সমব্যথী
প্রিয়ব্রত দত্ত
মোবাইলটা রেখে দিয়ে রাগে গজ গজ করতে করতে শোবার ঘর থেকে বেড়িয়ে যাচ্ছে সুতপা।-হাজার কাজ বাকি, হাজার কাজ বাকি, কী যে করি...
কমলা আজ আসবে না। খুব একটা কামাই করে না মেয়েটা। আজ যে কী হলো?
-কেন আসবে না কিছু বললো? বাথরুমের দিকে যেতে যেতে সুতপাকে জিজ্ঞাসা করে মনোজ।
- সত্যি মিথ্যে জানি না বাপু, ওর জায়ের না কি কী একটা অপারেশন হবে। আর আমার অপারেশনের শরীর, বাচ্চা মেয়ে, আমি কী করে সামলাবো? রান্না ঘর থেকেই ঠুং ঠাং বাসনের আওয়াজের মাঝে খাপ্পা মেজাজের উত্তর পেল মনোজ।
এতদিন ওদের কাজের লোক ছিল না। মিন্তি ওদের জীবনে আসতেই আর পেরে উঠছিল না সুতপা। বাধ্য হয়ে কমলাকে রাখা। ভালো মেয়ে। কলিগদের মুখে কাজের মেয়েদের নানান গল্প শুনেছে মনোজ। কামাই করলে যে কী সমস্যা, তাছাড়াও নানাবিধ জ্বালা যন্ত্রনা। তবে কমলার ক্ষেত্রে তেমন কিছু মনে হয় নি। কিন্তু এখন বছর দেড়েকের মিন্তির জন্য অনেকটা সময় যায় সুতপার। সত্যি একা একা পেরে ওঠে না ও। আজ খুব কষ্ট হবে। মনোজের অফিস না থাকলে আজ কিছুটা সাহায্য করতে পারতো। মিন্তি খাটে ঘুমুচ্ছে। মনোজ ধীর পায়ে রান্না ঘরে সুতপার পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। সুতপার দুগাল বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে।
মনোজ আলতো করে সুতপার পিঠে হাত রাখে। -আজ কি অফিস কামাই করে দেব।?
-না না, অফিস কামাই করো না। এমনিতেই ছুটি ছাটা নিয়ে তোমার অফিসে নানান ধরনের হ্যাপা তৈরি হয়, আমি ঠিক ম্যানেজ করে নেবো। তুমি একটা কাজ করো কাল কমলার মাইনের টাকাটা আর সঙ্গে আরো পাঁচশো টাকা রেখে যেও...
- হুম্, সেই ভালো, সুতপার কথার মাঝেই মনোজ বলে, ওর মাইনে দিয়ে ওকে বিদেয় করে দাও। একটা ভালো কাজের মেয়ের সন্ধান আছে। গতকালই তাপস বাবু বলছিলেন। বিধবা মেয়ে, একটা ছেলে আছে সেভেনে পড়ে। কাজ খুঁজছে। আমি আজই অফিস গিয়ে কথা বলছি।
সুতপা কিছু বললো না। হাতের উলটো দিক দিয়ে চোখ মুছে আবার কাজে মগ্ন হয়ে গেল।
সন্ধ্যেবেলা অফিস থেকে ফিরে এসে কোলে থাকা মেয়েকে একটা চুমু খেয়ে, সুতপাকে জড়িয়ে ধরলো মনোজ।
- সারাদিন তোমার ভীষণ কষ্টে কেটেছে জানি। তবে আর চিন্তা নেই তাপসদা ফোনে কথা বলিয়ে দিয়েছেন মেয়েটার সাথে। কমলার থেকে আরো দু'শ বেশি নেবে। কামাই করবে না। শুধু পুজো-পার্বণে বুঝেশুনে দিলেই হবে। কাল কমলাকে জবাব দিয়ে দাও পরশু থেকে কাজে লাগিয়ে দেব। সে দু'শটা টাকা বেশি নেয় নিক। তোমাকে তো কখনো কোন দামি জিনিস দিতে পারি নি, শুধু চেষ্টা করি তোমার যেন কষ্ট না হয়।
সুতপা মনোজ এর বুকে মাথা রেখে বললো, তুমি আমার জন্য এত ভাবো এটাই আমার কাছে সবচেয়ে দামি। কাল কমলা আসুক তারপর দেখছি।
পরদিন সকালে কমলার অপেক্ষায় মনোজও উদগ্রীব ছিল। কমলা এল কিন্তু অনেক দেরি করে। একটু যেন উদভ্রান্ত দেখাচ্ছে ওকে। সুতপা কি ওকে আগে থেকেই ফোনে জানিয়ে দিয়েছে কাজ ছাড়ানোর কথা? হতেও পারে, তাই ও হয়তো এমন খাপছাড়া লাগছে ওকে। অন্য দিন বেশ পরিপাটি, সুসজ্জিত থাকে কি না।
- দিদি, আজও আমি কাজ করতে পারবো না। শোবার ঘর থেকে মনোজ ওদের কথা শুনছিল।সুতপা হয়তো এই বলে বসলো তোকে আর কাজে আসতে হবে না... তবে সুতপা শান্ত গলায় বললো কেন রে? কী হলো আবার?
- আমার জায়ের অবস্থা ভীষণ খারাপ গো। নানা রকম রোগ, তার ওপর আবার জরায়ুতে সিস্ট ধরা পড়েছে। অপারেশন হয়েছে কিন্তু ভালো নেই। ওর ছেলেমেয়েদের জন্য একটু ভাতটাত ফুটিয়ে না দিলেই নয়। ওর সংসারটাতে একটু হাত লাগাতে হচ্ছে। কী যে করি?
- কী আর করবি? তোকে তো ওদের এইসময় সাহায্য করতেই হবে। মনে হয় আরো কদিন তোর কামাই হবে কি বল?
- না দিদি কাল থেকেই আবার চলে আসবো।
-না না শোন তোর এখন ওদের পাশে থাকা উচিত। যদি মনে করিস দুদিন বাদে আসবি, তাই আসিস। কোন সমস্যা নেই, আমি ঠিক চালিয়ে নেব। আর এই মাইনেটা রাখ। সঙ্গে পাঁচশো, এই মাসে থেকে বাড়িয়ে দিলাম। তোর ফেলে যাওয়া কাজ করতে গিয়ে দেখেছি সত্যি প্রচুর কাজ, কীভাবে সামলাস সে তুই-ই জানিস।
-দিদি গো... বলতে বলতে সুতপার পায়ে ঠকাস করে একটা প্রনাম করে কমলা, মনোজ ততক্ষণে রান্না ঘরে। আমি কালকেই আসবো।যে করেই হোক ও দিকটা সামলে আমি তোমারটা অন্তত করে দিয়ে যাব।
কমলা চলে যেতেই মনোজ সুতপার পিঠে হাত রাখে।
সুতপা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো, আসলে আমরা ততক্ষণ একজন আরেক জনের কষ্ট বুঝি না, যতক্ষণ না একজন পুরোপুরি আরেকজন হয়ে উঠছি।
--------------------------
ভালো
উত্তরমুছুনধন্যবাদ
মুছুন