স্মৃতিকথা ।। একদিন বিকেলেতে দুজনে ।। অভিষেক ঘোষ
একদিন বিকেলেতে দুজনে
- অভিষেক ঘোষ
আজকাল মাঝেমাঝেই মনে পড়ে যায় আমাদের ছাত্র-জীবনের কথা । ট্রেনে যাতায়াত-কালে ছোটো থেকে কত বিচিত্র অভিজ্ঞতাই না হয়েছে !
শিয়ালদা থেকে ছুটতে ছুটতে ট্রেনে উঠে অফিস-ফেরতা ভদ্রলোককে ভরসা করে ট্রেন ছাড়ার সময় জানতে চেয়ে কীভাবে ঠকেছি মনে পড়ে !
"দাদা, ট্রেন-টা কটায় ছাড়বে ?"
"আমায় বলে নি জানেন...
" - সহাস্য বিদ্রূপ শুনেও ফ্রাস্টেটেড হায়েনার দলে একা বলে, রাগ গিলে নিয়েছি ।
আবার এই ট্রেনেই টিকিট না কেটে উঠে দুরু দুরু বুকে গন্তব্যে পৌঁছানোর ঠিক একটা স্টপেজ আগে চেকারের কাছে হাতেনাতে ধরা পড়ে ল্যাজেগোবরে হয়েছি ।
পুরোনো বান্ধবীকে সহসা আবিষ্কার করেছি ট্রেনেই নিত্যযাত্রীদের সাথে রবীন্দ্রজয়ন্তী পালন করতে ।
আবার এই ট্রেনে সপরিবারে বাড়ি ফেরার সময় একবার মায়ের চোখে জানালা দিয়ে তীব্র গতিতে মাটির শক্ত ঢেলা এসে লাগতেও দেখেছি - বদমাশ বাচ্চাদের ভয়ানক খেলা । একটুর জন্য মা-র চোখ বেঁচেছিল সেবার ।
বহু আগে, তখন আমি অনেক ছোট, মেলা থেকে ফেরার পথে বাবা মায়ের সঙ্গে লক্ষ্মীকান্তপুর স্টেশনে সারা রাত কাটাতে হয়েছিল । কারণ আজ আর ভালো মনে নেই । হয়তো কোনো কারণে লাইনে সমস্যা হয়েছিল বা, কোনো দুর্ঘটনা, ফলে অত রাতেও ট্রেন আচমকা বন্ধ হয়ে যায় । শুধু যে ঘটনাটা স্পষ্ট মনে আছে তা হল, ব্যাগে মাথা দিয়ে শোয়ার সমস্যা হচ্ছিল আর ঠান্ডাও ছিল বেশ । ওয়েটিং রুম বলে সেকালে কিছুই ছিল না গ্রামাঞ্চলে, একালেও যে লোকাল ট্রেন-লাইনে সেরকম কিছু আছে, তা মনে হয় না । তো সেবার দয়ালু স্টেশন মাস্টার অত্যন্ত সহৃদয়তার সাথে, সেই রাতে, আমাদের তাঁর অফিস ঘরে ডেকে নেন । আমার ঘুম পাচ্ছিল না বলে বই পড়তে দেন ও বেশ মনে আছে, গোটা দুই বইয়ের ওপর মাথা রেখেই সে রাতে শেষ পর্যন্ত ঘুমিয়েছিলাম ।
এমন কত কত স্মৃতি !
একটা অত্যন্ত ব্যক্তিগত সুখের মুহূর্তও কৌশলে বলা যায় । ট্রেনেই প্রথম ভালো করে দেখেছিলাম তাকে । সহপাঠীই ছিল । তারপর...
তো এক বিকেলে তাকে ভীড়ের মধ্যেও কেবল গল্প বলে একলা করে দিতে পেরেছিলাম । মনে মনে ভাবতে ভালোবাসি, আমার এই ক্ষমতাটা আছে ! আমি এমনভাবে গল্প বলতে পারি, যাতে পাশের মানুষটার আর কিছু খেয়ালই থাকবে না - ভীড় আর হট্টগোলেও মনে হবে, আছি শুধু আমি-তুমি ।
কী গল্প বলেছিলাম ? একটা নয়, দুটো । দক্ষিণ কোরিয়ার এক বিখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক কিম কি-দুক সেই মুহূর্তে আমার প্রিয়তম পরিচালক । তাঁর দুটি ছবি, যা দেখার পর আমি কয়েকটা রাত স্বপ্নেও সেই ছবির দৃশ্যগুলোই দেখেছি, সেই ছবিদুটির প্লট শুনিয়েছিলাম তাকে... '3-Iron' আর 'The Bow' ।
উল্লিখিত প্রথম ছবিতে এক ভবঘুরে ছোকরা ফাঁকা বাড়িগুলির কী-হোলে দোকানের খাবারের মেনু কার্ড সেঁটে দিত, তারপর কয়েকদিন বাদে বাদে এসে দেখত, কোন কার্ডগুলো যথারীতি, অক্ষত অবস্থায় স্ব-স্থানে রয়েছে । কারণ এর মানে ওই বাড়িগুলো ফাঁকা পড়ে আছে, কেউ থাকে না । তারপর সে সেই সব বাড়িতে মালিক না আসা পর্যন্ত দিব্যি থেকে যেত । অবশ্যি একেবারে এমনি নয়, বিনিময়ে যেচে উপকার করে দিত । খারাপ বা অচল ব্যবহার্য জিনিসপত্র থাকলে, অলক্ষ্যে সারাই করে দিত, জামা-কাপড় কেচে দিত ইত্যাদি । আর এভাবেই একদিন সে এক ধনী ব্যক্তির বাড়িতে আবিষ্কার করে এক অসুখী গৃহবধূকে । তারপর...
আর দ্বিতীয় গল্প এক বোবা মেয়ের সাথে এক বুড়োর আশ্চর্য সম্পর্কের - অধিকার বোধ আর অদম্য কামনা যেখানে দুই অসমবয়সী মানুষের মধ্যে এনে দেয় অপক্ক রক্তিম পরিণাম । সেই ছবিতে কী অপূর্ব সঙ্গীতের ব্যবহার ছিল আহা ! তেমনি চোখ জুড়োনো ক্যামেরা আর আলো ! আর গল্প শোনাতে শোনাতে কথক যদি শ্রোতার চোখেও তেমনই আলো দেখতে পায়, তাহলে তো কথাই নেই । অবশ্য জানি না ভান ছিল কিনা ! এই দুনিয়ায় ভাই সবই হয়... সব সত্যি ! সব সত্যি ! কিন্তু সেই বিকেলের অনাবিল আনন্দ এখনো চলন্ত লোক্যাল ট্রেনের মতোই মৃদু দোলা দিয়ে যায় মনে । হাত অন্যমনস্ক ভাবে, বেখেয়ালি বাতাসে, কারো কপালে এসে পড়া চুল আপনি সরিয়ে দিতে উদ্যত হয় । তারপর ঘুম ভাঙে আর খেয়াল হয়, ট্রেন তো চলছে না আর; কবেই গিয়েছে থেমে ।
----------------------------