চোখের আলোয় চেয়ে
সৌমেন দেবনাথ
অণুশ্রীর চোখের তারায় চেয়ে ঐ যে হারিয়েছি, আর নিজেকে ফেরাতে পারিনি। মায়ার বাস নাকি মনের মধ্যে, কিন্তু আমি দেখেছি মায়া যত সব ওর চোখের তারায়। একবার তাকালে আর চোখ নামানো যায় না। চোখের তারায় হারিয়ে যাই বলে সে আবার চোখের বাড়তি পরিচর্যা করে। কাজল কালো চোখে চেয়ে চেয়ে আমার সময় চলে যায় আমি বুঝতেও পারি না। চোখের ভাষায় কত কথা লেগে থাকে, লিখলে বড়ো কলেবরের উপন্যাস হবে। দুই ঠোঁট অস্ত্র করে ঐ দুই চোখে প্রেমদাগ না এঁকে দিলে ঠোঁটদ্বয় অস্থির হয়ে থাকে। চোখে আদর এঁকে দিলে চোখ দুটো আরও মায়াবি হয়ে উঠে। আদর পেলে চোখের তারায় ঝিলিক জাগে। দুই চোখের মণি যেন কৃষ্ণ গহ্বর, আমি তার মধ্যে তলিয়ে যাই, হারিয়ে যাই। দুই চোখের চারটি পাপড়িতে কতগুলি পালক আছে আমি বলে দিতে পারি। হঠাৎ একটি পালক খসে পড়লে বুঝতে পারি স্পষ্টভাবে, এমনি আমি তার চোখের একনিষ্ঠ পাঠক।
চোখ যে আত্মার আয়না আগে পড়লেও বুঝতাম না। শুধু চোখে চেয়েই ভেতরটা পড়ে ফেলা যায়। ওর চোখের অভিব্যক্তি আমার কাছে সহজপাঠের মতো একদম সহজ আর সরল। আমাকে ঘিরে তার আকুলতা ঠোঁটের চেয়ে চোখেই বেশি প্রকাশমান। তার হৃদয়ে প্রবেশের প্রবেশদ্বার তার ঐ দুটি চোখই। যে চোখের তারায় চেয়ে হৃদয়ের অলিগলিতে সাঁতার কাটা যায় অনায়াসে। মুখের ভাষার চেয়ে চোখের ভাষার শক্তি কত যে প্রবল শুধু অণুশ্রীর চোখে চেয়ে বুঝেছি। অভ্যন্তরীণ সত্তাকে বুঝতে চোখের ভাষার গবেষক হতে জানতে হয়। চোখের ভাষার বিশ্লষকরা খুব সুখী হয়। বলতে না পারা কথাগুলো যেহেতু চোখের মণিতে লুকায়িত থাকে, তাই চোখের ভাষা বুঝতে জানলে হৃদয় সত্তার সারথি হয়ে উঠা যায়।
আবেগের ঘনঘটা চোখেই থাকে। তাকানোর ধরনে নিজের গুরুত্ব তার কাছে কত ঘনায়মান বোঝা যায়। অপলকে চায় বলে বুঝতে পারি আমাকেই চায় সে। নয়নতুষ্টি নয়নেই থাকে। হৃদয় লোপাটের অস্ত্রই হলো চোখ, চোখের মায়া, চোখের তারার মায়া। যেদিন নির্লিপ্ত নয়নে থাকে ও বুঝে নিই অকারণেই কোনো কথায় তাকে কষ্ট দিয়ে ফেলেছি। নিজের ভেতর তখন নিজেই প্রশ্ন করতে থাকি, কোন বেফাঁস কথায় হলো সে আঘাতপ্রাপ্ত। বলে না, কিন্তু বুঝে নিই কেবল তার চোখের অভিব্যক্তির কারণে। খুব সহজে তাই তার মনোকষ্টের পুরুষ থেকে মনোতুষ্টির পুরুষ হয়ে যাই।
সূর্যের তাপে বরফ গলে যায়, তার নয়নে নয়ন রেখে নিজে গলে যাই। তার উপর কোনো রাগ উঠলে ধরে রাখতে পারি না। আমি রাগ করলেই সে শুধু বলবে, চোখ বরাবর চেয়ে কথা বলো।
ঐ চোখে তাকালে রাগ কর্পূর হয়ে বাতাসে মিশে যায়। এত মায়া যে চোখে সে চোখকে অগ্রাহ্য করা যায় না। রাগ পুষে রাখা যায় না। যে চোখে আমার খুশির তারা সে চোখকে অগ্রাহ্য করাও যায় না। যে চোখে নিহিত আমার ভাগ্যের তারা সে চোখে চেয়ে থেকেই মরে যাবো।
কৌণিক চোখে তাকালে ইতস্তত হই। কৌণিক চাওয়ার কারণ খুঁজে পাই না যখন তখন চোখ বন্ধ করি। চেয়ে দেখার চেয়ে চোখ বন্ধ করে অনেক কিছু দেখা যায়। যখন চেয়ে দেখে বুঝি না তখন চোখ বন্ধ করে বুঝে নিই। চোখ দিয়ে সবাই তো দেখে, খালি চোখে দেখা আর মনের চোখে দেখা এক না কখনো। উপলব্ধিযোগ্য চোখ খুব দামি। সে চোখের দেখাতে ভুল থাকে না। কৌণিক চোখে দেখার কারণ বুঝে নিয়ে সমাধানের চেষ্টা করি। আবার হাসি জাগে চোখের তারায়, আবার ফুল ফোটে চৌধারায়। এক চোখ, আর তাতে কত কত নিগূঢ় কথা।
শুদ্ধ চোখে দেখি তাকে তাই লাগে ঐশ্বরিক। দোষ চোখে দেখি না তাকে, দোসর যে। নিন্দার চোখে দেখলে সব খারাপ লাগে। পরিশুদ্ধ যে আমার কাছে তাকে পরিশুদ্ধ চোখেই দেখি। দেখতে দেখতে একঘেয়ে লাগলে বুঝতে হবে দেখার চোখ আছে, দেখার দৃষ্টি নেই। হৃদয়ের যে অংশীজন তাকে দেখতে হয় হৃদয়ের চোখেই৷ চোখ থাকলেই হয় না, দেখতেও জানতে হয়। শুধু সুন্দর করে দেখার অনাভ্যাসে সম্পর্কে দূরত্ব বেড়ে যায়। কত কথা মুখে বলি, কিন্তু বুঝে নিতে চোখই লাগে। শুধু দেখতে জানার বিরল গুণে আপন হয়ে যায় আরও আপন। আপাতত চোখ দিয়ে দেখার গুরুত্ব কমিয়ে আত্মার চোখে দেখতে থাকলে সব হয়ে যায় সুন্দর। যে অণুশ্রীকে আমি দেখি সে অণুশ্রীকে পাওয়ার পরও পেতে হয়েছে। পেলেই পাওয়া না, পাওয়াটা তখনই স্বার্থক যখন হৃদয়টা মেলে। তাকে পাওয়ার পরও পেতে আমার বেগ পেতে হয়েছে। আপাতত দৃষ্টি কমিয়ে যখন অন্তর্দৃষ্টি বাড়ানোর চেষ্টা করেছি তখনই দেখাটা হয়েছে আরও নান্দনিক, আরও অনিন্দ্যশোভন।
একবার তাকে তীর্যক চোখে বলেছিলাম দুটো কটুকথা। সে রক্তিম চোখে আমাকে দেখেছিলো একবার। আর তাতেই জ্বলে গিয়েছিলাম আমি। তার ঠোঁটের কথার চেয়ে চোখের কথা কত বেশি শক্তিসম্পন্ন সেদিনই বুঝেছিলাম। সে আমাকে জয় করেনি মিষ্টি কথার ফোয়ারায়, সে আমাকে পরাজিত করেছে সূক্ষ্ম চোখের চাহনি দিয়ে। দৃষ্টিশক্তির মায়াবি মমতায় তলিয়ে না যেয়ে উপায় নেই। এখন এত বেশি কাতর হয়ে আছি তার মায়ায়, পারি না আর শক্ত কথা বলতে। তীক্ষ্ণ চোখ দেখে হৃদয়ের প্রকোষ্টের সব, দুর্বল চোখ দেখে শুধু আপাতত বহির্বর্ণের জ্বাজ্বল্য। হৃদয় হরণা হতে তাই তীক্ষ্ণধী চোখের অধিকারি হতে হয়।
একদিন মায়ের সাথে উচ্চস্বরে কথা বলছিলাম বলে আড়চোখে চেয়ে ইশারায় আমাকে নিবৃত্ত করেছিলো সে। কথার চেয়ে বলে কথা বেশি চোখ। যে চোখের ইশারা এভাবে নিবৃত্ত করতে জানে সে চোখের মায়ায় জড়িয়ে ঠকার সম্ভাবনা নেই। যে চোখ আমায় নির্বাক হয়ে দেখে সে চোখ আমায় ছাড়া আর কিছুই বোঝে না। যে চোখ আমার অনুপস্থিতিতে পথ পানে চেয়ে রয় সে চোখে সব সময় ধরা পড়ে যাওয়া ভালো। যে চোখ আমার উদ্বিগ্নতায় চোখ বন্ধ করে থাকতে পারে না সে চোখ গভীরেরও গভীর থেকে খোঁজে আমায়। যে চোখ আমার মূর্খতায় ভিজে যায়, সে চোখের কারণে বারবার শুদ্ধ হতে হয়। যদি রূঢ় আচরণ করে ফেলি, সে বলে, কার চোখে দেখছো আমায়, আমায় দেখো তোমার চোখে!
আমি দেখি তাকে আবার আমার চোখে। আমি তার হয়ে যাই আবার তার মতো করে। আমি কখনো যদি তার কাছে কথা লুকানোর চেষ্টা করি সে বলে, চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলো, মিথ্যা বলতে পারবে না।
তার চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলতে গেলে সব অশুদ্ধ শুদ্ধ হয়ে যায়, সব মিথ্যা সত্য হয়ে যায়, সব প্রচ্ছন্ন কথা প্রচ্ছন্ন থাকে না, ব্যক্ত হয়ে যায়।
সংসার জীবনে মনোমালিন্য না হওয়াটা অস্বাভাবিক। ওকে আর আমি ওর মতো করে পাই না, বদলে গিয়েছে যেন। অভিমানে গাল ভার করে থাকে। অভিরাগের চিহ্ন চোখে-মুখে স্পষ্ট। বলি, আমি এখন তোমার চোখের ভাষা বুঝি না কেন?
সে সরে যায় পাশের ঘরে, কথা বলে না। আমি চোখ বাঁকিয়ে উঁকি মেরে দেখি তাকে। যাকে দেখে আমার কৌতূহল মেটে না, সে কেন কথা না বলে আরও কৌতূহল বৃদ্ধি করে? যাকে দেখে আমার তৃপ্তি মেটে না, সে কেন অতৃপ্তি বৃদ্ধির জন্য আরও দূরে যাবে? আমি ওর কাছে গেলাম। ও মুহূর্তেই রেগে বললো, শুধু বসে বসে দেখবে বলেই কি আমায় বিয়ে করেছো?
কথাটি শুনতেই থমকে গেলাম। রাগে ফুঁসছে সে। আঙুনরঙা চোখে তাকানো দায়। যে চোখে এত মায়া সে চোখে এত আগুন! তাকে শান্ত করার উদ্দেশ্যে বললাম, আমার অজ্ঞানবশত ভুলের জন্য আমি ক্ষমাপ্রার্থী।
রেগে সে জবাব দিলো, সামনে থেকে সরে যাও।
আহা, তার চোখে অসহ্যের হয়ে গিয়েছি, সামনে থেকে সরে যেতে বলছে। যে চোখের দোসর আমি সে চোখের দুর্বৃত্ত হয়ে গিয়েছি যেন। রেগে আছে কেন প্রশ্নের উত্তর জানার জন্য ওর সামনে থেকে সরতে ইচ্ছা হয় না। বলি, তোমার চোখে জল, তোমার চোখে জলকুচি আমি ভাবনাতেও রাখি নাই।
নিমীলিত নয়নে সে বলে, আমাকে বসে বসে দেখে সময় অপচয় করলে কি তোমার জীবন চলবে? ঘরে থাকো, পরজনে তো মন্তব্য করে।
কিছুটা বুঝতে পেরেছি তার রাগের কারণ, তাই বললাম, তোমাকে দেখবো তাতে অন্যের জ্বলে কেন? তোমাকে না দেখে কি আমি কাজে মন দিতে পারবো? আঁখি মেলে দেখবো তোমায় জ্বলে তাতে জ্বলুক অন্যের আঁখি। যে আঁখিতে আঁখি রেখে হয়েছি আমি অবাক সে আঁখিতে আঁখি রাখবোই আমি অনন্তকাল।
বলে সে, না, দেখবে না; দেখার ভেতর না যত প্রাপ্তি না দেখলেও ততোধিক দেখা সম্ভব সদূর দেখার দৃষ্টি আছে যার। চোখ মেলে দেখার চেয়ে চোখ বন্ধ করে আরও বেশি দেখা যায়। কাছে থেকে যতটা দেখা যায়, দূরে থেকেও তারচেয়ে বেশি দেখা যায়। কাজ করবে মন দিয়ে। আমায় দেখতে গিয়ে, আমায় ভাবতে গিয়ে অন্যমনস্ক হয়ে পড়ো। আমি তোমারই, সুতরাং আমাকে দেখা নিয়ে তোমাকে উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছুই নেই।
বলি, এভাবে বলো কেন? তোমায় দেখি যে চোখে তুমি দেখো না কেন আমায় সে চোখে? চোখ থাকতে তুমি অন্ধ!
চোখ পাকিয়ে ও বললো, এই চোখে চেয়ে চেয়ে তুমি হবে অন্ধ।
চোখ রাঙানিতে না রেগে বললাম, চোখে তুমি ঠুলি পরে আমায় না দেখতে চাও ভালো, কিন্তু আমি তোমার চোখে চেয়ে চেয়ে হারাবোই।
সে আরও রেগে বললো, চক্ষুলজ্জা থাকলে আমার কথায় চোখ টাটাতো। কাজ বাদ দিয়ে ঘরে বসে বৌকে দেখে, একটা বেকুব। এতে যে আমি কত বিরক্ত হই চোখেও পড়ে না।
বলি, চোখের দেখা দেখতে আমি নই রাজি। দেখবো তোমায় আমি চোখেই কিন্তু চোখে চোখে রেখে। চোখের দেখা কোনো দেখা নয়, চোখে চেয়েই দেখবো সময় নিয়ে নিয়ে।
খুব রেগে বললো সে, তোমার চোখে পর্দার অভাব। এত রাগি রাগো না তবু। চোখ ধাঁধানো জীবন পেতে আমার চোখে চেয়ে থাকলে হবে না, কাজ করো মন দিয়ে। এভাবে চেয়ে চেয়ে জ্বালা ধরিও না।
বলি, শান-শওকত আমার চোখের বালি, তুমি আমার চক্ষু চড়কগাছ। যতই তুমি রক্তচক্ষু দেখাও, হও চক্ষুশূল; বলবো কথা এই চোখপানে চেয়ে। খুঁজবো সুখ আমার তোমার চোখের মায়ার জালে।
রাগ তার তবুও হয় না প্রশমিত, বলে, বড়ো বড়ো বুলি আওড়ায়ে লাভ নেই। চোখে আঙুল দিয়ে তোমার ভুল ধরিয়ে দিচ্ছি, তুমি শুদ্ধ হও। প্রতিটি কাজ করো যত্ন করে। কাজের সময় তুমি তোমাকে সময় দাও, অবসরে আমি তোমায় সময় দেবো। অণুশ্রীর চোখে চেয়ে সব দেখতে পাবে না, পাখির চোখে দেখো; সমাজটা দেখবে, বুঝবে।
বিস্ময়ে চোখ কপালে তুলে বললাম, অণুশ্রীর চোখে চেয়ে আমি যা দেখতে পাই দেখার জন্য আমার আর কিছুর প্রয়োজন নেই। সব বিস্ময় তোমার চোখের ভেতর আছে। দেখি আমি দেখি অবাক হয়ে।
বলে সে, চোখের মাথা খেয়েছো, তাই এভাবে বলো। চোখ কচলাও, চোখে ধুলো পড়েছে। ভালো হও, আরও ভালো। বয়স হলো চোখ ফুটলো না। শিশুদের মতো কথা বলো।
বলি, খারাপ দেখোনি, তাই আমায় খারাপ ভাবছো। খারাপরা খুব খারাপ, আমার মতো না। তারা চোখ উল্টায় মুহূর্তেই। তারা চোখে ধুলো দিয়ে চলে। চোখের মাথা খেয়ে তারা চোখ খোলে না। বোধের চোখে দেখো, দেখো আমার চোখেও সুখের ধরা।
বিরক্তি হয়ে সে চলে যেতে যেতে বললো, তোমার মূঢ়তা চোখ বুজে সহ্য করছি। তোমার ভাঁড়ামি দেখেও না দেখার ভান করি।
এরপর থেকে ওকে বাড়তি সময় নিয়ে দেখতে পারি না। চোখের তারায় তাকিয়ে বেশি কথা বলতে পারি না, চোখ নামিয়ে নিয়ে বলে, তোমার রোজগারে আমাদের চোখে-মুখে হাসি ফুটবে, তোমার অলসতায় আমাদের মাঝে দুর্ভিক্ষ নামবে।
বলি, তোমায় দেখলে আমার চোখে-মুখে হাসি ফুটবে, তোমায় না দেখলে আমার ভেতর দুর্ভিক্ষ নামবে।
খুব বিরক্তি প্রকাশ করে ও বললো, তুমি আমার কাছে বিরক্তির অন্য নাম হয়ে উঠছো!
বলি, তোমার বিরক্তি ভরা মুখটাও আমার দেখতে ভালো লাগে। চোখে তোমার যে বিরক্তি বিভা তাও আমার খুশির আভা। চোখে যে তোমার ক্রোধাগ্নি, আমার লাগে হেমাগ্নি। যে চোখের কণিকায় হারিয়েছি আমি তাতেই আমি অবগাহন করবো। চোখে যদি জাগাও অগ্ন্যুৎপাত তাতেও হবো জেনে রেখো অঙ্গার।
খুব বিরক্ত হয়ে সে সরে গেলো। ওর এবারকার সরে যাওয়া তেমন পছন্দ হলো না। পছন্দ করি তো খুব, তাই গুরুত্ব পাই না। চোখে চোখে রাখি তো, দূরে সরে গেলে যে যন্ত্রণা সে বোঝে না। চোখে চোখে রাখলে অগুরুত্বপূর্ণ হয়ে পড়তে হয়। শরীর ঘেঁষে রাখি তাই আর শরীরের গন্ধ ভালো লাগে না। চোখের মায়ায় বেঁধে রাখি তো তাই আর চোখের মায়ার মূল্য বোঝে না।
এরপর থেকে একটু দূরত্ব রেখে চলি। কথা একটু ভেবে বলি। প্রশংসা করা কমিয়ে দিয়েছি। দখলে যে তাকে অত আর দরদ দিই না। দেখি না আর ওকে আমার চোখে, দেখি দেখে কিনা আমায় তার চোখে। দূরে থেকে দেখি তার চোখে ছায়া নামে কিনা। চোখে যদি ফোটে দুঃখ দুঃখ ভাব বুঝে নেবো ভুল বুঝতে পেরেছে। হৃদয় দুঃখিত হলে চোখে সে দুঃখিত ভাব ফোটে ছাড়া কি! মন যদি ভারী হয় চোখে সে ভারী ভাব ফুটবেই। আমাকে দেখতে দেখতে তার যে বিরক্তি বেড়েছে দেখি দূরত্ব বজায় রেখে কমে কিনা। কিন্তু বাস্তবতা উল্টো। সে কাজে ব্যস্ত থাকে তার মতো করেই। মুখে হাসি, চোখে হাসি, ঠোঁটে হাসি। নিশ্চয় হৃদয় হাসিতে আন্দোলিত। কী ভাবি, ঘটে কী! আমাকে দূরে রেখেও যার মনে হাসি প্রবল সে তো বড্ড শক্ত মনের। শক্ত মনের মানুষের চোখে অত কথা থাকে কখনো? নানা চিন্তায় আমার চোখ বন্ধ হয়, নানা ভাবনায় ভেঙে পড়ি। আমার চোখে আমি তাকে বিচার করি কী, আর সে তার চোখে আমায় দেখে কী! দূরে দূরে থাকে, একটু আড়চোখে দেখলেও তো পারে! নিষ্ঠুর। তীর্যক চোখে দেখুক, আমার তো তাতেও সমস্যা নেই। আমি যে তার কাছে ধরা সে জেনেছে অনেক আগেই, আর তাই দূরে থেকেও প্রশান্তি পায়। কিন্তু তাকে রেখে দূরে আমি পাই না শান্তি, আমি তার উপস্থিতিকাতর। তার উপস্থিতিতে আমার নেই কোনো বিরক্তি। নিজেকে সরিয়ে নিয়েছে কিন্তু সে আমার চোখের ভাষা পড়ে বুঝে নিয়েছে দূরে আমি তাকে সরাতে পারি না। তাই দূরে থেকেও কত উৎফুল্ল সে। নিজেকে কখনো তার চোখ থেকে লুকাতে পারবো না, তাই তাকে মিছে দূরে রাখার সিদ্ধান্ত থেকে পিছিয়ে এলাম। খুব কাছে গেলাম তার, বললাম, অণুশ্রী, তুমি দূরে থাকো কী করে? মন বন্ধ করে দূরে থাকা যায়? চোখ বন্ধ করে দূরে থাকা যায়?
বলে সে, কল্পনার চোখে না চেয়ে বাস্তবতার চোখে দেখো আমায়। আমায় নিয়ে পড়ে থাকলে তোমার বাস্তবতা কঠিন হয়ে উঠবে। তোমার মেধার কাছে আমি নিছকই অণু না, পরমাণু। অণুশ্রী তোমার, অণু নিয়ে থেকো না। কাজ করো, দিনান্তে একবার দেখো। আমার চোখের গহ্বরে তলিয়ে গেলে জীবন তোমার কৃষ্ণ গহ্বরে যাবে। চোখ খোলা শুধু আমার পানে না, বাস্তবতার পানেও রাখো। জীবন খুব কঠিন, অন্ধ হয়ে পড়ে থাকলে পারবে না।
খুব বিরক্ত হয়ে চলে গেলাম বাসা থেকে বাজারে। ইদানীং সে বেশি বেশি বলছে আমায়। জ্ঞান দিচ্ছে যথেষ্ট। চোখে যে শব্দভাণ্ডার পেয়েছিলাম মুখে তার ভিন্ন শব্দগুচ্ছ। কোন নয়নের আলোয় ফেলেছিলাম নয়ন, হৃদয় পড়ে বুঝেও বুঝলাম না; এখন হৃদয় পুড়ে যায়। অত বেশি ওর চোখে চেয়েছি বলেই এত বেশি দুর্বল হয়ে গিয়েছি। আর তাই এত বেশি আমায় কষ্ট দিতে কাঁপে না তার হৃদয়। এখন কেন ওর চোখের ভাষা বুঝতে পারি না। চোখ তো সেই চোখই আছে, সেই চোখের ভাষা এত দুর্বোধ্য হয়ে গেলো কেন? চোখের মতো চোখ কি আমার নেই? দেখার মতো চোখ কি আমার নেই?
মানুষ বদলে গেলে বদলে যায় তার চোখের ভাষাও।
=====================