দীপঙ্কর সরকার
বাঙালির বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় অভিযোগ হল বাঙালি ব্যবসা বিমুখ, বাঙালি ব্যবসা করতে পারে না। এছাড়াও বাঙালির বিরুদ্ধে আরও একটি অপবাদ আছে বাঙালি আত্ম বিস্মৃত জাতি। নাহলে আমরা কী করে ভুলে যাই প্রায় দুশো বছর আগেই বিদ্যাসাগর সফল ব্যবসায়ী হিসেবে প্রভূত খ্যাতি লাভ করে ছিলেন। আদর্শগত কারণে সংস্কৃত কলেজের সম্পাদক রসময় দত্তের সঙ্গে বিরোধ দেখা দিলে বিদ্যাসাগর সংস্কৃত কলেজের সহকারী সম্পাদকের পদ থেকে পদত্যাগ করেন। ১৬ জুলাই ১৮৪৭ সালে বিদ্যাসাগরের পদত্যাগ পত্র গৃহীত হলে, রসময় দত্ত আড়ালে বলতে থাকেন, " বিদ্যাসাগর যে চাকরিটা ছেড়ে দিলে, এখন খাবে কি? " প্রত্ত্যুরে বিদ্যাসাগর বলেন, " রসময় বাবুকে বলো, বিদ্যাসাগর আলু-পটল বেচে খাবে। " সৌভাগ্যের বিষয় বিদ্যাসাগরকে আলু-পটলের ব্যবসা করতে হয়নি, তিনি নিজেকে একজন সফল পুস্তক ব্যবসায়ী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে ছিলেন। বাঙালি হিসেবে সেটি কম গৌরবের বিষয় নয়।
আলোচ্য প্রবন্ধে সে বিষয়েই আলোকপাত করার চেষ্টা করব। কর্মহীন হলেও বিদ্যাসাগরের পক্ষে তাঁর বাসায় আশ্রিত প্রায় ২০ জন আত্মীয় স্বজনের ছেলেকে ছাড়া সম্ভব হয়নি। তাই বিদ্যাকে মূলধন করেই তিনি বিদ্যা বণিক হওয়াই শ্রেয় মনে করে একাধারে তিনি মুদ্রক, প্রকাশক ও গ্রন্থকার হলেন। যতদূর সম্ভব সহকারী পদ ছাড়ার আগেই তিনি ' সংস্কৃত প্রেস ' ও ' ডিপজিটারি ' প্রতিষ্ঠা করে ছিলেন। এ বিষয়ে তিনি নিজেই লিখেছেন," যৎকালে আমি ও মদনমোহন তর্কালঙ্কার সংস্কৃত কলেজে নিযুক্ত ছিলাম, তর্কালঙ্কারের উদ্যোগে সংস্কৃত যন্ত্র নামে একটি ছাপাখানা সংস্থাপিত হয়। এ ছাপাখানায় তিনি ও আমি সম অংশভাগী ছিলাম। "
কিন্তু ছাপাখানা করতে যে অর্থের প্রয়োজন তা মদনমোহন ও বিদ্যাসাগর কারো কাছেই ছিল না। শেষ পর্যন্ত ঋণ করে তা করতে হয়েছিল। এ সম্পর্কে তাঁর সহোদর শম্ভুচন্দ্র লিখেছেন , " এই সময়ে অগ্রজ মদনমোহন তর্কালঙ্কারের সহিত পরামর্শ করিয়া সংস্কৃত-যন্ত্র নাম দিয়া একটি মুদ্রাযন্ত্র স্থাপন করেন। "অর্থাভাবে বন্ধুবর নীল মাধব মুখোপাধ্যায়ের কাছে ৬০০ টাকা ধার করে ওই প্রেস ক্রয় করা হয়। ঋণ পরিশোধের তাগিদে একদিন কথা প্রসঙ্গে বিদ্যাসাগর মার্শাল সাহেবকে বলেন যে," আমরা একটা ছাপাখানা করিয়াছি, যদি কিছু ছাপাইবার আবশ্যক হয়, বলিবেন।" এ কথা শুনে সাহেব ভারতচন্দ্র কৃত
অন্নদামঙ্গল কৃষ্ণনগরের রাজবাড়ি থেকে আদি অন্নদামঙ্গল এনে শুদ্ধ করে ছাপার কথা বলেন। ওই ' অন্নদামঙ্গল ' দিয়েই বিদ্যাসাগর মুদ্রক ও প্রকাশকের ব্যবসা আরম্ভ করেন ।
এই ' সংস্কৃত -যন্ত্র ' ছাপাখানা থেকেই মদনমোহন তর্কালঙ্কার প্রণীত ' শিশুশিক্ষা প্রথম ভাগ ' ১৮৪৯ সালে মুদ্রিত ও প্রকাশিত হয়। বিদ্যাসাগরের ' বর্ণপরিচয় প্রথম ভাগ ' ও ১৮৫৫ তে এই সংস্কৃত যন্ত্র থেকেই মুদ্রিত হয়। বই প্রকাশ করেই তিনি ক্ষান্ত ছিলেন না , বই বিক্রির ও ব্যবস্থা করেছিলেন তিনি। তার জন্য সংস্কৃত প্রেস ও ডিপজিটারি (১৮৪৭) নাম দিয়ে এক বইয়ের দোকান খোলেন। সেখানে কেবল নিজেদের প্রকাশিত বইই বিক্রি হত না, অন্যের প্রকাশিত বইও এজেন্সি নিয়ে বিক্রি করা হত। হিন্দু কলেজ ও সংস্কৃত কলেজ এই দুই বিদ্যাকেন্দ্রের অনতি দূরেই বিদ্যাসাগর বইয়ের দোকান প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। কালক্রমে ওই অঞ্চল কলকাতার শ্রেষ্ঠ বিদ্যাকেন্দ্র প্রধান গ্রন্থকেন্দ্র হয়ে ওঠে। বিদ্যাসাগরের নিজের বই বিক্রি ও অন্যান্য এজেন্সির বিক্রিত বই থেকে প্রভূত অর্থ আয় হত। তাই ১৮৫৮ সালে যখন তিনি সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষের পদ ত্যাগ করেন, তখন কোনো রূপ বিচলিত হননি, কেননা তখন তাঁর বই বিক্রির ব্যবসা থেকে মাসিক আয় হত তিন - চার হাজার টাকা, যার বর্তমান বাজার মূল্য লক্ষাধিক টাকার সমতুল। তিনি জানতেন, অর্থ সর্বস্ব এই সমাজে অর্থের মূল্যে স্বাতন্ত্র্য বা আত্ম মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত। তাই ১৮৫৭ সাল থেকেই তিনি স্বাধীনভাবে ছাপাখানা ও বিয়ের ব্যবসা শুরু করেন ।
যুগপৎ পুস্তক প্রণয়ন ও পুস্তক বিক্রি যদি একজনের মস্তিষ্ক প্রসূত হয়, তবে তাকে ব্যবসায়িক বলাই শ্রেয়। সেদিক থেকে বিচার করলে পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর একজন ব্যবসায়ীই বটে এবং বঙ্গদেশে
তিনি প্রথম সফল পুস্তক ব্যবসায়ী হিসেবে স্মরণীয় হয়ে থাকবেন।
======================
তথ্যসূত্র
১। বিদ্যাসাগর ও বাঙালী সমাজ - বিষয় ঘোষ - ওরিয়েন্টাল ব্ল্যাক সোয়ান - তৃতীয় খণ্ড প্রথম সংস্করণ - ভাদ্র ১৩৬৬
২। বিাদ্যাসাগর ও অন্যান্য ব্যক্তিত্ব - কোরক সংকলন - সম্পাদক - তাপস ভৌমিক - জানুয়ারি ২০১৪।
=========================
ঠিকানা
দীপঙ্কর সরকার
কাঁঠাল পুলি
(সিংহের হাটের কাছে)
চাকদহ
নদীয়া।