে যদি চকরি না পায়, কিভাবে চালাবে সংসার। দেশে কি তাহলে প্রকৃত স্বাধীনতা আসেনি। নাকি আমরা স্বাধীনতার অপব্যবহার করছি।
পরিস্থিতিটা দেশের দুর্দিন বলে মনে করছে বীরেন। এই দুরবস্থা থেকে মুক্তি পেতে হলে আরো একটা লড়াই প্রয়োজন। সে লড়াই হবে ক্ষুধার বিরুদ্ধে লড়াই। উপার্জনের জন্য লড়াই। শিক্ষার জন্য লড়াই। নয়তো ভারতবসীর প্রকৃত মুক্তি নেই।
পরের দিন বুড়ি এল না। বীরেন চিন্তিত হয়ে পড়ল। তার পরের দিনও বুড়ির দেখা নেই। বীরেন নিশ্চিত হল, তার কথায় বিশ্বাস করে উঠতে পারেনি সে। কিন্তু ২৬শে জানুয়ারী প্রজাতন্ত্র দিবসের দিনে বুড়ি এসে হাজির। তাকে দেখে বীরেন বলল,"তুমি আসোনি কেন ঠাকুরমা?"
"আমাকে ওরা নিয়ে গিয়েছিল। আজ ছেড়েছে। আজ দশটার মধ্যে নাকি আমার সব জ্বালা-যন্ত্রণা দূর হয়ে যাবে,"বলল বুড়ি।
"ওরা কারা?"জিজ্ঞেস করল বীরেন।
"যারা আমার ওষুধ দিয়েছে," বলল বুড়ি।
"দেখি কেমন ওষুধ?" বলল বীরেন।
বুড়ি কোমরের কাপড় সরিয়ে দেখাল। ঔষধ দেখে চমকে উঠল বীরেন। বুড়ির কোমরে টাইম বোম বেঁধে দিয়েছে দুষ্কৃতীরা। বীরেন জিজ্ঞাসা করল,"এটা পরে আমার এখানে তোমাকে আসতে বলেছে তারা?"
"না, ওরা বলেছে কোথাও যাবে না। স্কুলমাঠে পতাকা তোলার সময় সবার মধ্যে দাঁড়াতে। ওখানে এসে ওরা আমাকে টাকা দিয়ে সাহায্য করবে। স্কুলের হেডমাস্টারের সঙ্গে ওদের কথা হয়েছে।" বলল বুড়ি। তারপর সে জিজ্ঞেস করল,"এখন কটা বাজে খোকা?"
"দশটা বাজতে অনেক বাকি। তুমি পান্তাভাত খেয়ে নাও। তারপরে যাবে।" বলে সে তার মাকে বুড়ির পান্তাভাত দেবার কথা বলল।
বীরেনের মা বুড়িকে পান্তাভাত দেবার আয়োজন করছে। বীরেন মায়ের মোবাইল নিয়ে বাগানের দিকে গিয়ে ১০০ নম্বরে ফোন করল। তারপর থানার বড়বাবুর সঙ্গে কথা বলতে চাইল। বড়বাবু ফোন ধরলে সম্পূর্ণ বৃত্তান্ত খুলে বলল। শেষে বলল সময় খুব কম। তাড়াতাড়ি চলে আসুন আমি ঠাকুরমাকে আমাদের বাড়িতে আটকে রাখছি।
এসব করতে গিয়ে বেশ কিছুক্ষণ সময় পেরিয়ে গেছে। বুড়ি পান্তাভাত খেয়ে চলে গেছে। বীরেন তার মায়ের কাছ থেকে জেনে নিয়ে স্কুলের দিকে দৌড়াল। পুলিশের নির্দেশ মতো কাউকে কিছু জানাল না। স্কুলের মধ্যে ঢুকে বুড়িকে ভিড়ের মধ্যে দেখতে পেল। সে আবার বড়বাবুকে ফোন করে জানাল," বুড়ি স্কুলের মধ্যে আছে।" বড়বাবু জানালেন,"স্কুল ঘিরে ফেলা হবে দশ মিনিটের মধ্যে।
বুড়িকে একধারে নিয়ে বসাও। গেটের বাইরে আসতে দিও না। তাহলে সন্ত্রাসীরা বুঝে যাবে।"
পুলিসের কথামত বীরেন কাজ করে চলেছে। দশ মিনিটের মধ্যে পুলিশ ও বোম স্কোয়াডের লোকেরা হাজির। বুড়িকে উদ্ধার করলো পুলিশ। বোমস্কোয়াডের কর্মীরা বোম নিষ্ক্রিয় করল। পুলিশ চিরুনি তল্লাসি করে দু'জন দুষ্কৃতীকে আটক করল। পুলিশ বুড়ি ও বীরেনকে ধরে নিয়ে চলে গেল।
এক সপ্তাহ পরে ফিরে এল বীরেন। সে বাড়ি ফিরে দেখে, পুলিশ পাহারা দিচ্ছে তার বাড়ি। স্কুলের পক্ষ থেকে তাকে সম্বর্ধনা দেওয়া হল। স্কুলকে অনেক বড় নাশকতা থেকে বাঁচিয়েছে সে। বড় ছক কষেছিল দুষ্কৃতীরা। প্রজাতন্ত্র দিবসের দিনটি ছিল তাদের টার্গেট।
গ্রামের বড় ক্লাব একটি অনুষ্ঠান করে তাকে সম্মান জানায়। তারা খবরের কাগজের কাটিং টাঙিয়ে উপরে বড় করে লিখে দেয় গ্রামের গর্ব বীরেন। এরপর পুলিশের পক্ষ থেকে আয়োজন করা হয় সবর্ধনা আনুষ্ঠান। জেলা পুলিসের বড়কর্তা তার হাতে একটি মানপত্র তুলে দেন। তিনি তাঁর বক্তব্যে বলেন,"দেশের প্রতি ভক্তি না থাকলে কেউ এভাবে জীবনের ঝুঁকি নেয় না। বীরেন দেশের গর্ব। বীরেন সব বয়সের মানুষের প্রেরণা হয়ে থাকবে।"
বীরেন আজ বুঝতে পারল দেশভক্তি কাকে বলে।
-------------------------------
হারান চন্দ্র মিস্ত্রী
গ্রাম ও পো:-আমতলা,
থানা- ক্যানিং,
জেলা-দক্ষিণ ২৪পরগনা
মোবাইল নং: 9733702450
Whats' App No:9733702450