গল্প ।। বাসা বদল ।। অদিতি ঘটক
বাসা বদল
অদিতি ঘটক
অরূপ রোজ এই রাস্তা দিয়েই মর্নিংওয়াকে যান। এত বছরে আজ এই প্রথম এমন একটা পাখি দেখতে পেলেন। এত সুন্দর রঙের বাহার দেখলে মনে হয় একমাত্র প্ৰকৃতিই পারে এই রকম অপরূপ কারিগরি।
এখন শীতের শুরু। এই সময় পরিযায়ী পাখিদের ভিড় থাকে। তবে এই মফস্বলগুলোও যে ভাবে রাতারাতি শহরে বদলে যাচ্ছে তাতে এদের আর দেখা মেলে না। তবে করোনার কারনে লকডাউনের জন্য অর্থনৈতিক কর্মকান্ড সব বন্ধ থাকায় আর মানুষ গৃহবন্দী হয়ে যাওয়ায় প্রকৃতি তার ক্ষত নিরাময়ে কিঞ্চিত সময় পেয়েছে। সেইজন্যই এত তাড়াতাড়ি পরিযায়ীদের ভিড়।
পাখিটা ডেকে উঠতেই বুঝলেন এই পাখির ডাক তিনি অনেক শুনেছেন। পানচেতে থাকতে শাল জঙ্গলের শর্টকার্ট দিয়ে যখন সরমাদের বাড়ি যেতেন অথবা জঙ্গলের নিভৃত কোন জায়গায় দুজনে শীতে কাঁপতে কাঁপতে দেখা করতেন। কি আশ্চর্য ! ডাকটা এখনও স্পষ্ট মনে আছে। আরও আশ্চর্য পাখিটাকে কোনো দিনও হাজার খোঁজাখুঁজি করেও দুজনেই দেখতে পাননি। ওঁদের কতদিন শুধু পাখিটাকে দেখবার নেশায় কেটে গেছে। সরমা ঘড়ি দেখে আঁতকে উঠে পড়িমরি করে বাড়ি ফিরে গেছে।
অরূপ জোর হাঁটা লাগলেন পাখিটা বিতস্তা কে দেখাতে হবে। নিশ্চয় মিত্তিরদের বাগানে ওর বাসা তাই তো সকাল সকাল এই রাস্তার উপর হেঁটে চলে বেড়াচ্ছে।খাবার খুঁজছে বোধহয়। এই রাস্তার পাশেই তো ডোবা, আর একটু এগিয়ে বেঁকে গেলে একটা ছোট বাঁশ ঝাড়। এতদিনে কোনোবারই মিত্তিরদের বাগানে পরিযায়ী আসেনি এই প্রথম !
অরূপ হাঁটার গতি আরও বাড়ালেন। বিতস্তার কথা মনে পড়লেই বেশ চনমনে লাগে। এক অদ্ভুত ভালো লাগা, অকারণ উৎফুল্লতায় মনটা ভরে ওঠে। মিসেস ঘোষ থেকে বিতস্তায় নামতে খুব বেশি সময় লাগেনি। মর্নিং ওয়াকের পরিচিত মুখ থেকে এখন হাঁটা শেষে পার্কের বেঞ্চে বসে চা খেতে খেতে গল্প করে দিন শুরু হয়। এই যে লকডাউনের জন্য সমস্ত জনজীবন যেভাবে থমকে গেছিল তাতে আর কারুর কি কষ্ট হয়েছে তা উনি বলতে পারবেন না, মর্নিংওয়াক বন্ধ হয়ে যাওয়াতে বিতস্তার সঙ্গে দেখা না হওয়াতে ওনার দিনটাই সঠিক ছন্দে শুরু হত না। মনের ভেতরটা সারাক্ষন তেতো হয়ে থাকত।
বিতস্তাকে পাখিটা দেখাবার জন্যই অরূপ প্রায় দৌড় লাগলেন। কিন্তু বিতস্তা কই ? কোথায়? চারিদিকে অনেক খোজাখুঁজি করেও দেখতে পেলেন না। এমন তো হয় না। যদি কচিৎ কখনো না আসতে পারেন তাহলে মেসেজ করে আগেই জানিয়ে দেন। অরূপও সেদিন গড়িমসি করে একটু দেরিতে হাঁটতে যান আর বেজার মুখে বুড়োগুলোর সাথে কোন রকমে চা গিলে বাড়ি আসেন। না গেলে প্রাতভ্রমনকারী জনতা রংদার খবর পরিবেশনে ব্যস্ত হয়ে পড়বে।এমনিতেই ওদের নিয়ে একটা চাপা গুঞ্জন যে চলতে থাকে তা অরূপ বেশ বুঝতে পারেন আর হবে নাই বা কেন এই বয়সেও বিতস্তা যা সুন্দরী আর ব্যক্তিত্বময়ী তাতে যে কোনও পুরুষের মাথা ঘুরিয়ে দিতে পারেন। মনে মনে সব পুরুষ এমনকি মহিলা মর্নিং ওয়াকাররা ওর সঙ্গ প্রত্যাশা করে অথচ সেই বিদুষী মহিলা শুধু মাত্র অরূপের সঙ্গে বসে চা খেতে খেতে গল্প করেন আর সবার সঙ্গেই ওনার সম্পর্ক সৌজন্যমূলক। এইজন্য মনে মনে অরূপ বেশ শ্লাঘা অনুভব করেন। কিন্তু বিতস্তা কোথায়? না এলে উনি অবশ্যই মেসেজ করে জানিয়ে দেন। এই দু বছরে তার অন্যথা একবারও হয় নি। ভীষণ দায়িত্বশীল কর্তব্যপরায়ন। পরিচিত জনের অনুভূতির কদর করেন।
বলেন, 'আপনারা আমার জন্য অহেতুক চিন্তা করবেন তাতে আমার খুব কুণ্ঠাবোধ হয়।"
বিতস্তা 'আপনারা' বললে অরূপ জানেন বিতস্তা 'আপনি' বলতে চান কিন্তু চক্ষুলজ্জার খাতিরে বলতে পারেন না। অরূপের চওড়া ছাতি আরও চওড়া হয়ে যায়। হৃদয় ভালোলাগায় পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে।
বিতস্তা পাখি খুব ভালোবাসেন তবে খাঁচায় পোষা একদম পছন্দ না। পাখিদের কিচিরমিচির খুব মন দিয়ে শোনেন কোনও পাখি উড়ে গেলে তো আর কথাই নেই পাখির ওড়া দেখতে দেখতে বিভোর হয়ে যান। অরূপ ইচ্ছে করলেই পাখিটার ছবি মোবাইল এ তুলে নিয়ে বিতস্তা কে দেখাতে পারতেন কিন্তু অরূপের ইচ্ছে ছিল অন্যরকম, পাখিটার অজুহাতে আরও একটু বেশি সময় বিতস্তার সঙ্গে কাটানো। হাঁটতে হাঁটতে একসঙ্গে আরও খানিকটা পথ চলা।
প্ৰথম প্রথম সরমাকে বলতেন চল না একসাথেই হাঁটি আমার যেমন সুগার ধরেছে তোমারও মেদ জমছে, বাত ,গ্যাস অম্বল। ডাক্তার সেন তোমায়ও তো হাঁটতে বলেছেন। পাঞ্চেৎ এর মত অত ফ্রেশ না হোক কিন্তু এখানকার প্ৰকৃতি, পরিবেশও যথেষ্ট ভালো। মিত্তিরদের বাগানটাই ধর অত বড় বাগান। ভেতরে কত বড় পুকুর। পুরো বাগান বাড়ি। মানছি ওটা এখন আস্ত একটা জঙ্গল। এখনো পর্যন্ত এ তল্লাটে ফ্ল্যাট বা ফ্যাক্টরির থেকে গাছপালার সংখ্যা বেশি। সরমা কেমন যেন গিন্নি হয়ে উঠেছে। সকালে বারান্দায় বসে বড় মেয়েকে ফোন তারপর কাজের লোকের ওপর ছড়ি ঘোরানো তারপর ছেলে, বৌমা, নাতির উপর খবরদারি। আরে বাবা তারা কি জানে না যে রোজ কাজ, রান্না, খাওয়া, টিফিন গোছানোর তদারকি করতে হবে ! এর পর সরমা পড়ে রঙ্গিনীকে নিয়ে। ওর ছোলা, জল, বাসা পরিস্কার। কথা বলা।
নিজেদেরই আমগাছে রঙ্গিনী এসে বসে ছিল। ছেলের বায়না ওই পাখিটা ধরে দিতে হবে। ও হাতে নিয়ে দেখবে । সরমা কি করল টিয়াটাকে একদম খাঁচা বন্দি করে ফেলল। বিতস্তা হলে কি এটা করত ! কত বছর হয়ে গেল পাখিটা খোলা আকাশে উড়তে পারেনি।
নাহ, বিতস্তা আশেপাশে কোথাও নেই। শরীর খারাপ হল নাকি ? একা মানুষ ! মর্নিংওয়াক জমল না। তাড়াতাড়ি ফিরে এলেন। পার্কে বসে মেসেজও করলেন। রাত পর্যন্ত নো রিপ্লাই। আজ এক সপ্তাহ ধরে বিতস্তার কোনো খবর নেই। কোনো মেসেজ করছেন না। মেসেজের রিপ্লাইও দিচ্ছেন না। কারুর কাছে ওনার সম্বন্ধে কোনো খবরও নেই। নাকি তারা অরূপের উদ্বেগ তাড়িয়ে উপভোগ করছেন ! বিতস্তাকে ফোন করলে ফোনও বেজে যাচ্ছে। অরূপের উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা বেড়ে চলেছে। একবার কি বিতস্তার বাড়ি চলে যাবেন ? খোঁজ খবর নিয়ে আসবেন। এই অতিমারীতে যা সব অনাসৃষ্টি চলছে। কি জানি একা মহিলা কেমন আছেন ! অরূপের মনটা অস্থির হয়ে আছে। সব কিছু একেবারে বিস্বাদ লাগছে। মর্নিংওয়াকে যাওয়ার সেই চাৰ্মটাই হারিয়ে গেছে, অভ্যাস বসত এবং লোকনিন্দার ভয়ে এখনো সকালে নিজেকে টেনে আনছেন। পাখিটাকে দেখলে তাও মনটা ভালো লাগত। আর ভুল করতেন না। এবার একটা ফটো ঠিক তুলতেন কিন্তু পাখিটাকেও আর দেখতে পাচ্ছেন না। কোথায় যে গেল ! বিতস্তার মত পাখিটারও কোনো খোঁজ নেই। বেশ কদিন পরে অফিসের পুরনো ডেলি প্যাসেঞ্জাররা মিলে একটা ট্যুর এরেঞ্জ করা হল। শীতে দু দিন একটু বাইরে কাটিয়ে আসা। পূর্বস্থলি ঘুরে নবদ্বীপ, মায়াপুর দেখে বাড়ি ফেরা। পূর্বস্থলির রাস্তায় হঠাৎই পাখিটাকে দেখতে পেলেন, ভাবলেন অন্য পাখি। না ! ওইটাই কারন ওর গলায় রেডিও কলার লাগানো। পাখিটা বাসা বদল করেছে। আর একটু এগিয়ে বিলের কাছে যেতেই দেখলেন তার খুব কাছের মানুষ বসে এক মনে পাখি দেখে যাচ্ছেন-- মনটা আনন্দে নেচে উঠল, ডাকতে গিয়ে দেখেন পাশে অচেনা এক পুরুষ। একজনের হাতের উপর আরেকজনের হাত ----
##################
অদিতি ঘটক
১১৩,ময়নাডাঙ্গা
চুঁচুড়া(R.S.)
হুগলি