রীতা
মম মজুমদার
ছোট্ট কালো মেয়েটি নাম তার পুষ্প সরকার। বয়স ১০-১১ বছর গ্রামের আনাচে-কানা ঘুরে বেড়াতো কোলে তার দুটো ভাই বোন ,সাথে সাথে চলতো আরো তিনটে ভাই বোন ।
কোনদিন একবেলা ভাত জুটলে রাত্রিবেলা উপোষ ছিল তাদের নিত্যদিনের রুটিন!
বড় মাটির উনুনটা হা করে থাকতো কখন এক মুঠো চাল সেখানে ফুটবে ।
গ্রামের বেশিরভাগ পরিবারই এইরকম হাগুড়ে বুনো শাক, গেড়ি গুগলি কখনো বা এক মুঠো চাল সৌভাগ্য থাকলে এক ফোঁটা তেল ।
এই ছিল তাদের নিত্য দিনের জীবন। তুলনামূলক যাদের জমি জিরাত আছে তাদের ঘরের সারা বছর খাবার থাকতো ,ছেলে মেয়েগুলো দূরের স্কুলে যেত ।
রিতার বাবা গঞ্জে বাতাসা কাটে মা বাড়ি বাড়ি ধান ঝেড়ে কোনদিন চাল আনতে পারে কোনোদিন বা পারে না !
অক্ষর জ্ঞান কোনদিনই হয়নি, ভাত জোটে না যেখানে সেখানে আবার অক্ষর জ্ঞান!
অভাবী সংসার গুলিতে আর কিছু না থাক যৌন চাহিদা প্রচন্ড পরিমানে।
যে কারণে একাধিক সন্তান বছর অন্তর আসবেই! ডারউইনের তত্ত্ব অনুযায়ী অস্তিত্বের জন্য সংগ্রাম করে কিছু শিশু বেঁচে থাকে। তারাই পরবর্তীকালে শহরে বাবুর বাড়িতে খাটতে যেত ।এই ধরনের শিশু শ্রমিক গুলোর শহরে প্রচন্ড চাহিদা ছিল ।খাওয়া পড়া ও সামান্য বেতনের মাধ্যমে বছর ভর দিন রাতের কাজের লোক হিসাবে কাজ করতো।
শহরে প্রায় বেশিরভাগ সচ্ছল পরিবারের এই ধরনের দিন রাতের কাজের ছোট মেয়ে বা ছেলে রাখার রেওয়াজ ছিল।
এদের শহরে পৌঁছে দেওয়ার জন্য একদল দালাল ছিল ,যারা কমিশনের বিনিময় ছোট ছোট ছেলে মেয়ে সাপ্লাই দিত ।
ঠিক এইভাবে পুষ্পর ১০ টাকা মাইনের বিনিময় দিনরাতের কাজের মেয়ে হয়ে মাত্র এগারো বছর বয়সে কলকাতার কলেজ স্ট্রিটে পা দেয় ।গ্রামের মাসির সাথে প্রথমে নৌকা পরে বাসে অজানা অচেনা জায়গায় প্রিয় বাবা-মা, ভাই বোনকে ছেড়ে সারা রাস্তায় কাঁদতে কাঁদতে পুষ্প পৌঁছে ছিল কলকাতায়।
সারাদিন ফাইফর্মাস খাটতো ছেলেমেয়ে দুটোকে স্নান করানো গিন্নির সাথে বাজারে যাওয়া ,ছোট্ট দুটি হাত দিয়ে বালতি করে জল ভরা। ঘর মোছা ঝাড় পোছ করা কখনো কখনো রান্নাঘরে হেসেলে সবজি কেটে দেওয়া। অনেক চেষ্টা করে ভাতের হাড়িটা নামাতে পারতো না! তার জন্য অনেকবার মারও খেয়েছে। একবার তো ফ্যান পায়ে পড়েই গেল! সেই পোড়া পা নিয়ে কাজ করতে হয়েছে!
বাড়িতে আত্মীয়-স্বজন কুটুম আসলে তাদের জন্য ফাইফর্মাস খাটতে হতো। বিনিময় জুট তো নেকরায় বাধা আলাদা চাল দিয়ে তৈরি ভাত সামান্য সবজি।
কোনদিন মাছ-মাংস এক্সট্রা হলে ২-১ টুকরো জুটেও যেত।
প্রতি মাসে গ্রামের মাসি এসে বাড়িতে পাঠানো 10 টাকা মাহিনা নিয়ে যেত মাকে দেবার জন্য।
সন্ধ্যা হলে আত্মীয়-স্বজন বন্ধু-বান্ধবএ সে দেদার ফুর্তি করতো।
বাসন ধুতে ধুতে ছোট্ট পুষ্প কখন যে খাটের তলায় ঘুমিয়ে কাদা হয়ে যেত কেউ তার খবর রাখতো না!
পরের দিন সকাল বেলা পাহাড় প্রমাণ বাসন নিয়ে তাকে বসতে হত ধুয়ার জন্য ।
মনে পড়তো গ্রামের পুকুরপাড়, ঘোষেদের গোলা জমিদারের নাট মঞ্চ যেখানে সারাদিন ঘুরে বেড়াতো।
ছোট্ট মেয়েটার বাড়ি ফেরা হতো না পাছে চাকরি চলে যায়!বাড়িতে যে টাকা পাঠাতে পারবে না!
দালাল মাসি নিয়ে গেল অন্য বাড়িতে এখানে মাইনে পনেরো টাকা!
বাড়ির গিন্নি মানুষটা খুব ভালো, বাড়ির কাজ যত না করা তো ফাইফর্মাস দোকান থেকে জিনিসপত্র নিয়ে আসা এসবই করা তো।
বাড়ির গিন্নি এবং তাদের একটি মাত্র মেয়ে যে তখন দশম শ্রেণীতে পড়তো পুষ্পকে চেষ্টা করেছিল অক্ষর জ্ঞান তৈরি করার। একটু লেখাপড়া শেখাতে।
কিন্তু পারেনি।
যখনি তারা যেখানে যেতেন পুষ্পকে সাথে করে নিয়ে যেতেন।
এই বাড়ির কর্তা পুষ্পর নাম রেখেছিল রিতা। কারণ তার বড় শালিকার নাম পুষ্প ছিল যে।
রিতা এই বাড়িতে এসে অনেক কিছু শিখেছিল আগে যেমন সকলকে ভয় পেত এখানে দিদির কাছে থেকে ভয়টাকে জয় করেছিল।
দিদি সব সময় বলতো তুই সত্যি কথা সবার সামনে জোর গলায় বলবি। কাউকে ভয় পাবি না ।সব মানুষ সমান ।
তাই তো পোস্ট অফিসে মানি অর্ডার করে বাড়িতে টাকা পাঠালে একবার যখন আটকে গেল দিদির কথা অনুযায়ী পোস্টমাস্টার কে বলতে পেরেছিল ,তোমার মাইনেটা যদি এক মাস না হয় তাহলে তুমি কি করবে? আমার টাকাটা যত তাড়াতাড়ি পারো আমার মায়ের কাছে পৌঁছে দাও ।
এক বছর এই বাড়িতে থাকার পর রিতা মায়ের অসুখ শুনে দেশে ফিরে যায় দালাল মাসির সাথে ।গিয়ে দেখে মায়ের সিঁথি সাদা !
এক লাফে ১১ বছরের মেয়েটা ২১ বছরে পৌঁছে যায়। বুঝতে পারে সংসারের সব দায় তার ঘাড়ে। আবার চলে আসে কলেজ স্ট্রিটের এক বাড়িতে যেখানে মালিক বৃদ্ধ মেসোমশাই একাই থাকতেন। তার কাছে অনেক শিক্ষিত লোকজন আসা-যাওয়া করতো কিন্তু তারা কিছু নেশার বস্তু এই মেসো মহাশয় কাছ থেকে সংগ্রহ করত। রিতা বুঝেও না বুঝার ভান করতো। কারন তখন তার টাকা চাই। ধীরে ধীরে রিতা ও এই কারবারে জড়িয়ে গেল ছোট ছোট ভাই বোন গুলোকে মানুষ করার তাগিদে।
রিতা জীবনের সফল হয়েছিল সিথির মোড়ের এক বছরের শিক্ষা নিরক্ষর রিতা কে মানুষ করে দিয়েছিল।
নেশার বস্তু কিনতে আসা সরকারি চাকুরে একজনের সাথে ছোট বোনটা বিয়ে দিয়ে তাকে কলকাতার বাসিন্দা করে ।
এইভাবে বাকি ভাই বোন গুলোকে এক এক করে শহর কলকাতায় নিয়ে আসে তাদের রুটি রোজগারের ব্যবস্থাও করে দেয়।
বৃদ্ধ মেশোমশাই হঠাৎ পৃথিবীর ওপারে চলে গেলে! রিতার কারবারও বন্ধ হয়ে যায় ।
পুলিশ রিতাকে ধরতে পারেনি।
আজ রিতা সফল ঘরণী তার ছেলেমেয়ে দুটো পড়াশোনা করছে। ।
স্বামী স্ত্রী মিলে তারা কলেজ স্ট্রিটে ভাতের হোটেল চালায় ।ফুটপাতে এখন এটা শুধু ভাবে তাদের সময় তো মিড ডে মিল ছিল না ছিল না কন্যাশ্রী ছিল না সাইকেল ছিল কেবল না খাবার জ্বালা। হয়তো আজকের দিনে জন্মালে রিতা একটু হল অক্ষর জ্ঞান পেত। ছেলে মেয়েদের মধ্যে দিয়েই নিজের স্বপ্নকে সফল করতে চায় আজ!
================================
,,,কলমেঃঃ মম মজুমদার ।