অণুগল্প ।। শ্বাশত প্রেম ।। দীনেশ সরকার
শ্বাশত প্রেম
দীনেশ সরকার
সুদীপকাকু দুবছর জার্মানীতে পোস্ট ডক্টরেট করে গতকাল রাত্রে বাড়ি ফিরেছে আর আজ সকালেই আমাদের বাড়ি চলে এসেছে মিনুপিসির সঙ্গে দেখা করতে । অনেকক্ষণ এসেছে, কিন্তু মিনুপিসি তো ঘর থেকে বেরোচ্ছেই না, তাই সুদীপকাকু মার সঙ্গে জার্মানীর গল্প করছে । সুদীপকাকু মিনুপিসিকে খুব ভালোবাসে সেটা আমি ছোটোবেলা থেকেই জানি । আমি অনুলেখা ক্লাস টেনে পড়ি, এখন আমি ভালোমতোই জানি মিনুপিসিও সুদীপকাকুকে খুব ভালোবাসে । আই আই টি থেকে ডক্টরেট করে পোস্ট ডক্টরেট করতে সুদীপকাকু যেদিন জার্মানী যাচ্ছিলো সেদিন আমি আর মিনুপিসি এয়ারপোর্টে গিয়েছিলাম সুদীপকাকুকে বিদায় জানাতে । এয়ারপোর্ট থেকে ফেরার পথে মিনুপিসির ছলছল চোখ দেখে বুঝেছিলাম মিনুপিসি সুদীপকাকুকে কতটা ভালোবাসে ।
মিনুপিসি আসছে না দেখে আমি মিনুপিসিকে ডাকতে গেলাম । মিনুপিসির ঘরে ঢুকে দেখি মিনুপিসি খাটের এক কোণায় জুবুথুবু হয়ে দাঁড়িয়ে । আমি বললাম, 'কিগো মিনুপিসি, সুদীপকাকু এসেছে আর তুমি ঘরের কোণায় দাঁড়িয়ে আছো । এসো, সুদীপকাকু কখন থেকে তোমার জন্য বসে আছে ।'
মিনুপিসি আমার হাতদুটো ধরে কাচুমাচু মুখ করে বললো, 'তুই বল্ অনু, আমি এই চেহারায় কি করে সুদীপের সামনে গিয়ে দাঁড়াবো । আমি পারবো না । তুই সুদীপকে চলে যেতে বল্ ।'
আসলে সুদীপকাকু জার্মানী চলে যাওয়ার পরে মিনুপিসির ক্যান্সার ধরা পড়ে । অনেকগুলো কেমো নিতে হয় । চিকিৎসার পরে মিনুপিসি সুস্থ হয়েছে ঠিকই, কিন্তু মাথার সমস্ত চুল উঠে গেছে, শীর্ণ শরীরে কালো কালো ছোপ পড়েছে । তাই সংকোচে নিজেকে ঘরের মধ্যে গুটিয়ে রেখেছে । ঘর থেকে বের হয় না , কারও সাথে মেশে না ।
আমি সুদীপকাকুর হাত ধরে মিনুপিসির ঘরে নিয়ে গেলাম । মিনুপিসি চমকে উঠে মুখ নীচু করে থাকলো । সুদীপকাকু বললো ,'মিনু, আমি সব জানি । তোমায় আমি কতদিন ফোন করেছি বলো । তুমি তো আমার ফোন ধরতেই না । কিন্তু অনুলেখা আমাকে প্রতিদিন হোয়াটসঅ্যাপে তোমার সব খবর দিত । তোমার ছবি পাঠাতো । কোন্ ডাক্তার কবে কি বলেছে সব আমায় জানাতো । কবে কবে তোমায় কেমো দিয়েছে সব আমার মুখস্থ । শোনো মিনু, আমি তোমার চুল দেখে, তোমার শরীর দেখে তোমাকে ভালোবাসিনি । আমি তোমার মনটাকে ভালোবেসেছি , তাই তুমি আমাকে ফিরিয়ে দিতে পারবে না ।'
মিনুপিসিকে এত নার্ভাস আমি কোনোদিন দেখি নি । কাঁপা কাঁপা গলায় কোনরকমে বললো, 'যে মিনুকে তুমি জানতে আজকের মিনু তো আর সে মিনু নয় । কি পাবে তুমি এই মিনুর কাছে !'
' কি পাবো না পাবো সেটা তুমি আমাকে বুঝে নিতে দাও । তুমি এতটা ভেঙে প'ড়ো না মিনু । শোন মিনু, তোমার অসুখের জন্য তো তুমি দায়ী নও । শরীর থাকলে অসুখ হয়, চিকিৎসা করে সেই অসুখকে সারানোর চেষ্টা করতে হয় । তোমার পরিবার পরিজন তাই করেছে । তুমি কেন নিজেকে সংকুচিত করে গুটিয়ে রেখেছো ? আমার ভালোবাসার কি কোনো দাম নেই তোমার কাছে ?'
'ও কথা বোলো না সুদীপ । তুমিই বলো আমার এই জরাজীর্ণ শরীর নিয়ে কি করে আমি তোমার সামনে, তোমার পরিবার-পরিজনদের সামনে গিয়ে দাঁড়াবো ?' আমি পারবো না । তুমি আমায় ভুলে যাও সুদীপ । আমার সাথে আর যোগাযোগ রেখো না ।'
'তোমার পরিস্থিতি যদি আমার হ'তো, তুমি কি আমায় ছেড়ে যেতে পারতে ? কালই আমি মা-বাবাকে তোমাদের বাড়িতে এনে বিয়ের দিন পাকা করে যাবো ।'
সুদীপকাকু মিনুপিসির হাত ধরলো । মিনুপিসি একটু কেঁপে উঠলো, দুচোখ দিয়ে অবিরল ধারা গড়াতে লাগলো । আমি ঘর থেকে বেরিয়ে গেলাম । আমারও চোখ ছলছল করে উঠলো, মনে মনে বললাম, ওদের প্রেম যেন শ্বাশত প্রেম হয় ।
************************************************************************************************
দীনেশ সরকার
১৪০ ডি, হিজলি কো-অপারেটিভ সোসাইটি,
প্রেমবাজার, খড়্গপুর, পশ্চিম মেদিনীপুর।