বড়গল্প।। সুখের সন্ধানে।। উত্তম চক্রবর্তী
সুখের সন্ধানে
উত্তম চক্রবর্তী
শৈবালের কথায় একটা ইঙ্গিত ছিল যেটা রিমা ঠিক বুঝতে পারল কিনা বোঝা গেল না। শৈবাল হয়ত চাতক পাখীর মত একটু ভালোবাসার কাঙাল হয়ে রিমার উত্তরের অপেক্ষায় ছিল। কিন্তু রিমা হঠাৎ অন্য প্রসঙ্গে চলে যাওয়ায় শৈবাল চুপ করে রিমার শান্ত পদ্মদিঘির মত টলটলে মুখটার দিকে তাকিয়ে ভাবতে লাগল ‘ কী করে একে বোঝাব যে তোমাকে ছাড়া আমি বাঁচবো না, আমার এই মনটাই যে চুরি করে নিয়েছ তুমি ’।
রিমা আজ প্রায় দুইমাস যাবৎ আছে শৈবালদের এই ছোট্ট খোলিতে। ঘাট কোপার রেলস্টেশন থেকে মাত্র দুই কিলোমিটার দুরে আম্বেদকর কলোনিতে শৈবালদের এই চাল। মুম্বাইতে এইসমস্ত একই রকম দেখতে বাড়িগুলিকে বা খোলিকে চাল বলেই চেনে সবাই। এর একেকটা চালে একেকটা পরিবার থাকে। অনেকক্ষেত্রেই চাল ছোট এক কামরার হয়। এখানকার একেকটা চালে দুটো বড় ঘর যার মধ্যে পিছনেরটাতে পারটিশন দিয়ে একটা ছোট রান্নাঘর আরেকটা টয়লেট কাম স্নানের ঘর করা আছে। বাকিঅংশ মেয়েদের থাকবার। আর সামনের ঘরটা বসবার কাম ছেলেদের শোবার ঘর। এরই মধ্যে মাথা গুঁজে থাকে একেকটা চার থেকে ছয় জনের পরিবার। এই চালগুলির মালিককে মাসে শুধু আট হাজার টাকা ভাড়া দিতে হয়।
শৈবাল ওর মা বাবা আর ছোট ভাই প্রবালকে নিয়ে এই চালে আছে তাও প্রায় চোদ্দ পনের বছর হল। ওর একমাত্র বোন চম্পার বিয়ে দিয়ে দিয়েছে চার বছর হল। চম্পার বর বিলাস সিন্ধে মারাঠি মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে। বি ই এস টি সি তে চাকরি করে, ভাল মায়না পায়। প্রবাল এবার এম এস সিতে ফাইনাল ইয়ার পড়ছে। শৈবালের বাবা রেলের কেরানি ছিলেন। আজ প্রায় পাঁচ বছর হল রিটায়ার করে বাড়িতেই বসা। তবে শৈবালের মা কিন্তু ওনার প্রাইমারি স্কুলের অঙ্কের দিদিমনির চাকরিটা ছাড়েননি।
রিমার আসল নাম মধুরিমা মল্লিক। বর্ধমানের পালসিট গ্রামের মনোতোষ মল্লিকের বড় মেয়ে। রিমা আর ওর বন্ধু ইলা দুজনে মিলে মুম্বাইতে সিনেমায় নামবার উদ্দেশ্যে বাড়ি থেকে পালিয়ে সোজা হাওড়া স্টেশনে চলে গেছিল বছর দুয়েক আগে এক সন্ধ্যা বেলা। দুজনেই তখন বারো ক্লাস ফাইনাল পাশ করে কলেজে ভর্তির জন্য তৈরি হচ্ছে। কিন্তু আজকালকার মেয়েদের মতই চোখে অনেক রঙিন স্বপ্ন ওদের। দুজনেই প্রায় সম বয়সী, প্রায় কুড়ির কাছাকাছি। হিন্দি সিনেমা দেখে দেখে দুজনেই এবার নিজেরাও সিনেমায় নামবার জন্য প্রস্তুত হচ্ছিল। অপেক্ষা করছিল শুধু হায়ার সেকেন্ডারির রেজাল্ট বের হবার।
ইলা তেমন একটা ভাল স্টুডেন্ট নয়, কোন মতে থার্ড ডিভিসনে পাশ করেছিল। কিন্তু রিমা হাই সেকেন্ড ডিভিশনে পাশ করে। ওর বাবা মা বড়দা বা ছোট বোন কেউই জানতে পারেনি যে সেইদিন বিকেলে ইলাকে নিয়ে রিমা রঙিন স্বপ্নের হাতছানিতে অন্ধকারকে উপেক্ষা করে এক অজানা জগতের দিকে পা রাখবে। একটা ছোট ব্যাগে কয়েকটা ভাল এবং কয়েকটা বাড়িতে পড়বার জামা কাপড় নিয়ে সালোয়ারের ওরনিতে মুখ ঢেকে দুজনেই উঠে বসেছিল পাঁচটা পঁয়ত্রিশের বর্ধমান হাওড়া লোকাল ট্রেনে। আর হাওড়ায় নেমেই সাধারন সেকেন্ড ক্লাসের টিকিট কেটে উঠে পড়ে ছিল রাত আটটার হাওড়া মুম্বাই মেলে।
রিমার চেহারাটা বেশ সুন্দর। লম্বায় প্রায় সাড়ে পাঁচ ফুট, গায়ের রং ফর্সা ও স্বাস্থ্য বেশ ভাল। কুড়ি বছরের একটা সুন্দরী যুবতি বলতে যা বোঝায়। অন্য দিকে ইলার গায়ের রঙটা একটু চাপা, মাথায় কোঁকড়ানো চুল। যদিও ইলা লম্বায় রিমার চেয়ে একটু উচুই হবে কিন্তু ওর মুখটা অত মিষ্টি নয়, বরং একটু লম্বা ধরনের। কিন্তু ওর স্বাস্থ্য বেশ ভাল আর আকর্ষণীয়। দুজনকে দেখলে বোঝাই যায়না যে ওরা গ্রাম্য পরিবেশে মানুষ। যদিও ইলেভেন টুয়েলভ ওরা বর্ধমানে নিবেদিতা কলেজ থেকে পড়েছে আর তাতেই ওদের গায়ে শহরের হওয়া লাগিয়ে রঙিন চশমা পড়িয়ে দেয়।
রাতের ট্রেনে দুজনকেই বেশ কষ্ট করে ভিড়ের মধ্যে চাপাচাপি করে বসতে হয়েছিল। গরমকাল, হাওড়া স্টেশনে দালালদের পঞ্চাশ টাকা করে হাতে দিয়ে দুজনেই জানলার ধারে সিট পেয়ে গিয়েছিল। কোনমতে কচুরি তরকারি দিয়ে রাতের খাবার খেয়ে দু’জন গভীর রাতে ট্রেনের ঝাকুনিতে ঘুমিয়ে পড়ে। ভিড় ট্রেনে সেই সুযোগে মাঝরাতে কোন বদমাশ লোক ওদের দুজনের সিটের নিচে রাখা ব্যাগ তুলে নিয়ে চলে যায়। নাগপুর স্টেশনে স্পেশাল টি টি ওঠে ট্রেনে, টিকিট দেখাতে বলে। তখন রিমা আর ইলার নজরে পড়ে যে ওদের ব্যাগ চুরি হয়ে গেছে যার ভিতরে ওদের টিকিট টাকা পয়সা ইত্যাদি সবকিছু ছিল। টি টি কোন অনুরোধের পারোয়া না করে দুজনকেই ট্রেন থেকে নামিয়ে দেয় নাগপুর স্টেশনে। বেলা তখন প্রায় আড়াইটা।
গরমের ছুটি পড়ে গেছে। নাগপুর স্টেশনে যাত্রীদের চূড়ান্ত ভিড়। রিমা ও ইলার অত সুন্দর চেহারা এবং ওদের এই দুর্দশা দেখে নাগপুরেরই এক বাঙালি ভদ্রলোক অবনি মুখারজির দয়া হয়।ভদ্রলোক ঐ ট্রেনেই ফিরছিলেন কলকাতা থেকে বিরাটিতে ওনার বাবা মার সাথে দেখা করে। উনি সপরিবারে নাগপুরেই থাকেন ও ধানতোলিতে একটা খাবারের হোটেল চালান প্রায় বছর দশেক হবে। মেয়ে দুটোকে টি টি যখন নাগপুর স্টেশনে নামিয়ে দেয় তখন উনি এগিয়ে আসেন ওদের সাহায্য করতে। এই অজাচিত বিপদের সময় রিমা ও ইলা যেন হাতে চাঁদ পায় তখন। বিদেশ বিভূঁইয়ে কে এমন ভাবে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেবে ? মধ্যবয়সী অবনি মুখারজি রিমা ও ইলাকে নিজের বাড়িতে নিয়ে গিয়ে তোলেন।
অবনি মুখারজির বাড়িতে আছে চারজন। ওনার দশ বছরের ছেলে নিমাই,ওনার শালা বাবলু ও স্ত্রী বনলতা। এই অবনি বাবুর ভাড়া বাড়িতে তিনটে ঘর। একটা বসবার আর দুটো শোবার ঘর। অবনি বাবু স্ত্রীকে আলাদা করে ডেকে বোঝান যে এই মেয়ে দুটোকে উনি হোটেলের কাজে লাগিয়ে দেবেন। এবার উনি কলকাতায় আবার চেষ্টা করেছিলেন একটা অন্তত কাজের মহিলাকে নাগপুরে নিয়ে আসবার। কিন্তু কেউই কলকাতা ছেড়ে আসতে রাজি হয়নি। এই দুটো মেয়ে বাড়ি থেকে পালিয়ে আসা মেয়ে। সুতরাং ওদের আর কোথাও যাবার যায়গা নেই। এখানেই হোটেলে কাজকর্ম করবে আর ওরা থাকা খাওয়া আর কিছু টাকা হাতে দেবে। অবনি বাবুর কথায় বুদ্ধিমতী বনলতা সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে যায়।
রিমা আর ইলার কাছে আর কোন রাস্তা খোলা ছিল না। আপাতত ওদের মুম্বাই অভিযান বাতিল করে দুজনেই অবনি বাবুর হোটেলে রান্না বান্নার কাজে হাত লাগিয়ে দিল। সামনের বসবার ঘরে মেঝেতে দু’খানাতোষক বালিশ দিয়ে ওদের দুজনের রাতে শোবার ব্যাবস্থা হয়। খাওয়া দাওয়া ও থাকার যায়গা ছাড়া প্রথম মাস থেকেই অবনি বাবু ওদের হাতে প্রত্যেককে তিন হাজার টাকা করে দিতে থাকেন। অগত্যা একপ্রকার বাধ্য হয়েই দুই বন্ধু ঝর্নার জল যেমন নিজের অজানা উদ্দেশে চলতে থাকে সেইভাবে সময়ের প্রবাহে গা ভাসিয়ে দেয় ও অবনিবাবুর পরিবারের সাথেই একবছরের উপর কাটিয়ে দেয়।
রিমার মনের সেই সিনেমায় নামার স্বপ্নটা কিন্তু সময়ের কঠিন মাটির তলায় ধিকিধিকি জ্বলতেই থাকে। মনে মনে প্ল্যান করে যে টাকা পয়সা একটু জমলেই ইলাকে নিয়ে আবার পালাবে এবং সোজা গিয়ে মুম্বাইতে উঠবে। সিনেমায় ওকে যে ভাবেই হোক নামতে হবে, অত সহজে হাল ছাড়বার পাত্রী রিমা নয়। কিন্তু ইলাকে আপাতত কিছু জানায় না ও। ভগবানের বোধ হয় সেটাই ইচ্ছা ছিল। এক বছর বাদেই একদিন এমন একটা ঘটনা ঘটল যাতে রিমা বাধ্য হল আবার রাস্তায় নামতে।
অবনি বাবুর শালা বাবলুর বয়স এখন পঁচিশ বছর। আধুনিক যুবক, কলেজে তিন বার চেষ্টা করেও বি এ পাশ না করায় বাবা ওকে কলকাতা থেকে দিদির বাড়ি পাঠিয়ে দেন যাতে জামাইবাবুর সাথে হোটেলে কাজ করে ব্যবসাটা শিখে এসে বিড়াটিতেই একটা খাবারের হোটেল খুলতে পারে। বাবলুর প্রথম দিন থেকেই নজর পড়ে গিয়েছিল ইলার উপর। সারাদিন হোটেলে ইলার উপর নজর রাখত এবং প্রায়ই রাতে ভিতরের ঘর থেকে উঠে এসে ঘুমন্ত ইলার দিকে তাকিয়ে থাকত। ইলার ফুটন্ত যৌবন ওকে ভীষণ ভাবে আকর্ষিত করত এবং মনে মনে ইলার সুন্দর দেহটাকে তছনছ করবার প্ল্যান করছিল বাবলু।
এক রাতে চলে আসে সেই সুযোগ। সেদিন ছিল দশমীর রাত, খাবার হোটেল বন্ধ আজ। ধানতোলির সার্বজনীন দুর্গাপূজার ঠাকুর ভাসান হবে প্রায় পাঁচ কিলোমিটার দুরে আম্বাজারি লেকে। রাতে নিমাই, বনলতা , রিমা ও বাবলুকে নিয়ে অবনি বাবু পাড়ার ক্লাবের ভাসানের লরিতে চেপে চললেন ভাসান দেখতে। ইলার শরীরটা ভাল নয়, গায়ে জ্বর জ্বর ভাব আছে বলে ইলা আর যায়নি, বাড়িতেই থেকে যায়। কিন্তু লরি স্টার্ট হবার একটু বাদেই তলপেট চেপে ধরে পেট ব্যাথার নাটক শুরু করে বাবলু। বাধ্য হয়েই অবনি বাবু ওকে বাড়ি ফিরে যেতে বলেন আর ওনারা সবাই চলে যান ঠাকুর ভাসান দেখতে। বাবলু অটোরিকশায় চেপে ফিরে আসে বাড়িতে। রাত তখন প্রায় এগারোটা, ইলা উঠে এসে দরজা খুলে দেয়।
বাবলু ঠিক এই সুজোগটাই খুঁজছিল। ইলাকে ওর খুব পেট ব্যাথা হচ্ছে বলে বাড়ির ভিতরে ঢুকে যায় বাবলু আর গিয়ে জামা কাপড় পাল্টে শুয়ে পড়ে নিজেদের খাটে। জল চাইবার বাহানায় ঘরে ডেকে আনে ইলাকে আর ওকে জাপটে ধরে নিয়ে ফেলে দেয় বিছানায়। এই অতর্কিত হামলার জন্য মানসিক বা দৈহিক কোন ভাবেই প্রস্তুত ছিল না ইলা। বেচারি অনেক ভাবে বাঁধা দিতে চেষ্টা করেও বাবলুর কামার্ত শরীরের কাছে পরাস্ত হয় ও বাবলু ওর নরম দেহটাকে তছনছ করে নোংরা করে ছাড়ে। বাড়ি থেকে পালিয়ে আসা মেয়েটা ভাগ্যের পরিহাসে নিজের ইজ্জৎ বিসর্জন দিতে বাধ্য হল সেই দশমীর রাতে।
সেই রাতে অবনি বাবুরা ফিরে আসেন প্রায় রাত একটা নাগাদ আর এসেই সবাই শুয়ে পরে। কিন্তু পরদিন সকালে সবাই হোটেলে চলে গেলেও ইলা হোটেল যায় না শরীর খারাপ বলে ঘরে শুয়ে থাকে। ইলার চুপচাপ থাকা ও এভাবে হোটেলে না আসা দেখে রিমার মনে একটু সন্দেহ জাগে আর রান্না সেরে বেলা বারোটা নাগাদ রিমা একাই বাড়িতে চলে আসে। কিন্তু ততক্ষণে যা হবার হয়ে গেছে। ইলা সিলিং ফ্যানে দড়ি বেঁধে ঝুলে পড়েছে। দরজাটা ভেজানো ছিল বলে রিমা ঘরে ঢুকতে পারে আর সামনের ঘরেই ঐভাবে ইলার ঝুলন্ত দেহ দেখে স্তম্ভিত হয়ে যায়। তাড়াতাড়ি নাড়ি চেক করে দেখে ওর দেহে কোন প্রাণ নেই।
দরজা বন্ধ করে দেয় রিমা। মুহূর্তের মধ্যে গতরাতে হটাত ঐভাবে বাবলুর বাড়ি ফিরে আসবার কারণটা ওর কাছে পরিষ্কার হয়ে যায়। ইলার সাথে নিশ্চয় বদমাইশি করেছে ছেলেটা। কয়েকদিন যাবতই ওর তাকানোটা ভাল লাগছিলনা রিমার। কিন্তু যেহেতু ইলা আর নেই এই ঘটনার সাক্ষ্য দেবারও কেউ রইল না। এখন এইভাবে রিমার এই বাড়িতে থাকাটাও সেফ নয়, যে কোনদিন আবার ঐ শয়তানটা রিমার উপর ঝাঁপিয়ে পড়বে।
একটা ব্যাগে জামাকাপড় টাকা পয়সা নিয়ে দরজাটা ভেজিয়ে রেখে বেরিয়ে পড়ে রিমা। আজ যেভাবেই হোক ওকে আবার পালাতেই হবে। ইলার ঝুলন্ত মৃত দেহটার ছবি বারবার ভেসে আসছিল চোখের সামনে, কোনমতে কান্নাটা চেপে আঁটোতে উঠে বসে রিমা।শত হলেও দুজন ছোটবেলার বন্ধু ওরা। আজ ইলা এভাবে ওকে ছেড়ে চলে যাবে সেটা রিমা ভাবতেও পারে নি কখনো। কিন্তু এখন নিজের ইমোশনটা চেপে রাখতেই হবে। রিমা সোজা নাগপুর স্টেশনে গিয়ে মুম্বাইয়ের টিকিট কেটে সেই বেলা সোয়া দুটোর হাওড়া মুম্বাই মেলে জেনারেল বগিতে চেপে বসল। উদ্দেশ্য একটাই, যে ভাবেই হোক মুম্বাই পৌঁছান।
মুম্বাই পৌছনোর আগেই ভি টি র আগের স্টেশন থেকে ওঠা তিনজন মারাঠি বদমাশ যুবক ওকে একলা পেয়ে রিমার পিছনে লেগে যায়। বিভিন্ন ভাবে ওরা রিমাকে উত্যক্ত করা শুরু করে, এমনকি স্টেশনে নামবার সময় কেউ হাত ধরে আর কেউ ওড়নি টেনে ধরে রিমাকে ওদের সাথে যেতে বলে। কিন্তু রিমা ওদেরকে এভয়েড করে সোজা চলে যায় রেল পুলিশের কাছে এবং সেই ছেলেগুলিকে দেখিয়ে পুলিশের সাহায্য চায়। ট্রেনেরমেয়েটা পুলিশের কাছে যাচ্ছে দেখেই ছেলেগুলি দুরত্ব বাড়িয়ে দেয় এবং পুলিশ ওদের দিকে তাড়া করতেই দৌড়ে পালিয়ে যায়। ঠিক সেই সময়েই ওখানে দাঁড়িয়ে রেল পুলিশের এক কর্তার সাথে স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে একটা শুটিঙের ব্যপারে আলোচনা করছিলেন বিখ্যাত পরিচালক সুরঞ্জন সেন।
সুরঞ্জন সেন অভিজ্ঞ মানুষ। বাঙালি, বয়স প্রায় বাষট্টি তেষট্টি হবে। অনেক দুর্দান্ত হিট হিন্দি ছবির পরিচালনা করেছেন উনি। প্রবাসে সাধারণত একজন বাঙালি আরেকজন বাঙালিকে তার কথা বলার ধরন দেখেই চিনতে পেড়ে যায়। সুরঞ্জন সেনও রিমাকে দেখেই বুঝতে পেড়ে যান যে মেয়েটা বাঙালি ও বোম্বেতে বোধ হয় এই প্রথম একা এসেছে। সুরঞ্জন বাবু এগিয়ে গিয়ে রিমাকে জিজ্ঞাসা করেন, “কোথায় যাবে মা ? তুমি কী একা না আর কেউ আছে সঙ্গে ?”
রিমা ভি টি স্টেশনে একজন বয়স্ক বাঙালি ভদ্রলোকের দেখা পেয়ে যেন সাগরের অথৈ জলের মধ্যে হটাত একটুকরো ভাসমান কাঠ খুঁজে পেল। মিষ্টি হাসিতে মুখ ভরিয়ে বলল, “না মেসোমশাই, আমি একা। আমার যাবার কোন ঠিকানা নেই। সত্যি কথা বলতে কি আমি বাড়ি থেকে না জানিয়ে চলে এসেছি। জানিনা কোথায় যাব কার কাছে গিয়ে উঠব। আপনি আমাকে একটু সাহায্য করতে পাড়বেন প্লিস।”
সুরঞ্জন সেন রিমার কথা বলার ধরন ও পোশাক আসাক দেখে বুঝলেন মেয়েটি খারাপ মেয়ে নয়, নিশ্চয়ই ভদ্র ঘরের মেয়ে। তবুও জিজ্ঞাসা করলেন, “তা তুমি এভাবে বাড়ি থেকে একা একা বেরিয়ে পড়লে যে বড় ?”
“কী করব ? আমার মামা আমাকে জোড় করে একটা বুড়ো লোকের সাথে বিয়ে দিতে চাইছিল। তাই বাধ্য হয়েই আমি বাড়ি ছেড়ে পালাই মেসোমশাই। আমি ছোট থেকেই বাপমা হারা, মামারাই তো আমাকে মানুষ করেছেন। ” রিমা বানিয়ে বানিয়ে একটা গল্প শুনিয়ে দেয়।
সুরঞ্জন সেনের মায়া হয়, তারও একটা মেয়ে আছে , ঠিক রিমার বয়সি। বিলেতে থেকে পড়াশুনা করছে এখন। ঘরে স্ত্রীও অসুস্থ, পায়ের আরথারাইটিসের যন্ত্রণায় ভাল করে হাটা চলা করতে পারেনা। মনে মনে ভাবলেন মেয়েটাকে নিয়ে গিয়ে বাড়িতে স্ত্রীর দেখা শুনা করার কাজে লাগিয়ে দিলে মন্দ হয়না। একটু চিন্তা করবার ভান করে বললেন, “তোমার যদি কোন আপত্তি না থাকে তাহলে আমার সাথে আমার বাড়ি গিয়ে থাকতে পারো। আমার বাড়িতে আমি আমাদের অনেক পুরানো এক চাকর ও আমার স্ত্রী ছাড়া আর কেউ নেই। মেয়ে বিলেতে থেকে পড়াশুনা করে। তুমি যদি চাও তো আমার সাথে গিয়েও থাকতে পার।”
রিমা এই অচেনা অজানা শহরে একজন পিতৃসম ভদ্রলোক ওকে থাকতে দেবার দয়া দেখাচ্ছেন সেটাকে না করে কীভাবে। সেইদিনই সুরঞ্জন সেনের সাথে কুরলাতে ওনার বিশাল প্রাসাদোপম বাড়িতে চলে আসে। সেন বাবুর স্ত্রী ভীষণ অমায়িক মহিলা। রিমার এতো সুন্দর চেহারা ও কথা বার্তায় খুব খুশি হন। দেখতে দেখতে একমাসের মধ্যে রিমা ওদের সবার মন জয় করে নেয়। সুরঞ্জন বাবু ও ওনার স্ত্রীর খাওয়া দাওয়া ওষুধ বিশুধ সমস্ত কিছুই এখন রিমা দেখাশুনা করে। কালুদা, মানে ওদের সর্বক্ষণের কাজের লোক রিমাকে মেয়ের মত স্নেহ করে। লোকটা নিজেও বর্ধমান জেলার লোক, আর রিমা পালসিটের মেয়ে শুনে আরও খুশি। কতদিন বাদে দেশের বাড়ির লোককে পেয়েছে, আনন্দ আর ধরেনা।
সুরঞ্জন বাবু যশ রাজ ফিল্মের একটা সিনেমাতে সহ পরিচালক হিসাবে কাজ করছেন। ওদের আন্ধেরি ওয়েস্টের স্টুডিওতে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত শুটিং শুরু হয়েছে। সুরঞ্জন বাবু যেহেতু বাইরের খাবার খান না প্রতিদিন বেলা বারোটার পর বেরিয়ে কালুদা বাবুর দুপুরের খাওয়া নিয়ে গিয়ে একদম সামনে বসে খাইয়ে দিয়ে আসত। এদিকে রিমাও ওর সাথে শুটিং দেখতে যাবার ইচ্ছার কথা বলে রেখেছিল কালুদাকে। শেষে একদিন মালকিনের অনুমতি নিয়ে কালুদা রিমাকে নিয়ে গেল স্টুডিয়োতে। সুরঞ্জন বাবু ওকে দেখে একটু অবাক হলেও কিছু মনে করলেন না।
এরপর থেকে রিমাই রোজ সুরঞ্জন বাবুর লাঞ্চ নিয়ে স্টুডিয়োতে যাওয়া শুরু করে। বাসে করে কোন কোন দিন একটু আগেই পৌঁছে যায় আবার কখনো ফেরার পথে একটু দেরি করেই বের হয়। আসলে রিমার মনের সেই সুপ্ত বাসনাটা জেগে ওঠে স্টুডিয়োতে গিয়ে নায়ক নায়িকাদের অভিনয় দেখতে দেখতে। কয়েকদিন যাবত টানা একটা সাংসারিক দৃশ্যের শুটিং হচ্ছে যেখানে নায়িকা তার বাবার সাথে নায়কের ব্যাক্তিগত চরিত্র নিয়ে উত্তেজিত ভাবে কথা বলছে আর নায়িকার মা ওকে থামাবার চেষ্টা করছেন।
সিনটা বেশ বড়। এ কয়দিনে অনেকগুলি সট হয়ে গেছে। সেদিন রাতে হটাত রিমার ঘরের পাশ দিয়ে নিচে নিজের অফিস ঘরে যেতে গিয়ে সুরঞ্জন বাবুর কানে সেই সিনে নায়িকার ডায়লগ গুলি কানে ভেসে এলো। উনি থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে তাকালেন রিমার ঘরের দিকে। দরজাটা একটু ফাঁক ছিল। উঁকি মেরে দেখেন রিমা একদম হুবহু সেই নায়িকার ডায়লগ মুখস্ত বলে সুন্দর করে অভিনয় প্র্যাকটিস করছে। মনে হচ্ছে যেন এই সিনটা ওকেই করতে দেওয়া হয়ছে এবং ওকে কালই এই সিনের সট দিতে হবে। সুরঞ্জন বাবু যে দরজার ফাঁক দিয়ে ওকে দেখছেন রিমা সেটা দেখতেই পেল না। ওর নায়িকার অভিনয়টারিমা চালিয়ে গেল।
সুরঞ্জন বাবু পরদিন সকালে রিমাকে ওনার সাথেই স্টুডিয়োতে যেতে বললেন আর একটু ভাল ড্রেস পরে নিতে বললেন। রিমা যেহেতু সঙ্গে যাচ্ছে কালুদাকে বললেন ওদের দুজনের লাঞ্চ একসাথে নিয়ে যেতে। রিমা বেশ অবাক হয়ে গেলেও মুখে কিছু বলল না। ওর সবচেয়ে ভাল ড্রেসটা পরে সুরঞ্জন বাবুর সাথে গাড়িতে চলে গেল স্টুডিয়োতে। শুরু হয়ে গেল রিমার এক সম্পূর্ণ নতুন জীবন, যেই জীবনের স্বপ্ন ও সেই ছোটবেলা থেকে দেখে আসছে। যেই স্বপ্ন পুরন করতে রিমা ওর বন্ধু ইলাকে নিয়ে একদিন বাড়ি থেকে বেরিয়েছিল।
সুরঞ্জন বাবু সেদিন রিমার স্ক্রিন টেস্ট করান। রিমার লম্বা ফর্সা চেহারাতে মেক আপ করবার পর ওকে আরও বেশি সুন্দরী দেখাচ্ছিল। এই স্টুডিয়োতে ওনাদের যেই সিনেমাটার শুটিং চলছিল সেই একই ফিল্মে উনি রিমাকে একটা ছোটখাটো রোলে নামিয়ে দিলেন। রিমার রূপে ও ওর অভিনয় দেখে সবাই ভীষণ অবাক হয়ে গেল। রিমাকে পরবর্তী ফিল্মে সুরঞ্জন বাবু একদম সহ নায়িকার রোলে নামিয়ে দিলেন এবং রিমা সেই চরিত্রেও অসম্ভব ভাল অভিনয় করে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিল। এতদিনে রিমা তার নির্দিষ্ট লক্ষে পৌঁছায়।
দিনে দিনে রিমার নাম ছড়িয়ে পড়ে এবং রিমাকে সুরঞ্জন বাবু অনেক টাকা পয়সা দিয়ে ভরিয়ে দেন। মেয়েটা সত্যি যেন ওনার একটা অসাধারন আবিস্কার। অন্য অনেক পরিচালক এখন রিমাকে দিয়ে নায়িকার চরিত্রে অভিনয় করাতে চায়। সুরঞ্জন বাবু নিজে সেইসব পরিচালকদের সাথে কথা বলেন এবং পছন্দ মত বই সিলেক্ট করেন। কয়েক মাস বাদেই রিমার নায়িকা হিসাবে প্রথম ফিল্ম রিলিজ হয়েই ভীষণ ভাবে হিট করল। রিমার ব্যাঙ্কে এখন অনেক টাকা, পেপারে প্রায়ই ওকে নিয়ে লেখা লেখি হয়। জীবনের সব চাওয়া পাওয়া এত তাড়াতাড়ি পূর্ণ হতে চলেছে দেখে রিমাও এখন ভীষণ খুশি।কালুদা ওদের জেলার একটা সাধারন মেয়ে এতো বড় অভিনেত্রী হয়ে উঠেছে দেখে মনেমনে খুশি হয়, এখন রিমাকে বেশ সন্মান দিয়ে কথা বলে।
একরাতে হটাত সুরঞ্জন বাবু রিমাকে গাড়ি নিয়ে বাড়ি চলে যেতে বলে নিজে একজন সুরকারের সাথে তার স্টুডিয়োতে চলে গেলেন। জাঠ ড্রাইভারযশোয়ান্তকে নিয়ে রিমা যখন স্টুডিয়ো থেকে বের হয় তখন রাত প্রায় দশটা। কুরলা ওদের স্টুডিয়ো থেকে প্রায় ষোল কিলোমিটার, পৌনে এক ঘণ্টার রাস্তা। অর্ধেকের বেশি রাস্তা পার হয়ে মুম্বাই এয়ারপোর্টের বেশ কিছুটা আগে নুরজাহান মসজিদের কাছে ওদের গাড়িটা হঠাৎ গরর গরর শব্দ করে দাঁড়িয়ে পড়ে। ড্রাইভার কোনমতে রাস্তার একপাশে গাড়ি দাঁড় করিয়ে সামনের বনেট খুলে চেক করবার জন্য নেমে যায়। বাইরে অন্ধকার, গাড়ির ভিতরে একা বসে থাকে রিমা।
ঘড়িতে রাত সাড়ে দশটা বেজে গেছে। হটাত দুজন যুবক এসে দাঁড়ায় রিমার দরজার সামনে। অন্য গাড়ির হেডলাইটে রিমা ওদের দেখেই চিনতে পারে যে এরা সেই ছেলেগুলি যারা ভি টি স্টেশনে সেদিন ওর পিছনে লেগেছিল। তাদের মধ্য থেকে একজন এসে হঠাৎ গাড়ির পিছনের দরজা খুলে রিমার হাত ধরে টান মারে আরেকজন ড্রাইভার যশোয়ান্তের মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে রাখে। সমস্ত ঘটনাটা মূহুর্তের মধ্যে ঘটে যায় ও রিমা কিছু বুঝবার আগেই একটা গাড়ি এসে জোর করে ওদের তুলে নিয়ে বেরিয়ে যায় ওখান থেকে। রিমার নাকে চেপে ধরা ঘুমের ওষুধ, রিমা মুহূর্তের ভিতর অজ্ঞান হয়ে ঢলে পড়ে।
ভোর সাড়ে পাঁচটার সময় নিজের মোটর সাইকেলে শৈবাল মুম্বাই আগ্রা ইস্টার্ন এক্সপ্রেস ওয়ের ঘাটকোপার রেল স্টেশন থেকে প্রায় দেড় কিলোমিটার দুরে যেখানে ওর ট্র্যাফিক ডিউটি সেই দিকেই যাচ্ছিল। শৈবাল মুম্বাই ট্র্যাফিক পুলিশের সাব ইন্সপেক্টর। ভোর ছয়টায় ওর ডিউটি শুরু, তাই প্রায় খালি রাস্তায় গুনগুন করে গান গাইতে গাইতে বাইক চালাচ্ছিল। হঠাৎ একটু দুরে রাস্তার বাঁ দিকে একটি মেয়ে মানুষের দেহ দেখেই স্পিড কমিয়ে সামনে এসে দাঁড়ায়। বদমাশ ছেলেগুলি আগের রাতেই রিমাকে উঠিয়ে নিয়ে গাড়িতেই তিন জন মিলে পরপর ওকে ধর্ষণ করে আর রিমার অচৈতন্য দেহটা এক্সপ্রেস ওয়ের পাশে ফেলে রেখে চলে যায়। প্রায় ঘণ্টা দুয়েক কোন পথচারি মানুষের সাহায্য না পেয়ে অচেতন রিমা ওখানেই পড়েছিল।
সেই ভোরেই রিমাকে উঠিয়ে এম জি রোডে হরাইজন হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে ভর্তি করিয়ে দেয় শৈবাল। ওর আর ডিউটিতে যাওয়া হয়না। যদিও বুঝতে পারছিল যে মেয়েটার উপর শারীরিক অত্যাচার হয়েছে হয়ত, শৈবাল কোন পুলিশ কমপ্লেন করার দিকে গেলনা। কিন্তু ওর রিমাকে দেখেই মনে হয়েছিল মেয়েটা ভদ্র ঘরের মেয়ে এবং হয়ত বেশ বড়লোকের মেয়ে হবে। কারন ওর পরনে ছিল খুব দামী সালোয়ার কামিজ। শৈবাল তেমন সিনেমা টিনেমা দেখে না তাই রিমাকে চিনতে পারে নি।
রিমাকে সেই দিনই সন্ধ্যায় হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দেয়। রিমা যে বাঙালি শৈবাল সেটা জানতে পারে ওর জ্ঞ্যান আসবার পর। রিমা প্রথমে চুপকরে সবাইকে দেখতে থাকে আর তারপর একটু ধাতস্থ হয়ে বাংলাতেই বলে উঠেছিল, “আমি কোথায় ? এটা কি কোন হাসপাতাল ?”
শৈবাল ঐ কেবিনের একপাশে চেয়ারে বসেছিল। ডাক্তার আর নার্স ছিল রিমার সামনে। বাংলায় কথা শুনেই শৈবাল তাড়াতাড়ি এগিয়ে এসে বাংলাতেই বলে, “তুমি এখন হাসপাতালে সোনা। বেশি কথা বলবে না, তোমার খুব শরীর খারাপ হয়েছিল।” রিমাকে কথাটা বলেই শৈবাল ডাক্তার আর নার্সদের দিকে তাকিয়ে ইশারায় ওদের চলে যেতে বলে। আসলে শৈবাল রিমাকে নিজের হবু স্ত্রী বলে পরিচয় দিয়েই হাসপাতালে ভর্তি করেছিল। সুতরাং ও চাইছিল না যে রিমা কোন বেফাস কথা বলে ফেলে।
এদিকে রিমা শৈবালকে বাংলা কথা বলতে দেখে একটু ভরসা পায়। ওর যৌনাঙ্গে ভীষণ ব্যাথা অনুভব হওয়ায় রিমা বেশ বুঝতে পারে ওর উপর শারীরিক অত্যাচার হয়েছে, মুহূর্তে চোখের কোনে জল জমে যায়। ওর মনে পড়ে যায় কাল রাতে গুণ্ডারা ওকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল আর গাড়িতেই গুণ্ডারা ওকে কী একটা মুখে চেপে ধরার পরেই ও অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল। তারপর রিমার আর কিছু মনে নেই। কিন্তু এখন এই লোকটা সবকিছু জেনেও ওকে ‘সোনা’ বলল কেন রিমা সেটা বুঝে উঠতে পারল না।
অনেকদিন যাবত সেই গুণ্ডাগুলি রিমার উপর নজর রাখছিল। প্রথম যেদিন খবরের কাগজে রিমার ছবি বের হয় যাতে সহ নায়িকা হিসাবে রিমা যথেষ্ট প্রশংসা পেয়েছিল, সেদিনই ওরা চিনতে পেরে গিয়েছিল রিমাকে। সেই থেকে ওর ব্যাপারে আরও খোঁজ খবর নিয়ে ওরা রোজই স্টুডিওর বাইরে রিমাকে একা পাবার সুযোগের অপেক্ষায় ছিল। কাল রাতে রিমা একাই স্টুডিয়ো থেকে বের হয়েছে দেখে ফলো করতে থাকে। এরপর গাড়ি খারাপ হওয়ায় গুণ্ডারা সেই সুযোগটা কাজে লাগায়। রিমাকে তুলে ঘাটকোপার ইস্টার্ন হাইওয়ের দিকে চলতে থাকে,পরে গাড়ি দাঁড় করে রিমাকে সবাই মিলে ধর্ষণ করে ওদের বদলা নেয়।
শৈবাল সেদিন রিমাকে নিজের পরিচয় দিয়ে ওকে বোঝায় যে ওকেশৈবাল কীঅবস্থায় পেয়েছিল। শৈবাল ওকে কাছের এই হাসপাতালে নিয়ে এসে কেন ভর্তি করেছিল। কেন ওর পরিচয় শৈবালের হবু স্ত্রী বলে দিতে বাধ্য হয়। নাহলে এতক্ষনে রিমা হয়ত পুলিশের হাতে চলে যেত আর একবার পুলিশের হাতে পড়া মানেই কোর্টে কেস ওঠা এবং খবরের কাগজে ও টি ভির সব নিউজ চ্যানেলে একটা ব্রেকিং নিউজ হয়ে যাওয়া। শৈবাল রিমাকে এই সব কিছুর থেকে দুরে রাখতে চায়।ও চায়না রিমার জীবনটা ছারখার হয়ে যাক।
রিমা সেদিন কান্নায় ভেঙ্গে পড়েছিল সব শুনে। এই অচেনা অজানা লোকটার প্রতি শ্রদ্ধায় মাথা নুয়ে আসে। শৈবালের কথায় রিমা যথেষ্ট যুক্তি দেখতে পেয়ে হাসপাতাল থেকে এসে উঠেছিল ওদের এই খুপরিঘরে মানে চালে। আর শৈবালের মায়ের স্নেহের ছোঁয়ায় এবং ওর বাবা ও ভাইয়ের ভালোবাসায় রিমা সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে ওঠে। প্রবাল রিমাকে দেখেই চিনতে পেড়ে যায় এবং ওর আড়ালে বাবা মাকে জানায় যে রিমা একজন উঠতি নায়িকা, ওকে বাড়ির বাইরে যেতে দেওয়া উচিত হবেনা। সবাই চিনে ফেলবে। শৈবাল কিন্তু রিমার আসল পরিচয় জানবার কোন গরজ দেখায় না। মনে মনে ভাবে রিমা সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠলে ওকে ওর স্থায়ী ঠিকানায় ফিরে যেতে সাহায্য করবে। কিন্তু একসাথে থাকতে থাকতে রিমাকে শৈবালও কখন মনেমনে ভালবেসে ফেলেছে সেটা ও নিজেও জানতে পারেনি।
দেখতে দেখতে দুই মাস পার হয়ে যায়। কিন্তু রিমা শৈবালদের ছেড়ে যাবার কোন গরজ দেখায় না। রিমা যদিও জানে যে ও এখন একজন হিন্দি সিনেমার উঠতি নায়িকা। বাজারে এখন ওর অনেক দড়।
আসলে শৈবালের মত একজন হ্যান্ডসাম ভদ্র ছেলে যেভাবে ওকে রাস্তা থেকে ঐ অবস্থায় তুলে এনে চিকিৎসা করিয়ে সুস্থ করবার চেষ্টা করে যাচ্ছে সেটা রিমার ভীষণ ভাল লাগছে। রিমাকে সময়মত ওষুধ খাওয়ানো, ওর জন্য আপেল, নেসপাতি, কমলা ইত্যাদি কিনে আনা, রোজ সকালে ওকে এক গ্লাস দুধ জোর করে খাওয়ানো এসব দেখে রিমার ভীষণ লজ্জা লাগত। রিমা ভাবত ও একজন সিনেমার হিরোইন বলেই বোধহয় এরা এরকম ভাবে ওর খাতিরদারি করছে। কিন্তু রিমার সেই ভুল ভাঙ্গতে বেশি সময় লাগল না।
রবিবার বেলার দিকে রিমা একা একা সামনের ঘরে বসে টি ভি দেখছিল। বাবা ভিতরের ঘরে ঘুমচ্ছেন। ভাই গেছে মাকে নিয়ে দাদারে সিদ্ধি ভিনায়কের মন্দিরে পূজা দিতে। বাইরের মোটর সাইকেল গ্যারাজ থেকে ফিরে ঘরে ঢুকে রিমাকে একা বসে থাকতে দেখে শৈবাল এসে বসল ওর সামনের সোফাতে। রিমা শৈবাল ফিরে এসেছে দেখে উঠে দাঁড়িয়েছিল আর ভিতরে যাবার জন্য পা বাড়িয়েছিল। ওর উদ্দেশ্য বুঝতে পেড়ে শৈবাল হাত তুলে বারন করার ভঙ্গি করে বলে উঠল, “আর বসুন বসুন। আমি আর অবেলায় চা খাব না।”
রিমা আবার হাসি মুখে বসে তাকিয়ে রইল শৈবালের মুখের দিকে। শৈবাল জানে এখন এই দুই মাসে রিমা সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠেছে। ঐ ধর্ষণের ঘটনায় রিমা যেই ট্রমার মধ্যে দিন কাটিয়েছে তার থেকে এখন ও অনেক ফ্রি ও স্বাভাবিক হয়ে উঠেছে। সরু চোখে তাকিয়ে রিমাকে জিজ্ঞাসা করল, “কি, এবার বোধ হয় আপনার বাড়ি ফিরবার জন্য খুব ইচ্ছা হচ্ছে তাই না ? বাবা মার কথা নিশ্চয়ই মনে পড়ছে তাই চুপচাপ বসে সেই কথাই ভাবছিলেন বোধ হয় ?আসলে আমি চাইছিলাম আপনি সম্পূর্ণ সুস্থ হলে পর নিজে গিয়ে আপনার বাড়িতে পৌঁছে দেব। আপনি এবার আপনার পরিচয় ও মনের ইচ্ছাটা জানালে খুশি হব।”
শৈবাল ভাবছিল রিমা নিশ্চয়ই ওর মনের কথাটা বলবে এবার। শৈবাল যে ওকে ভালবেসে ফেলেছে সেটা নিশ্চয়ই বুঝতে পারে মেয়েটা। কিন্তু শৈবালকে অবাক করে দিয়ে রিমা জিজ্ঞাসা করল, “আচ্ছা আপনি সিনেমা দেখতে ভালোবাসেন ? না মানে আমি জানতে চাইছিলাম কী সিনেমা দেখেন, হিন্দি না ইংরাজি ?”
বাড়ি ফেরার কথা তোলায় হঠাৎ এই সিনেমার প্রসঙ্গ কেন এলো শৈবালের মাথায় ঢুকল না। এদিকে রিমা একটু অবাক হয়েছিল শৈবাল ওকে বাড়ি ফিরবার কথা কেন বলছে ? ও কি জানেনা রিমা কে ? লোকটা কি সিনেমায় ওকে দেখেনি কোনদিন ? নাকি সব জেনেও ন্যাকামো করছে। রিমা বেশ কনফিউশনে পড়ে গেল। এদিকে শৈবালকে রিমারও ভীষণ ভাল লেগে গেছে। কী ভদ্র ও দায়িত্বশীল মানুষ। এতদিন যাবত ওকে দেখছে কিন্তু কখনই কোন নোংরা দৃষ্টিতে তাকায়নি রিমার দিকে। আর ওদের পরিবারটার তো তুলনাই হয়না। যেমন বাবা মা তেমনই ওর ভাই বোনেরা। সবাই ওকে কত ভালোবাসে আর আদর করে।
শৈবাল একটু হতাশ গলায় বলল, “না ,আমি হলে ভাল পুরানো বাংলা বা হিন্দি সিনেমা এলে তবেই দেখতে যাই এবং আজকালকার ছ্যাবলামো সিনেমা দেখবার কোন আকর্ষণ নেই আমার। টি ভিতে যা সব উল্টো পাল্টা হিন্দি গান হয় তাতেই বুঝতে পারি সিনেমা এখন কোন পর্যায়ে গেছে।” কথাটা বলে শৈবাল ভাবতে লাগল রিমা হটাত সিনেমার প্রসঙ্গ ওঠাল কেন ? ও কি বাড়ি ফিরতে লজ্জা পাচ্ছে এই ভেবে যে ওকে যদি বাড়ির লোকেরা গ্রহন না করে আর তাড়িয়ে দেয় ? রিমার অবস্থা ভেবে শৈবালের মনটা খারাপ হয়ে গেল।
এদিকে রিমা শৈবাল হিন্দি আধুনিক সিনেমা দেখেনা শুনেই বুঝতে পেড়ে যায় শৈবাল ওকে আজও চিনতে পারেনি। একদিকে সিনেমা জগতে ওর সুনাম, গোছা গোছা টাকা, সম্পত্তি আরেকদিকে শৈবালের অফুরন্ত ভালোবাসা, ওদের এই আদর যত্ন, শৈবালের মধ্যবিত্ত সাজানো সংসার এই সবের মধ্যে রিমা হারিয়ে যেতে লাগল। ওকে যেমন সিনেমার জগত টানে তেমনই টানে এক চিলতে ভালোবাসা একটা সুন্দর পরিবার। রিমা বুঝতে পারল শৈবাল ওর কথার মানে কিছুই বুঝতে পাড়ছে না। অথচ রিমাকে বাড়িতে পোঁছে দেবার লোভ দেখাচ্ছে আর তার মাধ্যমে নিজের নিঃস্বার্থতার পরিচয় দিতে চাইছে। কিন্তু এইটুকু জীবনে রিমা এটা বেশ ভালই বুঝে গেছে এই দুনিয়ায় একটা সংসারের একটা ভালোবাসার মানুষের কত প্রয়োজন। শুধু কারি কারি টাকা আর সম্পত্তি ও সুনাম থাকলেই সুখ পাওয়া যায়না। রিমার দু চোখ ভিজে উঠল। কান্না ভেজা আদুরে গলায় বলল, “আমি যদি আর বাড়ি ফিরতে না চাই শৈবাল, তুমি থাকতে দেবে আমাকে ?”
শৈবাল এক মুহূর্ত রিমার কথার মানে বুঝতে না পেরে ফ্যাল ফ্যাল করে রিমার দিকে তাকিয়ে রইল। আর রিমা শৈবালের ঐ হকচকানি দেখে এই কান্নার মাঝেও ফিক করে হেসে ফেলল আর উঠে এসে একদম শৈবালের কোলে বসে ওর গলা জড়িয়ে ধরে বলল, “বুদ্ধু কোথাকার। আমি তোমাকে ছাড়া থাকব কী করে সেটা একবার ভেবে দেখছ ? আমি বরাবর একজন হিন্দি সিনেমার নায়িকা হতে চেয়েছিলাম। আর সেটা হয়েছিও। আমার অনেক নাম হয়েছে আর টাকাও হয়েছে। কিন্তু সেসব আজ আমার কাছে অতি তুচ্ছ মনে হচ্ছে, কারন আমি তোমায় ভালবেসে ফেলেছি শৈবাল। আমাকে তুমি তাড়িয়ে দেবে নাতো ? আমি চিরকাল তোমার সোনা হয়েই থাকতে চাই গো।”
শৈবালের বাকরুদ্ধ হয়ে যাবার মত অবস্থা। রিমা একজন ফিল্ম স্টার শুনে সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়িয়ে রিমার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে বলল, “তুমি ফিল্ম স্টার সেটা তো জানতাম না। তাই নাকি ?”
ঠিক তখনই ঘরে ঢুকল প্রবাল আর তার পিছনে ওদের মা। প্রবালের কানে দাদার শেষ কথাটা গিয়েছিল। প্রবাল হাসতে হাসতে বলে উঠল, “হ্যাঁরে দাদা, উনি হলেন বিখ্যাত নায়িকা রিমা মল্লিক। এখন বম্বে ফিল ইন্ডাস্ট্রির একজন উঠতি নায়িকা। আমি প্রথম দিন দেখেই রিমা ম্যাডামকেঠিক চিনতে পেরে গেছিলাম আর মাকে সেটা বলেও ছিলাম। আমি ভাবেছিলাম তুইও হয়ত চিনিস ওনাকে ।”
শৈবালের হতভম্ব মুখের দিকে তাকিয়ে ওর মা বললেন, “রিমি যেই হোকনা কেন ও আমাদের ঘরেররিমি, আমাদের মেয়ে। তোমাকে আমরা কোথাও যেতে দিতে চাইনা রিমি। থাকবে তুমি এই গরীবের ঘরে আমার বৌমা হয়ে ? আমার এই ভোলেভালা ছেলেটাকে আমি তোমার হাতে সপে দিতে চাই মা।”
এতো কথা বার্তায় শৈবালের বাবার তন্দ্রা ভেঙে গেছিল। উনিও উঠে এসেছিলেন সামনের ঘরে। এদিকে রিমির দুচোখ বেয়ে চলেছে জলের ধারা। ও অবাক হয়ে যাওয়া শৈবালের জবাবের প্রতীক্ষায় তখনো এক দৃষ্টে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে। শৈবাল একবার চোখ বুজে একটা লম্বা শ্বাস নিয়ে বলল, “ছিঃ ছিঃ, তোমার বোধ হয় অনেক কষ্ট হয়েছে রিমা আমাদের এই ছোট্ট ঘরে থাকতে ? আমি সত্যি জানতাম না তোমার আসল পরিচয়। কিছু মনে কোরনা প্লিস।”
রিমা শৈবালের ভদ্রলোকি উত্তরে খুশি হলেও মনে মনে রেগে গেল। অভিমান করে বলল, “আমি রিমি মল্লিক হই বা যেই হই আমি কিন্তু তাড়িয়ে দিলেও আর বাড়ি ফিরে যাচ্ছি না। আপনি আমাকে থাকতে দিন বা না দিন আমি এখানেই থাকব, কি তাইতো মা ?” বলেই রিমি শৈবালের মাকে জড়িয়ে ধরল আর ওনার বুকে মুখ গুঁজে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল।
অনেকদিন পর শৈবালের মাকে জড়িয়ে ধরে নিজের মার মত মনে হচ্ছিল ওর। রিমি কাঁদতে কাঁদতেই একবার মুখ তুলে অভিমানির মত চাইল শৈবালের দিকে। আর এই দেখে শৈবালের বাবা এবং বাকি ঘরের সবাই হো হো করে হেসে উঠল। আর শৈবাল হাসতে হাসতেই বলল, “ঠিক আছে দেবী, আপনার ইচ্ছাই শিরোধার্য হইল।”
শব্দ সংখ্যা - ৪৪৬৮।
-------------------------------