এক নারীর কলমে পৃথিবীর প্রাচীনতম উপন্যাস
অনিন্দ্য পাল
উপন্যাসের জন্ম কবে? কেই বা ছিলেন সেই উপন্যাসের লেখিকা? স্বাভাবিক ভাবেই এই প্রশ্নের উত্তরে বিতর্কের সূত্রপাত হতে পারে। তবে গবেষক এবং ঐতিহাসিকরা বেশিরভাগই যে নামটা বলে থাকেন, সেটা হল " গেঞ্জি মনোগাতারি " । আজ থেকে প্রায় এক হাজার বছর আগে এই উপন্যাস লেখা হয়েছিল। লিখেছিলেন এক নারী, "মুরাসাকি শিকিবু " । মুরাসাকি ছিলেন জাপানের বাসিন্দা। আনুমানিক ৯৭৮ খৃষ্টাব্দে জাপানের ফুজিয়ারা পরিবারে জন্ম। এই ফুজিয়ারা পরিবার জাপানের তৎকালীন শাসক হেইয়ানদের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ এবং প্রতিপত্তিশালী ছিল। আসলে বকলমে দেশ চালাতো এই ফুজিয়ারা পরিবারের সদস্যরা। প্রশাসন, শিক্ষা, সংস্কৃতি ও সাহিত্য এই সব ক্ষেত্রেই ফুজিয়ারা পরিবারের কর্তৃত্ব ছিল অপরিসীম। মুরাসাকির পূর্বপুরুষদের অনেকে ছিলেন নামকরা কবি। আবার তাঁর বাবা তামেতোকি ছিলেন উচ্চপদস্থ রাজকর্মচারী। তামেতোকি একদিকে যেমন ছিলেন পণ্ডিত অন্যদিকে তেমন কবিতাও লিখতেন। তবে তামেতোকি কবিতা লিখতেন চীনা ভাষায়। আসলে সেই সময় জাপানী ভাষাকে সাধারণ পাঠকের ভাষা হিসেবে দেখা হত, এই কারণে জাপানী ভাষা খানিকটা অবজ্ঞার পাত্রও ছিল। উল্টোদিকে চীনা ভাষা ছিল পণ্ডিতদের ভাষা। বিজ্ঞ, বিখ্যাত পুরুষরা লিখতেন চীনা ভাষায়। জাপানী ভাষায় কেউ লিখতেন না তেমনটা কিন্তু নয়। শুনতে অবাক লাগলেও, জাপানী ভাষায় লিখতেন প্রধাণত মেয়েরা।
হেইয়ানদের শাসনকালে মেয়েদের চীনা ভাষা ও সাহিত্য পাঠের রীতি ছিল না। আবার সেই সময় স্বামী স্ত্রী আলাদা থাকার নিয়ম ছিল। তবে মুরাসাকি এবং তাঁর দাদা নোবুনোরি বাবার সঙ্গেই থাকতেন। সম্ভবত তাদের মা মারা যান। তাই বাবার উদ্যোগে অনেক ছোটবেলায় মুরাসাকির পড়াশুনা শুরু হলেও চীনা ভাষা শিখতে পারছিলেন না। তবে তাঁর দাদাকে চীনা ভাষা শেখানো হত। আর মেধাবী মুরাসাকি দাদার পড়া থেকেই চীনা ভাষা বেশ আয়ত্ত্ব করে ফেলেন। এমনকি দাদার পড়া কোথাও আটকে গেলে মুরাসাকি সেটা ছাড়িয়ে দিতেন বা বলে দিতেন। পরবর্তী সময়ে মুরাসাকির চীনা ভাষাজ্ঞান কাজে লেগে যায় "গেঞ্জি মনোগাতারি" লেখার সময়।
মুরাসাকি ঠিক কবে গেঞ্জি মনোগাতারি লেখা শুরু করেন তার কোন সঠিক তথ্য পাওয়া না গেলেও ১০০২ থেকে ১০১২ খৃষ্টাব্দের মধ্যে এই উপন্যাসের বেশিরভাগটাই লেখা হয়েছিল তা বোঝা যায়। আর উপন্যাসটা লেখা সম্পূর্ণ হয় বা প্রকাশিত হয় সম্ভবত ১০২১ সালের কাছাকাছি সময়ে। তবে তখন মুরাসাকি বেঁচে নেই। মুরাসাকির মৃত্যুর সঠিক তথ্য নিয়ে বিতর্ক আছে, কেউ বলেন ১০১৪ খৃষ্টাব্দ কেই বলেন ১০৩১ খৃষ্টাব্দ।
মুরাসাকি কেন এই উপন্যাস লিখলেন তার একটা পটভূমিকা আছে। জাপানে তখন সাধারণ মেয়েদের সম্পর্কে চলতি ধারণা ছিল " নারীরা কর্মে অসমর্থ এবং বুদ্ধিতে অপরিপক্ব। তাই তাদের চীনা শিখতে দেওয়া হত না"। তবে মুরাসাকি এই ব্যাপারে একটু সুবিধা পেয়েছিলেন। চীনাটা উনি রপ্ত করে নিয়েছিলেন। আর এই ভাষা শিক্ষার দৌলতে তিনি কবিতা ও লেখা শুরু করেন। তাঁর আত্মজীবনীমূলক কবিতায় ধরা পড়ে তাঁর সময়ের চেয়ে এগিয়ে থাকা মনের প্রতিফলন।
বাবার সঙ্গে মফস্বলের জীবন দেখেছেন, দেশকে জেনেছেন, ফলে মুরাসাকির দেখার চোখ তৈরি হয়েই ছিল, শুধু দরকার ছিল একটু ইন্ধনের। সেটা এল বিয়ের দরুণ।
সম্ভবত ৯৯৮ খৃষ্টাব্দ নাগাদ বিয়ে করেন মুরাসাকি। স্বামী ছিলেন তাঁদের ফুজিয়ারা পরিবারের এক প্রভাবশালী সরকারী কর্মচারী। ফুজিয়ারা নো নোবুতাকা বিত্তশালী কিন্তু বাইশ বছরের মুরাসাকির চেয়ে বয়সে ছিলেন অনেক বড়, সাতচল্লিশ বছরের নোবুতাকা তখন প্রায় মুরাসাকির বাবার বয়সী। শুধু তাই নয়, নোবুতাকার আরো অনেক সম্পর্কে জড়িয়ে ছিলেন, ছিল উপপত্নী এবং রক্ষিতা। ফলে প্রথমে মুরাসাকি রাজি ছিলেন না। তবে শেষ পর্যন্ত মুরাসাকি নোবুতাকাকেই বিয়ে করেন। বিয়ের একবছর পর জন্ম হয় তাদের কন্যা সন্তান কেনসি আর তার দুবছর পরে কলেরায় মারা যান নোবুতাকা।
মুরাসাকির বিবাহিত জীবন সম্পর্কে কেউ বলেন, তিনি সুখী ছিলেন আবার জাপানী সাহিত্য সমালোচক এবং গেঞ্জি স্কলার হারুশিরেন বলেন, মুরাসাকি স্বামীর সঙ্গে তেমন সুখী কখনোই ছিলেন না। তবে স্বামীর মৃত্যুর পরেই মুরাসাকির জীবন অন্য ধারায় বইতে থাকে।
নোবুতাকার মৃত্যুর পর মুরাসাকির বাবা তাকে রানী আকিকোর সহচরী বা "ইম্পেরিয়াল লেডি-ইন- ওয়েটিং" হিসেবে সম্রাট ইচিজোর রাজ প্রাসাদে পাঠিয়েছিলেন। সেখানে শুরু হয় তাঁর দিনলিপি লেখা। ১০০৮ খৃষ্টাব্দ থেকে শুরু করে ১০১০ পর্যন্ত তাঁর দিনলিপি এখনো জাপানী সাহিত্যের মাস্টারপিস। রাজপ্রাসাদে সম্রাট ইচিজোর অনেক রানীর মধ্যে প্রধানমন্ত্রী মিচিনাগার মেয়ে ১২ বছর বয়স্কা শোশি ও একজন রানী ছিলেন। মিচিনাগা মেয়েকে অন্য রানীদের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় পারদর্শী করে তোলার জন্য মুরাসাকিকে নিয়োগ করলেন। আর এই কাজে মুরাসাকিকে নিয়োগের অন্যতম কারন ছিল তাঁর সাহিত্য এবং চীনা ভাষা জ্ঞান। এই সময়েই সম্ভবত মুরাসাকি শুরু করেন তাঁর উপন্যাস, "গেঞ্জি মনোগাতারি"।
মুরাসাকি কেন লিখলেন গেঞ্জি মনোগাতারি? এই বিষয়ে একটা জনপ্রিয় জাপানী প্রবাদ আছে। একবার, রাজপ্রাসাদে তাকে আদেশ করা হল একটি উপন্যাস লিখে দেবার জন্য। তবে এই আদেশ ঠিক কে দিয়েছিলেন তা আজও সঠিক ভাবে জানা যায় নি। যাইহোক, মুরাসাকি একটু আতান্তরে পড়লেন, তখনো তিনি কোনো উপন্যাস লেখেননি এবং উপন্যাস কেমন ভাবে লিখতে হবে তাও তাঁর জানা নেই। তিনি প্রেরণার জন্য এলেন ওমি প্রদেশের ইশিয়ামাডেরা মন্দিরে। বিওয়া হ্রদের উপর এই মন্দির। অষ্টম মাসের পূর্ণিমা রাতে মনোরম চাঁদের আলোয় বসেছিলেন হ্রদের দিকে তাকিয়ে। হঠাৎ মনে এল প্লট, তখনি লেখা শুরু হয়ে গেল গেঞ্জি মনোগাতারি, লেখা হয়ে গেল দুটি অধ্যায়। এখনো সেই মন্দিরে একটা ঘর সাজিয়ে রাখা হয়েছে, যাকে বলা হয় "গেঞ্জির ঘর"। কথিত, এই ঘরে বসেই মুরাসাকি "গেঞ্জি মনোগাতারি" লিখেছেন। সেই ঘরে আজও মুরাসাকির ব্যবহার করা দোয়াত-কলম রাখা আছে।
জীবনীমূলক এই উপন্যাসের সুবৃহৎ আয়তন। চুয়ান্নটা অধ্যায়, চুয়ান্নটা আলাদা বই এর সমান বলা যায়। উপন্যাসের দুটো অংশ। প্রথম একচল্লিশটা অংশ, অর্থাৎ প্রথম খণ্ড, সেখানে নায়ক হিকারু গেঞ্জি। উপন্যাসের দ্বিতীয় খণ্ড, সেখানে নায়ক কাওরু।
গেঞ্জি মনোগাতারি জীবনীমূলক উপন্যাস। গেঞ্জির প্রেম এবং জীবনের রোমাঞ্চকর প্রবাহ এই উপন্যাসের মূল বিষয়বস্তু। গল্প জুড়ে খানিকটা মধ্যযুগীয় রোমান্স ছড়িয়ে আছে। সুন্দরী কিরিৎসুবো সম্রাটের উপপত্নী হওয়াতে সম্রাজ্ঞী কোকিদেন ভয়ানক রেগে গেলেন। কিরিৎসুবোর পুত্রসন্তান হলে এবং এই সন্তান সম্রাটের মন জয় করে নিলে এই রাগ ঈর্ষায় পরিণত হল। কোকিদেন প্রমাদ গুনলেন, পাছে তাঁর সন্তান সিংহাসনের অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়। কোকিদেন - এর বিদ্বেষ বিষে ফুলের মত কোমল কিরিৎসুবো অকালে মারা গেলেন। সম্রাট এই ছেলের নাম দিলেন হিকারু গেঞ্জি। বারো বছর বয়সে বিয়ে দিলেন মন্ত্রীর মেয়ে আওই- এর সঙ্গে। কিন্তু আওই গেঞ্জির চেয়ে চার বছরের বড় হওয়ায় এই দাম্পত্য একবারেই সুখের হয় নি। তৈরি হয় নি স্বামী স্ত্রীর অন্তরঙ্গ সম্পর্ক। এদিকে গেঞ্জি বড় হতে লাগলো, হয়ে উঠতে লাগলো রূপবান, গুনবান। রাজার কাছে ভালো চাকরিও পেল। আর এই সব চাকচিক্য তাকে মেয়েদের কাছে দুর্নিবার আকর্ষণের ব্যক্তি করে তুলেছিল। একাধিক নারী সঙ্গ তৈরি করলো জটিল ঈর্ষা আর কলহমুখর পরিস্থিতি। একরাতে গেঞ্জি সুন্দরী রুগাও এর সঙ্গে রাত কাটাচ্ছিল, ঠিক তখনই কেউ এসে রুগাওকে খুন করে চলে যায়। এই খুনি আসলে গেঞ্জির অন্য প্রেমিকা। এই ঘটনা গেঞ্জির শরীর-মন ভেঙে দেয়। সে তখন কিছুদিন রাজধানী থেকে দূরে পাহাড়ের উপর কিছুদিন কাটিয়ে আসে। সেখান থেকে নিয়ে আসে "মুরাসাকি -নো উয়ে", সংক্ষেপে সবাই ডাকতো মুরাসাকি। এই মুরাসাকি তখন নাবালিকা। গেঞ্জি একে বড় করতে লাগলো। এদিকে আওই সন্তান সম্ভবা হল। দুশ্চিন্তা আর নিরাপত্তার অভাব, সম্পর্কের টানাপোড়েন আওইকে চরম অসুস্থ করে তুলেছিল। সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে মারা গেল আওই। এই মৃত্যু গেঞ্জি কে অন্য মানুষ করে তুললো। সে বিশৃঙ্খল জীবন, অবাধ নারী সঙ্গ থেকে সরে এল। এদিকে বড় হয়ে উঠেছে অনাথ মুরাসাকি। গেঞ্জি তাকে বিয়ে করে আবার সংসারী হল। তবে এই সংসার টিকলো না বেশী দিন। অকাল মৃত্যু হল মুরাসাকির। শোক সহ্য হল না গেঞ্জির ও। সেও মারা গেল কিছুদিনের মধ্যেই।
এরপর গল্পের বাঁধন খানিকটা আলগা হয়ে যায়। নায়কের মৃত্যু, রোমাঞ্চের খামতি উপন্যাসের পরবর্তী ধাপকে কিছুটা অনালোকিত করে তোলে। তারপর, অর্থাৎ গল্পের শেষ অংশে কাওরু এবং নিওউ এর দ্বন্দ্ব আর প্রতিদ্বন্দ্বিতা গল্পকে এগিয়ে নিয়ে যায়। কাওরু কে সবাই গেঞ্জির ছেলে বলেই জানে, কিন্তু আসলে তা নয়। গেঞ্জি জানতে পারে, কাওরু আসলে তার এক পত্নীর গর্ভে অন্যের সন্তান। গেঞ্জি কে ঠকিয়েছিল সেই পত্নী। এহেন কাওরুর সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে নিওউ।
গেঞ্জি মনোগাতারি মূলত সামাজিক বাস্তবাতার চিত্র। এটা অবশ্যই সেই পটভূমিকায় লেখা একটা মৌলিক উপন্যাস যার মূলকথন আসলে প্রেম। এই প্রেম যেমন সামাজিক তেমনি অবৈধও বটে। রাজপ্রাসাদের আনাচে কানাচে তৈরি হওয়া নানা রকমের নারী-পুরুষ সম্পর্কের ঘটনাক্রম উপন্যাসটাকে গতিময় করেছে। তবে বৈধ - অবৈধ সম্পর্কের জাল বুনলেও তা কখনোই শরীরের বা নগ্নতার বর্ণনায় উথলে ওঠেনি। ক্ষমতার অলিন্দে থাকা মানুষদের চরিত্র, তাদের ঈর্ষা, দ্বন্দ্ব, ধর্মের নামে কু-সংস্কার, বহুনারীসঙ্গ, বহুবিবাহ, অসীম লোভ এই সব বিষয় বিভিন্ন বৈচিত্রের আঙ্গিকে এই উপন্যাসের উপজীব্য হয়ে উঠেছে।
আজ থেকে হাজার বছর আগে লেখা এই উপন্যাসের
বিশ্বময় সম্মান পাওয়া কিন্তু খুব একটা সহজ কাজ ছিলো না। ১৮৮২ খৃষ্টাব্দে সুমাতসু কেচো প্রথম এই উপন্যাসের ইংরাজী অনুবাদের চেষ্টা করেন, আংশিক সফল হলেও পুরোটা হয়ে ওঠেনি। এরপর আর্থার ওয়ালে ছটা খণ্ডে এর ইংরাজী অনুবাদ করেন, তবে সেখানেও একটি অধ্যায় বাদ চলে যায়। ১৯২১সাল থেকে ১৯৩৩ সালের মধ্যে তিনি এই অনুবাদ প্রকাশ করেন। এরপরই মোটামুটি গেঞ্জি মনোগাতারি বিশ্বময় সাড়া ফেলে দেয়।
মুরাসাকি শিকিবু - র লেখা গেঞ্জি মনোগাতারি বিশ্বের প্রথম উপন্যাস হলেও এর আধুনিক মনস্কতা এবং শৈল্পিক মনন এই উপন্যাসকে ক্লাসিকের সম্মান এনে দিয়েছে।
===========================
অনিন্দ্য পাল
প্রজত্নে -- বিশ্বনাথ পাল
গ্রাম -- জাফরপুর
পোঃ-- চম্পাহাটিি
পিন - ৭৪৩৩৩০
থানা -- সোনারপুর
জেলা -- দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা
পশ্চিমবঙ্গ, ভারত
বেশ ঋদ্ধ আলোচনা, ধন্যবাদ অনিন্দ্য পাল দাদাকে।
উত্তরমুছুন