বিস্তারিত জানতে ছবিতে ক্লিক করুন :

ছোটগল্প ।। জুলুম ।। সুদামকৃষ্ণ মন্ডল

 

জুলুম

সুদামকৃষ্ণ মন্ডল

         

         সূর্য তখনও পাটে যায়নি। গলা কাঁসার রং সবুজ জলাভূমি জন অরণ্যে স্নান করিয়ে দিচ্ছে । পাখিরা বাঁসায় ফেরার জন্য মনস্থির করেছে । শেষ বেলায়  নদীর ঝর্ণায় বকেরা বসে চুনো চাঁদা ধরে উদর পুরণের চেষ্টায় নিমগ্ন।  সকাল থেকে গাড়ি আসার অপেক্ষায় বাড়িওয়ালা অভীক মিশ্র কোত্থাও যায়নি । মালপত্তর এসে গেলে লোকজন দিয়ে নামাতে হবে । দো-তলা ঘরটা অনেকদিন খালি পড়ে আছে । ভাড়াটে পাওয়া যায় না। ওটাই ভাড়া দিয়ে কোনওরকম অভীক মিশ্রের চলে।  যা পায় তাই দিয়ে কোনরকম চলে যায়। এখন অভীকবাবু সকাল সকাল স্নান সেরে বেরিয়ে যায় দোকানে দোকানে পূজা করতে তাতে মাসোহারে যা পায় তাই দিয়ে কোনওরকম চলে যায় । ওই দো-তলায় এক বিডিও ছিলেন । মহামান্য বিডিও গত  ভোটে  রিগিং-এ  সরাসরি যুক্ত । সেই অপরাধে তাকে আদালতের নির্দেশে বদলি হতে হয় । ফলে গত তিন মাসে   আর কাউকে ভাড়াটে পাওয়া যায়নি । যারা রিগিং করে ক্ষমতায় আছে সেই দলের কেষ্ট বিষ্টুরা দাপিয়ে বেড়ায়। ফলে অভীকসহ আরও বাড়িওলা,  দোকানদার,  স্কুল, চালের গোলা,  কয়লা দোকানী,  সব্জি আড়ৎদার, ফলওলা সবাই তটস্থ -আতঙ্কিত।  বিডিও তো বাধ্য হয়েই বৌ -বাচ্চা- নিজের প্রাণের ভয়ে রিগিং করেছে ।
     স্টেশনের পিলারে বিজ্ঞপ্তি থেকে নীলকান্ত দ্ত্ত  সপরিবারে ভাড়াটে বাড়িতে উঠবে ।
    অভীক পাড়ার পটলাকে দিয়ে ঝাড়পোঁছ করিয়েছে।  স্ত্রী অথবা মেয়ে অনিন্দিতাও সহযোগিতা করেছে।  সোমত্ত  সুন্দরী মেয়ের ব্রাহ্মণের ঘরে  বিয়ে দেবার জন্য অনুসন্ধান চলছে । কন্যাদায়গ্রস্ত পিতার পাত্রপক্ষকে সম্প্রদান করতে অর্থ ব্যয় তো হবে । যা হোক একটা ব্যবস্থা হয়েছে মনে মনে স্বস্তি পেলেও দুশ্চিন্তা বেড়েছে ওদেরকে নিয়ে । ওরা মানে সান্টু -জগা- মদন -নিখিল সমীরদের নিয়ে । স্থানীয় ক্লাবের পোষা গুন্ডা । এলাকায় সন্ত্রাসের মূলমাথা।  দাপিয়ে বেড়ায়। ভয়ে  সিঁটকে নেই এমন কেউ নেই । মেয়ে বিয়ে দিতে গেলে যেমন তোলা দিতে হবে তেমনি ছেলের বিয়েতেও তোলা  দিতে হয় । প্রত্যেকটা অনুষ্ঠানের জন্য খাসি মাংস তিরিশ কেজি পনের পেটি বিলেতি মদ দিতেই হয় গৃহস্থকে।  ছেলে -মেয়ে যেকোনও  বিয়েতে ওদের দিতে হয় । তাছাড়া স্পেশাল ব্যবস্থাপনায় ব্যয়িত অর্থের শতকরা ধরে ক্লাব উন্নয়নের জন্য দিতে হবেই । ওদের পাওনা গণ্ডা পরিশোধ  হলেই আমন্ত্রণপত্র ছাপানোর অনুমতি পাওয়া যায় । ফলে অভীকের মাথায় যেন অগ্নিপিণ্ড জ্বলছে ।
     গাড়ি থেকে পটলা জয়ন্ত মালপত্র নামাচ্ছে । সান্টু মস্তান তার দলবল নিয়ে হাজির ।
----- কাকাবাউ ---   অ্যায় কাকাবাউ --- শুনতে পাচ্ছেন  ? আরে মশাই আমাদের না জানিয়ে ভাড়াটিয়া ঠিক করে নিলেন ?  কি পেয়েছেন  মশায় ? মগের মুলুক ?
পিছনে ওরা কয়েকজন তাসের আড্ডা থেকে উঠে সান্টুর পিছু নিয়েছে । সান্টুর সঙ্গে ওরা থাকে ।
---- তা কি করব ? মাথার উপর বোঝা চেপে বসে আছে  যে । দু'জন বুড়ো -বুড়ির দু'বেলা নুন ভাতের ব্যবস্থা তো করতে হবে নাকি  ?
----- তা বলে আমাদের না জানিয়ে ? দিন - আমাদের পাওনা ছাড়ুন  । শালার যেই না একটু বেলা গড়িয়েছে সন্ধ্যার সময় ভাড়াটে ঢুকিয়ে দিচ্ছেন  ? আমরা টের পাবো না ভাবছেন ?  ক্লাবকে ফাঁকি দিয়ে পার পাবেন ??
---- আরে বাবা না ।
---- ছাড়ুন। হকের পাওনা ছাড়ুন । শালার আমরা এলাকা জেগে  বসে থাকি । কুকুর শেয়াল তবু ঘুমায়-- ;  আমরা ঘুমাই ? দিন দিন মাল ছাড়ুন তো।  চৌকিদারি করি  কি করে ফাঁকি দেবেন ?
----  এই নাও । বলে অভীক পাঁচ হাজার টাকা
দিয়ে দিল । সে খপ্ করে নিয়ে ---- এতে কত দিলেন ? বলে বান্ডিলটা নাড়া ঝডড়া করছে ।
----  ফাজলামো করছেন ?  ইয়ার্কি করতে আসিনি আমরা  ।  ভেবেছেন কি মশায় ? ব্যাপারটা জানিনা ?  টেংরি খুলে নেব ! বেশি পাঁয়তাড়ি করেন যদি দেখিয়ে ছাড়ব।  মশাই আপনি আমাদের কি ভিক্ষে দিচ্ছেন? জানেন আমরা বিশুদার বাহিনী  ? ক্লাবে পুরো দস্তুর   সরকারের অনুদান পাই । সরকারি শুধু ওই টাকায় কি  আমাদের চলে ?  একটা ক্লাব চালাতে কত খরচ জানেন  ? আমাদের সঙ্গে ছেলে খেলা করবেন না । বেশি চালাকি করলে গলায় ফাঁস দিয়ে গাছে লটকে  আত্মহত্যার বিবরণ লেখাতে শান্ত পোদ্দার ভালো জানে । দিন--  ছাড়ুন ।
---- এক হাজার টাকা কেটে রাখছিলাম,  তোমার কাকিমার নিত্যি পরা কাপড় নেই, মেয়েটারও একটা চুড়িদার কিনব বলে  ---। তাছাড়া---
----  আমরা পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে চোখে ধুতুরা ফুল দেখব  ? একটু ছেঁড়া কাপড়ের তলা দিয়ে চোখের নেশায় তো মনের আশ মেটাতে পারি  ? আমাদেরও চলবে কেমন করে ভেবে দেখেছেন ?
অভীকের পকেটে হাজার টাকা   ;  দশটা একশ' টাকার নোট  দিয়ে দিতে বাধ্য হল ।
----- তাহলে ? দু'মাসের ভাড়া দিলেন এই ক'টা টাকা? উনি তাহলে ভাড়াটিয়া ?  আপনাকে তো চেনা চেনা লাগছে ? নীলকান্ত দত্ত ,  রিটিয়ার্ড মাস্টার ?  দিন  দিন আপনারটাও দিন । জানেন না দিতে হয়  ?          
----আমাকে আবার কি দিতে হবে  ? আমার পেনশন আটকে আছে ! ছেলেমেয়ে বেকার!  বাড়িঘর বন্ধক পড়েছে লেখাপড়া শিখিয়ে  চাকরির লোভে ঘুষ দিয়ে ?  কেস চলছে। আমাকে তো অভীকবাবু কিছু বলেননি ?
---- খুবই অবাক হচ্ছেন !  না বলার কি আছে ? অ্যাঁ ? ঘর ভাড়ায় নিচ্ছেন দিনরাত্রি নিরিবিলিতে কাটাবেন বলে? আমরা ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়াব কেন ?  এত বড় এলাকায় লক্ষ্য  নজর রাখতে ফাউ খাটব আমরা ?  আমাদের কষ্টটা বুঝবেন না ? তা কি করে হয় ? দিন ছাড়ুন - এটাই আপনাদের মুদ্রাদোষ -- পাড়ার ছেলেদের কথা ভাববেন না ? এরা কি ভূমিপুত্র নয়  ? বলুন তো ওই যে আপনার মেয়ে রাস্তাঘাটে কেউ সম্ভ্রমহানি   করলে কে দেখবে  ? আমরা আবার এ বিষয়ে পাক্কা ঝুনা নারকেল আছি । নাড়ু ফাটানোয় ওস্তাদ ।  দিনের বেলায়ও আমরা ইজ্জত লুটতে ভালো পারি । হাঁ--- ওগুলোর কেস থানার বড়বাবুর সাথে বোঝাপড়া হয়ে থাকে । এলাকায় একটাও ধর্ষণ কেসের আসামিকে পাওয়াই যায়না ।  তেমন হলে আমরা বেশি সময় নেব না। চেটেপুটে খেয়ে দইর ভাঁড় নর্দমায় ফেলে দিতে পারি।  কিরে ধনঞ্জয় পারবি তো? ----.পারব মানে ? ধনঞ্জয় বলল ।
----  চুপ কর হারামজাদা । নীলকান্তর স্ত্রী ধরিত্রী বলল।
----- পৈ পৈ  করে বললাম এই এলাকাটা অসভ্য ইতর লোকের আস্তানা । কোনও ভদ্রতা জানে না --- শুনলেই না ! আরো বললে এর থেকে কম ভাড়ায় আর কোথায় পাবি?  শুনলে আমার কথা..? এবার ঠেলা সামলাও । নীলকান্তের শিক্ষিতা মেয়ে ঐশী বলল ।
----  পাওনাটা ছাড়ো না ডার্লিং ?  এত ফোঁসফোঁস করছ কেন ? ফেলো কড়ি  মাখো তেল । ব্যস ।
---- এই মুহূর্তে আমার কাছে তো নেই । নীলকান্ত বলল।
---- সেলামি না নিয়ে গাড়ি রওনা দিল কি করে?  এলাকা জুড়ে এই একই নিয়ম জারি আছে জানো না বুঝি ?  কচি খোকা না খুকু, নাকে তেল দিয়ে ঘুমাও?
-----. তুই চুপ কর.।  আমাদের সঙ্গে তো কথা হচ্ছে  ?  তা কত দিতে হবে ?.আমার কাছে ৫০০ টাকা আছে ।
------  পাঁ--- চ --শ  হা হা হা হা হা ! একি দক্ষিণা ওরা সকলেই হেসে লুটে পড়ছে।  ধনঞ্জয় বলল,  ফাল্তু অজুহাত রাখুন  । পাওনা না দিলে রুমে প্রবেশ করতে পারবেন না --- হয়েই গেল।
-----  কি হলো আমরা কি দাঁড়িয়ে থাকবো ? যদি বলেন শেষ দেখতে, তবে দেখিয়ে  দিতে কোন অসুবিধা নেই । মাঈরি মানুষ আপনারা ! আমরা তো বাইরের কেউ নই ।  পাড়ার ছেলেদের করে কম্মে খেতে দেবেন না ?  যেন আকাশ থেকে পড়লেন ?  কি যোগ্যতায়  যে মাস্টারি করতেন--- অবাক হচ্ছি ! 
----কি , বাবা এত ভিড় কেন এখানে ? আবীর বলল ।
---- ওদের ছয় হাজার  টাকা পাওনা  ;  দিয়ে দে তো।
----  ছয় হাজার  !  কেন.?  ছেলে শুনে বিস্মিত হলো ।
-----  সে উত্তর তোকে আমি পরে বলব  ।
---- আমার কাছে তো এত টাকা নেই  ! বড়জোর সাড়ে   তিন ।
---- থাক ।  এই-  এই আংটি --   সোনার আংটিটা না হয় রাখো বাবা  । বিক্রি করে ওর চেয়ে অনেক বেশি পেয়ে যাবে ।  বিবাহের আংটিটা খুলে দিতেই ঘুরে ফিরে দেখে চলে গেল ।
---- নাই মামার চেয়ে কানা মামা ভালো । বলল সান্টু । ----- হকের টাকা দেবে না বলে ! কোন জগতে আছি বলতে পারিস ? জগা বলল  ।
   এই জুলুমবাজি বা গা জোয়ারিতে ওরা একরোখা জেদী বা বদমেজাজি ।
-----  শালা বলে কি , সরকার আমাদের টাকা দেয় ।  নিখিল--  বিকালে অর্জুন নস্করকে ধরবি  তো ?  জমি  কেনাবেচা করল পাওনাটা আজও অবধি দিল না !  হলধর মাঝি  আজ কাল করছে  , বাড়ি হাঁকাল গাড়ি নামালো হকের টাকাটা এযাবৎ পৌঁছালো না ! সেলিম ডাক্তারের ঘরে এসি বসেছে লক্ষ্য করেছিস  ? সন্ত বিকেলে মোড়ের টোটোদের ধরবি তো । নতুন যে কটা রোডে নামছে হিস্যাটা বুঝিয়ে দেয়নি কেন  ?  মনে আছে তো? আজকে মানিক মাস্টারের মেয়ের জবাব নিতে হবে ? সন্ধ্যা সাতটায় সকলে বাসস্ট্যান্ডে চলে যাবি  ।.........সান্টু বকবক করতে ক্লাবের দিকে গেল ।  দেবদারু গাছগুলো আড়াল হতেই ওদের দেখা গেল না।
========================
সুদামকৃষ্ণ মন্ডল
গ্রাম: পুরন্দর পুর (অক্ষয় নগর)
পোস্ট : অক্ষয় নগর
থানা : কাকদ্বীপ
জেলা : দঃ চব্বিশ পরগণা
পিন কোড :743347

Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.