বিজ্ঞপ্তি
লেখা-আহ্বান-বিজ্ঞপ্তি : মুদ্রিত নবপ্রভাত বইমেলা ২০২৫
নভেম্বর ২১, ২০২৪
আশিস আর বাঘাঅঞ্জলি দেনন্দী, মম
ভারতের, বঙ্গের, হুগলী জেলার, চৈতন্যবাটী গ্রাম। সেখানে বাস করে শ্রী আশিস কুমার নন্দী। সে ঐ গ্রামেরই প্রাইমারী স্কুলের ক্লাস ফোরের ছাত্র। প্রতি বছর ও ফার্ষ্ট হয়ে নতুন ক্লাসে ওঠে। ওর বাড়িতে ওর সঙ্গে থাকে ওর ঠাকুরদা, ঠাকুরমা, মা, বাবা, দিদি ও বোন। দিদি পাশের গ্রামের স্কুলের ক্লাস সেভেনের ছাত্রী। আর বোন ওর স্কুলেই ক্লাস ওয়ানে পড়ে। ঠাকুরদার সঙ্গে আশিসের খুব ভাব - গলায় গলায় একেবারে। দুজনে দুজনের হাত ধরাধরি করে হাট, বাজার, রাস্তায়, মেলায়, খেলার মাঠ ইত্যাদি ইত্যাদি ইত্যাদি বিভিন্ন স্থানে ঘুরে বেড়ায়। বয়সে একজন ছোট ও একজন বৃদ্ধ হলেও ওরা খুব ভালো বন্ধু। দুজনে আবার একই বিছানায় রাতে শুয়ে গলা জড়াজড়ি করে ঘুময়। ভোরে ঘুম থেকে উঠে দুজনে মিলে প্রাত ভ্রমণে যায়। বিকাল বেলায় দুজনে মাঠে যায়। আশিস তার সমবয়সীদের সঙ্গে খেলে আর ঠাকুরদা তার সমবয়সীদের সঙ্গে সেই খেলার মাঠেরই এক পাশে বসে আড্ডা দেয়। তারপর সন্ধ্যার একটু আগে সকলেই যে যার বাড়ি চলে আসে। আশিস ও ওর ঠাকুরদাও একসঙ্গে নিজেদের বাড়ি ফিরে আসে।এক স্কুল ছুটির সকালে আশিস বাগানে গেল ঠাকুরদার জন্য পাতি লেবু তুলতে। ঠাকুরদাকে আশিসের মা ওই লেবুর রস জলে মিশিয়ে, তাতে মধু দিয়ে গুলিয়ে দেয় ও ঠাকুরদা তা রোজ প্রাত-ভ্রমণ করে বাড়ি এসে পান করে। সেদিন সকালে বাগানে গিয়ে নাতী আশিস দেখল যে ফলের বাগানের এক কোণে, এক নারকোল গাছের নিচে একটি মা কুকুর তিনটি বাচ্চা নিয়ে শুয়ে আছে। কুকুর ছানাগুলির চোখ ফোটে নি। সাদা-কালো রঙের মায়ের মতই ছানাগুলিও সাদা-কালো রঙের দেখতে হয়েছে। আশিস অনেকক্ষণ ধরে ওদের দেখতে লাগল। তারপর পাতিলেবু নিয়ে বাড়ির ভেতরে এল।রোজ যখনই ইচ্ছা হয় আশিস বাগানে গিয়ে কুকুর বাচ্চাদের দেখে। এভাবেই বেশ কয়েকটি দিন কাটল। হঠাৎ একদিন সে গিয়ে দেখল যে মা কুকুরটি নড়ছে না। আর আরো দুটি ছানাও নিথর দেহে পরে আছে। সে ওদেরকে ডাকাডাকি করল, কিছুতেই কেউই সারা শব্দ দিল না। নড়াচড়াও করল না। তবে একটি ছানা আশিসের পায়ের এসে কিউ কিউ কিউ শব্দ করছে। সে তো চোখে দেখতে পায় না। একটা আবরণ দিয়ে ওর চোখদুটি ঢাকা তো। আশিস কি যে করে, ভেবে পেল না। এরপর সে ছানাটিকে নিজের দুহাতে তুলে নিয়ে বাড়ির ভেতরে গেল। ঠাকুরদাকে বলল, "দাদু! বাগানের কুকুরগুলো কেউই নড়ছে না। একবার চল! দেখবে!" এই বলে সে দাদুর হাত ধরে টেনে বাগানে নিয়ে গেল। দাদু দেখে বলল, "এগুলো তো বেঁচেই নেই রে আশিস! বোধ হয় সাপে কামড়ে মরেছে।" এবার আশিসের বাবাকে দাদু হেঁকে ডাকল। বাবা এসে দেখল। বাবা বলল, "এগুলোকে তাহলে ভাগাড়ে ফেলে দিয়ে আসি!" এই বলে সে বাড়ির ভেতরে গিয়ে সেখান থেকে একটি বস্তা এনে মরা কুকুরগুলোকে ঢুকিয়ে তুলে নিয়ে গিয়ে ভাগাড়ে ফেলে এল। আশিস জীবন্ত ছানাটিকে সেদিন থেকে নিজের ঘরে রেখে দিল। তার নাম রাখল - বাঘা। বাটীতে করে মায়ের কাছ থেকে হাল্কা গরম গরুর দুধ এনে চামচে করে বাচ্চাটিকে খাওয়ায়। ও বিছানায় দাদু ও আশিসের সঙ্গে ঘুময়। আশিস যখন স্কুলে যায় দাদু তখন ছানাটিকে দেখাশোনা করে। ওটা একটু একটু একটু করে বড় হল। তারপর ওটা একদম পূর্ণ কুকুর হয়ে গেল। এখন ও ঘেউ ঘেউ ঘেউ করে। একটা পা তুলে ওটা এখন গাছের গোড়ায় প্রস্রাব করে। আশিসের সঙ্গে ও আবার স্কুলেও যায়। একা একাই আবার লেজ নাড়াতে নাড়াতে নাড়াতে বাড়ি ফেরে। ছুটির সময়টা বাঘার জানা তাই ঠিক ওই সময়মত ও বাড়ি থেকে রওনা দেয় ও স্কুলের কাছে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করে। আশিস বের হলে একসঙ্গে বাড়ি আসে।এক অমাবস্যার রাতে আশিসের বাড়িতে চোর এলো। বাঘা খুব চেঁচাল। পাড়ার লোকজন ও বাড়ির লোকজন উঠে পড়ল। চোর একটা ছুরি দিয়ে বাঘার গলায় চালিয়ে দিল। আর ছুটে পালিয়ে গেল। সকলে এসে দেখল বাঘা রক্তে ভেসে যাচ্ছে। আশিসের বাবা বাঘাকে কোলে নিয়ে ডাক্তারের কাছে ছুটে গেল। চিকিৎসা করিয়ে বাড়ি ফিরে এল। কয়েক দিন পর বাঘা সুস্থ হয়ে গেল।আশিস এবার ওই স্কুল থেকে পাস করে উঁচু ক্লাসে উঠল এবং অনেকটা দূরের - অন্য এক গ্রামের - অন্য আরেকটি স্কুলে ভর্তি হল। ক্লাস ফাইভের ছাত্র সে এখন। বাঘাকে আর এখন ঠাকুরমা আশিসের স্কুলে যেতে দেয় না। বাঘা তাই বাড়িতে বসেই আশিস কখন বাড়ি আসবে তার জন্য অপেক্ষা করে। এলেই সামনের দু পা তুলে তার দু কাঁধ ধরে ও পেছনের দু পায়ে দাঁড়িয়ে পরে। আর বেদম লেজ নাড়ায়। ওর যে খুব আনন্দ হয় তা বাড়ির সকলেই বুঝতে পারে। আশিস বাঘার গায়ে, মাথায় হাত বোলায়। কিছুক্ষণ পর বাঘা আশিসের কাঁধ ছেড়ে চার পায়ে দাঁড়ায়। আশিস স্কুল ইউনিফর্ম চেঞ্জ করে নেয়। এবার খেতে বসে। বাঘাও আশিসের সঙ্গে ওর পাশেই খায়।একরাতে দাদুর খুব শরীর খারাপ হল। বাবা বাড়িতে ডাক্তার ডেকে আনল। ডাক্তারবাবু অনেক চেষ্টা করলেন। কিন্তু দাদু মারা গেল। সবাই কাঁদল। বাঘার চোখ দিয়েও জল গড়িয়ে পড়ছে। দাদুকে বাবা ও পাড়ার সবাই পোড়াতে নিয়ে গেল। বাঘাও গেল। সবাই যখন বাড়ি ফিরে এল বাঘাও এল। কিন্তু প্রায় এক সপ্তাহ ধরে বাঘা শুধু জল খেয়ে রইল। আর দাদুর জুতোগুলিকে মুখে করে তুলে নিয়ে এদিক ওদিক ঘোরাঘুরি করতে লাগল। কখনও বা আকাশের দিকে মুখ উঁচু করে খুব ডেকে ডেকে ডেকে কাঁদতে থাকল।এখন আশিস একাই শোয়। দাদুর জায়গাটা খালি। তবে বাঘা রাতে জেগে বাড়ি পাহারা দিলেও দিনের বেলায় ওই বিছানায় শুয়ে থাকে।পরের বছর ঠাকুরমা, আশিস, বাবা, মা, দিদি ও বোন বিদেশে ভ্রমণ করতে গেল। বাঘা একা বাড়িতে থাকল। মা তার খাবার রেখে গেল।অনেকদিন পর যখন ভ্রমণ করে বাড়ি ফিরে এল তখন আর কেউই বাঘাকে দেখতে পেল না। আশিস খুব খোঁজাখুঁজি করল। বাবাও খুঁজল। কেউই তাকে খুঁজে পেল না। পাড়ার কেউ কিছুই বলতে পারল না। আশিস খুব কান্নাকাটি করল। আশিস ও বাঘার একসঙ্গে তোলা যে সব ফোটো বাঁধিয়ে দাদু দেওয়ালে টাঙিয়ে রেখেছিল, সেগুলোকে নামিয়ে বুকে চেপে ধরে আশিস যখন তখনই কাঁদে। মা তাকে চুপ করায়।একদিন আশিস স্কুল থেকে বাড়ি ফিরছে এমন সময় হঠাৎ রাস্তায় বাঘা এসে আশিসের কাঁধ ধরে দাঁড়িয়ে পড়ল। আশিস যেন আকাশের চাঁদ পেয়ে গেল। চেঁচিয়ে উঠল, "বাঘা আ আ আ!!!..." দুজনেরই খুশির সীমা নেই। এরপর একসঙ্গে বাড়ি ঢুকল। সকলে বড় আনন্দ পেল। ঠাকুরমা জিজ্ঞাসা করল, "হ্যাঁ রে বাঘা! তুই কোথায় চলে গিয়েছিলিস? আমরা সবাই তোকে কত ডাকলাম; বল এতদিন কোথায় ছিলিস?" বাঘা দাদুর বাঁধানো সেই ছবিটির কাছে গেল যেটি আশিসের জন্মদিন উপলক্ষে আশিস, বাঘা ও দাদু, বেশ অনেকটা দূরে, একসঙ্গে এক আশ্রমে বেড়াতে গিয়ে তুলেছিল। সেদিন দাদু ওই আশ্রমে অনেক মানুষকে নাতীর জন্মদিন পালন করার জন্য পেট ভরে লুচি, ডাল, তরকারী, চাটনী, দই ও মিষ্টি ভোজন করিয়েছিল। ওই আশ্রমেই দাদু ক্যাটারার দিয়ে রান্না করিয়েছিল। ঠাকুরমা বলল, "ওঃ তুই তাহলে ঐ আশ্রমে গিয়ে ছিলিস! তা বাড়ি পাহারা দিস নি কেন? বল! যদি চুরিফুরি হয়ে যেত, তাহলে কি হত? তোর ভরসায় আমরা বেড়াতে গিয়েছিলাম তো।" বাঘা খুব লেজ নাড়ল। বাবা এরপর বাঘাকে ও আশিসকে সঙ্গে করে নিয়ে সেই আশ্রমে গেল। সেখান থেকে জানলো যে বাঘা এতদিন ওখানেই খেত। তবে রোজ রাতে সে আশ্রমে থাকত না। বাবা ও আশিস বুঝল যে বাঘা রাতে তাদের বাড়ি পাহারা দিত ও মায়ের রেখে যাওয়া খাবারগুলো খেত। আর দিনের বেলায় এই আশ্রমে এসে থাকত। বাবা আশ্রমে অনেক টাকা দান করল। এবার সকলে বাড়ি ফিরে এল। বাবা ঠাকুরমাকে বাঘার গুণ কীর্তির কথা বলল। ঠাকুরমা বাঘাকে খুব আদর করল।এরপর ছয় মাস কেটে গেল। ঠাকুরমার ক্যান্সার হল। নার্সিং হোমে ভর্তি হল। মারা গেল। বাঘাও বাড়ির সবার মতই কাঁদল।এর কয়েক মাস পর আশিস ও তার পরিবারের সদস্যরা সকলে মিলে বাঘাকে সঙ্গে নিয়ে সেই গ্রাম ছেড়ে বহু দূরের এক শহরে বাড়ি কিনে বাস করতে লাগল। আশিস নতুন স্কুলে ভর্তি হল। দিদি ও বোনও অন্য নতুন স্কুলে ভর্তি হল। এখানেও আশিস আর বাঘা এক বিছানায় থাকে। আশিস বাঘার ছবি এঁকে ও বাঘাকে নিয়ে গল্প লিখে পুরস্কার পেল।=======================অঞ্জলি দেনন্দী, মমপি এক্সটেনশন - ১১৪মোহন গার্ডেনউত্তমনগরনতুন দিল্লী - ১১০০৫৯