পুরাণ কাহিনী।। ব্যাস কাশী ।। দীপক পাল
ব্যাস কাশী
দীপক পাল
শিব তীর্থ বারাণসী হিন্দুদের প্রাচীন তীর্থ স্থান। বরুণা ও অসী এই দুই নদীর মিলনস্থলে অবস্থিত বলে সম্ভবত এর নাম বারানসী। আকৃতি এর খানিকটা অর্ধচন্দ্রাকার। বারানসীর গঙ্গার ওপারে রামনগর। সেখানে ব্যাসদেব বসবাস করতেন বলে তাকে ব্যাসকাশী বলা হয়। ব্যাসদেব ছিলেন পরাশর ও সত্যবতীর পুত্র। তিনি শিবকাশী এসে কাশীর মহিমা কীর্তন করতেন। ফলে তার কিছু শিষ্য হলো। সারাদিন কীর্তন করে যা ভিক্ষা পেতেন তাই দিয়ে শিষ্যদের নিয়ে কিছু আহার করে ক্ষুন্নিবৃত্তি নিবারণ করতেন। একদিন তাকে শিবের পরীক্ষা নেবার ইচ্ছা হলো।
তিনি দেবী অন্নপূর্ণাকে বললেন, ' আজ যেন ব্যাসদেব কোনো ভিক্ষা না পান।' সারাদিন ভিক্ষা না পেয়ে তিনি সমস্ত কাশীবাসিদের উদ্দেশ্যে অভিশাপ দিলেন, ' যে মুক্তির আশায় তোরা গর্ববোধ কিরিস, তিন পুরুষ তোরা কোন মুক্তি পাবিনা।' এই বলে সব ভিক্ষাপাত্র তিনি ছুঁড়ে ফেলে দিলেন। এমন সময় দেবী অন্নপূর্ণা ছদ্ববেশে সেখানে উপস্থিত হয়ে ব্যাসদেবকে বলেন, 'আমার স্বামী প্রতিদিন অতিথি সৎকার না করে মুখে অন্ন তোলেন না। আপনারা যদি অতিথি হয়ে আমাদের বাড়ীতে আহার করেন তবে ভাল হয়।' বেদব্যাস অতিথি সৎকারে রাজী হয়ে যান। অতঃপর তিনি শিষ্যদের সমেত আহার করে খুবই তৃপ্ত হন এবং অত্যন্ত খুশি হন। তখন দেবী অন্নপূর্ণা বেদব্যাসকে জিজ্ঞেস করেন,
- ' স্বার্থ সিদ্ধি না হবার জন্য যে শাপ দেয় সেই শাপ কার গায়ে লাগে?' বেদব্যাস বলেন,
- ' সে শাপ শাপদাতারই প্রাপ্য।' বিশ্বেশ্বর বলেন,
- ' বিনা কারণে তুমি যে কাশীবাসীকে শাপ দিয়েছ সেই কারণে তুমি কাশীতে বাস করার অধিকার হারিয়েছ। তাই তুমি এখনই কাশী ত্যাগ কর।'
দেবী অন্নপূর্ণা শিবকে রাজী করায় তিনি অষ্টমী ও চতুর্দশীতে কাশীতে প্রবেশের অনুমতি পেলেন।
আমরা কয়েকজন মিলে গঙ্গার ওপারে রামনগর রাজবাড়ী আর ব্যাস দেবের কাশী অর্থাৎ ব্যাসকাশী দেখার উদ্দেশ্যে অটোয় চেপে বসলাম। রাস্তার হাল যে এত খারাপ আর ধুলি ধূসর, বলার অপেক্ষা রাখে না। অটো ওই উঁচু নিচু রাস্তায় তাই গতি নিতে পারেনা। অনেক কায়দার পর অতঃপর আমরা জৈত সিংহের প্রাসাদে এসে উপস্থিত হলাম। রাজবাড়িটি বিশাল কিন্তু দেখলেই বোঝা যায় বেশ প্রাচীন। সামনে বিশাল ফটক। টিকেট কেটে ঢুকতেহয়। টিকেট কেটে দ্বাররক্ষীকে দেখিয়ে ভিতরে প্রবেশ করলাম। দেখলাম এটি এক অস্ত্র সাংগ্রহাশালা। অস্ত্রশস্ত্রের সংগ্রহও প্রচুর। সেগুলো এত ভারী ভারী যে দেখলে মনে জাগতেই পারে রাজারা এত ভারী অস্ত্র ব্যবহার করে যুদ্ধ করতেন কি করে। তলোয়ার ঢাল শিরস্ত্রাণ হাত বন্ধনী সব ভারী। আমিতো একটা তলোয়ার দুহাতেও তুলতে পারবো না। একটা প্রায় দেড়শো বছরের পুরনো দেয়াল ঘড়ীতে এখনও চন্দ্র সূর্যের অবস্থান, দিনক্ষণ, সময় শুনলাম নিখুঁত। এছাড়া আছে রাজাদের ব্যবহৃত বিভিন্ন প্রকারের নানা রাজকীয় জিনিস সুন্দর করে সাজানো দোতলায়। প্রাসাদের এক প্রান্তে রাজাদের অন্দর মহল। বারান্দা থেকে ফটক পর্যন্ত সুন্দর দৃশ্যমান। বারান্দার আর এক প্রান্ত থেকে গঙ্গা খুব সুন্দর দেখা যায়। নৌকা করে খুব সহজেই শিবকাশি যাওয়া যায়। একটু দূরে আছে জৈত সিংয়ের দূর্গাবাড়ী। দুর্গাবাড়ীর কারুকাজ নাকি খুব সুন্দর। রাজা নিয়মিত সেখানে যান। কিন্তু আমরা সেখানে যেতে পারিনি। কারণ, সময়। রাজবাড়ীর পিছনে আছে ব্যাসদেবের মন্দির। মন্দিরে অবস্থান তিনটি অষ্টধাতুর পাশাপাশী মূর্তি। মধ্যিখানে ব্যাসদেব আর দুপাশে বিশ্বনাথ ও শুকদেব। শুকদেব ব্যাসদেবের পুত্র। তিনি ছিলেন ব্রহ্মচারী। ব্যাসদেবের এই স্থানের নাম ব্যাসকাশী। কথিত আছে এই ব্যসকাশীতে মৃত্যু হলে সে নাকি পরজনমে গাধা হয়ে জন্মায়। এর পিছনে একটি সুন্দর গল্পগাঁথা আছে।
কাশী থেকে বিতাড়িত হয়ে ব্যাসদেব গঙ্গার এই পারে রামনগরে বসবাস শুরু করেন। তিনি এখানে মন্দির স্থাপন করে শিষ্যদের নামকীর্তন শোনাতেন আর বলতেন আমি শিবকাশী অপেক্ষা এই ব্যাসকাশীকে আরোও মহিমান্বিত করবো। শিব কাশীতে যেমন বাইরে পাপ করে সেখানে মরলে মুক্তি পায় অথচ শিবকাশীতে পাপ করলে সে মুক্তি পায়না। কিন্তু আমার ব্যাসকাশীতে যেখানেই পাপ করুক এখানে মরলে তার অবশ্যই মুক্তি হবে। এদিকে শিব ঠাকুর যারপরনাই চিন্তিত হয়ে পড়লেন। তাই দেবী অন্নপূর্ণা বৃদ্ধার ছদ্ববেশে লাঠি ঠুকে ঠুকে ব্যাসদেবের কাছে এসে বললেন,
- ' তুমি এখানে কি করছ বাবা?'
- ' আমি এখানে এক নতুন কাশী তৈরি করছি যা হবে শিবের কাশী অপেক্ষা ভালো। কারণ মানুষ যেখানেই পাপ করুক, এই কাশীতে অথবা বাইরে, সে এখানে এসে মরলে তার মুক্তি হবে।'
- ' বেশ বেশ।' বলে বৃদ্ধা মাথা নাড়িয়ে চলে গেলো।
কিছুক্ষণ পরে বৃদ্ধা আবার ফিরে এলো,
- ' তুমি কি বললে বাবা? এখানে মরলে কি হয়?'
- ' যেখানেই পাপ করুক এখানে মরলে সে মুক্তি পাবেই।'
মাথা নাড়তে নাড়তে বৃদ্ধা চলে গেলো। কিন্তু কিছুক্ষণ পরেই ফিরে এসে বলে,
- ' দেখো বাবা আমি কানে কম শুনি। তাই ঠিক বুঝতে পারি নি। কি হয় বাবা এখানে মরলে?'
ভীষন বিরক্ত হয়ে রেগে ব্যাসদেবের বলেন,
- ' গাধা হয় গাধা।' বৃদ্ধা হাত তুলে বলে,
- ' তথাস্তু। ' বলে অদৃশ্য হয় বৃদ্ধা।
ভেঙ্গে পড়েন ব্যাসদেবে। বুঝতে পারলেন স্বয়ং অন্নপূর্ণা এসে ছিলেন শিবকাশী রক্ষার্থে।
-০-০-০-০-০-০-০-০-
সূত্র : সাহায্য,
শ্রদ্ধেয় ভ্রমণ কাহিনী লেখক শ্রী সুবোধ
চক্রবর্তির ' রম্যানি বিক্ষ ' ।
Address :-
---------
Dipak Kumar Paul,
DTC Southern Heights,
Block-8, Flat-1B,
Diamond Harbour Road,
Kolkata - 700104.