মানুষের সাথে সাপের অনুপম সহাবস্থান: ঝঙ্কেশ্বরী দেবীজ্ঞানে পূজিত হন বর্ধমানের মঙ্গলকোট এবং ভাতারের গ্রামে
বারিদ বরন গুপ্ত
কথায় বলে সাপ মানুষের জাত শত্রু, সেই জ্যান্ত বিষধর কোবরা জাতীয় সাপ ঝঙ্কেশ্বরীকে সর্পদেবী জ্ঞানে পুজো করেন বর্ধমানের মঙ্গলকোটের পোষলা,মুসুরি,পলসোনা, এবং ভাতার থানার বড় পোষলা গ্রামের মানুষজন। কথাটা শুনলে অনেকেই অবাক হয়ে যাবেন, সত্যিই অবাক হয়ে যাওয়ার মতই ঘটনা। কিন্তু পঞ্চমী তিথিতে নয়, সাধারণত আষাঢ় মাসের গুরু পূর্ণিমার পর প্রতিপাদ তিথিতে এই পূজা অনুষ্ঠিত হয়, মনে করা যেতে পারে যে প্রাক-ব্রিটিশ ভারতে স্বয়ংসম্পূর্ণ গ্রাম সমাজের আঙিনায় গড়ে ওঠে এই জ্যান্ত সর্পদেবী কে তুষ্ট করতে এবং সর্পদেবীর আশীব্বার্দ লাভের উদ্দেশ্যে গ্ৰামসমাজ এরূপ পূজার আয়োজন করেছিল বলে মনে করা হয়।
উল্লেখ্ করা যেতে পারে যে জ্যান্ত সাপের পূজা, জ্যান্তো সর্পদেবীর আনাগোনা দেখার জন্য শুধু বর্ধমান জেলা নয়, দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে লোকজন ছুটে আসেন, সাপের সঙ্গে মানুষের এই অনুপম সহাবস্থান দেখে সকলে অবাক হয়ে যান, সত্যিই জীবন্ত বিষধর সাপের সঙ্গে সহবাস আর কোন দেশের কোথাও দেখা যায় বলে জানা নেই। একেবারে হেঁশেল ঘর থেকে শোয়ার ঘর পর্যন্ত এই ঝঙ্কেশ্বরী বা ঝাঙলাই দেবীর আনাগোনা। একে অঠেল বিশ্বাস, দেবতা জ্ঞানে ভক্তির প্রকাশ ছাড়া আর কি বলা যেতে পারে! গ্রামবাসীদের কাছ থেকে জানা গেল যে বৈশাখ জৌষ্ঠ মাস থেকে আশ্বিন কার্তিক মাস পর্যন্ত এই ঝাঙলাই সর্পদেবীর আনাগোনা শুরু হয়, কেউটো জাতীয় বিষধর সাপ এই ঝঙ্কেশ্বরী, কিন্তু আশ্চর্যর বিষয় যে গ্রামের আজ পর্যন্ত কোন মানুষ এই সাপের দংশনে প্রাণ হারিয়েছেন বলেও তেমন জানা নেই, যদিও এর কোন বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যাও নেই, নাজা গোত্রের এই সাপটি কিন্তু তীব্র বিষধর ! ডাক্তার বা সর্প বিশারদদের ধারণা এই নাজা জাতীয় সাপের প্রায় ৭০% ছোবল বিষহীন! শুধু তাই নয় এই সাপের কামড় কে অনেকে প্রসাদ বলে মনে করেন। মায়ের তলায় মাটি লাগালে বা বিষহরি পুকুরে স্নান করলে বিষ নষ্ট হয়ে যায় বলে গ্রামবাসীদের ধারণা। আসলে দীর্ঘ দিনের একটা বন্ধুত্বপূর্ণ সহাবস্থান তার সাথে ধর্মীয় বিশ্বাস মিলেমিশে একাকার হয়ে আছে এই ঝঙ্কেশ্বরীর সাথে, যদিও ঝংকেশ্বরী দেবীর একটি প্রাচীন শিলামূর্তি রয়েছে, তবুও চির ঐতিহ্যবাহী প্রথা অনুসারে জ্যান্ত সাপ জাঙলাই বা ঝঙ্কেশ্বরীকেই প্রথম দুধ ফল মিষ্টান্ন সহকারে পূজা করা হয়।
এই সাপের প্রকৃতি নির্ধারণ দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে সর্প বিশারদরা এসেছেন, তারাও স্থানীয় মানুষের সাথে সাপের এই সম্পর্ক দেখে অবাক হয়ে গেছেন। সাধারণত নাজা গোত্রের এই সাপ কেউটে সাপের সমগোত্রীয়, কিন্তু কেউটের মতো হিংস্র প্রকৃতির নয়, কিছুটা ধীর গতির এবং নিস্তেজ প্রকৃতির, ফনা যুক্ত, আবার পদ্মচিহ্ন কেউটের মতো মাথায় নয়, একটু ঘাড়ের দিকে। সর্প বিশারদদের ধারণা চোয়াল এবং পেশীর গঠনগত ত্রুটির জন্য হয়তো বিষথলি থেকে বিষ ছোবল মারার আগেই বেরিয়ে যায়, হয়তো এই জন্যই এর দংশনে মৃত্যুর ঘটনা শোনা যায় না।
বর্ধমান কাটোয়া রোডে রোডে বলগোনা সন্নিহিত এই অঞ্চলটি এক সময় ঝঙ্ক পরগনায় অবস্থিত ছিল, সেই পরগনার নাম অনুসারেই হয়তো এই দেবীর নাম ঝঙ্কেশ্বরী হয়েছে বলে অনেকে মনে করেন। এই ঝঙ্কেশ্বরী দেবীর পুজো নিয়ে এই অঞ্চলে অতিকথন আছে, যা মনসামঙ্গল কাব্যের সতী বেহুলার দৃশ্যপট ভেসে ওঠে !, গ্রাম সমাজের ধারণা, লোহার বাসর ঘরে কালনাগিনী লখীন্দর কে দংশন করলে সতী বেহুলা তার কাজলতা দিয়ে কালনাগিনী কে ছুড়ে মারেন এবং তাতেই তার লেজ কেটে যায়, তারপর সেই কালনাগিনী বেহুলার অভিশাপে মর্তে এসে অধিষ্ঠিত হন এবং পৃথিবীর মধ্যস্থল এই মসূরী সংলগ্ন এই অঞ্চলে ঝঙ্কেশ্বরী রূপে বসবাস শুরু করেন বলে গ্রাম সমাজ আজও মনে করে। আবার এর সংলগ্ন কৃত্তিবাসী রামায়ণে মঙ্গলকোটের সতীপীঠ ক্ষীরগ্ৰাম কেও পৃথিবীর মধ্যস্থল বলে বর্ণনা করা হয়েছে! যাইহোক তার পরে এই সর্প দেবী গ্রাম সমাজকে স্বপ্নাদেশ দেন তাঁর পূজো করার জন্য, সেই থেকেই এই পূজার সূত্রপাত বলে অনেকের ধারণা। এর স্বপক্ষে প্রমাণ হিসেবে গ্রাম সমাজ মনে করেন যে বাসর ঘরে কালনাগিনীর লেজ কাটা গেছিল বলে সর্পদেবী ঝঙ্কেশ্বরীরও লেজকাটা অর্থাৎ লেজের দিকটা সামান্য মোটা! আবার এই ঝঙ্কেশ্বরী থাকায় এই অঞ্চলে অন্য সাপের উপদ্রব নেই বললেই চলে। অতএব ঝঙ্কেশ্বরীর জন্যই এই গ্রাম সমাজ রক্ষা পেয়েছে বলে জানা গেল, কারণ এই ঝঙ্কেশ্বরী
দেবীর ভয়ে অন্য কোনো বিষধর সাপ এই গ্ৰামগুলিতে থাকতে পারে না। এক কথায় বলতে গেলে এই ঝঙ্কেশ্বরী দেবী এই গ্রাম সমাজকে দীর্ঘদিন ধরে আগলে আছেন। তাই ঝাঙলাই বা
ঝঙ্কেশ্বরী এই অঞ্চলে লৌকিক গ্রাম্য দেবীতে পরিনত হয়েছেন!!
উল্লেখ্য যে রাঢ়ের ইতিহাস প্রায় সাড়ে তিন হাজার বছরের প্রাচীন! আর রাঢ়ের প্রাণ কেন্দ্র তো বর্ধমান! প্রাচীন রাঢ় দীর্ঘদিন অনার্যদের দখলে ছিল! অজয় এবং কুনুর নদীর উপত্যকার বিস্তীর্ণ অঞ্চল একসময় সমাজের নিম্নবর্গের মানুষের দখলে ছিল, যার ফলে চন্ডী মনসা এবং ধর্মের আরাধনার প্রভাব প্রতিপত্তি যথেষ্ট ছিল বলে মনে করা যেতে পারে। আচার্য সুকুমার সেন ডক্টর নীহার রঞ্জন রায় সহ সকল গবেষকদের ধারণা প্রাচীন রাঢ়েই দেবী মনসার পূজার সূত্রপাত ঘটে! যেহেতু মঙ্গলকোট সংলগ্ন অঞ্চলের ইতিহাস ও প্রায় সাড়ে তিন হাজার বছরের প্রাচীন, বিভিন্ন পুরাতাত্ত্বিক নিদর্শন এবং খনন কার্যের ফলে সেই তথ্যই প্রমাণিত হয়েছে! এই অঞ্চলে বৌদ্ধ এবং জৌন সংস্কৃতির অনেক নিদর্শন পাওয়া গেছে! অনেকের ধারণা এই দেবী বৌদ্ধ সর্প দেবী জাঙ্গুলী! পরবর্তীকালে গ্রাম সমাজ এই বৌদ্ধ সর্প দেবীকে ঝাঙলাই বলে অভিহিত করেন! যাইহোক পাল যুগের শেষের দিকে বৌদ্ধ ধর্ম ক্ষয়িষ্ণু এবং হীনবল হয়ে যায়! তখন থেকেই হিন্দু ধর্মের দেবদেবীর মূর্তিতে বৌদ্ধ সংস্কৃতির ছোঁয়া লক্ষ্য করা যায়! যা বৌদ্ধ এবং হিন্দু ধর্মের একটা মিলনক্ষেত্রের প্রেক্ষাপট তৈরি করে! আর ঠিক সেই সময় পর্বে এই অঞ্চল গুলিতে ঝঙ্কেশ্বরী দেবীর আরাধনার সূত্রপাত হয় বলে অনেকের ধারণা !!
আবার অনেকের ধারণা খ্রিস্টীয় দশম শতকের প্রথম ভাগ অর্থাৎ পাল যুগ থেকেই এই পূজার সূত্রপাত, কারণ এই অঞ্চলগুলো দীর্ঘদিন পাল শাসনেই ছিল । তাই সমাজের নিম্ন শ্রেণীর মানুষের মধ্যে জাঙ্গলী দেবীর আরাধনা স্বাভাবিক! শোনা যায় অতীতে কোন সামন্ত রাজা এই অঞ্চল সংলগ্ন খুনগড় ডাঙ্গায় দেবীর স্বপ্নাদেশে প্রথম ঝঙ্কেশ্বরী দেবীর আরাধনা করেন! এ সম্পর্কে এক গ্রাম প্রচলিত কাহিনী
জড়িয়ে আছে --
৯১১ সনে কৃষ্ণা প্রতি পদে
প্রথম বরিখা কালে পড়িয়া বিপদে
আগমন হন দেবী খুনগড় পাড়ে।।"
আবার অনেকের মতে মসুরি গ্রামের জনৈক মুরালি মোহন চক্রবর্তী দেবীর কাছ থেকে সপ্নাদেশ পান, তারপর থেকেই নাকি এই পূজা শুরু হয়। তবে এই পূজার কিছুটা বিশেষত্ব আছে,যা মনসা পূজো থেকে অনেকটাই ভিন্ন। সাধারণত মনসা পুজো নাগপঞ্চমী তিথি ধরে হয় কিন্তু ঝঙ্কেশ্বরি পুজো গুরু পূর্ণিমার পরের প্রতিপাদে সম্পন্ন হয়। যা মনসা পূজোর সম্পূর্ণ পরিপন্থী বলা যায়! কথায় বলে - একে মা মনসা তাতে আবার ধুনোর গন্ধ! কিন্তু এখানে মা ঝংকেশ্বরী ধূনোর গন্ধ পছন্দ করেন! সেই সুদীর্ঘকাল থেকে এই পূজার ধূপ-ধুনা প্রচলন আছে, যেটা মনসা পূজায় দেখা যায় না, শুধু তাই নয়, এই পূজার দুধ কলা ইত্যাদি সাথে এক টুকরো উচ্ছে দেওয়ার প্রচলন আছে, এবং প্রত্যেককে প্রসাদ ভক্ষণ করার আগে এই উচ্ছের স্বাদ গ্ৰহন করতে হয়। তাই আমরা বলতে পারি দেবী, ঝঙ্কেশ্বরীর আরাধনার এ সকল বিধি বা আচার অনুষ্ঠান অবশ্যই মনসা পুজো থেকে স্বতন্ত্র দাবি করে!
সত্যিই বিষধর সাপের সাথে মানুষের দীর্ঘদিনের এই অনুপম সহবস্থান এই পুজোর একটা অন্যতম দিক, সকলের কাছে এটা একটা বিরল অভিজ্ঞতা এবং বিস্ময়। সেই সুপ্রাচীন কাল থেকে প্রকৃতির সাথে মানুষের যে একটা মেলবন্ধন তার অনুপম নিদর্শন এই সর্প দেবী ঝঙ্কেশ্বরী সাথে এই অঞ্চলের মানুষজনের! বলতে গেলে দীর্ঘদিন একসাথে বসবাসের ফলে
একটা বিশ্বাসযোগ্য বোঝাপড়ার সূত্রে এই জ্যান্ত সর্প দেবীর সাথে এই অঞ্চলের মানুষজনের গড়ে উঠেছে একটা আত্মিক সম্পর্ক। যা ঐতিহ্যবাহী প্রথার মত সেই প্রাচীন কাল থেকেই চলে আসছে! বেঁচে থাক বাংলার এই লৌকিক দেবী ঝঙ্কেশ্বরী, এবং এর মাধ্যমে ভেসে আসুক প্রাচীন লৌকিক সমাজের সুর।
=========================
লেখক: বারিদ বরন গুপ্ত( মন্তেশ্বর পূর্ব বর্ধমান)