উপন্যাসের আলোয় শরৎচন্দ্র
ডঃ রমলা মুখার্জী
বাংলা কথাসাহিত্যের জগতে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এক উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক। উপন্যাস রচনায় তিনি জনপ্রিয়তার শীর্ষে পৌঁছেছিলেন কারণ সকল শ্রেণীর কাছে তাঁর উপন্যাস সমান প্রিয় হয়ে উঠেছিল। ১৩৪৩ সালের ২৬ শে আশ্বিন শরৎচন্দ্রের জন্মোৎসবে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, "অন্য লেখকরা অনেকে প্রশংসা পেয়েছে কিন্তু সর্বজনীন হৃদয়ের এত আতিথ্য পায়নি। এ বিস্ময়ের চমক নয়, এ প্রীতি। অনায়াসে যে প্রচুর সফলতা তিনি পেয়েছেন তাতে তিনি আমাদের ঈর্ষাভাজন।"
কথাসাহিত্যে শরৎচন্দ্রের প্রথম প্রকাশ গল্পকার হিসাবে। ১৯০৪ সালে ''মন্দির'' গল্প লিখে তিনি উচ্চ প্রশংসিত হয়েছিলেন।
সমস্যাজীর্ণ গ্রামীণ সমাজ এবং সাধারণ মধ্যবিত্ত ও বিত্তহীন মানুষের স্নেহ, প্রেম, সুখ-দুঃখ, আশা-নিরাশার কথাই উপন্যাসে প্রকাশ করেছেন দরদি কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র। বিষয়বস্তুর ওপর নির্ভর করে শরৎচন্দ্রের উপন্যাসগুলিকে নিম্নলিখিত কয়েকটি পর্যায়ে ভাগ করা যায়: যেমন:-
১) প্রেমের উপন্যাস "চন্দ্রনাথ", "বিরাজ বৌ", "বড়দিদি'', ''দেবদাস'', ''পরিণীতা'', ''দত্তা'', ''দেনাপাওনা'' প্রভৃতি উপন্যাস হল শরৎচন্দ্রের কয়েকটি বিখ্যাত প্রেমমূলক উপন্যাস।
২) পারিবারিক উপন্যাস: শরৎচন্দ্রের এই পর্যায়ের উপন্যাসগুলির মধ্যে উল্লেখযােগ্য হল ''বিন্দুর ছেলে'', ''মেজদিদি'', ''নিষ্কৃতি'', ''বৈকুণ্ঠের উইল'' ইত্যাদি। পারিবারিক দ্বন্দ্ব-জটিলতা, নারী মনস্তত্ত্ব, বিবিধ বৈষম্য এই উপন্যাগুলিতে স্থান পেয়েছে।
৩)আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস: শরৎচন্দ্রের আত্মজীবনীমূলক উপন্যাসের মধ্যে এক এবং অদ্বিতীয় হল ''শ্রীকান্ত''। পরে আমি এই উপন্যাসটির আলোচনায় আসব।
৪) মনস্তাত্ত্বিক উপন্যাস: শরৎচন্দ্রের তিনটি প্রধান মনস্তাত্ত্বিক উপন্যাস হল ''গৃহদাহ'', ''চরিত্রহীন'' ও ''শেষ প্রশ্ন''।
৫) রাজনৈতিক উপন্যাসঃ
বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ রাজনৈতিক উপন্যাস শরৎচন্দ্রের ''পথের দাবী''। শুধু রাজনৈতিক স্বাধীনতা নয়, এই উপন্যাসে আছে মানুষের অর্থনৈতিক ও সামাজিক স্বাধীনতার কথা। 'বঙ্গবাণী'তে ''পথের দাবী'' প্রথম প্রকাশ পাওয়ার পর সারা দেশ একেবারে উত্তাল হয়ে উঠেছিল, তাই ইংরেজ সরকার এই উপন্যাসটিকে বাজেয়াপ্ত করেন।
শরৎচন্দ্রের অন্যান্য উপন্যাসগুলিরও সংক্ষিপ্ত আলোচনা করার চেষ্টা করছি।
১৯০৭ সালে 'ভারতী' পত্রিকায় শরৎচন্দ্রের প্রথম উপন্যাস ''বড়দিদি'' প্রকাশ পেতে শুরু করে। রবীন্দ্রনাথ এই উপন্যাসটি পড়ে মুগ্ধ হয়েই তাঁকে সাহিত্য সভায় আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। তবে শরৎচন্দ্রের অপরিণত বয়সের লেখা হওয়ায় কিছু অসংগতি লক্ষ্য করা গেলেও পরবর্তী উপন্যাসগুলি তাঁর সর্বাঙ্গ সুন্দর হয়ে উঠেছিল।
"বিরাজ বৌ" 'ভারতবর্ষে' প্রকাশিত শরৎচন্দ্রের প্রথম রচনা। বইটি আপামর জনসাধারণের প্রশংসায় ধন্য হয়েছিল। পতিপরায়ণা বিরাজের স্বামীর প্রতি অসীম ভক্তি এখানে প্রধান স্থান পেয়েছে।
'যমুনা'য় প্রকাশিত "পরিণীতা" উপন্যাসটিতে শরৎচন্দ্র ধনী ও দরিদ্র এই দুই শ্রেণীর মানুষের মধ্যে যেন একটা সমঝোতার চেষ্টা করেছিলেন শেখর আর ললিতার প্রেমের মধ্যে দিয়ে। উপন্যাসটিতে পরিণত লেখনীর ছোঁয়া সর্বত্র দেখতে পাওয়া যায়।
''পণ্ডিতমশাই'' উপন্যাসের নায়ক পণ্ডিতমশাই অর্থাৎ বৃন্দাবন পাঠশালার নানারকম উন্নতির অক্লান্ত চেষ্টা অবিরত করেই চলেছেন ও গ্রামের পাঠশালাকে যেন বিশ্ব-পাঠশালায় রূপান্তরিত করেছেন।
''চন্দ্রনাথ'' উপন্যাসে দেখা যায় অসীম ভালবাসা আর স্নেহের পুরষ্কারে নারীর প্রাপ্তি শুধু অপমান আর লাঞ্ছনা।
''পল্লীসমাজ'' শরৎচন্দ্রের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সামাজিক উপন্যাস। এই উপন্যাসে কথাশিল্পী গ্রাম্য সমাজপতিদের দলাদলি, হিংসা, স্বার্থপরতা, সম্পত্তির জন্য লােলুপতা ইত্যাদি তুলে ধরেছেন। জনপ্রিয় এই উপন্যাসের মধ্যে দিয়ে শরৎচন্দ্র গ্রামের মানুষের কাছে শিক্ষার আলো পৌঁছে দেবার বার্তা পাঠিয়েছেন।
''বৈকুণ্ঠের উইলে'' ভ্রাতৃতের অটুট বন্ধনে সব প্রতিকুলতা জয়ের ছবিই আমরা দেখতে পাই।
শরৎচন্দ্রের শিল্পীসত্তার ও ব্যক্তিসত্তার নিবিড়তম প্রকাশ হল ''শ্রীকান্ত'' উপন্যাস। ''শ্রীকান্তে''র প্রথম পর্ব 'ভারতবর্ষ' পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। ভ্রমণকাহিনী রূপে শুরু হলেও এটি আসলে হয়েছে উপন্যাস, পাশাপাশি বলা যায় আত্মকাহিনী। শ্রীকান্ত-রাজলক্ষ্মীর প্রেম উপন্যাসটিকে আরও মধুর করেছে।
''শ্রীকান্তে"র দ্বিতীয় পর্বে দেখি শ্রীকান্তের ব্রহ্মদেশে বাস ও অভয়ার কাহিনী।
তৃতীয় পর্বে রাজলক্ষ্মীকে এক নতুন রূপে সাজিয়েছেন চিন্তাশীল শরৎচন্দ্র। সে কারণে শ্রীকান্তের বিদায়বেলায় রাজলক্ষ্মী অধীর না হয়ে শান্ত, সংযত, নিরুত্তাপ থেকেছে।
চতুর্থ পর্বে আবার রাজলক্ষ্মী-শ্রীকান্তের পুনর্মিলন ঘটেছে। এই রাজলক্ষ্মী শ্রীকান্তকে গৃহের বাঁধনে বেঁধেছে।
''চরিত্রহীন'' উপন্যাস প্রসঙ্গে ডঃ শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় জানিয়েছেন, "ইহার পাতায় পাতায় জীবন সমস্যার যে আলোচনা, যে গভীর অভিজ্ঞতা, যে স্নিগ্ধ উদার অনুভূতি ছড়ান রইয়াছে, তাহা আমাদের নৈতিক ও সামাজিক বিচার বুদ্ধির একটা চিরন্তন পরিবর্তন সাধন করে।"
''দত্তা'' উপন্যাসে শরৎচন্দ্র প্রেম ভালবাসাকে সর্ব ধর্মের ওপরে স্থান দিয়েছেন।
অন্যতম শ্রেষ্ঠ উপন্যাস ''গৃহদাহে'' এক ফুল দো মালির দ্বন্দ্ব সুষ্ঠু সংলাপ ও সুন্দর নাটকীয়তায় অসাধারণ হয়ে উঠেছে।
''দেবদাসে'' দেবদাস ও পার্বতীর প্রেমই মুখ্য। প্রেমের মহত্ব ও গৌরবের প্রতি সফল আলোকপাতে উজ্জ্বল দেবদাস।
''বামুনের মেয়ে''তে ব্রাহ্মণের নিষ্ঠুর অত্যাচারের রূপটি দেখানো হয়েছে। তবে তার পাশাপাশি প্রিয়নাথ যেন সমাজকে অক্সিজেন যুগিয়ে গেছে।
''দেনা পাওনা'' শরৎচন্দ্রের সমাজতান্ত্রিক চিন্তাধারার সফল উপন্যাস কারণ এর বেশিরভাগ অংশেই রয়েছে জমিদার ও প্রজার এই দুই শ্রেণীর বিরোধ।
''নববিধান'' উপন্যাসে দেখতে পাওয়া যায় স্বামী স্ত্রীর গভীর সম্পর্কের বিচ্ছেদ ঘটায় স্ত্রী ওরফে বিভার সামান্য কয়টি কথা।
জীবনের শেষের দিকে শরৎচন্দ্রের রচনা ''শেষ প্রশ্ন''তেই শুরু হয়েছিল বাংলা উপন্যাসের নতুন যুগের সূচনা।
''শুভদা'' শরৎচন্দ্রের মৃত্যুর পর প্রকাশিত হয়।
''শেষের পরিচয়'' শরৎচন্দ্রের শেষ রচনা, তবে এটি তিনি সম্পূর্ণ করে যেতে পারেন নি। তাঁর মৃত্যুর পর রাধারাণী দেবী বাকি অংশ লেখেন। দুই ভিন্ন লেখকের লেখা হলেও কিন্তু ঘটনাস্রোতে ও উৎকর্ষতায় শরৎচন্দ্রের শেষের উপন্যাস সত্যই সার্থক হয়েছে।
শরৎচন্দ্র তাঁর উপন্যাসের ক্যানভাসে বাঙালি জীবনের দুঃখসুখের যে নিপুণ ছবি এঁকেছেন এককথায় তা অনবদ্য। সব মানুষকেই তিনি সমান মূল্য দিয়েছেন। পতিতা নারীকেও তিনি তাঁর উপন্যাসে সম্মানের আসনে অধিষ্ঠান করিয়েছেন এখানেই তাঁর সার্থকতা, তাই তিনি চির অমর, চির ভাস্বর।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শরৎচন্দ্রের স্মৃতির উদ্দেশ্যে লিখেছিলেনঃ-
"যাহার অমর স্থান প্রেমের আসনে
ক্ষতি তাঁর ক্ষতি নয় মৃত্যুর শাসনে।
দেশের মাটির থেকে নিল যারে হরি,
দেশের হৃদয় তাঁরে রাখিয়াছে ধরি।"
শরৎচন্দ্র তাঁর উপন্যাসে গল্প বলার সহজ-সরল মনোমোহিনী যাদুর মাদকতায় প্রথম থেকেই অভিজাত পরিবার থেকে শুরু করে মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত বাঙালির মনে চিরস্হায়ী আসন লাভ করেছেন। সংস্কারমুক্ত মননে ও চেতনে, অভিজ্ঞতার সুগভীর বিশাল বিস্তারে, প্রখর পর্যবেক্ষণের আলোতে, সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিশ্লেষণে, আবেগের অসীম উচ্ছ্বাস ও অনুভূতিশীলতায় ঔপন্যাসিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বাংলা উপন্যাসের জগতে অমর হয়ে আছেন।
শরৎচন্দ্রের উপন্যাস শুধু বাঙালি পাঠক সমাজে নয়, অনুবাদের মাধ্যমে তা সমগ্র ভারতবর্ষে এবং ভারতবর্ষের বাইরেও পরিচিতি পেয়েছে। তাঁর উপন্যাস নিয়ে বাংলা ছাড়াও অন্যান্য প্রদেশেও চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে, নাটক মঞ্চস্হ হয়েছে। সমগ্র ভারতে এমনকি ভারতের বাইরেও শরৎ উজ্বল হয়ে আছেন তাঁর উপন্যাসের স্নিগ্ধ চন্দ্রের আলোয়।
===================
ডঃ রমলা মুখার্জী, হুগলী।