ছোটগল্প ।। গরিব গরিবের বন্ধু ।। দীনেশ সরকার
গরিব গরিবের বন্ধু
দীনেশ সরকার
'বাবা সুমু, দেখ্ না বাবা ছাগলদুটো কত দূরে গেলো । একটু কাছাকাছি তাড়িয়ে নিয়ে আয় না বাবা' বলেই সুমুর মা আবার ঘরের দাওয়া নিকোতে লাগলো । ঘর মানে ছোট্ট এক চিলতে টালির ঘর, তার গায়ে একটা ছোট্ট দাওয়া । সামনে ছোট্ট একটু উঠোন, তার একপাশে ছোট্ট একটু রান্নার জায়গা আর তার পাশে ছাগলদুটো থাকার জায়গা । রেললাইনের ধারে জবরদখল বস্তি । পূর্ববঙ্গ অধুনা বাংলাদেশ থেকে আগত ছিন্নমূল উদ্বাস্তুদের গাদাগাদি করে বাস করার এই বস্তি । বস্তির পুরুষেরা অধিকাংশই লোকাল ট্রেনের হকার । ট্রেনে কেউ মশলা মুড়ি বেঁচে, কেউ চা বেঁচে, কেউ চিড়ে ভাজা, বাদাম ভাজা, চানাচুর বেঁচে, কেউ মশলা চানা বেঁচে আবার কেউ লজেন্স বেঁচে । কেউ শশা বেঁচে আবার কেউ কেউ মোজা-গামছা বেঁচে । লোকাল ট্রেনে হকারি করেই এদের রুটি-রুজির সংস্থান হয় । আবার কেউ রিক্সা টানে, কেউ বা ভ্যান টানে ।
লকডাউন শুরু হতেই লোকাল ট্রেন বন্ধ । বস্তিবাসীদের কাজকর্মও সব শিকেয় উঠেছে । দিন-আনা দিন-খাওয়া পরিবারগুলো কি করে বেঁচে থাকবে তার কোনো দিশা খুঁজে পায় না । যাদের রেশন কার্ড আছে তারা বিনামূল্যে কিছু চাল-গম পাচ্ছে, তাতে ক'টা দিন হয়তো চলছে কিন্তু যাদের রেশন কার্ড নেই তাদের অবস্থা সঙ্গীন । কেউ কেউ আবার গ্রামের দিকে যাচ্ছে, যদি খেতে-খামারে মজুরের কাজ পাওয়া যায় । কিন্তু লকডাউনে সব কাজই প্রায় বন্ধ বলা যায় । সে এক অকল্পনীয় অবস্থা ।
সুমুর বাবা ট্রেনে প্যাকেট করা চিড়ে ভাজা, বাদাম ভাজা, ঝুরি ভাজা বিক্রি করতো । এখন ট্রেন বন্ধ, তাই গ্রামের দিকে যায় যদি মজুরের কাজ পায় । তিন দিন ফিরে আসার পরে হয়তো একদিন কাজ জোটে ।
বছর আটেকের সুমু উঠোনে ড্যাং-গুলি খেলছিল । খেলতে খেলতে বললো, 'ফেলিকে বলো না মা, ফেলি ছাগলদুটোকে তাড়িয়ে নিয়ে আসুক ।'
বছর পাঁচেকের ফেলি উঠোনের এককোণে বসে তার পুতুলের কাপড় পরাচ্ছে । ফেলি চেঁচিয়ে উঠলো, 'দেখছিস্ না দাদা, আমি সোনাবৌয়ের কাপড় পরাচ্ছি । তুই যা ।'
সুমুর মা দাওয়া নিকোতে নিকোতে আবার বললো, ' যা না সুমু, দেখ না ছাগলদুটো কত দূরে গেল ।'
অগত্যা সুমু ড্যাং-গুলি খেলতে খেলতে রেল-লাইন ধরে এগোতে লাগলো । ছাগলদুটো ছাড়াই থাকে । রেললাইনের ধারে ঘাস খায় । শুধু একটু চোখে চোখে রাখতে হয় ।
কিছুটা গিয়েই দেখলো ছাগলদুটো লাইনের ধারে ঘাস খাচ্ছে । বেশীদূর যায় নি । তারপর চোখ পড়লো লাইনের উপর টেপি গালে হাত দিয়ে চুপচাপ বসে আছে । টেপি সুমুর থেকে একটু ছোট আর ফেলির থেকে একটু বড় । সুমু জিজ্ঞেস করলো, 'কিরে টেপি, এখানে চুপচাপ বসে আছিস কেনো ?'
টেপি বিষাদভরা মুখ তুলে সুমুর দিকে চাইলো । সুমু জিজ্ঞেস করলো, কিরে টেপি, তোর মুখচোখ অমন শুকনো শুকনো লাগছে কেন ?'
টেপি আস্তে আস্তে বললো, 'জানো সুমুদাদা, কাল আমাদের রান্না হয় নি ।'
'কেন রে, তোর মার কি শরীর খারাপ ?'
' না গো । ঘরে তো কিছুই নেই, কি রান্না হবে বলো ।'
'কেন, তোরা ফ্রীতে রেশনে চাল-গম পাস্ নি ।'
'না গো । আমাদের তো রেশন কার্ড নেই । আমরা তো সবে দুবছর এখানে এসেছি ।' জানো তো আমার মা ট্রেনে লজেন্স বিক্রি করতো । কত আর উপায় হ'তো বলো । মার কাছে যে কটা টাকা ছিল তাতেই এই ক'দিন চলেছে ।'
-' কেন, তোর মামারা কিছু দেয় নি ।'
'দিয়েছে । দুদিন অল্প-অল্প চাল দিয়েছে ।' জা্নো তো মামা ট্রেনে চা বিক্রি করতো । মামার তো আর জমানো টাকা নেই । মামারই এখন দিন চলছে না, আমাদের কি ক'রে দেখবে বলো ?'
'তোর মা কোথায় ?'
' মা সকালে বেরিয়েছে । যদি ধার দেনা করে একটু চাল আনতে পারে ।'
টেপি আর ওর মা বছর দুয়েক হ'লো এই বস্তিতে এসে উঠেছে । আগে ওরা বনগাঁর দিকে রেললাইনের ধারে একটা ঝুপড়িতে থাকতো । টেপির বাবা রিক্সা চালাতো । সারাদিন যা উপায় করতো তার বেশীর ভাগটাই মদের ভাটিতে খরচ করে রাত্রে ঘরে ফিরতো । প্রতিদিনই অশান্তি হতো, ওর মাকে মারধর করতো । টেপি কোনোদিনই বাবার আদর পায় নি । শেষে একদিন রাতে মদের ভাটিতে আর এক মাতালের সাথে মারপিট করতে করতে মার খেয়ে ছিটকে পাকারাস্তার উপর পড়লো টেপির বাবা । আর উঠলো না । মাথা ফেটে চৌচির । ওখানেই শেষ । নিরূপায় হয়ে টেপির মা টেপিকে নিয়ে এই বস্তিতে দাদার কাছে এসে উঠলো । দাদার ঘরের পাশে একটা চালাঘর বানিয়ে টেপিকে নিয়ে থাকে আর ট্রেনে লজেন্স বিক্রি করে । লকডাউনে সব বন্ধ ।
সুমু বললো, 'তোর খুব খিদে পেয়েছে না রে টেপি ।' টেপি ঘাড় নাড়লো । সুমু বুঝলো কাল থেকে টেপি কিছু খায় নি । সুমু বললো, 'তুই একটু বোস, আমার ড্যাং-গুলিটা রাখ, কোথাও যাবি না । আমি একটু বাড়ি থেকে আসছি ।' সুমু লাইনের পাশ দিয়ে বাড়ির দিকে ছুটলো ।
সুমুর মা ঘর নিকানো শেষ করে হাত-পা ধুয়ে ছেঁড়া গামছায় হাত মুছছে । ছুটতে ছুটতে সুমু ঢুকলো, বললো, 'মা, ছাগলদুটো ধারেকাছেই আছে । জানো মা, কাল না টেপিদের রান্না হয় নি ।'
'কেন রে, টেপির মার কি শরীর খারাপ ?'
' না মা, ওদের ঘরে কিছু নেই । তাই রান্না হয় নি । ওদের তো রেশন কার্ড নেই, তাই ফ্রিতে চাল-গম ওরা পায় নি । ওর মা সকালে বেরিয়েছে যদি কোথাও থেকে ধার-দেনা করে একটু চাল যোগাড় করতে পারে । জানো মা, টেপিটা কাল থেকে কিছু খায় নি । ওর মুখ চোখ সব শুকিয়ে গেছে । মনমরা হয়ে লাইনের উপর বসে আছে ।'
'আহা রে, ওইটুকু বাচ্চা মেয়ে কি খিদে সহ্য করতে পারে ।'
'মা, আমি টেপিকে এক প্যাকেট চিড়ে ভাজা দিয়ে আসবো ?'
সুমুর বাবা ট্রেনে চিড়ে ভাজা, বাদাম ভাজা, ঝুরি ভাজা বিক্রি করতো । তারই কিছুটা ঘরে অবশিষ্ট ছিল । কবে লকডাউন উঠবে, কবে আবার ট্রেনে হকারি করতে পারবে কেউ জানে না । ততদিনে প্যাকেট করা খাবার নষ্ট হয়ে যাবে । তাই সুমু-ফেলি সকাল সন্ধ্যায় খিদে পেলে ওইগুলো খায় । বাদাম ভাজা, ঝুরি ভাজা শেষ হয়েছে, শুধু কয়েক প্যাকেট চিড়ে ভাজা পড়ে আছে ।
সুমুর মা বললো, ' যা বাবা, দিয়ে আয় । আর শোন্, টেপিকে বলিস্ ওর মা ফিরলে যেন আমার সাথে দেখা করে । আমি ওদের কিছুটা চাল দিয়ে দেবো ।'
'তুমি ওদের চাল দেবে মা ?' সুমুর মুখটা খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠলো।
'হ্যা বাবা, আমরা তো ফ্রিতে কিছুটা চাল-আটা পেয়েছি । তার উপর তোর বাবা তো তিন দিন ফিরে এসে একদিন মজুরের কাজ করেছে, ক'টা টাকা তো পেয়েছে । আজ আবার গেছে, দেখা যাক কি হয় । টেপির মার তো কোনো উপায় নেই । তাই ওদের কিছুটা চাল দিয়ে দেবো । আমরা না হয় দুটো কম কমই খাবো । গরিবের পাশে তো গরিবকেই দাঁড়াতে হয় বাবা । বড়লোক কখনো গরিবের পাশে দাঁড়ায় না । গরিবই গরিবের বন্ধু । তুই যা টেপিকে চিড়ে ভাজাটা দিয়ে আয় আর ওর মাকে আসতে বলিস কিন্তু ।'
সুমু ঘরে ঢুকে দু-প্যাকেট চিড়ে ভাজা নিয়ে বের হ'তেই ফেলি চেঁচিয়ে উঠলো, 'মা দেখো, দাদা দু-প্যাকেট চিড়ে ভাজা নিয়ে যাচ্ছে ।'
সুমু বললো, ' মা, টেপি এক প্যাকেট খাবে আর আমি এক প্যাকেট খাবো, তাই দু-প্যাকেট নিয়ে যাচ্ছি ।'
সুমুর মা বললো, 'আচ্ছা যা । টেপির মাকে আসতে বলিস্ কিন্তু ।'
'ঠিক আছে মা' বলে বোনের দিকে তাকিয়ে ভেংচি কেটে সুমু দৌড় লাগালো ।
সুমু দেখলো টেপি সেইভাবে উদাস হয়ে রেললাইনের উপরে বসে আছে । সবার মতো টেপিও হয়তো ভাবছে , কবে যে ট্রেন চলবে, আর কবে যে ওর মা ট্রেনে উঠে হকারি করবে । সুমুর পায়ের আওয়াজ পেয়ে টেপি ফিরে তাকালো । সুমু বললো, 'এই নে টেপি, এই দু-প্যাকেট চিড়ে ভাজা রাখ । এখন এক প্যাকেট খাবি আর পরে খিদে পেলে আর এক প্যাকেট খাবি ।'
চিড়ে ভাজার প্যাকেট দুটো হাতে দিতেই টেপির মুখটা খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠলো ।
সুমু বললো, 'আর শোন্ টেপি, তোর মা ঘরে ফিরলেই আমাদের বাড়িতে আসতে বলবি । আমার মা ডেকেছে । আমার মা তোদের কিছুটা চাল দেবে ।'
' তাহলে আজ আমরা ভাত খাবো, বলো ।' টেপির মুখটা অনাবিল আনন্দে উদ্ভাসিত হ'লো ।
এমন সময় দু-নম্বর লাইন দিয়ে প্যাসেঞ্জার ভর্তি একটা ডাউন লোকাল ট্রেন ছুটে গেল । টেপি চিৎকার করে উঠলো, 'সুমুদাদা, দেখো, দেখো, লোকাল ট্রেন চলছে ।'
' তাই তো রে, ওই তো লোকাল ট্রেন চলছে ।'
তারপর, 'লোকাল ট্রেন চলছে ! লোকাল ট্রেন চলছে' চিৎকার করতে করতে সুমু বাড়ির দিকে দৌড় লাগালো ।
সুমুর বাবার আজ আর কোথাও কাজ হয় নি । বাড়ি ফিরে দাওয়ায় বসে গামছা দিয়ে ঘাম মুছছে । ছুটতে ছুটতে সুমু ঢুকলো, 'বাবা, প্যাসেঞ্জার ভর্তি এক্ষুণি একটা ডাউন ট্রেন গেলো । তুমি দেখেছো ?'
সুমুর বাবা বললো, 'হ্যাঁ বাবা, দেখেছি ।'
' তাহলে কাল থেকে তুমি আবার হকারি করবে বলো । আমরা আবার আগের মতো হবো ।'
'না বাবা । ওটা স্পেসাল ট্রেন । ওই ট্রেনে আমাদের উঠতে দেবে না । ওই ট্রেনে শুধুমাত্র রেলের কর্মচারিরা যাতায়াত করতে পারবে ।'
সুমুর ছোট্ট মাথায় কিছুতেই ঢুকছে না, হোক না স্পেসাল ট্রেন, ট্রেন ভর্তি তো প্যাসেঞ্জার । তাদের তো খিদে পাবে, তাদের তো ছেলে-মেয়েদের জন্য লজেন্স- চানাচুর নিয়ে যেতে ইচ্ছে হবে । তবে কেন সুমুর বাবা, টেপির মাদের ট্রেনে হকারি করতে দেবে না ।
সুমু অবাক হয়ে বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো ।
********************************************************************
দীনেশ সরকার
১৪০ ডি, হিজলি কো-অপারেটিভ সোসাইটি,
প্রেমবাজার, খড়্গপুর, পশ্চিম মেদিনীপুর ---- ৭২১৩০৬
মোবাইল ও হোয়াটসঅ্যাপ নং ঃ ৯৮০০৪২১৫৩৫