Click the image to explore all Offers

প্রবন্ধ ।। মাতৃভক্ত বিদ্যাসাগর ।। গোবিন্দ মোদক

 

মাতৃভক্ত বিদ্যাসাগর 

গোবিন্দ মোদক 


        সংসারে এমন এক-একজন মানুষ আছেন যাঁদের বিরাটত্বের কোনও পরিমাপ হয় না --- বিদ্যাসাগর এমনই একজন বিরাট মানুষ। আকাশের মতো তিনি বিশাল। হিমালয়ের মতো উন্নত শীর্ষ। সমুদ্রের মতো গভীর। আবার তিনি যেমন করুণার সাগর, তেমন দয়া-দাক্ষিণ্যেও ভাস্কর। অন্যদিকে আবার তিনি মাতৃ-ভক্তিতেও অসামান্য। তাঁর পাণ্ডিত্য যেমন প্রবাদপ্রতিম, তেমনই তাঁর মাতৃ-ভক্তিও একটি প্রবাদের মর্যাদা লাভ করেছে।

         ১৮২০ খ্রিস্টাব্দের ছাব্বিশে সেপ্টেম্বর তারিখে মেদিনীপুর জেলার বীরসিংহ গ্রামে ঠাকুরদাস বন্দ্যোপাধ্যায় ও ভগবতী দেবীর সংসারে যে শিশুটি জন্মগ্রহণ করেছিল, সেই ঈশ্বরচন্দ্র-ই পরবর্তীতে পাণ্ডিত্যের কারণে মাত্র ২১ বছর বয়সে 'বিদ্যাসাগর' উপাধি প্রাপ্ত হন এবং পরবর্তীতে তাঁর আসল নামটি উপাধির আড়ালে ঢাকা পড়ে যায়। পাঠ্যজীবন শেষ করে মাত্র একুশ-বাইশ বছর বয়সেই তিনি কলকাতার ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে অধ্যাপনার মাধ্যমে তাঁর কর্মজীবন শুরু করেন। 

         এই ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে কর্মরত থাকাকালীন একদা তিনি খবর পান বীরসিংহ গ্রামে তাঁর সেজো ভাই শম্ভুচন্দ্রের বিয়ে পাকা হয়েছে। কয়েকদিন বাদেই তিনি তাঁর মায়ের কাছ থেকে একটি চিঠি পান। তাঁর মা তাঁকে শম্ভুচন্দ্রের বিয়েতে উপস্থিত থাকবার কথা লিখেছেন। মাতৃভক্ত বিদ্যাসাগর ভগবতী দেবীর মুখের কথাকে অবশ্য-পালনীয় আদেশ বলে মনে করতেন। কাজেই মাতৃ-আজ্ঞা পালন করবার জন্য তিনি ছুটির আবেদন করলেন। তাঁর উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ মি. মার্শাল সাহেব তাঁর আবেদন নামঞ্জুর করলেন। বিদ্যাসাগর খুব দুঃখিত মনে তাঁর বাসায় ফিরে মনোকষ্টে ভুগতে লাগলেন এবং ভাবলেন যে -- চাকরি বজায় রাখতে গেলে তাঁর মাতৃ-আজ্ঞা পালন করা সম্ভব নয়। সে রাত্রিটা তার নির্ঘুমেই কাটলো। সকাল হতে না হতেই তিনি মার্শাল সাহেবকে ফোন ক'রে তাঁর ছুটির আবেদন পুনর্বিবেচনা করার জন্য অনুরোধ করলেন। সেইসঙ্গে তিনি দৃঢ়স্বরে জানালেন যে --- এবারেও যদি তাঁর ছুটি মঞ্জুর না হয় তবে তিনি প্রয়োজনে চাকরিতে ইস্তফা দিয়েও চলে যাবেন, কেননা চাকরির চাইতে মাতৃ-আজ্ঞা তাঁর কাছে অনেক বড়ো, কাজেই মাতৃ-আজ্ঞা অমান্য করা তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়।

 


 

         বিদ্যাসাগরের অসাধারণ মাতৃভক্তির এই নমুনা দেখে মার্শাল সাহেব এতোটাই অভিভূত এবং চমৎকৃত হয়ে পড়েন যে কোনও প্রতিবাদের ভাষা উচ্চারণ না করে তক্ষুণি তাঁর ছুটি মঞ্জুর করেন। বিদ্যাসাগর ছুটি পেয়ে তখনই বীরসিংহ গ্রামের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন।

         ভাই শম্ভুচন্দ্রের বিয়ের রাতে  শেষ পর্যন্ত অবশ্য বিদ্যাসাগর তাঁর মায়ের কাছে পৌঁছতে পারেন, কিন্তু পথ-মধ্যে তাঁকে সাঁতরে পার হতে হয় ভরা বর্ষার বিক্ষুব্ধ বিপদ-সঙ্কুল দামোদর ও দ্বারকেশ্বর নদ। রাত্রিকালে যে ভরা নদী পার হতে নৌকার মাঝি পর্যন্ত ভয় পায়, সেই নদী অবলীলায় সাঁতরে পার হয়ে মায়ের কাছে পৌঁছান ঈশ্বরচন্দ্র --- মাতৃ-ভক্তির এ উদাহরণ সারা পৃথিবীতেই দুর্লভ। 

         মাতৃভক্তির এইরকম আরও উদাহরণ ছড়িয়ে আছে বিদ্যাসাগরের জীবন জুড়ে। আর একবার বিদ্যাসাগর তাঁর মায়ের জন্য বহুমূল্য শাল নিয়ে গেছেন --- কিন্তু ভগবতী দেবী কিছুতেই সেটা গায়ে দেন না। শেষপর্যন্ত মায়ের মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করে যখন বিদ্যাসাগর তাঁর দরিদ্র গ্রামবাসীদের সবাইকে কম্বল বিতরণ করেন, তখনই তাঁর মা হাসিমুখে শালটি গায়ে দেন। বিদ্যাসাগর বুঝেছিলেন যে- দরিদ্র গ্রামবাসীদের যেখানে ন্যূনতম শীতের পোশাক নেই, সেখানে তাঁর মা কিছুতেই শালটি গায়ে দেবেন না --- তাই বিদ্যাসাগর তাঁর সারা গ্রামে কম্বল বিতরণ করে তাঁর মায়ের ইচ্ছা পূরণ করেছিলেন অচিরেই। মাতৃভক্তির এ-ও এক অনন্য নজির। বিধবা বিবাহ আইন প্রচলনের জন্য যখন তিনি সংগ্রাম শুরু করেন, তখন তিনি তাঁর মায়ের চরণধূলি নিয়েছিলেন সংগ্রামে জয়ী হবার জন্য। বলা বাহুল্য, ভগবতী দেবীর সুসন্তান ঈশ্বরচন্দ্র বহু প্রতিকূলতা পেরিয়ে শেষপর্যন্ত জয়ী হয়েছিলেন এবং ১৮৫৬ সালের ২৬-শে জুলাই বিধবা-বিবাহ আইন পাশ হয়েছিল। সত্যিই অসাধারণ ছিল তাঁর মাতৃভক্তি।

         বিদ্যাসাগরের মাতৃভক্তি তাঁর চরিত্রের বিশিষ্ট গুণ। যে কোনও কঠিন কাজ করবার আগে সর্বদা তিনি তাঁর মায়ের সম্মতি নিতেন। আজকের এই নৈতিক অবক্ষয়ের যুগে যেখানে সন্তানেরা তাদের বৃদ্ধা মা-কে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠাতে দ্বিধা করে না, সেখানে বিদ্যাসাগরের মাতৃভক্তির এই উদাহরণ আজকের ছেলেমেয়েদের কাছে নতুন করে পৌঁছে দেবার সময় এসেছে।

_____________________


প্রেরক: গোবিন্দ মোদক। 

সম্পাদক: কথা কোলাজ সাহিত্য পত্রিকা। 

রাধানগর, ডাক- ঘূর্ণি, কৃষ্ণনগর, নদিয়া। 



Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.