জিজ্ঞাসার অবসান
পাভেল আমান
আর পাঁচজন ছাত্রদের থেকে সাবির একটু আলাদা। নিয়মানুবর্তিতা শৃঙ্খলাপরায়ণ কর্তব্য নিষ্ঠার পাশাপাশি সে প্রত্যেকটা বিষয়কেই গভীরভাবে জানার ও বোঝার চেষ্টা করে। অবচেতন মননের ডাল পালা কে প্রসারিত করে খুঁজতে থাকে কেন কিন্তু রহস্য উন্মোচন। ছোট থেকেই অজানাকে জানার নতুন কিছু শেখার আগ্রহ চরম। পড়াশোনাটা কে সে জীবনের ভালোলাগার অদম্য নেশা হিসেবে মনে করে। পাশাপাশি চোখ কান খোলা রেখে হাতে-কলমে কাজের মধ্যে দিয়ে বাস্তবতার সুনিপুন প্রয়োগ ঘটিয়ে সে বিমূর্ত শিক্ষার বিষয়বস্তুকে রপ্ত করতে চাই। পাঠ্যপির পাশাপাশি সে মাঝে মাঝেই প্রকৃতির সঙ্গে মিশে গিয়ে জল হাওয়াতে অহর্নিশ সন্ধান করে জীবনের প্রকৃত শিক্ষা লাভ।শুধুমাত্র মুখস্ত বিদ্যাতে নির্ভরশীল না হয়ে বুদ্ধি ও মেধার পারস্পরিক মেলবন্ধনে সে যে কোন জানার বিষয়কে সহজাত ও প্রাণবন্ত করার চেষ্টা করে। এভাবেই বোধশক্তিকে ব্যবহারিকভাবে প্রয়োগ করে সে জ্ঞানলাভের আকাঙ্ক্ষা ও ইচ্ছাকে পরিপূর্ণ করে তুলেছে। মাঝে মাঝে ক্লাসে শিক্ষকেরা তাহার অজানা অচেনার রহস্য উদঘাটনে একেবারে হতচকিত হয়ে যায়। তবুও বিরক্ত বিব্রত বোধ না করে শিক্ষকেরা সাবিরের এই আগ্রহ জিজ্ঞাস মনোভাবকে প্রশংসা করে। অষ্টম শ্রেণীর সাবির বরাবর সিলেবাসের বাইরেও নিজের অতৃপ্ত জিজ্ঞাসা ভান্ডার কে সম্পূর্ণ করে তুলতে প্রচন্ড উদগীব। মাঝে মাঝেই তার সহপাঠীরা তাকে কিছুটা তাচ্ছিল্য অবজ্ঞাভরে চিৎকার করে " সাবিরটা যেন এই বয়সেই বিজ্ঞানী নিউটন হয়ে গেছে। সর্বদাই পড়াশোনা কি কেন র উৎকণ্ঠায় ছটফট করছে। "
তার সহপাঠীদের কথাতে কোন কান না দিয়ে সাবির তার পড়াশোনার জগত নিয়ে নিবিষ্ট। ক্লাসের পড়া হয়ে গেলে অবসর সময়ে সাবির বিজ্ঞানীদের জীবনী পড়তে প্রচন্ড ভালবাসে। তাদের কষ্ট সহিষ্ণুতা প্রচন্ড জিজ্ঞাসা আগ্রহ তার অবচেতন মননকে প্রচন্ড নাড়া দেয়। সহসা ভাবতে থাকে আমিও যদি একদিন সেই সব বিজ্ঞানীদের মতো কোন কিছু আবিষ্কার করতে পারি তাহলে নিশ্চিতভাবে আমার স্বপ্ন পূরণ হবে। বিজ্ঞানের নেশা সর্বদা তার পড়ুয়া মনোভাবকে আকৃষ্ট ও তাড়িত করে। সে একটি কথা ভালোভাবেই জেনেছে বিজ্ঞানের আবিষ্কার উন্নতিতেই মানব সভ্যতার অগ্রগতি। এভাবেই তার ইচ্ছেগুলো জারিত হতে থাকে প্রাত্যহিক পড়াশোনার জগতে।
বাড়িতে সাবিরের বাবা-মা প্রতিমুহূর্তে তাকে কড়া চোখ রাঙিনি দিয়ে বলতে থাকে বাৎসরিক পরীক্ষায় যদি ভালো রেজাল্ট না হয় তাহলে তার ভবিষ্যৎ জীবনের আশা পূর্ণ হবে না। একমাত্র সন্তান সাবির কে নিয়ে তার বাবা-মায়ের অনেক স্বপ্ন ও আকাঙ্ক্ষা।অন্যান্য বাবা মায়ের মত তারাও চান সে সমাজে প্রতিষ্ঠিত হোক।
এদিকে বাৎসরিক পরীক্ষার আর খুব বেশি দেরি নেই। স্কুলে শিক্ষকেরা সমস্ত বিষয়ের পরীক্ষার সিলেবাস বলে দিয়েছেন। কিন্তু সাবিরের সিলেবাসের পড়ার মধ্যে কখনোই নিজেকে ধরে রাখতে পারছে না। সিলেবাসের সীমিত জ্ঞানের মধ্যে তার জানার পৃথিবীটা যেন ক্রমশ সংকুচিত হয়ে যাচ্ছে। খুঁজে পাচ্ছে না ভালোলাগার অনুভূতি। একটি প্রশ্ন তার সহজ সরল মননকে মাঝে মাঝে ধাক্কা মারে পড়াশোনা মানেই কি শুধু পরীক্ষাতে ভালো নম্বর পাওয়া পড়াশোনা মানেই কি শুধু বড় বড় ডিগ্রি লাভ করে চাকরি পাওয়া পড়াশোনা মানে কি শুধু বাবা-মায়ের আজ জন্মদিন স্বপ্নকে পূর্ণ করা। ক্রমশাই এই গতানুগতিক পড়াশোনা তাকে অস্থির করে তোলে। তার মননের নীল আকাশে মাঝে মাঝে কালো মেঘের ঘনঘটা। কিছু অপ্রিয় প্রশ্নের উত্তরে সে ঘুরপাক খেতে থাকে। তবুও এক প্রকার বাধ্য হয়ে নিজস্ব জগৎটাকে স্তব্ধ করে সে বাবা-মায়ের ইচ্ছেটাকে বাস্তবায়িত করার জন্য সিলেবাসের পড়াশোনাতে মনোযোগ দিতে থাকে বাৎসরিক পরীক্ষার ভালো ফলের জন্য। এভাবেই আমাদের সমাজে দেশে সাবিরের মত ব্যতিক্রমী মেধার ও প্রতিভার স্বাক্ষরকারী শিক্ষানবিশরা কক্ষপথ থেকে বিচ্যুত হয়ে ফিরে আসছে গড়পড়তা নিরস পড়াশোনা তে। যেখানে শুধুই চোখ-কান বুঝে জানার আগ্রহ উন্মাদনাকে দমিত করে মুখস্ত বিদ্যাকে অবলম্বন করে পরীক্ষায় ভালো নাম্বার পেয়ে বাজিমাত করা। যাইহোক বর্তমান সমাজে পরীক্ষার নম্বরেই একজন ছাত্রের যোগ্যতা ও উৎকর্ষতা মানদন্ড। এই ধারাবাহিকতা বজায় রেখে সাবিরের মত ব্যতিক্রমী মেধাবীরা মাঝপথেই অভিযান শেষ করে গতানুগতিক প্রবাহে নিজেদের সম্ভাবনাকে নিমজ্জিত করে। বিভিন্ন জিজ্ঞাসা গুলো হোঁচট খেয়ে নিরুত্তর থেকে যায়।
=======================
রচনা -পাভেল আমান- হরিহরপাড়া -মুর্শিদাবাদ