বেশ কয়েকদিন থেকে রশিদ ক্লাসে দেরি করে আসছে। ক্লাসে পৌঁছানোর পূর্বেই তার মনের মধ্যে এক তীব্র টানাপড়েন অনুভূত। ভাবতে থাকে ক্লাসে গিয়ে স্যারকে কি বলে আজকের বিলম্বের কারণটা বলবে। মাঝে মাঝে সে মনস্থির করে ফেলে এভাবে দোটানার মধ্যে না থেকে একেবারে পড়াশোনার পাঠ চুকিয়ে দিয়ে সংসারের হাল ফেরাতে বাবার মুদিখানার দোকানটাকে একেবারে ব্যবসিকের মতোই চালাতে শুরু করি। এদিকে দেখতে দেখতে মাস পাঁচ ছয় হয়ে গেল তার বাবার রোগটা একেবারে তাকে মাকড়সার জালের মত আটকে রেখেছে। নানান ডাক্তার চিকিৎসা ওষুধের মধ্যে দিয়ে সে যেন অসুস্থতার ঘোর থেকে বের হতে পারছে না। সামান্য রোজগারের সংসারে তার বাবার চিকিৎসা করাতে গিয়ে বড় কঠিন অবস্থা। অতল সাগরে ডুবে গিয়ে কূলকিনারাহীন অবস্থা। ভেবে উঠতে পারছে না কিভাবে দোকান সংসার সামাল দিয়ে লেখাপড়াটা করবে। ছোট বোন ও তার মাকে নিয়ে রশিদের চারজনের পরিবার। অথচ সে দেখেছে কিভাবে কঠোর পরিশ্রম করে অল্প পুঁজি দিয়ে একটা মুদিখানার দোকানকে দাঁড় করিয়ে তার বাবা সংসারের চাকাটা ঘোরাচ্ছিলেন। কিন্তু দীর্ঘ রোগগ্রস্ততায় তা বাবা একেবারে কাজ করার সামর্থ্য হারিয়ে বিছানার সঙ্গে পুঁতে গেলেন। তবুও অদম্য আশাতে রশিদ স্বপ্ন দেখে তার বাবা হয়তো একদিন তো হয়ে আবারো পূর্বের স্থিতিশীল জীবনে ফিরে আসবে। মুদিখানা দোকানটা কলেবরে বৃদ্ধি পেয়ে রমরমিয়ে চলবে। তার পড়াশোনাটাও গতি পাবে। সে রাখা ইচ্ছে গুলো পরিপূর্ণতা লাভ করে বিহঙ্গের মতো ডানা মেলে উড়ে যাবে কাঙ্খিত গন্তব্যস্থলে। কিন্তু সময় পরিস্থিতি আজ রশিদের বিপ্রতিপে অবস্থান করছে। ছাত্র জীবনটা তার কাছে যেন দিনকে দিন তীব্র লড়াই সংগ্রাম সহিষ্ণুতার চরম পর্যায়ে পৌঁছে গেছে । সে যেন নিজেকে আর কোনমতেই এই দম বন্ধ করা পরিবেশে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারছে না। এই বয়সের ছাত্ররা যখন নিজের মত খোলা মানে ঘুরে বেড়াচ্ছে খেলাধুলা করছে। যেখানে নেই কোন চিন্তা কাজ আছে শুধুমাত্র অফুরন্ত ভালো লাগা জীবনকে তরিয়ে তরিয়ে উপভোগ করা। সহসা রশিদ যেন নিজেকে হারিয়ে ফেলে এক অজানা অচেনা পরিস্থিতির সংস্পর্শে যেখানে শুধুই অসহায়তা অস্থিরতা। তবুও সংযম হয়ে সে আবারও ফিরে আসে স্বাভাবিকতায় খুঁজতে থাকে এই সমস্যা সংকট থেকে মুক্তি লাভের। নিষ্পাপ মননে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করে তার বাবার রোগ মুক্তির। তার ইচ্ছার পরিপূর্ণতে লুকিয়ে আছে আগামীর ঝলমলে নীল আকাশ। কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে বাস্তবতায় ফিরে এসে ক্লাসে ঢুকেই শিক্ষক রাকেশ তাকে প্রশ্ন করে-" এভাবে দিনকে দিন ক্লাসে দেরী করার অভ্যাস তোমাকে ছাড়তে হবে"।
ইচ্ছাকৃতভাবে আমি কখনো ক্লাসে দেরি করি না স্যার। কিন্তু বাবা রোগে বিছানাগত হওয়ার ফলে সাংসারিক কাজের পাশাপাশি আমাকেই বাবার মুদির দোকানটা চালাতে হচ্ছে। মাঝে মাঝে ভাবনা আসে আমি হয়তো আমার পড়াশোনাটা আর চালিয়ে যেতে পারবো না।
রশিদের অকপট স্বীকারোক্তিতে শিক্ষকের মন বিগলিত হয়ে উঠল। এই বয়সে অষ্টম শ্রেণীর একটি ছাত্র কিভাবে দৈহিক পরিশ্রম করে পারিবারিক সংসার চালাচ্ছে। রশিদের কষ্ট সহিষ্ণতায় তার মধ্যে এক অকৃত্রিম ভালবাসা স্নেহ মমতার বোধ জাগ্রত হল। তবে তিনি রশিদকে পরামর্শ দিলেন, পড়াশোনার হালটা ছাড়িস না বাবা। জীবন সংগ্রাম করেই এগিয়ে চল। আমি তোর সাহায্যে সব সময়ই পাশে আছি।
শিক্ষকের পরামর্শ মতামত রশিদকে চরমভাবে অনুপ্রাণিত করল। সে মানসিক দিক থেকে আরও বেশি সাবলীল হয়ে উঠলো। শিক্ষকের অভয় বাণী তার কাছে আগামীর পথ চলার পাথেয় হয়ে উঠলো।
সহজ সরল অবচেতন মননে সে ভাবতে থাকে জীবন মানেই ঘাত প্রতিঘাত বাধা বিঘ্নতা বিবিধ সমস্যাবলি অন্ধকার হতাশা তবুও তার মধ্যে উত্তরণের অভিমুখ। স্বপ্ন দেখে একদিন অবস্থার পরিবর্তন। তার বাবার সুস্থতা। অস্থিরতার ঘনঘটা দুর্যোগের কালো মেঘ পার করে আসবে সেই সুখের মুহূর্ত যখন নীল আকাশে আবার সূর্য উঠবে। উদ্ভাসিত আলোয় বিলীন হবে জরা দগ্ধতা যাতনা নৈরাশ্য।
=================
পাভেল আমান- হরিহরপাড়া -মুর্শিদাবাদ