ছবিঋণ - ইন্টারনেট।
কাটোয়ার ঐতিহ্যবাহী কার্তিক লড়াই -
পট ভূমিকায় গনিকা ও বাবু সমাজ
বারিদ বরন গুপ্ত
এক একটা জায়গা এক একটা জিনিস, উৎসব ইত্যাদি দ্বারা বিখ্যাত হয়ে ওঠে, যেমন চন্দননগরের জগদ্ধাত্রী, নবদ্বীপের রাস,তেমনি কাটোয়ার কার্তিক লড়াই। মহাপ্রভু গৌরাঙ্গ দেবের স্মৃতি বিজড়িত এই মহকুমা শহর বহু ঐতিহাসিক ঘটনার সাক্ষী হয়ে আছে। অজয় ভাগীরথী সন্নিহিত এই অঞ্চল পালতোলা নৌকার যুগে ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য বিখ্যাত হয়ে উঠেছিল, সেই সূত্রে ভাগীরথী নদী সংলগ্ন এই অঞ্চলে দেশ-বিদেশের বণিক সমাজের আনাগোনা শুরু হয়, গড়ে ওঠে রাত্রি নিবাস কেন্দ্র, শুরু হয় বারবনিতাদের আনাগোনা, বারবনিতাদের সন্তান কামনার অঙ্গ হিসেবে শুরু হয় কার্তিক আরাধনা। ধীরে ধীরে পুজো নিয়ে শুরু হয় প্রতিযোগিতা,বাবুরাও জড়িয়ে পড়েন এই প্রতিযোগিতা বা লড়াইয়ে, আর এই-লড়াই এর পটভূমিকায় তৈরি হয় কাটোয়ার ঐতিহ্যবাহী 'কার্তিক লড়াই' !!
উল্লেখ করা যেতে পারে যে প্রাচীন বাংলার ইতিহাসে কাটোয়া একটি উল্লেখযোগ্য স্থান দখল করেছিল। ভাগীরথী লাগোয়া এই জনপদের নাম আমরা প্রাচীন ঐতিহাসিক গ্রন্থ গুলিতে পাই। তখন অবশ্য এই জনপদের নাম কাটোয়া ছিলনা, ছিল কন্টক নগর, ইন্দ্রানী পরগনার অন্তর্গত প্রাচীন যুগের এক ঐতিহ্যবাহী নগর। মনে করা যেতে পারে যে তখন কাটোয়া কণ্টকাকীর্ণ গাছগাছালিতে ভর্তি ছিল, এই ঘন জঙ্গলে যেমন বন্য পশু ছিল তেমনি দুধর্ষ ডাকাত দলের আস্তানা ছিল বলে জানা যায়। ধীরে ধীরে অপভ্রংশে কন্টক নগর কাটোয়ায় পরিণত হয়, মৌর্য যুগেও এই অঞ্চলের কথা জানতে পারা যায়, গ্রিক দার্শনিক আরিয়ানের বর্ণনায় এই জনপদের নাম কটদুপা বলে উল্লেখ ছিল! তাছাড়া প্রাচীন সাহিত্য রামায়ণ বা মহাভারতে এই অঞ্চলের কথা জানতে পারা যায়!
মহাপ্রভু স্মৃতিবিজড়িত এই শহর খুব সম্ভবত ষোড়শ শতক থেকেই পাদপ্রদীপের তলায় আসতে থাকে, এই অঞ্চলকে কেন্দ্র করে সাহিত্য-সংস্কৃতি বিকশিত হতে থাকে, ধীরে ধীরে এই অঞ্চল সংস্কৃতি চর্চার অন্যতম কেন্দ্র হিসেবে পরিচিতি লাভ করে, তবে একথা সত্য যে নবাবী আমল থেকেই কাটোয়া একটি অন্যতম বাণিজ্য কেন্দ্র হিসেবে পরিচিতি লাভ করতে থাকে, উল্লেখ করা যায় যে মুর্শিদাবাদে প্রবেশ করার একমাত্র পথ ছিল কাটোয়া। অষ্টাদশ শতকের প্রথম ভাগ থেকেই এই অঞ্চল ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য পরিচিতি লাভ করে, শুধু তাই নয় ঐতিহাসিক ঘটনাপ্রবাহ এই অঞ্চল ভারতবর্ষের ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করেছিল। উল্লেখ করা যায় যে আনুমানিক ১৭৪২ খ্রিস্টাব্দে রঘুজী ভোঁসলের সেনাপতি ভাস্কর পন্ডিত এর নেতৃত্বে এই অঞ্চলে বর্গী হাঙ্গামা হয়, শোনা যায় ভাস্কর পন্ডিত মাসাধিক কাল এই অঞ্চলে ব্যাপক লুটতরাজ করে, সমাজ বাড়িতে আস্তানা গড়ে,বলতে গেলে এই মারাঠি সরদার কাটোয়াকে খাস তালুকে পরিনত করে। কথিত আছে তিনি কাটোয়ার সন্নিকটে দাঁইহাট এর কাছে দেবী দুর্গার আরাধনা শুরু করেন, কিন্তু নবাব আলীবর্দীর অতর্কিত আক্রমণে তিনি নবমীর পূজা অসমাপ্ত রেখে, সিংহবাহিনীকে গঙ্গায় নিক্ষেপ করে কাটোয়া ছাড়েন। শুধু তাই নয়, লর্ড ক্লাইভের নেতৃত্বে পলাশী যুদ্ধের গোপন পরামর্শ এই কাটোয়ার বুকেই হয়েছিল বলে জানা যায়, তাছাড়া ১৭৬৩ খ্রিস্টাব্দে মীর কাসিম এর সাথে ইংরেজদের যুদ্ধের স্থান ছিল এই কাটোয়া। এই সব ঐতিহাসিক কাহিনীর পটভূমিকায় মনে করা যেতে পারে যে সাংস্কৃতিক অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক ভাবে প্রাচীন ইন্দ্রানী পরগনার এই অঞ্চল যথেষ্ট মর্যাদাপূর্ণ ছিল।
তবে একথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে প্রাচীনকালে কাটোয়া নয়, দাঁইহাট-ই ছিল ইন্দ্রানী পরগনার অন্যতম প্রাণকেন্দ্র, ভাগীরথী তীরে বারোঘাট তেরোহাট এই নিয়ে জমে উঠেছিল দন্তিহাট বা দাইহাট । এসব হাটের মধ্যে অন্যতম ছিল পাতাইহাট ,মন্ডলহাট ,ঘোষ হাট,বীরহাট, সগরৎপুরের হাট প্রভৃতি। আর ১২ ঘাটের মধ্যে ইন্দেশ্বর ঘাট, বারদুয়ারি ঘাট, বসন্ত বাবুর ঘাট, কদমতলা ঘাট, বকশির ঘাট উল্লেখযোগ্য। শুধু তাই নয় অতীত কাল এই ইন্দ্রানী পরগনায় ইন্দ্রদ্যুন্ম নামে এক রাজা রাজত্ব করেছিলেন, তার রাজধানী ছিল ইন্দ্রানী, এখানে ইন্দেশ্বরী দেবীর এক পাথরের মন্দির ছিল, যা ভাগীরথীর গর্ভে চলে গেছে, কিন্তু ইন্দোরেশ্বর ঘাটের শেষ চিহ্ন এক প্রস্তরখন্ড এখনো বিদ্যমান, দেবী ইন্দ্রানী না থাকলেও ইন্দ্রেশ্বর শিব আছেন! তাহলে বোঝা যায় যে সেই অতীত কাল থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত ইন্দ্রানীর গৌরব ভাগীরথী আপন বেগে প্রবাহিত করছে। উল্লেখ করা যায় যে ইন্দ্রানী পরগনার ঐতিহ্যের কথা যেন একসময় প্রবাদ হয়ে গেছিল-
"বারো ঘাট তের হাট তিন চন্ডী তিনেশ্বর
যে বলতে পারে তার ইন্দ্রানীতে ঘর।"
এই প্রবাদের মাধ্যমেই বারোঘাট তেরোঘাট দন্তিহাটের গুরুত্ব প্রাচীনকালে কতখানি ছিল তার সহজেই উপলব্ধি করা যায়! আমার মনে হয় প্রাচীনকাল উজানীর মতই ইন্দ্রানী ও ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল, আর ইন্দ্রানী অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য কেন্দ্র ছিল এই দন্তিহাট, বর্তমানে দাইহাট! সেই জন্য প্রাচীন বণিক সম্প্রদায় এই দাঁইহাটেই ডেরা বেঁধেছিলেন! বর্ধমান মহারাজারা দাইহাটের সমাজ বাড়িতে স্নান বা প্রার্থনা নিবাস গড়ে তুলেছিলেন, শুধু তাই নয়, মারাঠি সরদার ভাস্কর পন্ডিত এই অঞ্চলকেই বেছে নিয়েছিলেন । তা হলে বোঝা যায় প্রাচীন কালে ইন্দ্রানী পরগনার দাইহাট সংলগ্ন অঞ্চলগুলি ব্যবসা বাণিজ্যের জন্য কতখানি সমৃদ্ধিশালী হয়ে উঠেছিল। পরবর্তীকাল ভাগীরথী তার গতিপথ সরিয়ে নেয়, ফলে বাণিজ্য কেন্দ্র হিসেবে দাইহাটের গুরুত্ব কমে যায়, এর জায়গা দখল করে কাটোয়া! উল্লেখযোগ্য যে সপ্তগ্রাম বণিক সমাজ ভেঙে যাওয়ার পর দাইহাট সংলগ্ন কাটোয়ার গুরুত্ব অনেক বেড়ে গেছিল! গুজরাটি বণিক শ্রীবাটীর (চান্দেল) চন্দ্ররা, সপ্তগ্রামের বাস উঠিয়ে দাঁইহাটে প্রথমে বসতি স্থাপন করেছিলেন একজন প্রসিদ্ধ লবণ ব্যবসায়ী হিসেবে, একসময় দাঁইহাটে তাদের লবনের গোলা ছিল!
উনবিংশ শতকের প্রথম থেকেই কাটোয়া বাণিজ্য নগরী হিসেবে পরিচিতি লাভ করে, উল্লেখ করা যেতে পারে যে লবণ ,কাঁসা-পিতল, রেশম প্রভূতি পন্যের কেন্দ্রস্থল ছিল কাটোয়া, সেই কারণে পালতোলা নৌকার যুগে এই অঞ্চলে বণিকদের আনাগোনা শুরু হয়, ভাগীরথী সন্নিহিত অঞ্চল গুলিতে ব্যবসা-বাণিজ্যের সূত্রে গড়ে উঠতে থাকে রাত্রি বাস কেন্দ্র, বাবু সমাজে আনাগোনা, তাদের আমোদ-প্রমোদের বিনোদন সূত্রে গণিকাদের আনাগোনা শুরু হয়, ধীরে ধীরে গড়ে উঠতে থাকে বারবনিতা পল্লী, একসময় বারবনিতাদের সন্তান কামনার উদ্দেশ্যে শুরু হয় কার্তিক আরাধনা। উল্লেখ করা যায নিঃসন্তান দম্পতিরা পুত্র কামনায় সাধারণত এই পূজা করে থাকেন, যাই হোক ধীরে ধীরে এই পুজোর সাথে ধনী বনিক, বাবু সমাজ জড়িয়ে পড়ে, পুজো কে কেন্দ্র করে খানাপিনা, বাদ্যি বাজনা, এলাহি বাবস্থা চলতে থাকে, পুজোর জৌলুস কে কেন্দ্র করে এক গণিকার কার সাথে অন্য গণিকার প্রতিযোগিতা যেমন চলতে থাকে, তেমনি এই লড়াইয়ে বাবুরাও জড়িয়ে পড়তে থাকে, শুরু হয় পুজো কে কেন্দ্র করে ক্ষমতা বা আভিজাত্যের লড়াই, পরবর্তীকালে যা 'কার্তিক লড়াই' হিসেবে পরিচিতি লাভ করে।
উল্লেখযোগ্য চুনুরিপট্রির বারবনিতা পল্লী তত্কালীন সময়ে বিখ্যাত হয়ে উঠেছিল, এখানেই ব্যবসায়ী বাবু সমাজের আনাগোনা বেশি ছিল, শোনা যায় বাবুরা বারবনিতাদের জন্য ঘর তৈরি করে দিয়েছিলেন, তাছাড়া কাঠগোলা পাড়াতেও গনিকা পল্লী গড়ে উঠেছিল, মূলত এই দুই পাড়ার কার্তিক কে কেন্দ্র করে বারবনিতা সহ বাবুদের লড়াই জমে উঠেছিল, আজও বিখ্যাত হয়ে আছে চুনুরি পট্টির লেংটা কার্তিক এবং কাঠগোলাপাড়ার বাংড়া কার্তিক! তাছাড়া তাঁতী পাড়ার সাত ভাই কার্তিক ও বেশ প্রাচীন! তাহলে সহজে বোঝা যায় যে কাটোয়ার কার্তিক লড়াই এর পটভূমিকা এখান থেকেই তৈরি হয়েছিল! শোনা যায় এই কার্তিক লড়াই বাবুরা প্রচুর টাকা-পয়সা খরচ করত গান বাজনা সহ খানা পিনার বিশাল আয়োজন হতো! অন্যান্য বিদেশি বনিকরাও এই অনুষ্ঠানের যোগদান করত, তাহলে সহজেই বোঝা যায় গনিকাদের কার্তিক কে নিয়ে বাবুদের লড়াই বা প্রতিযোগিতা আজকের কাটোয়ার ঐতিহ্যবাহী কার্তিক লড়াইয়ের পটভূমি তৈরি করেছিল! পরবর্তীকালে সভ্যতার বিকাশের সাথে সাথে আরো অনেক ক্লাব বা পল্লী এই প্রতিযোগিতার মধ্যে চলে আসে, বাড়তে থাকে কার্তিক আরাধনা, রাসের অনুকরণে থাকা তৈরি হতে থাকে, ফলে লড়াই আরো জমে ওঠে!
তবে এ কথাও ঠিক যে অতীতে কাটোয়ার ঐতিহ্যবাহী কার্তিক লড়াই কে কেন্দ্র করে বেশকিছু অসামাজিক বা হিংসাত্মক ঘটনাও ঘটেছে, যা কাটোয়ার ঐতিহ্যবাহী কার্তিক লড়াইয়ের সুরকে ম্লান করে দিয়েছে, স্বাধীনতার পরবর্তীকালে ৮ এর দশক পর্যন্ত বেশ কিছু ব্যক্তিগত আক্রোশ জনিত হিংসা প্রতিহিংসার ঘটনা, এমনকি শ্লীলতাহানি পর্যন্ত ঘটেছে! তবে বর্তমানে বিভিন্ন ক্লাব বা প্রশাসনের সক্রিয়তায় এ ধরনের ঘটনা প্রায়ই কমে গেছে!
সপ্তদশ শতকের শেষ পর্ব থেকে গনিকা ও বাবু সমাজের হাত ধরে সেই শুরু, পরবর্তীকালে নগর সভ্যতার পত্তন ঘটে, ভাগীরথী দিয়ে অনেক জল গড়িয়ে গেছে, অনেক ইতিহাস কে বুকে জড়িয়ে কাটোয়া আজও যেমন স্বমহিমায় বিরাজমান, তেমনি ঐতিহ্যবাহী কার্তিক লড়াই কে সঙ্গে নিয়ে এগিয়ে চলেছে ভবিষ্যতের পথে!
==========================
তথ্যঋণ : ইন্দ্রানী ও উজানী (অম্বিকা চরণ ব্রহ্মচারী)
লেখক পরিচিতি:: কবি, লেখক ও প্রাবন্ধিক, বারিদ বরণ গুপ্ত, পিতা। ৺ ক্ষেত্রনাথ গুপ্ত, নিবাস পূর্ব বর্ধমান জেলার মন্তেশ্বর থানার সাহাপুর গ্ৰামে, বর্তমানে নদ নদী ও সমাজ সংস্কৃতির গবেষণামূলক প্রবন্ধ লেখালেখিতে যুক্ত আছেন।