প্রেমের ফাঁদে
সুজিত চক্রবর্তী
আজকেই ফেসবুকে একটা বেশ মজার পোস্ট পড়েছিলাম যাতে বলা আছে : সরস্বতী পুজো, ভ্যালেন্টাইন্স ডে সবই তো হয়ে গেছে। এবার তোমাদের পার্টনারদের পাট করে ভালো করে ন্যাপথলিন দিয়ে বাক্সে তুলে রেখো , আগামী বছর আবার বের করবে ! অর্থাৎ , সেই শীতকাল শেষ হলে কম্বল যেমন তুলে রাখতে হয় অনেকটা সেইরকম কেস নাকি ! তার মানে কি বিভিন্ন ঋতুর মতো প্রেমেরও একটা নির্দিষ্ট কাল আছে ?
আছে তো ! সেটা বসন্ত। এই বসন্তকে চিরদিন প্রেমের প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করে থাকেন কবি সাহিত্যকরাও। বসন্ত মানে জীবন ফিরে পাওয়া, বসন্ত মানে রঙের ছোঁয়ায় রাঙিয়ে দিয়ে যাওয়া!
" যে ক'দিন আকাশ জুড়ে দল বেঁধে যায় হাঁস,
যে ক'দিন শিমুল তলায় দাঁড়ায় ফাগুন মাস
সে ক'দিন দূরকে কাছে চেও,
যা খুশি তাই নিয়ে গান গেও! "
(স্বর্ণযুগের গানের কলি। গীতিকার: পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়। সুরকার: সুধীন দাশগুপ্ত। কণ্ঠশিল্পী: মান্না দে।)
অর্থাৎ বসন্তে প্রকৃতি যেমন সৃষ্টির আনন্দে মেতে ওঠে, সে কোনও বন্ধন মানতে নারাজ এই সময়টাতে ঠিক তেমনি করে প্রেম মানুষকে মুক্তি দিতে পারে । দৈনন্দিন জীবনের সমস্ত গ্লানি মুছে ফেলে একমাত্র প্রেমই মানুষকে অমৃতের সন্ধান পাওয়ার পথ দেখিয়ে তাকে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে সাহায্য করে। এইজন্যে হাজার হাজার বছর ধরে পথ চলার পরও প্রেমের জয়যাত্রা কখনও থেমে যায় না , কারণ একমাত্র প্রেমই অবিনশ্বর!
কিন্তু পাশাপাশি এটাও ঠিক যে প্রথম বসন্তে প্রকৃতি যেমন বেহিসেবি ফুল ফোটানোর খেলাতে মেতে ওঠে , শেষ বসন্তে সে যেন অনেকটা সংযত হয়ে যায়। একইভাবে মানুষের বয়স বাড়লে সে বুঝতে পারে এসব প্রেম-ট্রেম বলে কিছু নেই পৃথিবীতে, আসলে প্রেম হচ্ছে একটা ফাঁদ। হয়তো এটা বয়সের ধর্ম, কারণ এতদিনে সে পোড় খাওয়া একজন ব্যক্তি এবং বাস্তব অভিজ্ঞতা অর্জন করে ঋদ্ধ হয়েছে। সে বুঝে গেছে যে বিয়ের আগের প্রেম বিয়ের পর একেবারে নতুন মূর্তি ধারণ করে জীবনের অর্থ পাল্টে দিয়েছে এবং তার এযাবত্ দেখা স্বপ্ন ভেঙ্গে চুরমার করে দিয়েছে।
গুরুদেবের গানেও সেই কথাটাই ঘুরে ফিরে আসে, যদিও কিছুটা ভিন্ন অর্থ নিয়ে :
" প্রেমের ফাঁদ পাতা ভূবনে---
কে কোথা ধরা পড়ে কে জানে। "
( মায়ার খেলা l রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর l )
বিয়ের বয়স যত বাড়তে থাকে ততই বিবাহিত মানুষ, নারী পুরুষ নির্বিশেষে সকলেই আবিষ্কার করে, 'প্রেম নেই , মিছে কথা!' তারা তখন বুঝতে শুরু করে যে হাতে যথেষ্ট টাকাপয়সা না থাকলে প্রেম ফুরুৎ করে রান্নাঘরের জানলা দিয়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য। বিয়ে করে তারা ফেঁসে গেছে । এখন উল্টো দিকে চোদ্দ পাক মারলেও সেই সপ্তপদীর বাঁধন সহজে খুলবে না। অগত্যা কী আর করা যায়! সংসারের ভার কাঁধে নিয়ে সফল প্রেমিক বাজারে গিয়ে দরাদরি করে পালং শাক কেনে আর ব্যর্থ প্রেমিক দমবন্ধ করে কবিতা লিখতে শুরু করে।
এইজন্যেই হয়তো রবীন্দ্রনাথ শেষের কবিতা উপন্যাসে দেখিয়েছেন যে বিয়েতে প্রেমের অপমৃত্যু ঘটে । কিন্তু, তাই বলে মানুষ কি বিয়ে করবে না ? অবশ্যই করবে , একশো বার করবে ।সব জানার পরও কি মানুষ প্রেমে পড়বে না ? অবশ্যই পড়বে । কারণ, সে বিশ্বাস করে প্রেম আছে বলেই পৃথিবীটা আজও ঘুরছে । এতসব অনাসৃষ্টির মাঝে প্রেম নিঃশব্দ চরণেই আসে , আবার নিঃশব্দে একদিন চলেও যায়। প্রেম চলে যাওয়ার পরও প্রেমিক হৃদয় আশা নিয়ে বসে থাকে তারই ফিরে আসার পথ চেয়ে । এই বসে থাকার মধ্যেই হয়তো সীমাবদ্ধ থাকে জীবনের যত চাওয়া পাওয়ার ব্যালেন্স সিট।' টুরু লভ ' তবু দিল্লি কা লাড্ডু হয়ে মানুষের কল্পনাতেই থেকে যায় আজীবন।
****************
সুজিত চক্রবর্তী।
Address : New Panvel ( E) . Navi Mumbai
----------------------------------